শেষটাও_সুন্দর_হয়,পর্ব:-১০

0
1725

শেষটাও_সুন্দর_হয়,পর্ব:-১০
গোধূলি_লগ্নে_দুজনে
আমিনা_আফরোজ

সকাল দশটা। আমার ছোট্ট ঘরের বিছানায় শুয়ে আছি আমি। সূর্যের সোনালী কিরনে চারিদিক আলোকিত হয়ে ওঠেছে এখন। বাবা – মা আর অথৈ পাশের ঘরে। নিদ্র ভাইয়া ওঠেছে তিয়ান ভাইদের বাসায়। তিয়ান ভাই তো তার ছোট বেলার বন্ধুকে পেয়ে মহা খুশি। তিয়ান ভাইয়ের সাথে আমিও আজ বেজায় খুশি। মি.ট্রেনওয়ালাকে দিন চারেক নিজের চোখের সামনে দেখতে পারবো তো। এই আমার কাছে অনেক। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই শ্রান্তিতে বুজে আসলো চোখের পাতা। আর কিছু ভাববার অবকাশ পেলাম না আমি। ধীরে ধীরে ঢোলে পড়লাম ঘুমের রাজ্যে।

ঘুম থেকে ওঠতে ওঠতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। ঘড়িতে তখন সাড়ে চারটা বাজে । সেই যে দশটার দিকে ঘুমিয়ে ছিলাম কেবল ওঠলাম। টেবিলে রাখা ফোনটা হাতে নিয়ে অন করে দেখি ৩৬ টা মিসকল আর গোটা বিশেক মেসেজ যার সবগুলোই নিদ্র ভাইয়ের নম্বর থেকে এসেছে। এমনিতেই এতগুলো মিসকল দেখে আমার অজ্ঞান হবার যোগাড় তার ওপর আবার হুমকি ভরা মেসেজ। তাই আর দেরি না করে ঝটপট কল দিলাম নিদ্র ভাইয়ের নম্বরে। নিদ্র ভাই আমার কল কেটে নিজে কল ব্যাক করাতে মুচকি হেসে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ধমকের সুরে কেউ বলে উঠলো,

–” এই মেয়ে এই , কত বার কল দিয়েছি দেখো তো? কোন পাত্তা নেই। কই ছিলে সারাদিন হ্যা? জানো সারাদিন কতটা ছটফট করেছি আমি? আর তুমি…..

নিদ্র ভাইকে একধারে বকবক করতে দেখে এবার আমি নিজেই ওনাকে থামিয়ে দিলাম নয়তো ওনি বকবক করতেই থাকবেন। নিদ্র ভাইকে থামিয়ে আমি বললাম,

–” আরে আরে একা একা নিজেই বকবক করে যাচ্ছেন ,আমাকেও তো কিছু বলার সুযোগ দিবেন নাকি আমার কথা না শুনেই আমাকে দন্ড দিবেন?”

আমার কথা শুনে এবার যেন খানিকটা দমলেন নিদ্র ভাই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

–” বলো কি বলবে? তবে আগেই বলে দিচ্ছি ফালতু অযুহাত দিবে তো শাস্তি ভোগ করবে। তাই বুঝে শুনে কথা বলো।”

নিদ্র ভাইয়ের কথা শুনে আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,

–” আসলে নিদ্র ভাই হয়েছে কি……..

–” তুই আবার আমাকে ভাই বলে ডাকছিস? সেদিনের শাস্তিটা বোধহয় ভুলে গেছিস, দাঁড়া আজ হচ্ছে তোর।”

–” সরি সরি সরি। ভুলে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে তো। আর এমন ভুল হবে না। প্রমিস।”

–” তোকে কেন যেন আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আচ্ছা ঠিক আছে এইবারই শেষ। এমন ভুল আর একবার হলে কিন্তু আমি তোকে ছাড়বো না এই বলে দিচ্ছি।”

–” হ্যা হ্যা একদম। আমি তোমার সকল শর্তে রাজি।”

–” বাব্বাহ আজ হঠাৎ সূর্য কোন দিকে ওঠেছে বলোতো?”

–” কেন গো? সূর্য প্রতিদিন যে দিকে ওঠে, আজও সেই দিকেই ওঠেছে। আজ কি এমন স্পেলাল দিন যে সূর্যিমামা হঠাৎ পশ্চিম দিক থেকে ওঠতে যাবে?”

–” আজ তো স্পেশাল দিনই বটে। তুমি আজ বিনা ওজরে আমার শর্তে রাজি হলে তাই ভাবলাম আজ বোধহয় সূর্যিমামা তার দিক ভুল করে ওঠেছে।”

–” এই সব সময় আমাকে নিয়ে এমন কথা বলবে না বলছি। কি এমন করেছি আমি হু? তোমার শর্তে রাজি হয়েছি। এখন যদি আমি তোমার শর্তে রাজি না হতাম তখন তুমি কি বলতে জানো?”

–” কি বলতাম?”

–” বলতে বিয়ের একমাস গড়াতে না গড়াতেই তুমি আমার অবাধ্য হয়ে গেছো , বাকি জীবন তো পড়েই রইলো।”

–” এইটা অবশ্য তুমি ঠিক বলেছো?”

–” আমি সব সময় সঠিক কথাই বলি জনাব। আপনারা ছেলেরা হলেন এক আজব জিনিস, কখন যে কি নিয়ে রিয়েক্ট করেন তা নিজেরাই জানেন না।”

–” হয়েছে,হয়েছে এখন আর বকবক করতে হবে না। তাড়াতাড়ি তিয়ানদের বাসায় মোড়ে চলে এসো।”

–” ঠিক আছে আপনি মিনিট ত্রিরিশ এর মতো অপেক্ষা করুন,আমি আসছি।”

–“আরে এখান থেকে এখানে আসতে ত্রিশ মিনিট সময় লাগে নাকি?”

–” উফফ আমি এত অধৈর্য কেন? একটু সবুর করতে শিখুন তো। জানেন না ,সবুরে মেওয়া ফলে।”

কথাটা বলেই কলটা কেটে দিলাম। তারপর কাপড় নিয়ে চলে গেলাম ফ্রেশ হতে।

এদিকে পাশের কামরায় বসে আছেন আশরাফ মাহমুদ আর অরুনিমা মাহমুদ। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন তারা। আলোচনার মূল বিষয়বস্তু নিদ্র ও অদ্রি। আশরাফ মাহমুদ ওনার স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,

–” ছেলে মেয়ে দুটো বড্ড ছেলেমানুষ। এই ছেলেমানুষির কারনে কোন ভুল সিদ্ধান্ত না নিয়ে ফেলে।”

অরুনিমা মাহমুদ তখন উলের সোয়েটার বুনেছিলেন। স্বামীর কথা শুনে তিনি বলে উঠলেন,

–” এজন্যই আমি বলেছিলাম দুটোকে বিয়ে দিয়ে দাও। তাহলেই তো আর চিন্তা থাকতো না। নিদ্র তো আমাদের হাতে গড়া ছেলে, কি এমন ক্ষতি হতো এখন বিয়েটা সেরে ফেললে।”

স্ত্রীর এমন বোকা বোকা কথায় বেশ বিরক্ত হলেন আশরাফ মাহমুদ। বিরক্তি ভরা কন্ঠে বলে উঠলেন,

–” আহ অরু তুমি দেখি এখনো সেই অবুঝটাই রয়ে গেলে। বলি ওদের দুজনের কি পড়াশোনা শেষ হয়েছে? দুজনেই ওঠতি বয়সের ছেলে-মেয়ে। এখন যদি ওদের বিয়ে পড়িয়ে দেই ,তবে ওদের পড়াশুনা উচ্ছন্নে যাবে। যা আমি কিছুতেই হতে দিবো না। বুঝেছো?”

–” কচু হতো। তুমিও তো আমাকে ছাত্র অবস্থাতেই বিয়ে করেছিলে, কই আমাদের পড়াশোনার তো কোন ক্ষতি হয়নি তাহলে ওদের হবে কেন?”

–” আমি আর নিদ্র এক হলো নাকি? মোটেই না। শোনো তুমি কিন্তু আমার মেয়েটাকে আজে বাজে পরামর্শ দিবে না,এই আমি বলে রাখলাম।”

–“আমার বয়েই গেছে তোমার মেয়েকে আজেবাজে বুদ্ধি দিতে। যতসব।”

কথাটা বলেই অরুনিমা মাহমুদ চলে গেলেন রান্নাঘরের দিকে আর আশরাফ মাহমুদ স্ত্রীর কথাগুলো আমলে না নিয়ে গোধুলির রক্তিম আকাশপানে তাকালেন।

তিয়ানদের ফুলের বাগানের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর নিদ্র ভাই। বিকেলের এই সময়টা প্রকৃতি বড় নিশ্চুপ হয়ে থাকে। প্রকৃতির সাথে সাথে আমরাও নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তিয়ান ভাইয়ের বাড়ির দুরুত্ব আমাদের বাড়ি থেকে মিনিট দশেকের পথ। সাদা দোতলা বাড়ির সম্মুখ প্রান্তেই রয়েছে ফুলের বাগান। ফুলের বাগানের পাশেই রয়েছে একটি দোলনা। আজ অবশ্য তিয়ান ভাইদের বাসায় কেউ নেই। তিয়ান ভাইয়েরা সবাই পিঠার দাওয়াতে গিয়েছেন। বিশাল এই তে বাড়িতে শুধু একা রয়ে গেছেন নিদ্র ভাই যদিও এটা ছিল নিদ্রা ও তুহিন ভাই দুজনের মিলিত পরিকল্পনা।

আমি আর নিদ্র ভাই এগিয়ে গিয়ে ফুল দিয়ে সাজানো সেই দোলনায় বসলাম। চারিদিকে ততক্ষণে কুয়াশার শুভ্র চাদর পড়তে শুরু করেছে। সূর্যি মামাও ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছে পশ্চিম আকাশের কোলে। সারাদিনের শ্রান্ত পাখিরাও ফিরে চলেছে তাদের গৃহকোনে,যেখানে তার জন্যও অপেক্ষা করছে তার প্রিয়তম। আমি নিদ্র ভাইয়ের কাঁধে মাথা রেখে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম রক্তিম সূর্য মামার পানে।আর নিদ্র ভাই আমার হাত তার হাতের মুঠোয় নিয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।
আচমকা নিদ্র ভাই আমার কানে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন,

” কোন এক গোধূলি বেলার
স্নিগ্ধ হাওয়ায়
তোমায় নিয়ে হারিয়ে যাবো
দূর পাহাড়ের অচিন দেশে
যেথায় মোদের কেউ পাবে না খুঁজে”
~আমিনা আফরোজ

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here