শূন্যস্থানে_তুমি_পূর্ণতা #পর্বঃ০৪

0
661

#শূন্যস্থানে_তুমি_পূর্ণতা
#পর্বঃ০৪
#ফারজানা_আক্তার

প্রায়ই ১০মিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে রাইসা বলে “আব্বু ওই লোক টা তো এখনো স্টুডেন্ট আর আমিও স্টুডেন্ট। কেনো তোমরা এই বিয়েতে রাজি হলে? তুমি তো ওই ছেলে সম্পর্কে কোনো খোঁজ খবরও নাওনি, তুমি জানোই নাহ ছেলেটা কেমন। কিছু না জেনে এভাবে হুট করে বিয়েতে রাজি হয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হয়েছে তোমার? বিয়েটা তো দুই একদিনের জন্য না, বিয়েটা তো সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে আমাকে।”

ফারুক আহমেদ হালকা কাঁশি দিয়ে নড়েচড়ে বসেন। রাইসাকে বলেন এক গ্লাস পানি এনে দিতে। রাইসা পানি নিয়ে আসলে ওর হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে সব পানি খেয়ে নিলেন। মেয়ের কথা সঠিক মনে হলেও উনার যে কিছু করার ছিলোনা রাজি হওয়া ছাড়া। ফারুক আহমেদ রাইসা কে বসতে বললেন আর মাথা ঠান্ডা রেখে উনার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতে বললেন “মা তুই তো সব জানিস, তুই এই ঘরের বড় মেয়ে। তোর মাকে যখন বিয়ে করেছি তখন আমার একটা ভালো চাকরিও ছিলোনা আর তখন আমরা মধ্যবিত্তও ছিলাম না, গরিব ছিলাম খুব গরিব, একবেলা খেলে অন্য বেলা না খেয়ে থাকতে হতো তবুও আমার সাথে তোর মা এই সংসার করেছে, কোথাও যায়নি তোর মা। তখন তো ঘরে তোর দাদা দাদি ফুফি সবাই ছিলো কিন্তু তোর নানু সব জেনেও আমার ঘরে তোর মাকে দিয়েছে, তখন আমার অবস্থা খারাপ থাকলেও এখন কিন্তু ততটাও খারাপ না আমার অবস্থা। আমি ভালো চাকরি পাওয়ার পর-ই তোর ফুফিকে বিয়ে দিয়েছি। আমি এখন একটা বড় কোম্পানির ম্যানেজার আর এই চাকরিটা আমাকে সেদিন কে দিয়েছিলো জানিস তুই?”

কিছুটা চোখ বড় বড় করে রাইসা বলে “কে?”

একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ফারুক আহমেদ বলেন “তোর হবু শশুড়। তোর হবু শশুড় আর আমি একসাথেই স্কুলে পড়েছিলাম, একদিন হঠাৎ আল্লাহর হুকুমে ওর সাথে আমার রাস্তায় দেখা হলে আমরা একটা ঠং দোকানে বসি চা খাওয়ার জন্য তখন আমার পারিবারিক অভাবের কথা শুনে ও আমাকে একটা ছোট চাকরি দেয় ওদের অফিসে তারপর অনেকগুলো বছর পর প্রমোশন হয়ে ম্যানেজার হয়ে যায়। আল্লাহ যদি সেদিন ওর সাথে এভাবে হঠাৎ দেখা করিয়ে না দিতো তবে আমি হয়তো এখনো সেই অবস্থাতেই থেকে যেতাম। এবার তুই বল আমি যদি এই বিয়েতে রাজি না হতাম তবে আমাকে আবার তোদের কে নিয়ে রাস্তায় নামতে হতো। এই বয়সে নতুন চাকরি পাওয়া খুব জটিল হয়ে পরতো আমার জন্য। আর একটা কথা সেটা হলো সিয়ামের আর মাত্র কয়েকমাস পরেই অনার্স ফাইনাল পরিক্ষা তারপর ও পড়ালেখার ফাঁকে অফিসেও যোগ দিবে। এসব নিয়ে কোনো টেনশন করিসনা তুই মা। রাজ রানি হয়ে থাকবি ওই ঘরে তুই। খুব সুখে থাকবি তুই ইনশাআল্লাহ”

বাবার কথা শুনে জলে দুই চোখ ভরে গিয়েছে রাইসার। রাইসার আর কিছু বলার নেই বাবাকে। চোখের জল মুছে হাঁসিমুখে বাবাকে বলে যায় সে রাজি এই বিয়েতে।

*
হুসনা দরজা জানালা সব বন্ধ করে নিজের রুমে চুপচাপ হয়ে শুয়ে আছে। আজ কলেজ থেকে ফেরার সময় বাড়ির গেইট দিয়ে প্রবেশ করতেই সে তার বাবার সামনাসামনি পরে গেছে। কেনো জানি এই মানুষটাকে দেখলে ভীষণ ঘৃণা হয় হুসনার। হুসনার মা জাহানারা বেগম অনেক ডাকাডাকি করলেও হুসনা খেতে যায়না, বাবা নামের মানুষটাকে দেখলে খিদেও মিটে যায় তার। মেয়ের এমন আচরণে বেশ কষ্ট পান হুসনার বাবা ইমতিয়াজ হোসেন তবুও কিছু করার নেই, এটাই হয়তো ভাগ্যে ছিলো।
এই এলাকার-ই একটা ছেলে হুসনাকে ভীষণ ভালোবাসে কিন্তু হুসনা এসবে মোটেও বিশ্বাস করেনা। কখনো বিয়ে করবেনা বলে নিজের সাথে নিজেই ওয়াদা করে হুসনা এর কারণ সবার অজানা হলেও হুসনার বড় বোন আর মায়ের অজানা নয়।

*
আজ রাইসা আর সিয়ামের বিয়ে। সিয়াম অনেক আনন্দে থাকলেও রাইসার মনে প্রচুর সন্দেহ। কেনো না দেখেই সিয়াম ওকে বিয়ে করার জন্য পরিবার পাঠিয়েছে তা জানার জন্য অস্থির হয়ে আছে রাইসা।
খুব সাধারণভাবেই ওদের বিয়েটা হয়ে যায়। বিদায়ের সময় রাইসা ছোট বাচ্চাদের কান্না জুড়ে দেয় রোকসানা আমিন কে জড়িয়ে ধরে।

আজকেও ড্রাইভার নেয়নি সাথে সিয়াম, সে নিজেই ড্রাইভ করে বউ নিয়ে বাসায় যাচ্ছে। এতে কিছুটা অবাক হলেও চুপচাপ পাশের সিটে বসে আছে রাইসা। যদিও রাইসার মনে চলছে এখন হাজার প্রশ্ন। সিয়াম ড্রাইভ করছে আর আঁড়চোখে রাইসার দিকে তাকিয়ে দেখছে ওকে। ড্রাইভ করতে করতে হঠাৎ মাঝ রাস্থায় ঠাস করে গাড়ি থেমে যায়, রাইসা একটু সামনের দিকে ঝুঁকে গেলেও সামলিয়ে নেয় নিজেকে কারণ সে ভারি সাজগোজ করেনি, প্রতিদিনের মতোই সে বোরকা পরিধান করেই আছে। হঠাৎ গাড়ি থেমে যাওয়ায় রাইসা কিছুটা চোখ বড় বড় করে তাকায় সিয়ামের দিকে, সিয়াম কিছু না বলে গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে চেক করে এসে বলে গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে আর এতো রাতে এই রাস্তা দিয়ে কোনো গাড়ি যাতায়াত করে না তাই আজ তাদেরকে এখানেই রাতটা কাটাতে হবেে। এটা শুনে রাইসার খুব রাগ হয়, রাইসা জানে অন্য রাস্তা দিয়ে সিয়ামদের বাসায় যাওয়া যায় কিন্তু সিয়াম অন্য রাস্তা দিয়ে না যেয়ে এই ফাঁকা রাস্তা দিয়ে এনেছে তাই সিয়ামের উপর খুব ক্ষোভ হয় রাইসার কিন্তু প্রকাশ করছেনা কারণ সিয়াম এখন ওর স্বামী আর স্বামীর সাথে বেয়াদবি করার মতো শিক্ষা রাইসা পায়নি। রাইসা চুপচাপ বসে আছে আর রাগে ফুঁসছে। সিয়াম গাড়িতে উঠে বসে বলে “সরি গো, বিয়ের প্রথম রাত তোমাকে এভাবে রাস্তায় কাটাতে হচ্ছে, সত্যি বলছি খুব লজ্জা লাগছে আমার তোমাকে নিয়ে রাস্তায় রাত কাটাতে তাও আবার বিয়ের প্রথম রাত। বাসর রাতটা এভাবে কাটাবো কেমনে, একটু কাছে আসবে প্লিজ!”
সিয়ামের এই কথাগুলোই একটুও সত্যতা খুঁজে পায়নি রাইসা তবুও সে নিজেকে কন্ট্রোল করে চুপ করে আছে এখনো।
সিয়াম বাড়িতে কল করে বলেছে আজ সে রাইসাকে নিয়ে একটা হোটেলে থাকবে সেখানেই অনেক টাকা খরচ করে নাকি সে রুম সাজিয়েছে। ফজলুর রহমানও ছেলের কথা বিশ্বাস করে সবাইকে বলে ঘুমিয়ে যেতে রাত অনেক হয়েছে।

সিয়ামের এমন একটা মিথ্যা কথা শুনে রাইসা আর চুপ থাকতে পারলোনা।
“আপনি বাসায় মিথ্যা বললেন কেনো? মিথ্যা বলা পাপ জানেন না আপনি? আপনি যদি সত্যি টা বলতেন তাহলে হয়তো আঙ্কেল আমাদের জন্য অন্য গাড়ি পাঠাতো।”
কিছুটা উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বলে রাইসা।

“বাহ্ মহারানী বাহ্৷ বড়লোক ঘরে বিয়ে হতে না হতেই দেখি তোমার শরীরে বড়লোক্স ভাব চলে এসেছে”
তাচ্ছিল্যের হাঁসির সাথে কথাটি বলে সিয়াম। রাইসা খুব অপমানবোধ করে সিয়ামের এমন কথায়।
রাইসা বোরকা পরলেও সে বোরকার মধ্যে বিয়ের শাড়ি পরেছে, বিয়ে বলে কথা স্বামীর জন্য হলেও তো একটু সাজতে হলো যদিও রাইসা সাজতে চাইনি কিন্তু রিয়া জোর করে সাজিয়ে দিয়েছে। রাইসার এখন বেশ অস্বস্তি লাগতেছে, বিয়ের শাড়ি দিয়ে যেনো শরীর চুলকাচ্ছে কিছুটা কারণ রাইসা ঘেমে গেছে খুব যদিও এসি গাড়ি তবুও বোরকার কারণে রাইসার শরীরে তেমন এসির বাতাস যাচ্ছে না। রাইসা একবার ভেবেছিলো সিয়ামকে বলবে আবার বলেনি, কারণ সিয়ামকে তেমন সহ্যই হচ্ছে না রাইসার।

“মানুষটা অদ্ভুত ধাঁচের, মামুষটাকে বুঝতে সময় লাগবে অনেকটা।” ভাবছে রাইসা।

“বাহির থেকে গাড়ির ভেতরের কিছুই দেখা যাবেনা। তুৃমি নিকাবটা খুলতে পারো চাইলে বোরকাও খুলতে পারো।”
সিয়ামের কথায় ছেঁদ পরে রাইসার ভাবনায়। গাড়িতে বসে বোরকা খুলা সম্ভব না তবে নিকাব তো খুলা যায় এটা ভেবে নিকাবটা খুলে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয় রাইসা কিন্তু এবার সমস্যা হলো আরেকটা সেটা হলো ক্ষুধা, প্রচুর ক্ষুধা লেগেছে রাইসার কারণ সে আজ সকাল থেকে ভালো করে কিছুই খায়নি শুধু দুপুরবেলা ওর আম্মু ভাত খাইয়ে দিয়েছিলো কয়েক লোকমা তাও জোর করে। লজ্জায় সে সিয়ামকে বলতেও পারছেনা ক্ষুধার কথা আবার সহ্যও করতে পারছেনা ক্ষুধার জ্বা”লা টা। সিয়াম ঘুমিয়ে গেছে। রাইসার ঘুম আসছেনা, পেটে যেনো তেলাপোকা দৌড়াচ্ছে। মনে মনে সিয়ামকে অনেক বকাঝকা করে ঘুমিয়ে যায় রাইসা।

*
রিয়ার ঘুম আসছেনা বারবার শুধু মাহিনের কথা মনে পরছে ওর।
মাহিনেরও একই অবস্থা। মাহিন তো প্রথম দেখায় রিয়াকে বেশ পছন্দ করে ফেলেছে কিন্তু রিয়াকে বলার সাহস পাচ্ছেনা কারণ সে অনেক বড় ঘরের মেয়ে অথচ সে হচ্ছে খুব গরিব ঘরের ছেলে। মাহিন শুয়ে শুয়ে ভাবছে রিয়ার কথা সে আর ভাববে না, রিয়াকে সে কখনোই নিজের করে পাবেনা বরং কষ্ট পাবে পরবর্তী। নিজের মনকে কন্ট্রোল করার চেষ্টায় আছে মাহিন। মাহিনের মা খেয়াল করেছে মাহিন না ঘুমিয়ে কিছু একটা চিন্তা করছে তাই উনি রান্নাঘর থেকে পানি নিয়ে ছেলের রুমে যায়। মাহিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মাহিনের মা সেনুয়ারা বেগম বলেন “আমি জানিনা বাবা তুই কি নিয়ে চিন্তায় আছিস তবে এইটুকু বলতে পারি যে কখনোই কোনো কিছু নিয়ে এভাবে চিন্তা করবিনা শুয়ে বসে। কোনো কিছু নিয়ে খুব বেশি চিন্তা হলে অজু করে এসে নামাজে দাঁড়িয়ে যাবি দেখবি সব চিন্তা নিমিশে দূর হয়ে যাবে, আল্লাহ ছাড়া আর কেউই তোর চিন্তা দূর করতে পারবেনা মনে রাখিস সবসময়ই। নে পানি খেয়ে অজু করে আয়।”

*
রাইসা ঘুম থেকে জেগেই অবাক করা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সিয়ামের দিকে। সিয়ামের মুখে দুষ্টু হাসি। সব যেনো মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে রাইসার, কিছুই বুঝতে পারছেনা সে। মুখ ফুলিয়ে রাইসা বলে উঠে “কিভাবে কি হয়েছে বলবেন কি আমায় একটু?”________

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here