শেষটাও_সুন্দর_হয়,অন্তিম পর্ব
নতুন_পথ_চলা
আমিনা_আফরোজ
বছর ঘুরিয়ে আবারো এসেছে ফেব্রুয়ারি মাস। শীত,গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ আর হেমন্ত ঋতুর রূপ বদলে কেটে গেছে মাঝের তিনটি বছর। আজ ফেব্রুয়ারির দশ তারিখ। আজকের দিনটিতেই নিদ্র ভাইয়ের সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল আমার। নিয়তির পরিহাসে সেই আজকের দিনটিতেই বিয়ে হচ্ছে আমাদের। হ্যা আজ আমার আর নিদ্র ভাইয়ের বিয়ে। গত তিনটে বছর বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজকের এই শুভ দিনটির আগমন ঘটেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমাদের বিয়ে উপলক্ষে নিদ্র ভাইয়েরাও চলে এসেছেন তাদের আদি বাড়িতে। একই পাড়ায় বর কনের বাড়ি বোধহয় এই প্রথম। একারনেই পুরো পাড়াটা বোধহয় হৈ হুল্লোড়ে মেতেছে।
সেই তিন বছর আগে শেষ দেখা হয়েছিল আমাদের। এরপর বাবা- মা আর সোনা মা , সোনা বাবাই এর কঠোর নির্দেশে আর দেখা হয় নি । তবে দেখা না হলেও নিঝুম রাতের দ্বিপ্রহরে ঠিকই ফোনে কথা হতো আমাদের যা চলতো রাতের শেষ প্রহর অব্দি। তারপর আবারো দুজনে ফিরে যেতাম দৈনন্দিন রুটিনে। আমাদের এই নৈশ ফোনালাপনের কথাটা থাকত খুব সঙ্গপনে। এভাবেই কেটেছে দিনগুলি। এখন আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। আমার এই অর্জনটাও হয়েছে নিদ্র ভাইয়ের জন্য। এদিকে নিদ্র ভাই পড়াশোনা শেষে চাকরিতে যোগ দিয়েছে সবে। তাই সোনা মা আর দেরি না করে আমার বাবা-মার সাথে কথা বলে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে ফেলেছেন।
আজ সকাল থেকেই দুই বাড়িতেই বেশ তোড়জোড় শুরু হয়েছে। আত্মীয়-স্বজনদের ভারে জমজমাট হয়ে উঠেছে দুই বাড়ির পরিবেশ। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েদের কলরবে মুখরিত বাড়িটি দুখানা। রান্না-বান্নার আয়োজনে ত্রুটি নেই কোন বাড়িতে। সকলেই যে তার কাজ নিষ্ঠাভরে পালন করছে। পাড়ার কুকুরগুলো খাবারের অন্বেশনে ঘুরে বেড়াচ্ছে বাড়ির আনাচে-কানাচে। ছেলে – মেয়েরা সবাই মিলে ফুল দিয়ে গেট সাজিয়েছে। তাদের মধ্যে জনা কয়েকজন আবার ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে বরকে বরন করার জন্য অপেক্ষা করছে।
এদিকে আমি আমার ঘরের পাটিতে বসে রয়েছি এখন। বিয়ের দিন নাকি পাটিতে বসতে হয় ,তাই আমার নানি জোর করে আমাকে পাটিতে বসিয়ে দিয়েছে। সেই সাথে হাতে ধরিয়ে দিয়েছে হলুদের মুচি। বিয়ে উপলক্ষে অহনারাও এসেছে আমাদের বাড়ি। সেই সাথে এসেছে নেহা আপু ও ওনার হাজবেন্ড আর সৌরভ। সৌরভের সাথে অহনার বিয়ের কথাবার্তা চলছে সবে। আল্লাহ চাইলে হয়তো খুব তাড়াতাড়ি ওদের চার হাত এক করে দিবেন।
ঘন্টাখানেক পর আমাকে সবাই মিলে গোসল করানোর জন্য নিয়ে গেল। তারপর গোসল করানো শেষে আবারো পাটিতে বসিয়ে দিলো আমাকে। এবার আমার পাটির আশে পাশে আর কেউ নেই। সবাই আমাকে রেখে যে যার কাজে মশগুল হয়ে পড়েছে। আনুমানিক দুটোর পরে নিদ্র ভাই ঘোড়ায় চেপে উপস্থিত হলেন আমাদের বাড়ির দোরগড়ায়। ছোট থেকেই ওনার শখ ছিল ওনি নাকি ঘোড়ায় চড়ে আমাকে বিয়ে করতে আসবেন আর আমাকেও নাকি সেই ঘোড়ায় চড়িয়ে ওনার বাড়ি নিয়ে যাবেন। সে আরো অনেক ইচ্ছে আছে ওনার যা বলে শেষ করানো যাবে না। বিয়ে পড়াবো পড়াবো করেও মাগরিবের আগে আর বিয়ে পড়ানো হলো না। ওনার সাথে ঘোড়ায় চেপে যখন ওনাদের বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছালাম তখন ঘড়ির কাঁটা সাড়ে আটের ঘরে। শীতে উত্তরের হিমেল হাওয়ায় আমার অবস্থা তখন নাজুক। আমার অবস্থা দেখে সোনা মা আমাকে বরন করে দ্রুত ঘরে নিয়ে গেলেন।
শীতের চাঁদনী রাত গভির থেকে গভীর হতে লাগল। একে একে বাড়ির সমস্ত বাতি নিভে গেলেও নিদ্র ভাইয়ের ঘরে তখনো টিমটিম করে জ্বলছিল মোমবাতির আলো। পুরো ঘরটি ফুলের গন্ধে ভরপুর। আমাকে বেশ কিছুক্ষণ আগে ঘরে বসিয়ে রেখে গেলেও নিদ্র ভাই হবে ঘরে এলেন। এতক্ষন অব্দি বেচারা বন্ধুদের কব্জায় বন্দি ছিল। নিদ্র ভাই গুটি গুটি পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার সামনে বসলেন। তারপর আমার ঘোমটা খুলে আমার চিবুক ধরে বললেন,
–” মাশআল্লাহ তোমাকে আজ অপূর্ব লাগবে।”
নিঝুম রাতে নিদ্র ভাইয়ের পুরুষালী কন্ঠস্বর শুনে আমি লজ্জ্বায় মাথা নিচু করে রইলাম। নিদ্র ভাই আমাকে লজ্জা পেতে দেখে মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে বললেন,
–” নে এভাবে বসে না থেকে এবার আমার সালাম কর দেখি। প্রথম বিয়েতে তো সালাম টালাম করিস নি ,তাই আমিও কোন দোয়া দিতে পারি নি তোকে । তাই এবার আর কোন মাফ নেই। ওঠ ওঠ বলছি।”
নিদ্র ভাইয়ের এমন অগোছালো ছাড়া ছাড়া কথা শুনে আমি তো অবাক। কি সব বলছেন ওনি। সবসময় হেঁয়ালি করা যেন ওনার স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে নিদ্র ভাই আবারো তাড়া দিয়ে বলে ওঠলেন,
–” কি রে এভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছিস কেন? আয় বলছি?”
কি আর করার। নিদ্র ভাইয়ের ওপর কোন কথা বলার সাহস নেই আমার তাই ওনার কথামতো দাড়াতেই নিদ্র ভাই তড়িৎ গতিতে আমি কোলে নিলেন। আমি কিছু সময় স্তব্ধ হয়ে ছিলাম বটে তবে সম্বিত ফিরতে হাত – পা ছোটাছুটি করে বলতে লাগলাম,
–” কি করছেন কি আপনি? বলি মাথাটা কি একেবারেই গেছে আপনার? নাকি রাত বিরেতে ভুতে ধরেছে আপনাকে?”
–” ভুতেই ধরেছে বুঝলি। তাই আগেই সাবধান করে দিচ্ছি এরপর আর একবার হাত-পা ছুড়ে তিরিং বিরাং করে লাফাবি তো তোকে ঠাস করে মাটিতে ফেলে দিবো।”
–” আমাদের বিয়ের রাতে আমাকে এমন হুমকি দিতে পারলেন আমায়। ”
–” হুমকি দিতে আবার দিন,ক্ষন, মাস দেখা লাগে নাকি।”
–” লাগেই তো। সাধে কি আর আমি আপনাকে নিষ্ঠুর বলি বলুন?”
–” সে তোর ইচ্ছে। তুই তোর বরকে নিষ্ঠুর বলবি না অন্য কিছু বলবি সে তুই নিজে জানিস।”
আমি আর নিদ্র ভাইয়ের সাথে কথা না বাড়িয়ে চুপ করে রইলাম। কথা বাড়িয়েও তো আর আমি জিততে পারবো না তার থেকে বরং চুপ করে থাকাই ভালো। প্রায় মিনিট পাঁচেকের মাথায় নিদ্র ভাই আমাকে নিয়ে বেলকুনিতে এসে দাঁড়ালেন। বেলকুনির ফ্লোর জুড়ে রয়েছে গোলাপের পাপড়ি আর ছোট্ট ছোট্ট মোমবাতি। বেলকুনির শেষ মাথায় একটা দোলনাও রয়েছে। দোলনাটাও আজ ফুল দিয়ে নিজ হাতে সাজিয়েছেন নিদ্র ভাই। নিদ্র ভাই আমাকে ওনার কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে হাত ধরে বললেন,
–” শেহজাদি আপনার এই অধম প্রজার হাত ধরে এগিয়ে চলুন আপনার সিংহাসনের দিকে যা একান্ত আপনার জন্য সজ্জিত করেছে আপনার এই অধম প্রজা।”
নিদ্র ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া সারপ্রাইজটা আমার কাছে রিতিমত স্বপ্ন ছিল। আমাদের প্রথম বিয়ের রাতে ওনাকে আমার মনের কথাগুলো বলেছিলাম যা ওনি মনে রেখেছিলেন । আমি হেসে ওনার হাত ধরে এগিয়ে গেলাম দোলনার দিকে।
আকাশে আজ মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে বেলকুনির আনাচে কানাচে। বাহিরেও বসেছে চাঁদের হাট। চারিদিক ছেয়ে আছে কুয়াশার শুভ্র চাদরে। নিদ্র ভাই আমার হাতে হাত রেখে বললেন,
–” আজকের রাতটা খুব সুন্দর তাই না এলোকেশী।”
–” শুধু আজকের রাত নয় আজকের দিনটাও সুন্দর ক্যাবলাকান্ত মশাই।”
–” উহু শুধু আজকের রাত সুন্দর। দেখো আকাশে আজ চাঁদ উঠেছে। চাঁদের রুপালি আলোয় থৈ থৈ করছে চারিদিক। ”
–” আজকের রাত এই জন্য যে আজকের রাতে আমি আপনাকে প্রথম দেখেছিলাম। মনে আছে সেই রাতে কথা?”
–” হুম বেশ মনে আছে। দক্ষিনা হাওয়ার এমনি চাঁদনী রাতে ট্রেনের দরজায় তোমায় প্রথম দেখেছিলাম এলোকেশি। ”
–” আমিও দেখেছিলাম এক ঝাঁকড়া চুল ওয়ালা ক্যাবলাকান্তকে। তারপর তার সাথে পরিচয় আর সেই পরিচয় থেকে আজ বিয়ে।”
–” হুম আমি কিন্তু তোমাকে দেওয়া কথা রেখেছি এলোকেশি।”
–” কোন কথা বলুন তো?”
–” ছোট বেলায় বলেছিলাম আমি আমার সম্পদ আমার করেই ছাড়বো। দেখো আজ আমার চাঁদ আমার পাশে। তবে আর একটা জিনিস ফিরিয়ে দেবার আছে কিন্তু……
–” কি?”
নিদ্র ভাই ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন আমার দিকে তারপর আমার গালে জোরে কামড় দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন,
–” এইটাই তোমার পাওনা ছিল এলোকেশি। বলেছিলাম না সময় হলে ফিরিয়ে দিবো , ফেরত দিয়ে দিলাম তোমাকে।”
–” ইস আপনি আসলেই নিষ্ঠুর।”
–” উহু আমি নিষ্ঠুর নই আমি তোমার সেই ট্রেনওয়ালা ক্যাবলাকান্ত এলোকেশি যে তোমার শেষ সময়ের সঙ্গী হয়ে থাকবে।”
নিদ্র ভাইয়ের কথা শুনে আমি ওনার কাঁধে মাথা রেখে আড় চোখে একবার আকাশের দিকে। দেখলাম চাঁদটা আমাদের দেখে লজ্জায় মুখ লুকিয়েছে সাদা মেঘের আড়ালে। তাই আমিও হেসে নিদ্র ভাইয়ের বুকে মুখ লুকালাম। এভাবেই যেন শেষটাও সুন্দর হয় আমাদের। রাতের রুপোলি চাঁদ হেলে পড়ছে পুব আকাশের দিকে। একটু পরে আকাশের বুক চিরে উদয় হবে নতুন ভোরের। সেই সাথে শুরো হবে আমাদের নতুন করে পথচলা।
সমাপ্ত