শেষটাও সুন্দর হয়,সূচনা পর্ব
প্রথম_দেখা
আমিনা_আফরোজ
ফ্রেব্রুয়ারির ১০ তারিখ। এবারের শীতটা বেশ জাঁকিয়ে বসেছে প্রকৃতিতে। তবে ঘন জনবহুল এই ঢাকাতে তার তীব্রতা তেমন একটা নেই বললেই চলে। তাই এবার শীতে ঢাকার বই মেলা দেখার জন্য চলে এলাম বিলাস বহুল ঢাকা শহরে। ঢাকায় আমার ফুপুর বাসা। উপশহরের মেয়ে হিসেবে এখানে খুব একটা আসা যাওয়া হয়ে ওঠেনি আমার । এইটাই অবশ্য হওয়ার কথা। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা আর যাই হোক পরিবারের অনুমতি ছাড়া কোথাও যেতে পারে না । হয়তো সমাজ তা মানে না।
আমি অদ্রি ইসলাম । আমার বাবা আশরাফ মাহমুদ আর মা অরুনিমা মাহমুদ। আমি আমার বাবা-মার প্রথম কন্যা। আমি এবার সবে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে ওঠেছি। আমার ছোট বোন অথৈ পড়ে ক্লাস এইটে। লোকে বলে আমরা দুই বোন নাকি দুই জনের সতীন। কথাটা অবশ্য মিথ্যা নয়। সারাদিনে আমাদের ঝগড়া ২ সেকেন্ডও থামে কি না জানি না। যদিও এই ঝগড়ার পিছনে মূল কারণ থাকে স্বয়ং আমার ছোট বোন অথৈ। বদের বদ সে। অবশ্য বদমাইশির দিক দিয়ে আমিও কম যাই না। সে যাক গে, এবার মূল ঘটনায় ফিরে আসা যাক। আমাদের ঝগড়ার কথা শুরু হলে এই জনমে আর হয়তো শেষ হবে না। তার থেকে বরং আমার গল্প শুরু করা যাক।
ফ্রেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বাবা – মা দুজনের মতামতে এবারের শীতকাল আমরা ঢাকাতে কাটাবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। ঢাকাতে যাওয়ার আনন্দে আমরা দুই বোন খুশিতে আটখানা। আমাদের অবস্থা তখন অনেকটা হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। কারন আমাদের এই পানসে জীবনে নিজ এলাকা ছাড়া খুব একটা বাহিরে যাওয়া হয়ে ওঠে না। তাই যখন সুযোগ আসে তখন আর হাত ছাড়া করি না। আসল কথা হাত ছাড়া করতে ইচ্ছে করে না আর কি।
দেখতে দেখতে এসে গেল ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখ । শুক্রবার সেদিন। অর্থাৎ সরকারি ছুটি। সকাল থেকে আমরা তড়িঘড়ি করে সব গুছাচ্ছি। গুছানো আগেই হয়েছিল , তাই আজ তদারকি করছি বলা চলে । বাবা,মা ,আমার আর অথৈর কাপড়ের ভারে ব্যাগের সংখ্যা এসে দাঁড়ালো পাঁচে। বাবা আমাদের এত ব্যাগ দেখে মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে জুম্মার নামাজের জন্য বেরিয়ে গেলেন। তবে যাওয়ার আগে আমাদের তাগাদা দিয়ে যেতে ভুললেন না। আমাদের বাড়িটা অনেকটা গ্রামের মধ্যে। সভ্য কথায় যাকে উপ-শহর বলে। এখান থেকেই আমরা দুই -বোন পড়ালেখা করি আর আমাদের বাবা-মাও তাদের চাকুরী জীবন এখান থেকেই সম্পন্ন করেন। যাক গে সেসব কথা।
বাবা নামায থেকে ফিরলে আমরা সবাই মিলে দুপুরের খাবার শেষে সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা আজ রাতের ট্রেনে ঢাকা যাব। বাবা অনেক দিন আগে একবার বলেছিল রাতে ট্রেনে চড়তে নাকি বেশি ভালো লাগে। তাই বাবার এই সিদ্ধান্তে আমি আর অমত পোষন করলাম না। হিতে যদি বিপরীত হয়ে যায়। বাবা-মাকে এখন না খোচানোই ভালো ভেবে চুপটি করে ভদ্র মেয়ের মতো আমার ঘরে এসে বসে রইলাম। অথৈ তখনো বাবা-মায়ের পাশেই বসে ছিল।
আমার ঘরটা একতলার উওর -দক্ষিন বরাবর। ঘরের পশ্চিমে রয়েছে কাঠের বিছানা আর তার পাশেই গ্রিলের জানালা । জানালার ওপাশেই ছোট্ট একটি বেলকুনি , যেখানে শোভা পাচ্ছে হাজারো নাম না জানা গাছের সারি। ছোট থেকেই আমার বাগান করার প্রতি ছিল প্রবল ঝোঁক। সেই সূত্র ধরেই গড়ে ওঠেছে আমার বারান্দা বাগান। ঘরের বিছানার সামনে একটা ড্রেসিং-টেবিল এবং ঘরের পূর্ব দিকে একটা ওয়ারড্রোব আর রয়েছে আমাদের দুইজনের দুখানা পড়ার টেবিল। শীতকাল বিধায় আলতো রোদ এসে পড়েছে আমাদের বিছানায়। আমি জানালার পাশে বসে মিষ্টি রোদের ছোঁয়া গায়ে মাখতেই কোথায় থেকে যেন ছুটে অথৈ এসে বসল আমার পাশে, ওর হাতে বাবার ফোন। অথৈ ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে ওঠল,
–” আপু , অহনা আপু ফোন দিয়েছে। তোর সাথে কথা বলবে বলছে।”
অহনা আমার ফুফাতো বোন। তবে ফুফাতো বোন হওয়ার আগে ও আমার সখি। আমাদের দুজনাতে খুব ভাব। কেউ কাউকে ছাড়া কিছুই বুঝি না। অহনাও এবার ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। আমাদের মধ্যে পার্থক্য একটাই , অহনা পড়ে ঢাকার নামি দামী কলেজে আর আমি পড়ি আমাদের উপজেলার এক কলেজে। তবে বাবা বলেন, “তুমি কোথায় পড়ো সেইটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয় , গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তুমি ঠিক কতটা মন দিয়ে পড়ালেখা আরো।” আমিও বাবার কথা শুনে ভর্তি হয়ে যাই আমাদের উপজেলার কলেজে। ছাত্রী হিসেবে খুব একটা খারাপ না আমি ,বেশ ভালোই বলা চলে আমাকে। সবাই তাই বলে আর কি।
অথৈয়ের থেকে ফোনটা নিয়ে কানে লাগাতেই ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে এলো এক রিনরিনে কন্ঠস্বর।
–” কি রে , তুই দেখে আমাকে ভুলেই গেছিস?”
আমি অহনার কথা শুনে মুচকি হেসে বলে ওঠলাম,
–” তা কি করে হয় বলতো। আমি কি তোকে ভুলতে পারি?”
অহনায় কিছুটা আক্ষেপের সুরে বলল,
–” ভুলেই যদি না যেতি তাহলে আজ যে আসবি সেকথা বলিস নি কেন ? নেহাত মামা বলল ,নাহলে তো তোদের আসার খবরই পেতাম না।”
–“ইস কোথায় ভেবেছিলাম আজ অহনা চমকে দিবো কিন্তু বাবা আমার প্ল্যানের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। কি প্রয়োজন ছিল ফুপিকে বলার।”
–” কি রে চুপ করে রইলি কেন? আচ্ছা তোকে কিছু বলতে হবে না। এখন বল কয়টাই রওনা দিচ্ছিল তোরা?”
–” ইয়ে মানে….
–” কি রে এই সহজ প্রশ্নে এতো আমতা আমতা করছিস কেন শুনি?”
–” বাবা বললো রাতের ট্রেনে রওনা দিবে। তবে আমাদের এখান থেকে জেলার শহরে যেতে দুঘন্টা সময় তো লাগবেই তারপর না ট্রেনে উঠতে পারবো।”
–” তা ঠিক বলেছিস। তাহলে এখনো বসে আছিস কেন? সব কিছু গুছিয়ে তাড়াতাড়ি রওনা দে ,নাহলে তো অনেক রাত হয়ে যাবে। অনেকটা পথ আসতে হবে তো নাকি।”
–” এই তো এইবারে বের হবো আর কি। তুই এতো চিন্তা করিস না তো। তুই বরং বইয়ের লিস্ট করে রাখ। বই মেলায় যাবো আর বই কিনবো না তাই হয় নাকি।”
–” সে হবে ক্ষন । আগে তোরা ভালোই ভালোই চলে আয় তারপর দেখা যাবে।”
–“ঠিক আছে । রাখি তবে। খুব শীঘ্রই দেখা হচ্ছে তোর সাথে।”
–” ঠিক আছে। সাবধানে আসিস। আল্লাহ হাফেজ।”
–” আল্লাহ হাফেজ।”
অহনার সাথে কথা শেষ হতেই না হতেই ও ঘর থেকে বাবার ডাক পড়ল। দৌড়ে হাজির হলাম সে ঘরে। বাবা তখন বিছানায় শুয়ে আরাম করছিলেন আর মা বাবার পাশে বসে ছিলেন। বাবাকে এখনো শুয়ে থাকতে দেখে আমি তড়িঘড়ি করে বলে ওঠলাম,
–” বাবা তুমি এখন আরাম করছো? যাবে কখন? সময় তো নেই।”
–” আরে এখনো ঢের সময় আছে। আমাদের ট্রেন তো আটটায় আসবে । তাই আমরা এখান থেকে পাঁচটায় বেরোবো বুঝলি।”
–” সে তো বুঝলাম। বুঝলে বাবা আজ মনে সময় যেতেই যাচ্ছে না। দেখো তো আমাদের ঘড়িটা আবার খারাপ হলো না তো?”
আমার কথা শুনে বাবা-মা খানিকটা হেসে বলে ওঠলেন,
–” আরে পাগলি আমাদের ঘড়ি নষ্ট হয় নি আসলে তুই তোর ফুপুর বাসায় যাওয়ার জন্য এতটাই উগ্রিপ হয়ে আছিস যে তোর সময় কাটছেই না।”
–” তাই হবে হয়তো। যাই আমি একটু বিশ্রাম নিই গিয়ে । সারা রাত জেগে তো আবার ট্রেন ভ্রমন করতে হবে ।”
–” হ্যা হ্যা যা যা।”
বিকেল পাঁচটা। শীতের তাড়নায় চারিদিক হালকা কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে সবে। আকাশটাও আজ শান্ত। চারিদেকের কোলাহল ইতিমধ্যেই কমতে শুরু করেছে। আমাদের গাড়িটি ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে স্টেশনের দিকে । তারপর সেখান থেকে ট্রেনে করে আজ আমরা পাড়ি দিবো ঢাকার পথে। চাঁদনি রাতের চাঁদের আলোয় চারিদিক যখন আলোকিত থাকবে তখন আমিও বিভোর হয়ে থাকবো নৈস্বর্গিক দৃশ্যপটে। স্টেশনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমাদের সাতটা বেজে গেল। বাবা আমাদের প্লাট ফর্মের বেঞ্চ এ বসে রেখে চলে গেলেন টিকিট কাটতে। বেঞ্চ এর মাথায় বসে আছে মা, তারপর অথৈ , অথৈ এর বাসেই বসে আছি আমি। আমার দৃষ্টি তখন ফোনের স্ক্রিনে নিবদ্ধ। একটি ছেলে কখন যে আমার পাশে এসে বসেছে তা খেয়ালই করি নি আমি। আমার খেয়াল হতেই পাশ ফিরে তাকালাম আমি। ছেলেটির মুখ না দেখলেও ঘাড়ের তিলটা দৃষ্টিগোচর হলো আমার। তাই ছেলেটির মুখটি দেখার জন্য আর একটু এগিয়ে যেতেই হঠাৎ করে ছেলেটি কাঁধের ব্যাক নিয়ে এগিয়ে গেল টিকিট কাউন্টারের জন্য। আর আমি তখনো পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি তার দিকে। অদৃশ্য এক শক্তি যেন আমাকে সম্মহিন করে রয়েছে ।
চলবে
( ভিন্নধর্মী রোমান্টিক গল্প শুরু করলাম। হঠাৎ করেই মন চাইলো লিখতে তাই আর বিলম্ব না করে লিখে ফেললাম। শেষ পর্যন্ত পাশে থাকবেন। আশা করি আশাহত হবেন না। প্রথম পর্ব কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন)