#শূন্যস্থানে_তুমি_পূর্ণতা
#পর্বঃ০৭
#ফারজানা_আক্তার
সিয়াম বিরক্তি নিয়ে বসে আছে রাইসাদের ড্রয়িংরুমে। ঘরটা টিনের হলেও বড় বড় দালানকোঠাকেও হার মানাবে, খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে ঘরটা। সিয়াম বসে আছে আর সিয়ামের একমাত্র শালা ফাহিম ওকে জ্বালিয়ে পুরিয়ে শেষ করতেছে। রাইসা ওর রুমে কাপড় চেঞ্জ করতেছিলো, শাড়ি পরিধান করে থাকা ওর পক্ষে সম্ভব না তাই জামা পরিধান করে নেয়। রাইসা কখনো থ্রি পিচ পরিধান করে না, সে সবসময়ই গোল কাটিংয়ের জামা পরে ফ্রক এর মতো। রাইসা জামা চেঞ্জ করে এসেই সিয়ামকে ডেকে ওয়াশরুমে নিয়ে যায় ফ্রেশ হওয়ার জন্য। তারপর খাবার টেবিলে নিয়ে আসে। রোকসানা আমিন মেয়ে জামাইয়ের জন্য অনেক পদের রান্না করেছেন। বড় ঘরের ছেলেকে তো তাদের মতোই আপ্যায়ন করতে হবে এটা ভেবেই উনি এতোকিছু আয়োজন করলেন কিন্তু সব পদ খাওয়া সম্ভব হয়নি সিয়ামের। সিয়াম খুব চিমচাম, একসাথে বেশি খাবার খেতে পারেনা তবুও আজকে শ্বাশুড়ি মায়ের আবদারে যথেষ্ট খেয়েছে। খাওয়া দাওয়া শেষে ফারুক আহমেদ বলেন সিয়ামকে আর রাইসাকে রুমে যেয়ে আরাম করার জন্য।
রাইসা রুমে গিয়ে চুপচাপ বসে আছে, সিয়াম এক হাত মাথার নিচে রেখে আরেক হাত বুকের উপর রেখে চিৎ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। হঠাৎ নিরবতা ভেঙ্গে সিয়াম বলে “তোমার রুমে ওয়াশরুম নেই?”
রাইসা মনটাকে কিছুটা ছোট করে বলে “না, কেনো?”
সিয়াম শুয়া থেকে উঠে বসে উত্তেজিত হয়ে বলে “কেনো মানে কি সকালে গোসল করবো কি ওই বাহিরের ওয়াশরুম যেয়ে?”
মাথা নিচু করে ফেলে রাইসা। সিয়াম শক্ত কণ্ঠে বলে “আমরা আগামীকালই চলে যাবো। এতোদিন থাকতে হয়না, পরে অন্যসময় না হয় তুমি একা এসে থেকো।”
কথাগুলো বলে পাশ ফিরে শুয়ে পরে সিয়াম। সে যে উদ্দেশ্যে বিয়ে করেছে সেটা সফল না হওয়া পর্যন্ত শান্তি হবেনা ওর। সিয়ামের মেজাজ বিগ্রে যাচ্ছে বন্ধুরা জিজ্ঞেস করলে কি বলবে সেটা ভেবে।
রাইসার লজ্জা করছে সিয়ামের পাশে শুতে তাই সে বসে আছে। সিয়াম খেয়াল করছে রাইসা হুদাই বসে আছে তাই সে উঠে যেয়ে লাইট বন্ধ করে দিয়ে রাইসাকে বকাবকি করে শুইয়ে দেয়। রাইসা সিয়ামের বকা শুনে চুপচাপ শুয়ে গেলেও মনে মনে খুব অভিমান হয় ওর।
সকালে আজানের ধ্বনিতে ঘুম ভাংগে রাইসার। রাইসা ঘুম থেকে জেগেই দেখতে পাই সিয়ামের ঘুমন্ত মুখ। সিয়াম যে একজন বখাটে ছেলে সেটা কেউই বিশ্বাস করবেনা এই ঘুমন্ত চোহারটা দেখলে। ঘুমন্ত অবস্থায় একদম নিষ্পাপ লাগছে ওকে। রাইসা অনেকক্ষণ উপভোগ করে এই ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখটাকে। তারপর রাইসা ফ্রেশ হয়ে ওজু করে এসে নামাযে দাঁড়াতে যায়, নামাযে দাঁড়ানোর আগে সে একবার সিয়ামকে ডাকতে আবার বিছানার কাছে যায়। প্রায়ই অনেকক্ষণ ডাকলেও সিয়াম উঠেনা, পরে রাইসা হালকা পানি ছিঁটিয়ে দেয় ওর মুখে, সকাল সকাল ঠান্ডা পানির স্পর্শ পেয়ে লাফিয়ে উঠে সিয়াম।
“পাগল হয়েছো নাকি সকাল সকাল? পানি ছিঁটাও কেনো?”
রাগান্বিত কণ্ঠে বলে সিয়াম।
“আসলে নামাজ পড়ার জন্য ডাকছিলাম আপনাকে, কিন্তু অনেকক্ষণ ডাকলেও যখন আপনি উঠলেননা তখন বাধ্য হয়েই পানি ছিঁটালাম।”
রাইসার কথা শুনে কিছুক্ষণ রাগান্বিত নজরে তাকিয়ে ছিলো ওর দিকে সিয়াম তারপর বলে “পড়বোনা আমি নামায। কখনোই পড়িনি আমি। তুমি পড়ো যাও আর আমার জন্যও দোয়া করে দিও।”
সিয়ামের কথা শুনে অবাক হয় রাইসা। এটা কেমন মানুষ। রাইসা সবসময়ই একজন দ্বীনদার জীবনসঙ্গী চেয়েছে অথচ আল্লাহ তার ভাগ্যে এমন বাজে চরিত্রের একজন মানুষ মিলিয়ে দিবেন কখনো চিন্তাও করেনি সে। রাইসা আবারো ডাকে সিয়ামকে তখন রেগে যেয়ে ঝাঁজালো গলায় সিয়াম বলে “এতো নামায নামায করছো কেনো তুমি? কি হবে নামাজ পড়ে? পড়বোনা আমি নামায।”
রাইসা বলে “ধৈর্য আছে শোনার?”
বিরক্তি ভাব নিয়ে সিয়াম বলে “কি শোনার?”
“এই যে বললেন নামায পড়ে কি হবে সেটা?”
“শোনার ইচ্ছে নেই৷ ঘুমাতে দাও।”
“তবুও তো শুনতে হবে জনাব।”
“বাড়াবাড়ি করতেছো কিন্তু?।”
“হুম করতেছি আগে আমার কথা শুনুন তারপর নামায পড়ুন, নামায পড়লে আর কোনো বাড়াবাড়ি করবোনা প্রমিজ।”
সিয়াম কিছু বলেনা, শুধু লাল লাল চোখ করে রাইসার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে। রাইসা ভয় পেয়ে যায় সিয়ামের এমন দৃষ্টি দেখে তবুও সে সাহস করে বলে আচ্ছা শুনুন নামাজ কেনো পড়তে হবে –
যে কারণে নামাজ আল্লাহর কাছে প্রিয় আমল
ঈমানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল নামাজ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে বার বার নামাজের তাগিদ পেয়েছেন। কুরআনে পাকে আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন জায়গায় সরাসরি ৮২ বার সালাত শব্দ উল্লেখ করে নামাজের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন।
তাই প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাজকে ঈমানের পর স্থান দিয়েছেন। নামাজের গুরুত্ব ও ফায়েদা সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামের সামনে অসংখ্য হাদিস বর্ণনা করেছেন। তন্মধ্যে একটি হলো-
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম- (হে আল্লাহর রাসুল!) আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয় আমল কোনটি? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘নামাজ’। (বুখারি ও মুসলিম)
উল্লেখিত হাদিস বর্ণনা প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ইসলামি স্কলার আল্লামা মোল্লা আলি ক্বারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘এ হাদিসের মাধ্যমেই আলেমগণ ঈমানের পর নামাজকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে করেন।
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা মনোনীত সর্বোত্তম আমল হলো নামাজ। অতএব যে বেশি বেশি নামাজ পড়তে সক্ষম, সে যেন বেশি বেশি নামাজ পড়ে। (তাবারানি)
প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাজের গুরুত্ব বুঝাতে হাদিসের মাধ্যমে একটি উপমা প্রদান করেছেন।
হজরত আবু যর গিফারি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন যে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক সময় শীতকালে বাইরে (কোথা্র) তাশরিফ আনলেন। তখন গাছের পাতা ঝরার মওসুম ছিল। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গাছের একটি ডাল হাত দিয়ে ধরলেন। ফলে তার পাতা আরও বেশি ঝরতে লাগল।
অতঃপর তিনি বললেন, হে আবু যর! আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমি উপস্থিত। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন-
‘মুসলমান বান্দা যখন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নামাজ আদায় করে, তখন তার থেকে পাপসমূহ ঝরে পড়ে; যেমন এ গাছের পাতা ঝরে পড়ছে। (মুসনাদে আহমদ)
নামাজই একমাত্র ইবাদত; যার মাধ্যমে মানুষ দুনিয়ার সব কাজ ছেড়ে শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য নিবেদিত হয়ে যায়। এ নামাজই মানুষকে দুনিয়ার সব পাপ-পংকিলতা থেকে ধুয়ে মুছে পাক-সাফ করে দেয়। দুনিয়ার সব অন্যায়-অনাচার থেকে হেফাজত করে।
পরিশেষে…
নামাজের প্রতি যত্নবান হওয়া মুমিন মুসলমানের ঈমানের দাবি ও ফরজ ইবাদত। নামাজি ব্যক্তিই হলো সফল। যার সুস্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছেন প্রিয়নবি। তিনি বলেছেন-
‘যে ব্যক্তি নামাজের প্রতি যত্নবান থাকে; কেয়ামতের দিন ওই নামাজ তার জন্য নূর হবে এবং হিসেবের সময় নামাজ তার জন্য দলিল হবে এবং নামাজ তার জন্য নাজাতের কারণ হবে।
পক্ষান্তরে
যে ব্যক্তি নামাজের প্রতি যত্নবান হবে না- কেয়ামতের দিন নামাজ তার জন্য নূর ও দলিল হবে না। তার জন্য নাজাতের কোনো সনদও থাকবে না। বরং ফেরাউন, হামান ও উবাই ইবনে খালফের সাথে তার হাশর হবে।’
এবার বুঝেছেন নামাজ কেনো পড়তে হবে নাকি আরো বুঝাতে হবে?”
“থামো বলছি, আর একটা কথাও বলবেনা তুমি আমার সামনে। ওয়াশরুমে ওজু করা যাবে?”
“হুম যাবে। কিন্তু আপনি কি সত্যি সত্যি নামাজ পড়বেন?”
মুচকি হাঁসি দিয়ে চাপা কন্ঠে বলে রাইসা।
“তো কি? এখানে বসে তোমার লেকচার শোনার চেয়ে নামাজটা পড়ে চুপচাপ কানে তুলো দিয়ে ঘুমানো অনেক ভালো।”
দাঁত গিজগিজ করে কথাটি বলে সিয়াম বিছানা থেকে নেমে সোজা ওয়াশরুমে চলে যায়।
রাইসা মুচকি হেঁসে নামাযে দাঁড়িয়ে যায়।
দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে যায় রাইসা, তার পাশেই বসে ফোন ঘাঁটছে সিয়াম। হঠাৎ রাইসা ঘুমের মধ্যেই এদিক থেকে ওদিক হতে ওর একটা হাত সিয়ামের হাতের সাথে স্পর্শ হয়, হঠাৎ রাইসার স্পর্শ পেয়ে ফোন পরে যায় সিয়ামের হাত ফসকে। রাইসা ঘুমে বিভোর, সিয়াম ভাবছে সে এতো মেয়ের স্পর্শ পেয়েছে কিন্তু কখনো এমন অদ্ভুত অনুভূতি হয়নি। রাইসার স্পর্শে অন্যরকম একটা মিষ্টি অনুভূতি অনুভব করেছে সিয়াম। বসে থাকতে থাকতে একসময় সিয়ামও ঘুমিয়ে যায়।
আছরের আজান দিলে রাইসা উঠে ওজু করে আসে। রাইসা নামাযে দাঁড়ানোর আগে সিয়ামকে ডেকে দিলে সে রাইসার হাত ধরে টান দিয়ে রাইসাকেও তার পাশে শুয়ে দেয় আর বলে “চুপচাপ ঘুমাও, সকালেও ঘুমাতে দাওনি, একবার বাসায় গেলে কিন্তু সব উচল করে নিবে দেখে নিও।”
রাইসা সিয়ামের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের পরনের কাপড় ঠিক করে নেয় তারপর আবার সিয়ামকে ডাকে আর বলে “এবার না উঠলে কিন্তু সকালের মতো আবার শুরু করবো।” কথাটি বলেই মুখ টিপে হাঁসে রাইসা। সিয়াম আর একমুহূর্তও শুয়ে না থেকে উঠে ওজু করতে চলে যায়, যাওয়ার পথে বিড়বিড় করে বলে “একবার বাসায় নিয়ে যায় তোমায় তারপর বুঝাবো এই সিয়াম কি জিনিস”।
সিয়াম কথাগুলো বিড়বিড় করে বললেও রাইসা কিছুটা শুনে ফেলে, এবার রাইসা ভয় পেয়ে যায় আর নিজে নিজে বলে ” না জানি বাসায় গেলে কি অবস্থা হয় আমার।”
*
হুসনা টিউশনে গিয়েও ছাত্রী কে পড়াতে পারছেনা, মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে আছে হুসনার। আজ রিয়া কলেজ গিয়েছিলো কিন্তু হুসনার মন খারাপের জন্য একটু রিয়ার সাথে আড্ডা দিতে পারেনি। রিয়া অনেক জিজ্ঞেস করেছে হুসনার থেকে মন খারাপের কারণ কিন্তু হুসনা কিছুই বলেনি তাকে। এতো চাপা স্বভাবের মানুষ এর আগে আর কখনোই দেখেনি রিয়া। রিয়া একা একা শুয়ে শুয়ে চিন্তা করছে আর ভাবছে “ছেলেটা এমন কেনো? আজ একবারও আমার দিকে তাকায়নি ক্লাসে। আমি কি একটু বেশিই ভাব নিয়ে ফেলেছি, না না আমি ভাব নিতে যাবো কেনো? ভাবী বলেছে স্বামী ব্যাতিত কোনো পরপুরুষই একজন নারীর বন্ধু হতে পারেনা।”
#চলবে_ইনশাআল্লাহ