শূন্যস্থানে_তুমি_পূর্ণতা #পর্বঃ১৪

0
1020

#শূন্যস্থানে_তুমি_পূর্ণতা
#পর্বঃ১৪
#ফারজানা_আক্তার

অন্তরীক্ষে লাল হলুদের মিশ্রণ। কিছুটা ফর্সা হচ্ছে পৃথিবী। এখনো পুরোপুরি সকাল হয়নি। পাখির কিচিরমিচিরে মুখরিত চারিপাশ। ঝিরিঝিরি ঠান্ডা বাতাসে হাতে চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে রাইসা আর রাহেলা খাতুন। ফজরের নামাজের পর রাহেলা খাতুন কিছু কথা বলবে বলে ডেকেছেন রাইসাকে। রাইসা চায়ে চুমুক দিয়ে চোখ বন্ধ করে মিষ্টি সকাল উপভোগ করছে। হঠাৎ রাহেলা খাতুনের মিষ্ট কন্ঠে ঘোর কাটে রাইসার। রাহেলা খাতুন চায়ে চুমুক দিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসেন তারপর রাইসাকে বলেন “বসো মা। একটু কথা বলি দুজন প্রাণ খুলে।”
মৃদু হেঁসে রাইসাও অন্য একটা চেয়ার টেনে শ্বাশুড়ির মুখোমুখি হয়ে বসে।
রাহেলা খাতুন আকাশের দিকে দৃষ্টি রেখেই বলেন “তুমি জানো ওইদিন হুসনাকে আমি কেনো চাকরি দিতে নিষেধাজ্ঞা করেছি?”

“না আম্মু। কেনো আপনি হুসনাকে এভাবে মুখের উপর নাহ করে দিয়েছিলেন।”
“কারণ হুসনাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। মেয়েটার মাঝে এক অন্যরকম মুগ্ধতা আছে।”
রাইসা শ্বাশুড়ির মতিগতি বুঝতে না পেরে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উনার দিকে। রাহেলা খাতুন খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলেন “গতকাল রাতে তামিম নামের কারো কথা বলেছিলাম ডাইনিংয়ে। মনে আছে তোমার?”

“জ্বি।”
“তামিম হলো আমার চতুর্থ সন্তান। সিয়াম রিয়া শাহিল যেমন আমার সন্তান ঠিক তেমনই তামিম। তবে তামিম আর সিয়ামের চরিত্রে রয়েছে অনেক তফাৎ। তামিম খুব ভালো চরিত্রের ছেলে একদম ফুলের মতো স্নিগ্ধ। তামিম খুব অল্প বয়স থেকেই সবটা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন, বাবার কষ্ট সব শেয়ার করে নিয়েছেন। ছেলেটা আমার থেকে দূরে থাকে, খুব চিন্তা হয় ওর জন্য আমার। ওই ভিনদেশে ওর যত্ন নেওয়ার মতো কেউই নেই। তাই আমি চাই কেউ একজনকে ওর সাথে লন্ডন পাঠাতে যাতে আমি কিছুটা চিন্তামুক্ত হতে পারি।”
“জ্বি আম্মু বুঝেছি আপনার মনের অবস্থা। কিন্তু এখানে হুসনার কি কাজ? ও তো পরিবার ছেড়ে অন্যদেশে গিয়ে এমন জব করতে পারবেনা কারণ ও কিছুটা হলেও দ্বীনদার। ”
“তোমার প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ। বোকামেয়ে এইটুকু বুঝতে পারলেনা? আমি চাই তামিমের সাথে হুসনার বিয়ে দিতে কারণ হুসনা অন্যরকম একটা মেয়ে। হুসনার পরিবারের সাথে ওর ভাব খুবই কম তা ওর কথাবার্তাতেই বুজতে পেরেছি। যেহেতু ওর পরিবারের সাথে ওর তেমন ভাব নেই সেহেতু ও ভিনদেশে সবাইকে ছেড়ে খুব ভালোই মুহুর্ত উপভোগ করতে পারবে যা অন্যমেয়েরা পারবেনা। আর মেয়েটা ভীষণ বুঝদার একটা মেয়ে। এবার তুমি কি বলো আমার সিদ্ধান্তে কি কোথাও ভুল আছে? তুমি এই বাড়ির বড় বউ তাই তোমার মতামতেরও প্রয়োজন আছে বলে মনে করি আমি।”
“হুসনা আর তামিম ভাইয়া যদি রাজি থাকে তবে আমার কোনো অমত নেই বরং আমি ভীষণ খুশি আমি আর আমার বেস্টফ্রেন্ড একই পরিবারের পুত্রবধূ হবো সেটা ভেবে।”

রাইসার কথা শুনে বেশ শান্তি লাগছে রাহেলা খাতুনের। রাহেলা খাতুন রাইসাকে হুসনার সাথে কথা বলতে বলেছেন। হুসনা রাজি থাকলেই তামিমকে নিয়ে উনি হুসনাদের বাসায় যাবেন।
রাইসা চা শেষ করে এক ছুটে রিয়ার রুমে যায়। রিয়া তখন বসে বসে একটা রুমালে হাতের কাজ করছিলো, রাইসার পায়ের শব্দ শুনতেই রিয়া রুমালটা লুকিয়ে ফেলে তবুও রাইসা বুঝে ফেলে কিছুটা। রুমালে স্পেসিয়াল কারো নাম লিখেছে রিয়া তাই সে দ্রুত রুমাল বালিশের নিচে রেখে কিছুটা নড়েচড়ে বসে। রাইসা হাঁসি মুখ নিয়ে রিয়ার পাশে বসে তারপর ধীরেসুস্থে ওর আর রাহেলা খাতুনের মধ্যে যা কথাবার্তা হয়েছে সব রিয়াকে বলে। রিয়া যেনো আকাশ থেকে ধপাস করে মাটিতে পরছে এমনভাবে তাকিয়ে আছে রাইসার দিকে। রাইসা রিয়াকে চিমটি কেটে বলে “হুম বইন তুমি কানে যা শুনছো এতোক্ষণ সব বাস্তব। আচ্ছা শুনো নাস্তা করার জন্য ডাইনিংয়ে আসো আমি তোমার ভাইয়াকে ডেকে আসি।”

সিয়াম ব্যায়াম করতেছিলো তখন রাইসা গিয়ে বলে “আজকের জন্য এইটুকুই থাকুক। ফ্রেশ হয়ে আসুন নাস্তা করবেন।”
“এই কালো পরি তুমি কি আমাকে তোমার আঙ্গুলের ইশারায় নাচাতে চাইছো নাকি হ্যাঁ? একবার বলো নামায পড়তে একবার বলো ব্যায়াম করতে আবার বলে অনেক হয়েছে আজকের জন্য ব্যায়াম, মানে আমার ইচ্ছের কোনো মূল্য নেই?”
“অবশ্যই আছে আপনার ইচ্ছার মূল্য যদি সেই ইচ্ছেটা নেক হয়।”
“তোমার সাথে কথায় পারা যায় না।”
“পারতে হবেনা ফ্রেশ হয়ে আসুন।”
“আচ্ছা শুনো আজ আমি কলেজ যাবোনা তামিমকে রিসিভ করতে যাবো এয়ারপোর্ট তাই তুমি আর রিয়া ড্রাইভার কে নিয়ে যেও সাথে ”
“চিন্তা কি শুধু বোনের নাকি বউয়েরও আছে?”
দুষ্টু কন্ঠে বলে উঠে রাইসা। রাইসার এমন কথা শুনে সিয়াম চোখ লাল করে তাকায় রাইসার দিকে আর দাঁত চেপে বলে “তুই কখনো শুধরানোর নয়। সবসময়ই আমাকে রাগানোর ধান্দাই থাকিস কারণ তুই ভালো করেই জানিস আমি না রাগলে তোকে ইচ্ছে করে কখনোও ছুঁয়েও দেখিনা। বুদ্ধি ভালো আছে তোর কিন্তু আজ থেকে আমি সতর্ক হয়ে গেলাম, তোর এই ফাঁদে আমি আর পা রাখবোনা।”
কথাগুলো বলেই ফ্রেশ হতে চলে যায় সিয়াম। মন খারাপ করে অশ্রুসিক্ত চোখে সিয়ামের কথাগুলো ভাবতে থাকে রাইসা। কতটা কষ্ট পেলে মানুষের আঁখিতে নিজ অনিচ্ছায় অশ্রু জমে। এতোটা কষ্ট নিয়েও মেয়েটা সবার সাথে হাঁসি মুখে ডাইনিংয়ে বসে গল্প করছে আর সবার আঁড়ালে চোখের কোণের অশ্রু মুছে। সিয়াম খেয়াল করে রাইসা কিছুক্ষণ পর পর ওড়না দিয়ে চোখের কোণে ছুঁয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ করে সিয়ামের বুকের ভেতর মুচড়ে উঠে। মেয়েটার জন্য কিছুটা খারাপ লাগা কাজ করছে হুট করে সিয়ামের মনে। এমনটা হওয়ার কারণ সিয়াম বুঝতে পারছেনা। কেনো হঠাৎ এই মেয়ের প্রতি এমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে যাকে নাকি সে সহ্যই করতে পারেনা। সিয়াম আর বেশি কিছু না ভেবে দ্রুত নাস্তা সেরে রওনা দেয় এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে।

*
ক্লাস শেষ করে রিয়া রাইসা আর হুসনা ক্যাম্পাসে বসে আছে। রাইসা শ্বাশুড়ির কথা অনুযায়ী হুসনাকে সব খোলামেলা বলে দেয়। হুসনা চিন্তা করার জন্য সময় নেয় একদিন। আগামীকাল কলেজ এসেই সে রাইসাকে ওর সিদ্ধান্ত জানাবে বলে কথা দেয়। তারপর ওরা নিজেদের গন্তব্যে রওনা হয়।
হুসনা সারা রাত জুড়ে চিন্তা করে বিষয়টা নিয়ে। বিয়েটার জন্য যদি হুসনা রাজি হয় তাহলে ওকে কখনোই আর ইমতিয়াজ হোসেন এর মুখোমুখি হতে হবেনা আর ওর পড়ালেখার খরচের জন্য এতো পরিশ্রম আর চিন্তাও করতে হবেনা এটা ভেবে হুসনা বিয়েতে রাজি হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় আবার মা বোনের চিন্তায় মতামত চেঞ্জ করে ফেলে। হুসনার ভাবনা হলো ও ভিনদেশে চলে গেলে ওর মাকে আবারও ঘর থেকে বের করে দিবে ইমতিয়াজ হোসেন। চিন্তায় ঘুম আসছেনা হুসনার। এমন সুযোগ বারবার আসবেনা এটাও ভাবছে হুসনা। হুসনা কিছুতেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা। চিন্তায় সারা রাত আর ঘুম হয়নি হুসনার। জীবনটা ভীষন জটিলতায় ভোগছে। না পারছে কাউকে বলতে আর না পারছে সইতে। অন্যদিকে তামিম নামটা বেশ মনে ধরেছে হুসনার।

*
সকালে নাস্তার টেবিলে তামিমকে রাহেলা খাতুন এই বিষয়ে বললে তামিম স্পষ্ট বলে দেয় “বড় আম্মু আমি ছোট থেকেই তোমাকে আপন মায়ের চোখে দেখে আসছি। আমার কাছে মায়ের মমতা মানেই তুমি। আমি জানি আমার জন্য তুমি যা সিদ্ধান্ত নিবে আমার ভালোর জন্যই নিবে। আমার আলাদা কোনো পছন্দ নেই, আমার জন্য তুমি যাকে পছন্দ করবে তাকে নিয়েই আমি সন্তুষ্ট।”
রাহেলা খাতুন খুশিতে উতলা হয়ে বলেন “আলহামদুলিল্লাহ”
সব যেনো সিয়ামের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। রুমে এসে সিয়াম রাইসার কাছ থেকে জানতে চাইলে রাইসা সব খোলে বলে সিয়ামকে। সিয়াম সব শুনে বলে “তাই বলে এমন পরিবারের সাথে সম্পর্ক করতে যাবে আম্মু? আরে যে মেয়ে নিজের মা বাবার অবাধ্য সে তার স্বামীকে কতটুকু সম্মাণ করবে?”
“আপনি ওর সম্পর্কে সবকিছু না জেনে এভাবে কথা বলতে পারেননা।”
“আচ্ছা তাহলে তুমি কতটুকু জানো ওর সম্পর্কে?”
এবার রাইসা আমতাআমতা করে বলে “আসলে তেমন কিছু জানা নেই তবে এতোটুকু জানি হুসনা খুব ভালো মেয়ে। ও নিজের সম্পর্কে কখনো খোলামেলা কিছু বলেনি শুধু বলেছে ওর বাবাকে ও সহ্য করতে পারেনা, ওর মা অনেক ভালো তবুও বাবার জন্য মায়ের সাথেও তেমন একটা ভাব ওর নেই।”
“তুমি আম্মুকে বলো এই সম্পর্ক না করতে।”
“আমি কেনো বলবো? আপনার সমস্যা তাই আপনি বলুন, আমার কোনো সমস্যা নেই।”
এটা বলেই রাইসা কলেজ যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নেয়। সিয়াম আর কিছু না বলে চুপচাপ মাথার নিচে হাত দিয়ে আধশোয়া হয়ে শুয়ে থাকে চোখ বন্ধ করে। এই মেয়ের সাথে কথা বলে কখনোই পারবেনা এসব ভাবছে সিয়াম। রাইসা তৈরি হয়ে বলে “চলুন হয়ে গেছে আমার।”
“তামিমের সাথে ঘুরবো আজ পুরো শহর, তুমি যাও রিয়ার সাথে। ”
“ঘুরাঘুরি কলেজ থেকে ফিরেও করতে পারবেন। তামিম ভাইয়া দেশেই আছে কিছুদিন। চলুন উঠুন মাথার উপর পরিক্ষা ভনভন করছে সেটা দেখছেনা কেউ।”
কথাগুলো বলেই রাইসা সিয়ামকে হাত ধরে টেনে তুলে নিয়ে আসে গাড়ির সামনে। কেনো জানিনা আজকাল এই কালোপরির প্রতি অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে সিয়ামের। গাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো রিয়া। রাইসাকে সিয়ামের হাত ধরে টেনে আনতে দেখে কুটকুট করে হেঁসে ফেলে রিয়া। সিয়াম লাল লাল চোখ করে রাইসার দিকে তাকিয়ে এক ঝাটকায় হাত ছাড়িয়ে নেয়। মুখ টিপে হাঁসে রাইসা।

রিয়া কলেজের গেইটে গাড়ি থেকে নিচে পা রাখতেই দেখে সেখানে দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সাথে কোনোকিছুর আলোচনা করছে মাহিন। রিয়ার সাথে চোখাচোখি হতেই সেই স্থান মুহুর্তেই ত্যাগ করে মাহিন। রিয়া বুঝতে পারেনা হঠাৎ করে কেনো ছেলেটা ওকে ইগ্নোর করছে।
রাইসার ডাকে ঘোর কাটে রিয়ার। হাঁসি মুখেই রিয়ার হাত ধরে কলেজের ভেতরে প্রবেশ করে রাইসা।

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here