শেষটাও_সুন্দর_হয়,পর্ব:-০৬

0
733

শেষটাও_সুন্দর_হয়,পর্ব:-০৬
দুষ্ট_মিষ্টি_খুনশুটি
আমিনা_আফরোজ

বিকেল পাঁচটা। ঢাকা শহরের পিচ ঢালা রাস্তায় হেঁটে চলেছি আমি ,অহনা আর নিদ্র ভাই। আমি আর অহনা তখন গল্পে মশগুল হঠাৎ আমাদের সামনে এক আপু এসে বলে ওঠল,

–” আরে অহনা, তুই এখানে। কতদিন পরে দেখা। অনেক কথা জমে আছে আমার।”

–” আরে নিরা আপু তুমি। তোমাকে তো আর দেখাই যায় না।”

অহনার কথায় বুঝলাম ঝড়ে উড়ে আসা আপুটির নাম নিরা। হয়ত অহনার পূর্ব পরিচিত। অহনার কথা শুনে আপাতত তাই মনে হচ্ছে।

নিরা আপু আমাদের দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ না করেই অহনার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,

–” অনু চল না ঐ দিকটাই বসে দুজনে গল্প করি।”

–” আজ পারবো না আপু। আমার সাথে আরো দুজন আছে তো, ওদের ছাড়া কিভাবে যাই বলো।”

অহনার কথা শুনে নিরা নামক আপুটি এতোক্ষনে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন আমাদের দিকে। নিদ্র ভাইয়াকে দেখে আচমকাই চেঁচিয়ে বলে ওঠলেন,

–” আরশান মাহমুদ নিদ্র , এখনকার জনপ্রিয় লেখক। আমার সামনে,আমি তো ভাবতেই পারছি না। ”

কথাগুলো বলেই অহনাকে ছেড়ে নিদ্র ভাই এর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন,

–” বিশ্বাস করুন আমি সত্যিই ভাবতে পারি নি এভাবে আপনার সাথে দেখা হয়ে যাবে। আমাকে চিনতে পেরেছেন?”

–” আসলে সত্যি কথা বলতে আপনাকে ঠিক মনে করতে পারছি না।”

–” আরে আপনি আমাকে কিভাবে ভুলে গেলেন বলুন তো। আমি আপনার এত বড় এক পাঠিকা। আজ অব্দি আপনার লেখা একটা বই পড়া বাদ যায় নি আমার আর আপনি কি না আমাকেই ভুলে গেছেন?”

–” দুঃখিত। ভারি অন্যায় হয়েছে আমার।”

ওনাদের এমন ন্যাকা ন্যাকা কথা শুনে আমি অহনাকে বললাম,

–” তুই এখনি এই ন্যাকাকে এখান থেকে বিদায় কর,তা নাহলে তোর কপালে বহুত কষ্ট আছে বলে রাখলাম।”

–” আরে আমার কি দোষ এখানে? তোর হিরোই তোয়াগ বাড়িয়ে রসিয়ে রসিয়ে কথা বলছে ।”

–” কে কি করছে তা আমি জানি না,আমি জানি তুই এই ন্যাকাকে এখান থেকে বিদায় করবি।”

–” আরে আমি কি করবো?”

–” তুই কিভাবে কি করবি আমি কি জানি।”

আমার কথা শুনে অহনা নিরা আপুর দিকে তাকিয়ে বলল,

–” নিরাপু আমাদের একটু তাড়া ছিল আজ। তুমি বরং অন্য দিন গল্প করিও কেমন?”

–” আরে অনু কি যে বলিস না তুই। আজকের মতো সময় আর দিন কি রোজ রোজ পাবো নাকি।”

–” কিন্তু…….

অহনাকে থামিয়ে দিয়ে নিরা আবারো বলে ওঠল,

–” তুই থাম তো। মি. আরশান মাহমুদ নিদ্র এই শীতের পরন্ত বিকেলে যদি আপনাকে এক কাপ কফি খাওয়ার নিমন্ত্রণ করি তবে কি আপনি রাজি হবেন?”

নিদ্র ভাই কিছু বলার আগে আমি নিজেই বলে ওঠলাম,

–“না আপু ,আসলে আজ আমাদের হাতে খুব একটা সময় নেই। পরে একদিন না হয় তোমার নিমন্ত্রণ রক্ষা করবো কেমন।”

নিহা আপু আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

–” তুমি কে? ও তুমি বুঝি লেখক সাহেবের সাথে এসেছো? কে হও তুমি লেখক সাহেবের? বোন নাকি?”

নিহা আপুর কথা শুনে আমার রাগ তখন তুঙ্গে ওঠেছে। নিজেকে কোন রকম সামলিয়ে নিদ্র ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে ওনার এক হাত জড়িয়ে বললাম,

–” আমি মিসেস অদ্রি আরশান মাহমুদ। ওয়াইফ অফ আরশান মাহমুদ নিদ্র।”

আমার কথা শুনে নিদ্র ভাই অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। নিরা আপুও অবাক হয়ে নিদ্র ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,

–” আপনি বিবাহিত। এই তা হলে আপনার সেই এলোকেশী যাকে আপনি আপনার প্রতিটি বইয়ের পাতায় রেখেছেন। ”

–” আসলে…..

–” আসল নকল বুঝি না। এই যে এলোকেশী আপনি সত্যিই খুব ভাগ্যবতী। আপনি এমন একজন কে আপনার জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন যে আপনাকে আপনার থেকেও বেশি ভালোবাসে। যার অন্তরে শুধুই আপনার বসবাস। ”

কথাগুলো বলে তিনি আমাদের থেকে মুখ ঘুরিয়ে অহনার দিকে তাকালেন। নিরা আপুর চোখের কার্নিশ বেয়ে তখনো অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। হয়তো তার মনে ক্যাবলাকান্তের জন্য আমার মতোই কোন অনুভূতি লুকানো ছিল। হঠাৎ নিরা আপু ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠলেন। নিদ্র ভাই আমার দিকে তাকিয়ে নিরা আপুর দিকে চলে গেলেন তারপর নিরা আপুকে বললেন,

–” আমি জানি কাউকে ভালোবেসে তাকে না পাওয়ার কষ্ট ঠিক কতখানি হয় । তবে আমি তোমার জন্য অলিক মায়া ছাড়া আর কিছু নয়। হতে পারে আমি আগাগোড়া পুরোটাই তোমার মোহ। যাকে এখন হয়তো তোমার ভালো লাগছে কিন্তু আগামী সময়ের কোন না কোন এক সময় আমি প্রতি তোমার এই মোহ থাকবে না। তুমি তোমার মনকেই প্রশ্ন করে দেখো যে আমি তোমার মোহ না ভালোলাগা?”

নিরা আপু অশ্রু সজল দৃষ্টিতে নিদ্র ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,

–” আমি সত্যিই আপনাকে ভালোবেসে ছিলাম। আপনার আমিটাকে আমার অস্তিত্বের মাঝে আঁকড়ে রেখেছিলাম। এত দিন আপনার কাছে যে বেনামী চিঠিগুলো এসেছিল সেগুলো ছিল আমার মনের শুপ্ত
অনুভূতি।”

–” আমি তোমার কষ্টটা বুঝতে পারছি তবুও বলবো আমি তোমার কাছে শুধু একটা মোহের নাম। ভালোবাসা আর মোহ দুইটা পরস্পর থেকে আলাদা। আজ হয়তো আমার কথাগুলো তুমি বুঝতে পারবে না কিন্তু যেদিন তোমার জীবনে একজন সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষ আসবে সেই দিন ঠিক বুঝতে পারবে। শুধু বুঝতে পারবে তাই নয় ,সেদিন তুমি তোমার মনকে বলবে তুমি সোনার হরিণ ছেড়ে একদিন অন্য এক মরিচিকার পিছনে ছুটেছো।”

কথাগুলো বলেই নিদ্র ভাই আমার হাত ধরে আমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে নিয়ে আসতে লাগলো। আমি পিছনে ফিরে নিরা আপুর সেই অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। নিরা আপু তখনো আমাদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।

রাত এগারোটাটা বেজে ত্রিশ মিনিট। বেলকুনির গ্রিল বরাবর এক কোনে দাঁড়িয়ে আছি আমি। বাসার সবাই এতক্ষনে ঘুমিয়ে পড়েছে, শুধু এই নিশুতি রাতে একাই জেগে রয়েছি আমি। গ্রিলের ওপারের নীল আকাশ জুড়ে ওঠেছে পূর্ণিমার গোল চাঁদ। সেই সাথে পুরো আকাশ জুড়ে বসেছে তারার মেলা। উত্তরের শীতল বাতাস আলতো করে ছুয়ে যাচ্ছে আমায়। চারিদিক শুনশান, নিস্তব্ধ। হঠাৎ এই নিস্তব্ধতাকে ছাপিয়ে আমার হাতে থাকা ফোনটি বেজে উঠল। ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে মি. ক্যাবলাকান্ত ট্রেনওয়লা নামটি। আমি ক্ষনকাল সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে পুরুষালী গলার স্বর শুনতে পেলাম।

–” এখনো রাগ করে আছো এলোকেশী।”

–” রাগ নয় কষ্ট হচ্ছে।”

–” কেন ? আমি তো তোমারই আছি।”

–” তবুও তোমাকে নিয়ে অজানা এক ভয় বেঁধেছে নিদ্র ভাই।”

–” ভয়টা আমাকে নিয়ে নাকি অন্যকিছু?”

–” ভয় হচ্ছে আমি তোমার জীবনে নিছক মায়া হয়ে রয়ে না যাই। ”

–” হঠাৎ এমন সংশয় জাগলো কেন এলোকেশী?”

–” জানি না । হঠাৎ মনের কোনে উঁকি দিল । ”

–” দেখুন এলোকেশী আপনি আমার মোহ নন, আপনি আমার অস্তিত্ব । যাকে ছোট বেলা থেকে আমি আমার মাঝে আয়ত্ব করে নিয়েছি। নিজের অস্তিত্বকে কে ভুলতে পারে বলুন? ”

–” তবুও আপনাকে একান্তই আমার করে পেতে চাই আমি। যে আমিতে না থাকবে কোন সংশয় আর না থাকবে হারানোর ভয়।”

–” ঠিক আছে তবে তাই হোক। আগামীকালই আপনি আমাকে আপনার একান্ত করে পাবেন। এবার গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। রাত বাড়ছে যে। ”

–” আজ না ঘুমালে ক্ষতি কি। হোক না কি গোপন কথোপকথন।”

–” শেষে গোপন কথোপকথনে যদি আপনি লজ্জা পান তখন কি হবে।”

–” এমন দুই একবার লজ্জায় পড়লে খুব একটা খারাপ হয় না।”

–” ঠিক আছে কেটে যাক তবে কিছু পাল। আজ না হয় দুজনে দুজনের মাঝে হারিয়ে যাই। ”

এইভাবেই পূর্নিমার রুপালি আলোয় গোপন কথপোকথন চলতে লাগলো একজোড়া কপোত কপোতীর মধ্যে। রাতের নিস্তব্ধতায় দু’জন দুজনার আরো কাছে এলো। শুরু হলো এক নতুন উপাক্ষান। এক নতুন সূচনা।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here