গল্প- শূন্য কৌটা-০১
লেখক- সুহাসিনী
হবু শাশুড়ী দুইমাসের অন্ত্বসত্তা। খবরটা প্রথমদিন চাপা থাকলেও দ্বিতীয়দিনে বাতাসের চেয়েও দ্বিগুণ গতিতে নোমানের বাসায় পৌঁছালো। আত্মীয়দের ভিতর রীতিমতো ছিঃ ছিঃ রোল পড়ে গেছে। আর একমাস পর যার মেয়ের সাথে তার বিয়ে, সেই শাশুড়ীই কি-না আবার মা হতে যাচ্ছেন!
ঘৃণায় গা গুলিয়ে যাচ্ছে নোমানের। পার্কের বেঞ্চে বসে বিরক্তিভরা দৃষ্টিতে সে হবু বউ শিরিনের দিকে চেয়ে আছে। শিরিন মাথা নিচু করে বলছে,
-মা সত্যিই প্রেগন্যান্ট। ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে, এটা জানা যাবে বাচ্চার ছয় সাত মাস বয়সে। তবে মা যে প্রেগ্ন্যান্ট, এই কথাটা আমি ধাপাচাপা দেবো না। এটাই সত্যি।
-মানে? এসব কী বলছো তুমি? তোমার মা এই বয়সে প্রেগন্যান্ট? তাও আবার এই বুড়ো বয়সে! আমি জাস্ট ভাবতে পারছি না। আগামী মাসে আমাদের বিয়ে। আর এরমধ্যে তোমার মায়ের এইসব!
– এত অবাক হবার কী আছে? তার সক্ষমতা ছিলো। আর ডাক্তারের রিপোর্টে তো এটাই বলছে।
নোমান আরও একটু রাগ দেখিয়ে বলতে থাকে,
– দেখো শিরিন, আমি এত কথা শুনতে চাচ্ছি না। যেই মহিলার একমাত্র মেয়ের আজ বাদে কাল বিয়ে হতে যাচ্ছে, তিনি কি-না নিজেই পেটে বাচ্চা বাধিয়ে বসে আছেন! এটা আমি মানতে পারছি না। একেবারে অসম্ভব! এসব আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারবো না।
-আমিই কি মহা আনন্দে মেনে নিতে পেরেছি? যা হবার, তা তো হয়ে গেছেই। এভাবে রাগ দেখিয়ে তো লাভ নেই। এখানে আমারই বা কী করার আছে?
নোমান যেন প্রচন্ড আশাহত হলো। সে ভেবেছিল, শিরিন হয়তো তার সম্মানের জায়গাটার কথা ভাববে। অথচ ওর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, সে বেশ খুশিই হয়েছে। সে আরও দ্বিগুণ রেগে জিজ্ঞাসা করে,
– তোমার কী করার আছে মানে? এই বাচ্চা হলে লোকে কত কথা শোনাবে, জানো তুমি? যেখানে আমিই নতুন জামাই হিসেবে যাবো, সবাই হাসাহাসি করবে। আমার আত্মীয়-স্বজনরা মুখ টিপে হাসবে। আর হাসবে কী! এখনই যে অবস্থা শুরু হয়েছে। এইটা কি উনার বাচ্চা হবার বয়স নাকি?
– আমার বন্ধুরাও হাসাহাসি করছে। কিচ্ছু বুঝতে পারছি না, এখন আমি কী যে করবো! বাড়ি ছেড়ে চলে আসবো?
-পাগলের মত সিদ্ধান্ত নিবে না একদম। আমি তোমাকে বুদ্ধি দেই। একেবারে সহজ হিসাব। শুধু যা যা শিখিয়ে দেবো, তাই শুনতে হবে। রাজি?
শিরিন মাথা দুলালো। নোমানকে সে তিন বছর ধরে ভালোবাসে। আগামী মাসেই এই মানুষটাকে সে একান্ত নিজের করে পেতে চলেছে। সেখানে মায়ের এই ছোট্ট ভুলের জন্য ভালোবাসার মানুষকে সে হারাতে পারবে না। কোনোভাবেই না। নোমান বললো,
-তোমার মাকে বলবে, আরও বেশি লোক জানাজানি হবার আগেই আজকালের ভিতর এই বাচ্চাটা নষ্ট করে দিতে। এটা কিন্তু তোমাকে বলতেই হবে। নাহলে আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না। মানুষের কাছে আমার মানসম্মান আছে, স্ট্যাটাস আছে। আর তোমার বাবা মা এই সময়ে এসে সেই সম্মান নষ্ট করতে শুরু করছেন। সামান্য জ্ঞানবুদ্ধি নেই উনাদের। শিরিন, আমি বারবার করে বলছি, তুমি আজই বাচ্চাটা নষ্ট করতে বলবে। আর সেটা না পারলে আমার সাথে তোমার পরিবারের কেউ যেন দেখাও না করে।
– নোমান, আমি বলবো তো। তুমি রেগে যাচ্ছো কেন এত?
-তোমার মায়ের জায়গায় আমার মা প্রেগন্যান্ট হলে তুমি কি করতে?
কী আর করতাম! মায়ের আর বাচ্চার সেবা করতাম। পিচ্চি বাচ্চার সাথে খেলা করতাম।
-এসব আলগা গল্প করো না। আমার খুব ভালো করেই জানা আছে। তোমার বাবা মা জীবনেও রাজি হত না। সাফ কথা জানিয়ে দিলাম, আমি একজন কর্পোরেট মানুষ। আমার ইগোতে কাউকে হার্ট করার সুযোগ দিলে আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না। আসছি এখন।
-আমাকে সময় দাও প্লিজ। নোমান! আমার কথা শোনো…
কিন্তু নোমান ওর কথা না শুনেই রেগে চলে যায়। শিরিনের মায়ের প্রতি প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। মায়ের কি একবারও ঘৃণা লাগলো না?
একরাশ রাগ আর বিরক্তি নিয়ে সে বাসায় ফেরে।
পাড়ায় ঢুকতেই হাসমত চাচার মুদির দোকান। এক হালি ডিম কেনার ছিল তার। আশেপাশে তাকিয়ে সে দেখে নেয়, কেউ ফলো করছে কি-না। মায়ের জন্য এলাকায় মুখ দেখানোরও অবস্থা নেই শিরিনের। দ্রুত পায়ে দোকানে ঢুকে ফিসফিসিয়ে বললো,
-চাচা, এক হালি ডিম দিয়েন।
-ডিম কিন্তু এখন ষাট টাকা হালি বিক্রি করছি।
-যত টাকা হয়, আপনি দিন তো। এই নিন টাকা।
শিরিন একশো টাকার একটা নোট বের করে দেয়। হাসমত টাকাটা নিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো,
-তোমার জায়গায় তোমার বাপ থাকলে কত ঝাড়ি দিত এই দামের জন্য। তা তোমার বাপে কই গেছে? কুমিল্লা নাকি? বউকে এই অবস্থায় ঘরে রেখে এত চাকরি বাকরি করলে হবে? সারাজীবন চাকরির জন্যি দৌঁড়ে বেড়িয়েই তো ঠিক বয়সে বাচ্চাকাচ্চা আর হলো না। তুমি হবার পরেই শেষ।
-চাচা, আমার সময় নেই। রান্না বসাবো। আপনি ডিম দিন।
-আমার কথায় রাগ করলে নাকি আম্মাজান? রাগের কথাই তো বটে। এই বয়সে এসে পেট নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, তাও আবার জোয়ান মেয়ের সামনে। এসব কী ভাবা যায় নাকি? তা, তোমার যে বিয়ে ঠিক হয়েছিল, আছে নাকি গেছে? তোমারে বিয়ে দেওয়াও এখন দায় হবে গো আম্মা…
শিরিন লোকটার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকায়। ডিমের প্যাকেট নিয়ে তাড়াতাড়ি বের হয়ে যায় সে। হাসমত অবশ্য এতে বেশ বিনোদিতই হয়েছে। পাড়ায় এমন রসালো খবর এলে ফ্রি’তে বিনোদন জোটে। তা থেকে সেই বা বঞ্চিত হবে কোন দুঃখে?
কলিংবেল বাজছে। রেহেনা বেগম রান্নাঘরে দুপুরের খাবার তৈরি করতে ব্যস্ত। হামজা সাহেব অফিসের জরুরি কাজে কুমিল্লা গিয়েছেন। একমাত্র মেয়ে শিরিনকে নিয়েই এখন বাসায় আছেন। মেয়ের পছন্দসই রান্না না হলে ভারি রাগ দেখাতে বসে যাবে সে।
কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে একটা কাপড়ে হাত মুছতে মুছতে চিৎকার দিলেন,
-আসছি। একটু ধৈর্য ধর না রে বাবা।
তাড়াহুড়ো করে তিনি দরজা খুললেন৷ শিরিন মন খারাপ করে বাসার ভিতরে ঢোকে। রেহেনা বেগম জিজ্ঞাসা করলেন,
– কী রে? তুই না নোমানের সাথে দেখা করতে বাইরে গেছিলি? বিয়ের শপিং না কী কাজের জন্য বললি তখন।
শিরিন ক্লান্ত ভঙ্গিতে জবাব দেয়,
– হুম। গেছিলাম। গেলাম, ফিরলাম।
-খালি হাতে ফিরে এলি যে?
– এমনিই।
– মন খারাপ হয়েছে?
– না
রেহেনা মেয়ের কথায় সন্তুষ্ট হতে পারেন না। আবারও জোর দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
-তোর দোহায় লাগি। আমাকে বল। কী হয়েছে তোর? কেউ কিছু বলেছে নাকি? নোমান বকা দেয়নি তো? আচ্ছা, আমি ওকে কল দিয়ে বুঝিয়ে বলছি।
মায়ের এমন বিরক্তিকর কথায় প্রচন্ড রেগে যায় শিরিন। সে জোর গলায় বলে ওঠে,
– কী কল দেবে তুমি? আমার মন খারাপের কারণ তুমি, মা। এটা বুঝতে পারছো না? তুমি যা করছো, মুখ দেখানোর অবস্থা রেখেছো?
রেহেনা বোকার মত প্রশ্ন করলেন,
– কী করলাম আমি?
শিরিন পূর্বের মতই মেজাজ দেখিয়ে বলতে থাকে,
– কী করলে মানে? আজ বাদে কাল তোমার মেয়ের বিয়ে। আর সেই তুমি কি-না নিজেই এখন পেটে বাচ্চা নিয়ে বসে আছো? তোমার জামাই ঘরে আসবে, সেখানে তুমি আরেকটা বাচ্চা নিয়ে বিছানায় বসে থাকবে। এসব করার আগে একটুও লজ্জা করলো না তোমাদের?
-এভাবে বলছিস কেন মা? আমাদের অজান্তে হয়ে গেলে এখন আমি কী করবো? আমারও তো লজ্জা কম লাগছে না। কিন্তু এখন তো কিছু করারও নেই। কপালে ছিল, হয়েছে।
-কোনো কপালে ছিল না। এসব তোমাদের দোষ। আর, কে বলেছে করার নেই? তুমি এই বাচ্চা নষ্ট করে ফেলবে। নাহলে লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে।
– অসম্ভব। সন্তান আল্লাহ তা’আলার নেয়ামত। তুই সেই নেয়ামতকে নষ্ট করতে বলছিস? আল্লাহ আমাকে কখনোই মাফ করবেন না। কতবড় পাপের কথা বলছিস এসব!
– পেটে এতখানি পাপ নিয়ে ঘুরতে তোমার লজ্জা করবে না?
রেহেনা বেগম আহত গলায় জবাব দিলেন,
– এটা আমার বৈধ সন্তান রে বোকা মেয়ে। তোর নিজেরই বাবার সন্তান। এবার চুপ কর, তোর দোহায় লাগি আমি।
– তুমি এই বাচ্চা নষ্ট না করলে আমিই সুইসাইড করবো।
মেয়ের কথায় একরকম নিরুপায় হয়ে পড়লেন তিনি। কিছুক্ষণ ভেবে ধীর গলায় জানালেন,
– আচ্ছা, তোকে কিছু করতে হবে না। আমি এই বাচ্চা নষ্ট করে ফেলবো। তোর বাবা কুমিল্লা গেছেন। উনি ফেরার আগেই নষ্ট করবো। নাহলে সে কখনোই করতে দিবে না।
(উন্মুক্ত প্রশ্ন- বিয়ে হবার পর আপনার শাশুড়ীর এইরুপ ঘটলে আপনার সিদ্ধান্ত কী হবে?)
(চলবে…)