শূন্যস্থানে_তুমি_পূর্ণতা #পর্বঃ১৫ (অন্তুম পর্ব)

0
1599

#শূন্যস্থানে_তুমি_পূর্ণতা
#পর্বঃ১৫ (অন্তুম পর্ব)
#ফারজানা_আক্তার

কাঠফাটা রোদে দাঁড়িয়ে রিয়া আর রাইসা হুসনার সাথে কথা বলতেছে। সিয়াম কয়েকবার ডেকেছে বাসায় যাওয়ার জন্য কিন্তু রিয়া আর রাইসা নাছোর বান্দা, তারা হুসনার সব কথা শুনেই বাসায় যাবে। সিয়াম বলেছিলো গাড়িতে বসে কথা বলার জন্য কিন্তু হুসনা রাজি হয়নি তাতে। রাইসা বারংবার জিজ্ঞেস করতেছে হুসনাকে হুসনার মতামত। কিন্তু হুসনা এখনো কনফিউজড সে কি সিদ্ধান্ত নিবে। প্রায় অনেকক্ষণ পর কিছু একটা ভেবে হুসনা বললো সে রাজি আছে। এটা শুনে রাইসা আর রিয়া খুশি হয়ে হুসনাকে জড়িয়ে ধরে।
সন্ধ্যায় রাইসা রিয়া আর তামিমকে নিয়ে হুসনাদের বাসায় উপস্থিত হন রাহেলা খাতুন। সবাই কথা বলে কয়েকদিনের মধ্যেই ওদের বিয়ে দিয়ে দেন ইসলামীক শরিয়ত অনুযায়ী। বিয়ে হয়ে গেলেও সিয়াম এখনো মন থেকে মানতে পারেনি এই বিয়েটা।
বিয়ের তিন কি চারদিনের মাথায় হুসনাকে নিয়ে লন্ডন চলে যায় তামিম। রাহেলা খাতুন স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। এতোদিনে রাহেলা খাতুনের চিন্তার অবসান ঘটলো।
দিন যত ঘনিয়ে আসছে ততই সিয়ামের পরিক্ষা কাছে আসতেছে। সিয়াম পড়তে না চাইলেও রাইসা বাধ্য করেই ছাড়ে সিয়ামকে। সিয়াম মোটামুটি রাইসার প্রতি দূর্বল হয়েছে কিছুটা।
আজ সিয়ামের পরিক্ষার প্রথম দিন। সিয়াম ঘর থেকে বের হওয়ার সময় রাইসা বলে “আজ তো পরিক্ষা, অন্যদিনের মতো আজকেও কি চলে গেলে হয় এভাবে?”
“তো কিভাবে যাবো”
“আম্মুকে বলে আসুন”
“কেনো বলতে হবে? আম্মু তো জানেই আমার পরিক্ষা আজ থেকে, তাহলে আলাদাভাবে বলতে হবে কেনো আবার?”
“কথাকে লতা বানান কেনো সবসময়ই পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে? যা বলছি তাই করুন।”
সিয়াম আর কথা না বারিয়ে মায়ের রুমের দিকে পা বাড়ায়। কারণ সিয়াম জানে রাইসা যা বলে তা না করা অব্দি সে তাকে আর শান্তি দিবেনা। এভাবে সবগুলো পরিক্ষা শেষ হয় সিয়ামের। এর মধ্যেই সিয়ামের মাঝে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসে অনেকটা। এখন রাইসাকে একটা পলক না দেখলে পাগলের মতো ছট’পট করে সিয়াম। এখন সকালে আর সিয়ামকে ডাকাডাকি করতে হয়না রাইসার কারণ সিয়াম নিজেই রাইসার আগে জেগে যায় বরং সিয়াম নিজেই ডেকে দেয় রাইসাকে। রাইসা মুগ্ধ হয় প্রতিটি মুহুর্ত সিয়ামের এমন বদলে যাওয়া রুপ দেখে আবার বেশ খুশিও হয় মনে মনে। এবার রাইসা খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় রয়েছে কখন যে সিয়াম ওকে “ভালোবাসি” মধুর শব্দটা বলবে।

*
রিয়া দিনদিন কেমন জানি অদ্ভুত হয়ে যাচ্ছে। এখন আর আগের মতো কথা বলেনা সবার সাথে। চুপচাপ থাকে সবসময়ই। যে রুমালে মাহিনের নাম লিখেছিলো সেই রুমালটা যত্ন করে নিজের কাছেই রাখে সে। আজকে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য রিয়াকে ডাকতে আসে সিয়াম। সিয়ামকে রাইসা নিজেই পাঠিয়েছে কারণ রিয়া হয়তো ওর সাথে যেটা শেয়ার করতে পারছেনা সেটা ভাইয়ের সাথে নিশ্চয়ই করবে। কিন্তু রাইসা ব্যার্থ হলো রিয়া সিয়ামকেও কিছু বললোনা।
কয়েকদিন পর রিয়া নিজ থেকেই রাইসাকে বলে “ভাবি কিছু কথা বলবো তোমায়। তুমি কি বুঝবে আমার মনের অবস্থা টা? তুমি কি থাকবে আমার পাশে?”
কিছুটা ভ্রু কুঁচকে রাইসা বলে “হঠাৎ এমন কথা বলছো কেনো? কি হয়েছে তোমার? অনেক দিন ধরে আমি লক্ষ করছি তোমার আচার-আচরণ একদম চেঞ্জ হয়ে গেছে।”
“ভাবি আমার একটা ছেলেকে ভীষণ ভালো লেগেছে। আমি তার সাথে বৈধ সম্পর্কে নিজেকে বাঁধতে চাই। ”
রিয়ার কথা শুনে রাইসা অবাক। রিয়া যে এতোটা আবেগী রাইসার ধারণা ছিলোনা। রাইসা মৃদুস্বরে বলে “ছেলেটা কে? বাসা কোথায়? আমাকে সব বলো তুমি, আমি নিজেই আম্মুর সাথে কথা বলবো।”
“ওর নাম মাহিন, আমাদের-ই ক্লাসমেট। কলেজের প্রথম দিনেই ওর সাথে আমার পরিচয় কিন্তু এর পরদিন থেকেই আমি পর্দা করা শুরু করি তোমার সাথে এবং চলতে থাকি তোমার পথে তাই ওর সাথে প্রথম দিনের পর আর কথা হয়নি কখনো। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি জানিনা ওকে আমি ভালোবাসি কিনা তবে এইটুকু জানি ওর প্রতি একটা দূর্বলতা অনুভব করি আমি সবসময়ই। ”
“আচ্ছা তা বুঝলাম কিন্তু ওর পরিবার? ”
এই প্রশ্নটা শুনে মন খারাপ করে ফেলে রিয়া তবুও রাইসার বারংবার জিজ্ঞেস করার পর সে মুখ খুলে “আসলে ভাবি এই পৃথিবীতে মা ছাড়া আর কেউ ছিলোনা মাহিনের জীবনে কিন্তু কয়েকদিন আগেই ওর মায়ের মৃত্যু হয়। আমি কলেজেই শুনেছি, ও যখন কলেজে আসেনি তখন সবার কাছে জানতে পেরেছি এটা। আর এতোদিন এই কারণেই আমার মন খারাপ থাকতো সবসময়ই। তুমি তো এখন কলেজে গেলেও তেমন কোনো খুঁজ রাখোনা কোথায় কি হচ্ছে তাই তুমি শুনোনি কিন্তু ক্লাসের বাকি সবাই-ই জানে এটা।”
“তারপর, বুঝলাম ওর কেউ নেই কিন্তু ও থাকে কোথায়? ও ছেলে কেমন? এসব কি জানো?”
“যতটুকু জানি ও খুব ভালো ছেলে। আর কোথায় থাকে সেটা খুঁজ করলেই জানা যাবে।”
“আচ্ছা তুমি নিশ্চিন্তে থাকো, আমি আম্মুর সাথে কথা বলে নিবো রাতে।”

রাতে সবাই খাবার খেয়ে নিজ নিজ রুমে চলে গেলেও রাইসা যায়নি রাহেলা খাতুন সবাই খাবার খেয়ে ঘুৃমাতে চলে গেলে সব লাইট পাখা দরজা জানালা ভালো করে বন্ধ করেই ঘুমাতে যান। রাইসা কথা বলার জন্য বসে থাকলেও ভয়ে কিছু বলতে পারছেনা, শ্বাশুড়ি কি না কি বলে ফেলেন বা যদি রেগে যায় বকাবকি করেন সেই ভয়ে চুপচাপ বসে বসে টেবিলে রাখা ফলের ঝুঁড়িটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খেলা করছেন। রাইসাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে রাহেলা খাতুন বলেন “সবাই চলে গেছে তুৃমি বসে আছো কেনো এভাবে? বাবা মায়ের কথা খুব বেশি মনে পরছে বুঝি?”
“নাহ মা তেমন কিছুনা। আসলে আম্মু আমি কিছু কথা বলার জন্য বসে আছি কিন্তু সাহসে দিচ্ছেনা আমাকে।”
আমতা আমতা করে চোখ মুখ খিঁচে বলে রাইসা।
“এতো ভয় পাওয়ার কি আছে পাগলি মেয়ে? বলো কি বলবে।”
“আসলে আম্মু কথাটা হলো রিয়া একটা ছেলেকে পছন্দ করেছে কিন্তু সে ভয়ে আপনাকে বলতে পারছেনা।”
থমথমে গলায় বলে রাইসা।
“এতে ভয় পাওয়ার কি আছে? নিজের জীবনসঙ্গী নিজেকেই তো পছন্দ করতে হবে তাইনা?”
কিছুটা মৃদু হাঁসির সাথেই বলেছেন রাহেলা খাতুন। শ্বাশুড়ির কথা শুনে মনে সাহস পেলো রাইসা।
রাইসা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলো।
রাহেলা খাতুন এবার বললেন “ছেলের বাড়ি কোথায়? আর কি করে ছেলে?”
“আসলে আম্মু ছেলে আমাদেরই কলেজের। নাম মাহিন। ছেলেটার সাথে রিয়ার কথা হয়নি কখনো তাই ও ঠিকানা জানেনা। আর একটা কথা হলো ছেলেটার মা ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউই ছিলোনা কিন্তু দুঃখের কথা হলো কয়েকদিন আগেই ওর মা মারা যায়।”
“আচ্ছা সমস্যা নেই ছেলে যেহেতু তোমাদের কলেজের সিয়ামকে বলবো ছেলেটার সাথে কথা বলে সব খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য। ”
শ্বাশুড়ির সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে রাইসা নিজের রুমে চলে যায়। সিয়াম এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলো রাইসার জন্য। রাইসা আসতেই সিয়াম ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বলে “অনেক ভালোবাসি তোমায়, প্লিজ ছেড়ে যেওনা কখনো আমায়।”
হঠাৎ সিয়ামের মুখে এমন কথা শুনবে তা কখনোই কল্পনা করেনি রাইসা। রাইসা প্রথমে অবাক হলেও পরে বুঝতে পারে সিয়াম সত্যিই ওকে ভালোবেসে ফেলেছে। সিয়াম রাইসার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে “তুমি আসতে এতো দেরি করায় ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম খুব।” কিছুটা লজ্জাও আছে আজ সিয়ামের চোখেমুখে। বিয়েড পর আজ প্রথম সিয়ামের মুখে লজ্জা দেখলো রাইসা। সিয়ামের সাথে রাইসাও বেশ লজ্জায় কুটিকুটি হচ্ছে।

*
সিয়ামকে বললে সিয়াম সব খোঁজ খবর নেয় মাহিনের। সিয়াম এই সম্পর্কের জন্য প্রথমে রাজি না হলেও রাইসা ওকে বুঝিয়ে সুজিয়ে রাজি করিয়ে ফেলে। তারপর সিয়াম একটা শর্তে রাজি হয়, সিয়ামের একটাই কথা মাহিনের যেহেতু কেউই নেই তাই মাহিনকে ওদের সাথে এই বাড়িতেই থাকতে হবে কিন্তু মাহিন এটা মেনে নিতে পারেনা কিছুতে। পরে মাহিন অনেক ভেবে চিন্তে রাজি হয় এই বিয়ের জন্য কেননা এভাবে একা দিন পার করতে ওর খুব কষ্ট হচ্ছে তারচেয়ে ভালো প্রিয় মানুষটার সাথে তার বাড়িতেই থাকা। মাহিন রাজি হওয়ার সাথে সাথেই ওদের বিয়েটা সম্পন্ন হয়ে গেলো, দুইদিনের মধ্যেই বিয়েটা হয়ে যায়। রিয়া আজ ভীষণ খুশি। এতো সহজে মনের মানুষটাকে পেয়ে যাবে এটা হয়তো রিয়ার ভাবেনি কখনো, পরিবার নিয়ে বিশেষ করে সিয়ামকে নিয়ে বেশি চিন্তা ছিলো রিয়ার। রাইসাকে হাজার শুকরিয়া দেয় রিয়া, রাইসা সাহায্য করেছে বলেই এতদূর এগুতে পেরেছে সম্পর্ক টা। আল্লাহ সবসময়ই কেউ একজনকে পাঠিয়ে দেয় ঠিক সময়ে, মাহিনের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। হুট করে মাকে হারিয়ে খুব নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলো মাহিন ঠিক সেই সময়েই রিয়ার সাথে বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে একটা নতুন পরিবার পেয়েছে সে। রিয়া ওর রুমের বেলকনিতে বসে আছে, মাহিন এসে ওর পাশে বসে বললো “তুমি সত্যিই অসাধারণ। আমার ধুয়াসা জীবনটাকে মুহুর্তেই রাঙ্গিয়ে দিলে।”
রিয়া মুচকি হাঁসে, কিছু বলেনা। একটু পর রিয়া চুপচাপ সিয়ামের কাঁধে মাথা রেখে ওর বহু যত্নে বানানো রুমালটা এগিয়ে দেয় মাহিনের সামনে আর বলে “প্রতিটি মুহুর্ত এই রুমালটা সাথে রেখো, আমি সাথে না থাকলেও এই রুমালটা আমার ছায়া হয়ে আলোতে অন্ধকারে তোমার সাথেই থাকবে। ভেবে নিও এই রুমালের ভেতরেই আমার প্রাণ রয়েছে।”
“বুঝলাম না কেনো আসবে সম্পর্কের শুরুতেই এমন কথা?”
“আরে বোকা আমি কি সব সময় সব জায়গায় তোমার সাথে থাকতে পারবো নাকি তা-ই বলেছি।” এটা বলেই রিয়া দাঁত খিলখিল করে হাঁসতে লাগে। মাহিন মুগ্ধ হয়ে দেখছে আর মুচকি হেঁসে তৃপ্তি মিটাচ্ছে।

*
আজ রাইসা অনেক খুশি কারণ একটু আগেই রাইসা জানতে পারে যে সে মা হতে চলেছে। তাই আজ ওর খুশির কোনো সীমা নেই। সিয়ামকে জানালে এই কথা সিয়াম তো খুশিতে পুরো বাড়ি যেনো মাথায় তুলে নিলো নাচতে নাচতে।
রাইসা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তেঁতুল খাচ্ছিলো তখন সিয়াম ওর পাশে এসে বলে “একটা কথা কি জানো?”
“কি কথা?
খেতে খেতেই উত্তর দেয় রাইসা।
“তুমি আমার জীবনে না আসলে আমি কখনোই জীবনের মানে টা বুঝতে পারতাম না। তুমি এসেই আমাকে বুঝিয়েছো প্রকৃত সুখ কোনো জিনিসে। সত্যিই আমার জীবনের শূন্যস্থানে তুমি পূর্ণাতা।”
“আর আপনি কি জানেন আরেকটা কথা?”
খুব উৎসাহিত হয়ে সিয়াম বলে “কোন কথা?”
রাইসা মুখে থাকা তেঁতুল টা খেয়ে পেটের উপর হাত রেখে তৃপ্তির হাঁসির সাথে বলে “আপনার জীবনের শূন্যস্থানে যেমন আমি পূর্ণতা ঠিক তেমনই আমার জীবনের শূন্যাস্থানে আপনি পূর্ণতা আর আমাদের দুই জনের জীবনের শূন্যস্থানের পূর্ণতা এই ছোট্ট প্রাণটা।”
সিয়াম রাইসার কথাটি শুনে কুটকুট করে হেঁসে ফেলে আর বলে “হুম ভুল কিছু বলোনি। আমাদের জীবনের পূর্ণতা এই ছোট্ট প্রাণটা।”

————সমাপ্ত—————-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here