শেষটাও_সুন্দর_হয়,পর্ব:-০৪
অতিতের_কিছু-কথা
আমিনা_আফরোজ
সময় বারোটা বেজে ত্রিশ মিনিট । চারিদিক শুনশান। ধীরে ধীরে কমে আসছে যানবাহনের যান্ঞিক শব্দ । কুয়াশায় প্রকৃতিতে একাই জেগে আছে রাস্তার পাশে টিমটিম করে জ্বলতে থাকা নিয়ন বাতিগুলো। চৌধুরি বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও আমি এখনো জেগেই রয়েছি। মেলা থেকে বেরিয়ে আমারা গিয়েছিলাম এক অভিজাত রেস্টুরেন্টে রাতে খাবার উদ্দেশ্যে। সেখানে পেটপুরে খেয়ে তারপর বাড়ি ফিরি আমরা। অবশ্য এমন চাককিক্যময় রেস্টুরেন্টে এই প্রথম যাওয়া হয়েছিল আমার। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আমি। বাবা আর মা চাকরি করে যেটুকু আয় রোজগার করেন তা আমাদের পড়াশোনা আর খাওয়ার -দাওয়ার পিছনেই শেষ হয়ে যায়। তাই এসব রেস্টুরেন্টের দামি দামি খাবার আমাদের জন্য নয়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি তখন ভেবে চলেছি আমাদের অতিতের দিনগুলো।
মি.ট্রেনওয়ালা ক্যাবলাকান্ত ছিলেন আমাদের প্রতিবেশী। আমি তখন সবে ক্লাস ফ্লোরে পড়ি। বাসা থেকে কিছুটা দূরেই ছিল আমার স্কুল । আমার স্কুলে যাওয়া-আসার সাথী ছিলেন মি.ট্রেনওয়ালা ওরফে নিদ্র ভাই। বয়সে ওনি ছিলেন আমরা থেকে গুনে গুনে পাঁচ বছরের বড়। তখন তিনি পড়তেন ক্লাস নাইনে। ওনি নাকি ছোট থেকেই খুব ভাল ছাত্র ছিলেন। ওনার গুনে পঞ্চমুখ ছিল পাড়ার সকলে। বলা যায় ছোট বেলা থেকেই সকলের অতি আদরের পাত্র ছিলেন তিনি। আমি ওনাকে ডাকতাম নিদ্র ভাই বলে। ওনার প্রতিদিনের রুটিনে আমাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া আবার স্কুল থেকে নিয়ে আসা ছিল নিত্যদিনের কাজ। বিকেলে ওনি যখন ওনার বন্ধুদের সাথে খেলতেন আমাকে তখন মাঠের পাশের বেঞ্চ এ বসিয়ে দিতেন খেলার দেখার জন্য কিন্তু আমার খেলাধুলা করা ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। মূলত খেলাধুলা নিষিদ্ধ ছিল না নিষিদ্ধ ছিল ওনি ছাড়া অন্য কারো সাথে খেলা করা,কথা বলা বা হাসাহাসি করা। যদি দৈবাত ক্রমে আমি ওনার নিষিদ্ধ কাজগুলো করতাম তবে আর সেদিন রক্ষে ছিল না আমার। সারাটা দিন হয় কান ধরে একপায়ে দাঁড়িয়ে রাখতো নতুবা কান মোলা দিতো আবার কখনো কখনো পড়া ধরার বাহানা দিয়ে বেধড়ক পিটাতো। সেই ভয়ে নিদ্র ভাইয়া ছাড়া আর কারো সাথে খেলার বা কথা বলার চেষ্টাও করতাম না কখনো। সেধে কি আর শাস্তি পেতে চায়। সে শাস্তির কথা যাক গে। আমি যখন ক্লাস সিক্স এ ওঠলাম তখন হঠাৎ করেই নিদ্র ভাইয়ের বাবার ট্রান্সফার হয়ে যায় রাজশাহীতে। সেই সময় নিদ্র ভাইয়া অনেক জিদ করেও আর আমাদের ঐখানে থাকতে পারেন নি। তল্পিতল্পা গুটিয়ে তাদের চলে যেতে হয়েছিল রাজশাহী নামক নতুন শহরে । তবে চলে যাওয়ার আগে বারবার আমাকে সাবধান করেছিলেন যেন আমি অন্য কোন ছেলের সাথে না কথা বলি। সেদিনটা এখনো স্পষ্ট মনে আছে আমার।
সেদিন ছিল শুক্রবার । শুক্রবার মানেই তখন আমার কাছে বিরাট এক ব্যাপার। স্কুল নেই,পড়াশোনা বয়কট , সারাদিন নিজের মতো করে সময় কাটানো এ যেন এক এলাহি ব্যাপার। প্রতি শুক্রবারের মতোই সেদিনও আমি আমার রং পেন্সিল নিয়ে বসে গেছি ছবি অঙ্কন করতে। হঠাৎ আমাদের বাসার মেইন দরজা দিয়ে ঝড়ের বেগে বাসায় ঢুকল নিদ্র ভাই। চোখ মুখ ফোলা তার যেন গতরাতে সারাক্ষণ কেঁদেছেন তিনি। চুলের অবস্থা আরো খারাপ। সে সোজা আমার সামনে এসে বলল,
–” অদ্রি দাঁড়াতো। কথা আছে তোর সাথে।”
আমি সুবোধ বালিকার মত তার কথায় দাঁড়িয়ে গেলাম। কেন যে এখন তাকে ঘাটাতে ইচ্ছে করছে না। অন্য সময় হলে অবশ্য কিছুক্ষণ বাক-বিতন্ডতা চালাতাম ওনার সাথে । আমি দাঁড়াতেই নিদ্র ভাই হঠাৎ আমার আরো কাছে এসে দাঁড়িয়ে আমার চুলে হাত দিয়ে আমাকে আরো কিছুটা তার সাথে মিশিয়ে নিলো। আমাদের দুজনের মাঝে দুরত্ব খুব একটা ছিল না। আমি চুলে টান লাগাই চেঁচিয়ে বলে ওঠলাম,
–” আহ্ নিদ্র ভাই, চুল ছাড়ো। লাগছে তো।”
–” লাগার জন্যই তো ধরেছি।”
–” আরে কি হয়েছে তোমার বলবে তো নাকি? এমন পাগলের মতো করছো কেন তুমি? এই নিদ্র ভাই তোমাকে আবার পাগল কুকুরে কামড়ায় নি তো? আমার কিন্তু তোমার অবস্থা ভালো লাগছে না। সোনা বাবাইকে বলেছো তোমাকে যে পাগলা কুকুরে কামড়িয়েছে? কি সাংঘাতিক ব্যাপার নিদ্র ভাই। তোমার মতো একজনকে কি না কুকুর কামড়িয়েছে, তাও আবার যে সে কুকুর না একেবারে পাগলা কুকুর।”
আমার কথা শুনে নিদ্র ভাই রাগী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে জোরে ধমকে বলে উঠলেন,
–” চুপ। আর একবার যদি আবল-তাবল কথা বলেছিস তো দেখিস কি করি। আর শোন আমাকে যে কুকুর কামড়িয়েছে তার নাম জানিস?”
–” কুকুরের আবার নাম হয় নাকি? আগে জানতাম না তো ? দাঁড়াও সোনা মাকে জিজ্ঞেস করে আসি ।”
–” তোর সোনা মার কাছে যেতে হবে কেন? আমি আছি তো। আর তাছাড়া কুকুরটা যখন আমাকে কামড়িয়ে সেই কুকুরের নামটাও নিশ্চয় আমিই জানবো তাই না?”
–” তা ঠিক। তো বলো কুকুরের নামটা কি?”
নিদ্র ভাই এইবার আমাকে আরো কিছুটা নিজের দিকে তাকিয়ে আমার কানে ঠোঁট লাগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠলেন,
–” কুকুরীনির নাম অদ্রি ইসলাম ওরফে মিসেস আরশান মাহমুদ নিদ্র।”
আমি তখনো ওনার বাহু বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছি। ওনি আমার গালে হালকা করে কামড় দিয়ে বলে ওঠলেন,
–” তুই আমাকে কামড়িয়ে পাগল বানিয়েছিস তাই আমিও কামড়ে দিলাম। এখন তোর পাগল হবার পালা। আর এই যে খরগোশিনী, আমি থাকবো না বলে আমার বিধি-নিষেধগুলো ভুলে যাবেন না । মনে রাখবেন, আরশান মাহমুদ নিদ্র কখনোই তার জিনিস এর কথা ভুলে না । আর আপনি তো পুরোটাই আমার সম্পদ। বুঝেছেন? ”
–” আমি আবার তোমার সম্পদ হলাম কবে নিদ্র ভাই? আমি তো মানুষ। বাবা বলেছে আমি লক্ষী মেয়ে।”
–” আহ্ তোকে বুঝানো আর গাধাকে বুঝানো একই কথা।”
–” আমাকে তোমার কোন দিক থেকে গাধা মনে হয় বলো তো নিদ্র ভাই?”
–” এই তুই থামবি। কখন থেকে আজেবাজে বকেই বলেছিস। শোন আজ থেকে তিয়ান তোকে স্কুলে নিয়ে যাবে আবার নিয়ে আসবে। তোর যা যা প্রয়োজন তিয়ানকে বলবি ও সব করে দিবে। আর হ্যা তিয়ান কিন্তু তোর ওপর নজরদারিও করবে। যদি শুনেছি তুই কোন ছেলের সাথে কথা বলেছিস তো রাজশাহী থেকে এসে তোকে শাস্তি দিয়ে যাবো।”
–” তুমি রাজশাহী চলে যাবে?”
–” আমি না তোর সোনা বাবাই আর সোনা মাও যাবে। কি রে আমার কথা শুলো মনে থাকবে তো?”
–” হুম। এখন ছাড়ো , আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।”
–” দম বন্ধ হয়ে আসলেও এইভাবেই আজীবন থাকতে হবে আমার সাথে।”
কথাটা বলেই নিদ্র ভাই আমার চুল ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে নিতেই আমি বলে উঠলাম,
–” আরে আরে যাচ্ছো কোথায়? এখনো একটা কাজ বাকি রয়েছে যে?
নিদ্র ভাই আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু-কুচকে জিজ্ঞেস করলো,
–” আর কি বাকি আছে? সব তো বলেই দিলাম।”
–” ওহ হো তুমি তো দেখি পাগলের সাথে সাথে ভুলোমনাও । আরে আমার এক গালে কামড় দিয়েছো ,এখন ওপর গালে কামড় দিবে কে? তুমি জানো না এক গালে কামড় বা চড় দিলে বিয়ে হয় না।”
আমার কথা শুনে নিদ্র ভাই হেসে বলল,
–” তোর যেদিন বিয়ের বয়স হবে সেদিন আমি নিজেই তোর আরেক গালে কামড় দিয়ে যাবো কেমন।”
তারপর আমার দিকে ক্ষনকাল আমার দিকে তাকিয়ে চলে গেলেন। সেদিনই ওনার সাথে শেষ দেখা আমার তারপর আর কোন দিন দেখা হয় নি। মাঝে মাঝে অবশ্য সোনা মার সাথে কথা কিন্তু নিদ্র ভাই আর কোন দিন কথা বা দেখা করেন নি আমার সাথে। আজ অনেকগুলো দিন পরে আবারো তার সাথে দেখা হলো আমার। আমাদের দেখা হওয়াটা কি এক্সিডেন্ট নাকি আগে থেকে সাজিয়ে রাখা কোন নাটক। তবে সেদিনের পর থেকে তিয়ান ভাইয়াই আমার সব খেয়াল রেখেছে। আবারো তাহলে কি নিদ্র ভাইয়ের সাথে জড়িয়ে যাবে?
চলবে