শেষটাও_সুন্দর_হয়,পর্ব:-০৩
কিছুটা অভিমান কিছুটা খুনসুটি
আমিনা_আফরোজ
( গল্পে ব্যবহৃত সব নাম, চরিত্র সম্পূর্ন কাল্পনিক। তাই এ নিয়ে কেউ কোন অহেতুক কথা বলবেন না আমাকে।)
কলি প্রকাশনির স্টলটার সামনে একা দাঁড়িয়ে রয়েছি আমি। অহনা এতক্ষণ আমার পাশেই ছিল কিন্তু হঠাৎ কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল আর এদিকে মি. ট্রেনওয়ালা ক্যাবলাকান্তকে সেই কখন থেকে ডেকেই চলেছি কিন্তু তার কোন খোঁজ নেই। উনি ব্যস্ত আছেন ওনার পাঠকদের নিয়ে। এমন সময় অহনা পাশে এসে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো নীল রঙা মোলাটের একটা বই। বইটির কভারের ওপরে কালো রঙের কালিতে মোটা মোটা অক্ষরে লেখা আছে “বিষাদের নীল চিরকুট” । লেখকের নাম আরশান মাহমুদ নিদ্র। নামটা দেখতেই হঠাৎ আমার দু চোখে দ্রুতি খেলে গেল। অহনা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
–” এবার তোকে তোর মি.ট্রেনওয়ালার কাছে যেতে কে আটকায় দেখি।”
–” থ্যাংকু বোইনা। এত এত গুলা থ্যাংকু।”
কথাগুলো বলেই আনন্দে জড়িয়ে ধরলাম অহনাকে। অহনা বরাবরই এমন। যে কোন সমস্যা সহজ উপায় পাওয়া যায় ওর কাছে ।
–” হয়েছে হয়েছে আমাকে আর আহ্লাদ দেখাতে হবে না। এবার তোর ক্যাবলাকান্তকে সামলা গিয়ে।”
–” আরে আমি একা যাবো নাকি । তুইও সাথে চল। ব্যাটাকে আজ মজা দেখাবো দুজন মিলে।”
–” ঠিক আছে চল তবে।”
” বিষাদের নীল চিরকুট” বইটি নিয়ে আমি ওনার সামনে এসে দাঁড়াতেই ওনি চোখ মেলে তাকালেন আমার দিকে। আমি তখন মিষ্টি হেসে বললাম,
–” একটা অটোগ্রাফ চাই।”
ওনি হাত বাড়িয়ে আমার থেকে বইটি নিয়ে বললেন,
–” নাম কি আপনার?”
মি.ট্রেনওয়ালার কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম । ওনি একরকম অপরিচিতের মতো কথা বলছেন কেন আমার সাথে? তবে কি ওনি কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ভুলে গেছেন আমাকে? কিন্তু গতকাল রাতে তিনি যে বললেন এ জীবনে তিনি কখনোই ভুলবেন না আমাকে। তবে কি আমার এলোকেশী চুল আর বেলি ফুলের সুমিষ্টি সুগন্ধি সবটাই ভুলে গেছেন ওনি। কথাগুলো ভাবতেই বিষন্ন হয়ে গেলে আমার হৃদয়ের যত্নে রাখা মনিকোঠা, যেখানে গতকাল তাকে ঠাঁই দিয়েছিলাম আমি।
–” মিস আপনার নামটা বললে খুশি হতাম।”
আমি কিছুটা বিষন্ন হয়েই বলে ওঠলাম,
–” অদ্রি ইসলাম।”
ওনি আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ অটোগ্রাফ দিয়ে বইটা ফেরত দিলেন আমাকে। আমিও আর আগ বাড়িয়ে কথা বলি নি তার সাথে। যে ভুলে যায় তাকে আর অযথা মনে করিয়ে দিয়ে কি লাভ। স্টল থেকে এবার বেশ কিছুটা দূরে এসেই দাঁড়ালাম। অহনা এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখেছে পুরো ব্যাপারটা। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও বলে ওঠল,
–” আমি তোকে আগেই বলেছিলাম এ তোর মি.ট্রেনওয়ালা হতেই পারে না। আরে একে আমি আরো বছর তিনেক আগে থেকেই চিনে। আজ পর্যন্ত এনাকে নিয়ে কম লেখালেখি হয় নি। তবে সবগুলো আর্টিকেলে একই লিখেছে সবাই,লোকটা নাকি ভীষন অদভুদ। মেয়েদের খুব একটা সহ্য করতে না পারলেও তিনি কিন্তু জনপ্রিয় হয়েছেন রোমান্টিক জনরার হাত ধরেই। ওনার লেখায় নাকি জাদু আছে।”
অহনার কথা শেষ না হতেই আমাদের সামনে এক বছর আট বয়সের একটি ছেলে এসে দাঁড়ালো। মনে হচ্ছে বেশ খানিকটা পথ দৌঁড়ে এসেছে সে। কিছুটা স্থির হতেই আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো একখানা নীল রঙের কাগজ। সেই সাথে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে ওঠল,
–” এই লন ভাবী আপনার চিঠি। ভাইজান আপন্যারে দিতে কইছে?”
–” কোন ভাইজান পাঠিয়েছে তোমাকে?”
–” এত কতা কওন যাইতো না ভাবি। মেলা কাম আছে আমার। এতক্ষণ দেরি করন যাইবো না। দেরি হইলে মহাজন পিটাইবো আমারে।”
কথাগুলো বলেই আমার হাতে সেই নীল চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে ছেলেটি আবারো ছুটে মিশে গেল জন স্রোতের মাঝে। আমি নিরুপায় হয়ে কাগজটির ভাঁজ খুলে মেলে ধরলাম। সেখানে মোটা মোটা অক্ষরে লেখা আছে,
” এই যে এলোকেশী , মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে না থেকে হাতে রাখা বইটা খুলে দেখুন আর হ্যা আপনাকে না এমন এলোকেশী হয়ে ঘুরতে না করেছি আমি। কারো নজর লেগে যাবে তো। চুলটা বেঁধে ফেলুন। ”
ইতি
আপনার মি.ট্রেনওয়ালা
চিঠিটা দেখেই আমার মনটা ক্ষনিকের মাঝেই আবারো ভালো হয়ে গেল। মনে স্বস্তি হলো মি.ক্যাবলাকান্ত তাহলে ভুলে যায় নি আমাকে। চিঠিটা অহনাকে দিয়ে বললাম।
–” পড়ে দেখ একবার চিঠিটা। খুব তো বলেছিলি তোদের নিদ্র মহাশয় কোন মেয়েকেই নাকি সহ্য করতে পারেন না , তাহলে এসব কি?”
আমার কথা শেষ না হতেই অহনা আমার হাত থেকে চিঠিটা একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়েই পড়তে শুরু করল। পড়া শেষ হতেই নিজের হাতে কপাল চাপড়িয়ে বলে ওঠল,
–” এসব কি দেখছি আমি। এই আমার চোখ ঠিক আছে তো? যে ছেলেটা আজ পর্যন্ত কোন মেয়েকে তার পাশে ঘেঁসতে দেয় নি ,সেই নাকি আজ তোকে এসব লিখেছে। দেখ দেখ চিঠির নিচে আবার লিখেছে ইতি তোমার মি.ট্রেনওয়ালা। বোইন আমি এবার নিশ্চিত এইটা আরশান মাহমুদ নিদ্র হতেই পারে না। এই ব্যাটা নিশ্চয় অন্য কেউ।”
–” এসব কি আবল-তাবল বকছিস বল তো। এইটা ঐ ব্যাটায়। তবে যাই বলিস মি.ক্যাবলাকান্ত কিন্তু একটা মিচকে লোক। লোককে দেখায় অন্য কিছু আর করে তার বিপরীত।”
–” এইডা তুই এক্কেবারে আমার মনের কথা কইছোস। এখন এত বকবক না করে বইটা খুলে দেখ ,সেখানে এমন কি লিখেছেন তোর মি. ট্রেনওয়ালা ক্যাবলাকান্ত। ”
–” ঠিক কথা মনে করেছিস। চল তো দেখি কি লিখেছে।”
নীল রঙের বইটা খোলার আগেই হঠাৎ বাবার ডাক শুনতে পেলাম আমরা। অগত্যা তখন আর বইটা খুলে দেখার সুযোগ হলো না আমাদের । তখনি ছুটে চলে গেলাম বাবাদের কাছে। বাবাদের কাছে পৌঁছে দেখলাম বাবা,মা আর ফুপিদের সামনে নীল রঙের পাঞ্জাবি পড়া এক ছেলে দাঁড়িয়ে আছে আর বাবা সেই ছেলের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। আমাকে দেখেই বাবা বলে ওঠলেন,
–” এই অদ্রি ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এদিকে আয় ,দেখে যা কে এসেছে?”
আমি আর অহনা দুজনে মিলে বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম কিন্তু সামনে তাকিয়ে আমরা দুজনেই অবাক। আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং মি. ট্রেনওয়ালা ক্যাবলাকান্ত। আমি আর অহনা হা করে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। বাবা আমাদের এমনভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে ওঠলেন,
–” কি রে এভাবে হাঁ করে তাকিয়ে আছিস কেন? চিনতে পারলি না তো?”
বাবার প্রশ্নে আমি আর অহনা দুজনেই মাথা নাড়িয়ে না বোধক ইঙ্গিত দিলাম। আসলে এখন সব কিছুই যেন আমাদের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। এইবার বাবা হাসতে হাসতে বলল,
–” আরে এইটা আমাদের নিদ্র। আমার ছাত্র আবার সেই সাথে আমাদের প্রতিবেশিও ছিল। ছোটবেলায় তুই যাকে নিদ্রদা বলে ডাক তি।”
এইবার সম্পূর্ণ ঘটনাটা খোলসা হলো আমার কাছে। ইনিই তাহলে নিদ্র দা ,যে ছোটবেলায় আমার জীবনটাকে তেজপাতা বানিয়ে ফেলেছিল। তারমানে ব্যাটা ক্যাবলাকান্ত আমাকে আগে থেকেই চিনেন। আর এই জন্যই সেদিন ট্রেনে তিনি এমন ব্যবহার করছিলেন আমার সাথে। আমি বাবার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এইবার সোজাসুজি তাকালাম মি.ক্যাবলাকান্তের দিকে। ওনি তখন আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিলেন। তখন আমার সাথে ক্যাবলাকান্তের কথা না হলেও বার দুয়েক চোখাচোখি হয়েছিল আমাদের। তারপর বাবার থেকে বিদায় নিয়ে ওনি আবারো ওনার প্রকাশনীর স্টলের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমরাও আরো কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে রওনা দিলাম আমাদের গন্তব্যের দিকে। সময় তখন সন্ধ্যা হবে হবে এমন। আর কিছুক্ষণ পরেই পুরো শহরটাকে গ্রাস করবে নিকষ কালো অন্ধকার। অবশ্য এই ঝলমলে ঢাকা শহরে অন্ধকারের আধিপত্য নেই বললেই চলে। রাত যত বাড়তে থাকে, এই ঝলমলে ঢাকা শহরের জৌলুস ততটাই বাড়তে থাকে। সেই সাথে বাড়তে থাকে নানা রকমের মানুষের আনাগোনা, যাদের পুরো জীবনেই রয়েছে কোন না কোন গল্পের ঝুলি।
চলবে