#শেষের_পঙক্তি,পর্ব_২১,২২
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২১
গুরুগম্ভীর আবহাওয়া বিরাজমান কক্ষের আনাচে কানাচে। তূর কাঁচুমাচু হয়ে বসে আছে। মাঝে মাঝে যেন তার সব সাহস হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো বাতাসে মিলিয়ে যায়। তূরের বাবা তূরের ভীতু মুখশ্রী অবলোকন করে বললেন,
–কথাটা তুমি নিজে এসেও আমাকে বলতে পারতে। ইফতিকে দিয়ে বলানোর কি ছিল?
তূর অবাক হয়। তূর অজ্ঞাত ছিল ইফতির বিষয়ে। তূরের বাবা আবারও বললেন,
–তুমি রায়হানের সাথে বিয়েটা ভেঙে দেওয়ার পরেই বুঝতে পেরেছিলাম, তুমি এখনও ভুলতে পারো নি। হাজার হাজার মাইল দূরত্বে তাকে ভুলতে গেলেও তোমার সেই প্রচেষ্টা শূণ্য। তুমি আমার মেয়ে। তোমার খারাপ কখনও চাই না। আর আমি এও বুঝতে পারছি, তুমি ফিরেছ নিজের অতীতকে আরও একবার সুযোগ ও পুনঃপরীক্ষা করতে।
তূর কিছুই বলছে না। তার বাবা মিথ্যে তো বলছে না। সত্যি তো সে শেষ বারের মতো কষ্টদায়ক অতীতের সম্মুখীন হতেই এসেছিল। ভালো খারাপ যাই হতো সে এরপর নিজের মনকে স্বান্তনা দিতে পারবে ভেবেছিল। তূরের চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রুজল টুপ করে পরলো ওর হাতের উপর। পরপর আরও এক ফোঁটা অশ্রু বিন্দুর পতন ঘটলো। তূরের বাবা সেটা দেখলেন। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রশ্ন করলেন,
–মিহালের বিয়েটা মিহাল ভেঙে দিয়েছে?
তূর মা*থা নাড়ায় হ্যাঁ বোধক। তূরের বাবা পুনরায় জিজ্ঞাসা করেন,
–মিহালের ফ্যামিলি কি বিয়ে ঠিক করেছিল?
তূর পূর্বের ন্যায় জবাব দেয়। তূরের বাবা তৃতীয়বারের মতো প্রশ্ন করেন,
–মিহালের পরিবার কি অসন্তুষ্ট না এতে? তোমাকে কি তারা মেনে নিবে? তাছাড়া মিহাল তোমাকে একবার রিজেক্ট করেছে নিশ্চয়ই তার ফ্যামিলির জন্য? এখন যদি তার ফ্যামিলি রাজি না থাকে তবে আমি চাইবো না তুমি অনিশ্চিত দিকে আগাও। পরবর্তীতে এমনও হতে পারে আবারও সে ফ্যামিলির কনসেন্ট মেনে তোমাকে মাঝপথে ছেড়ে দিলো! একজন বাবা হিসেবে এগুলো আমার জানা অত্যাবশ্যকীয়। কখনোই চাইবো না তুমি একই কষ্ট দ্বিতীয়বার পাও।
তূর সংক্ষেপে জবাব দেয়,
–তার পরিবারে সবাই রাজি। এতো বছর আন্টি রাজি ছিলেন না। এখন তিনিও রাজি।
তূরের বাবা কিছুটা সন্তুষ্ট হলেন। তারপর ইশারায় তূরকে যেতে বললেন। তূর এক ইশারাতেই চলে যায়। তূর যাওয়ার পর তূরের মা তার স্বামীর পাশে বসলে তূরের বাবা বলে উঠলেন,
–ভাবছি মিহালের পরিবার এলে রাজি হয়ে যাবো। নাহলে মেয়ে আমার কবে বিয়ে করবে নাকি করবে না বলা যায় না। এদিকে নীরার হবু শ্বশুরবাড়ির মানুষজন চাইছে অন্তত আকদটা করে রাখতে। বড় মেয়েকে রেখে মেঝো মেয়েকে বিয়ে দিতে মন সায় দেয় না। পরবর্তীতে যদি তূরের বিয়ে নিয়ে ঝামেলা হয়? আমি ভাবছি, দুই মেয়ের একসাথে বিয়ে দিবো।
তূরের মা খুশি হলেন। তিনি তার স্বামী ও সন্তান উভয়ের খুশিতে চিন্তা মুক্ত।
_______
ভোরের আবহে প্রকৃতি রুদ্ররূপ ধারণ করেছে। শিতল আবহাওয়া ও ঝিরিঝিরি বৃষ্টিপাত থেকে ভারী বর্ষণের রূপ নিয়েছে সাথে ঝড়ো হাওয়া তো আছেই। গ্রীষ্মঋতুর প্রচণ্ড তাপদাহে এক পশলা স্বস্থি নিয়ে এসেছে প্রকৃতি। এ যেন বর্ষার আগমনী বার্তা দিচ্ছে প্রকৃতি বহু আগে থেকে। ঘুম প্রিয় মানুষদের জন্য দারুন একটা পরিবেশ।
তূর প্রচণ্ড ঘুম কাতুরে। গতকাল রাতে সে মোটামোটি নিশ্চিত তার বাবা সবটা মেনে নিবেন। তূরের বাবা কোনো কিছুতে সম্মত হলে পজেটিভ সিগনাল দেন যা তূর কালকে অনুভব করেছে। ভোরে হালকা শীত শীত অনুভূত হওয়াতে ঘুম ভেঙে গেছিলো। ফজরের নামাজটা পড়ে নিয়ে এখন আবার ঘুমাবে। পুনরায় ঘুমানোর আগে বৃষ্টির ছটায় সিক্ত ব্যালকনির মেঝেতে ন*গ্ন পা রেখে কেঁপে উঠলো তূরের স্নায়ুকোষ। শরীরের পশম গুলোও কাঁ*টা দিয়ে উঠছে। বৃষ্টির ছটা গায়ে এসে লাগছে। ক্রমান্বয়ে বৃষ্টির রেশ বাড়ছে। তূর বুক ভরে প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিয়ে ঘুমোতে চলে গেলো।
এদিকে মিহালও সকালে বৃষ্টির জন্য মসজিদে না গিয়ে বাসায় নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে নেয়। দুই দিন পর অফিসে ঈদের ছুটি শেষ হয়ে যাবে। আর এই মে মাসের আর মাত্র কিছু দিন বাকি তারপর অফিস থেকে বিদায় নিবে।
দেখতে দেখতে দুইটা দিন কে’টে যায়। দুইদিন পর,,
মিহালের পরিবার তূরদের বাড়িতে এলো বিয়ের কথা বার্তা বলতে। তূরের পরিবার তাদের আপ্যায়নে ত্রুটি রাখে নি। দুই পক্ষের কুশল বিনিময়ের পর বিয়ের কথা তোলে। দুই পরিবার রাজি। যেহেতু তূর ও মিহালের আমেরিকার ফ্লাইট আর বারো-তেরো দিন পর তাই এরই মধ্যে বিয়ের কার্যকর্ম শেষ করতে চায়। এখন ইফতিদের সাথে কথা বলে নিতে হবে। মিহাল ও তূরকে একসাথে কথা বলতে দেয়। ওরা ছাদে যায় কথা বলতে।
ছাদের একপাশে কিছু ফুলের গাছ আছে। রঙিন ও রঙহীন উভয় ধরনের ফুল গাছ। বেলি, গন্ধরাজ, গোলাপ, গাঁধা ইত্যাদি। বেলি ও গন্ধরাজ ফুল ফুটে আছে। তূর সেগুলোর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। মিহালও পাশে গিয়ে দাঁড়ায় পকেটে হাত গুঁজে। মিহাল ফর্মাল গেটআপে আছে। আজ সে অফিস থেকে দেড় ঘন্টা আগে ছুটি নিয়ে বাসায় এসেছে। অফিসের কাজ গুলো ব্রেক টাইমে করে ফেলেছে। সাদা শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত ফোল্ড করা ও কালো প্যান্ট। শার্টের সাথে ঝুলানো টাইটার নট মিহাল ছাদে এসে ঢিলা করছে। বিকেলের শেষ প্রহর। রক্তিম সূর্য তার শেষ দ্যুতি ছড়াতে ব্যাস্ত। তূর আড়চোখে মিহালকে দেখছে। কাকতালীয় ভাবে তূরও সাদা রঙের জর্জেটের থ্রিপিস পড়েছে। দুজনের ড্রেসের রঙ মিলে গেছে। মিহালের সামনের চুলগুলো কপালের সাথে লেপ্টে আছে। চেহারাতে সূক্ষ্ম ক্লান্তির ছাঁপ। মিহাল নিরবতা ভাঙতে শব্দ করে,
–উহুম উহুম।
তূর চোখের মণি ঘুরিয়ে পাশে তাকায়। মিহাল আবারও একই রকম ভাবে শব্দ করলে, তূর হুট করে বলে উঠে,
–তোমার যক্ষা হয়েছে? এভাবে কাঁশছো কেনো?
মিহাল হতভম্ব হয়ে গেলো। এইসময় এধরনের কথা আদৌ কী মানানসই? মিহাল তূরকে উদ্দেশ্য করে অসহায় কন্ঠে বলে,
–কথা বলার কিছু পাচ্ছো না বলে এভাবে!
তূর ভাব নিয়ে বলে,
–তাও তো আমি কথা শুরু করলাম। তুমি তো যক্ষা রোগীর মতো বারবার কাশি দিয়েই যাচ্ছো। এমন ভাব করছো যেন আজ আমাদের প্রথম দেখা!
মিহাল ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
–ঘাট হয়েছে আমার। তা বলো কেমন আছো?
তূর বলে,
–আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো? আর বাসায় যেহেতু গিয়েছিলে তাহলে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট করে সন্ধ্যার পর আসলেও পারতে।
মিহাল হালকা হেসে বলে,
–তোমার শাশুড়ি ও ননদ তো আমাকে অফিস থেকে ফেরার পথেই ফোন করে করে পাগল করে দিচ্ছিলো। ওদের জন্য আজ আমাকে সব কাজ খুব দ্রুত সারতে হয়েছে। বাসায় জলদি এসেছি তারপর আমাকে ফ্রেশ হতে দশ মিনিটের বেশি সময় দেয় নি। কায়রা আপু ও মা তোমাকে দেখার জন্য উতলা হয়ে যাচ্ছিলো। তুমি তো দেখলেই, আপু এসে সবার আগে তোমার রুমে তোমাকে দেখতে চলে গেছিলো।
তূর হেসে বলে,
–আপু এসে আমার সাথে একটু কথা বলছিল কিন্তু তার আগেই রিয়ানা (কায়রার মেয়ে) আমার কোলে এসে গলা জড়িয়ে ধরে আধো বুলিতে “মামি” ডাকছিল। বাচ্চাটা মাশাআল্লাহ অনেক কিউট।
মিহাল রিয়ানার কার্যকলাপ শুনে হাসে। রিয়ানার বয়স দুই বছর। কায়রা তাকে ‘মামি’ ডাকটা শিখিয়ে ফেলেছে তা মিহাল জানে কারণ আসার পথে রিয়ানা মিহালের কোলে বসে বসে “মামি যাবো” বুলি বারবার আউরাচ্ছিল। মিহাল বলে,
–সে খুব এক্সসাইটেড। আমাদের বাসায় আসলে আমি যদি বাসায় থাকি তবে সে আমার কাছ থেকে সরবেই না। তোমাকে পেলে মনে হয় আমাকে ভুলে যাবে।
তূর হাসে। মিহালের হুট করে কিছু মনে পরে। মিহাল আচানক তূরের পায়ের কাছে বসে পরে। আর তা দেখে তূর সরে যেতে নিলে মিহাল তূরের ডান পায়ে হাত দিয়ে আটকে দেয়। আর সরে যেতে পারে না তূর। তূর মুখে বলে,
–তুমি পায়ে হাত দিচ্ছো কেনো? পা ছাড়ো প্লিজ।
মিহাল নিজের পকেট থেকে এক জোরা রূপার নুপুর বের করে। নুপুরটাতে তিনটা ঝুনঝুনি তাও হুকের কাছে আর পুরো নুপুরটাতে ছোট থেকে বড় চেইন কে’টে কে’টে ঢেউ খেলানো ডিজাইন। তূর অবাক হয় নুপুর জোরা দেখে। মিহাল তূরের ডান পা নিজের হাঁটুর উপর নিতে চাইলে তূরের ব্যালেন্স হারাতে নিয়েও মিহালের কাঁধে হাত রেখে সামলে নেয়। মিহাল নুপুর পড়াতে পড়াতে বলে,
“তোমার পদচারণা আমার পৃথিবীতে শুভ হোক। ওষ্ঠকোনে হাসির রেখা অম্লিন হোক। সকল গ্লানি পেছোনে ফেলে নব সাঁজে আসো প্রিয়া। ”
তূর লজ্জাবতী লতার ন্যায় নুইয়ে যায়। তার ভালোবাসা আজ তার দুয়ারে ভালোবাসার পসরা সাঁজিয়ে হাজির হয়েছে। জীবনে দুঃখ চিরস্থায়ী না।
চলবে ইন শা আল্লাহ্,
#শেষের_পঙক্তি
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২২
অপলক দৃষ্টিতে মিহালের নত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে আছে। ছন্দটা বলার সময় মিহাল তূরের চোখের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বলেছিল তারপর আবার নুপুর পড়ানোতে মন দিয়েছে। তূরের আঁখিযুগল নোনাজলে ভরে উঠলো। মিহাল যে হুট করে মাথা উুঁচু করবে তূর বুঝতে পারে নি। তূরের ভেজা নয়ন দেখে ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে পরে মিহাল আর তূর নিজের চোখ মুছতে থাকে। মিহাল উঠে দাঁড়িয়ে তূরের গালের দুই পাশে হাত রেখে মুখমণ্ডল উুঁচু করে নমনীয় স্বরে জিজ্ঞাসা করে,
–কী হয়েছে? কাঁদছো কেনো? আমার করা কোনো কাজ তোমাকে কষ্ট দিয়েছে?
তূর না বোধক মাথা নাড়ায়। মিহাল তূরের চোখ ভালো করে মুছিয়ে দিয়ে বলে,
–তোমার চোখে জল এলে আমার হৃদয়ে কম্পন শুরু হয় জানো? আমার কারণে এই নয়নযুগল দিয়ে অনেক বর্ষণ হয়েছে। আমি চাই না আর বর্ষণ হোক আমার কারণে। পূর্বের করা কর্মের গ্লানি এখনো আমাকে পীড়া দেয়। এখন রংধনু উঠুক তোমার আমার দুঃখের বর্ষণ শেষে।
তূর মায়াময় নয়নে মিহালের চোখের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আদুরে স্বরে বলে,
–আনন্দাশ্রু ছিল ওটা। আর রংধনুর রঙে রাঙার পর ভালোবাসার বর্ষণ হোক আমাদের হৃদকুটিরে।
মিহাল তূরকে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়। হঠাৎ তূরের মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চাপে। সে মিহালের বাহুডোর থেকে আচমকা সরে এসে বাঁকা হেসে বলে,
–এই এই! দূরে থাকো হ্যাঁ! এখনও আমাদের বিয়ে হয় নি। ধৈর্য ধরতে শিখো প্রিয়! বুঝেছো? কন্ট্রোল!
এই বলে তূর দৌঁড়ে ছাদ থেকে নেমে যায়। মিহাল বোকার মতো কিছুক্ষণ তূরের গমনপথের দিকে তাকিয়ে থেকে বিষয়টা বুঝতে সক্ষম হলে এক হাত কোমড়ে ও আরেকহাত ঘারে রেখে হেসে ফেলে। তারপর মিহালও নিচে নেমে যায়। ওদের এতো প্রেম দেখে সূর্যও লজ্জা পেয়ে লুকিয়ে গেছে। আকাশে এখন সূর্যের কাল্পনিক লজ্জামিশ্রিত রক্তিম আভা দৃশ্যমান।
দুই পরিবারের পারস্পারিক সম্মতিতে মিহাল ও তূরের বিয়ে ঠিক হলো। ইতোমধ্যে ইফতির পরিবারের সাথেও ফোনে যোগাযোগ হয়ে গেছে। তারা তো এক মাস আগে থেকেই বিয়ের জন্য তৈরি তাই বিশেষ আপত্তি করে নি কিন্তু হাতে অন্তত দশ দিন সময় লাগবে বলে জানিয়েছে। দশ দিন পর গায়ে হলুদ হবে তিন পরিবারের একই সাথে তার পরেরদিন বিয়ে। তূরের আমেরিকার ফ্লাইট বিয়ের পরেরদিন পরেছে আর মিহালেরটা তার পরেরদিন। দুইজনের দুই দিনে ফ্লাইট হওয়াতে বিশাল ঝামেলা হয়ে গেছে। ইফতির ফুফা সেই ঝামেলাটাও মিটিয়ে দিলো। ইফতির ফুফার এয়ারপোর্টে চেনাজানা আছে। তার মাধ্যমে তূরের ফ্লাইট একদিন পিছিয়ে আনা গেলো।
_________
প্রকৃতি মত্ত তার আপন লীলাখেলায়। ঝড় বৃষ্টির তাণ্ডবে বিকেল হতেই সন্ধ্যা নেমে গেছে। বর্ষা ঋতু আসন্ন কিন্তু জৈষ্ঠ মাসের শেষ সময়ে বৈশাখের আবহ পাওয়া যাচ্ছে। দুপুর পর্যন্ত কাঠফাটা রোদ্দুরে তেজস্বী রূপে আকাশ হাসছিল পরক্ষণেই আকাশের মন খারাপে বৃষ্টি হয়ে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। তূর ও নীরা আজ বৃষ্টিতে ভিজতে ছাদে উঠেছে। ওদের মায়ের হাজার বারণ স্বত্বেও ওরা ভিজবে। নাফিহা ও তূর্যকে ছাদে আসতে দেয় নি কিন্তু ওরা কম পরিশ্রম করছে না ছাদে আসার জন্য। তূরের মা ও চাচি নাফিহা ও তূর্যকে ধ’মকে ধা’মকে আটকে রেখেছে। কিছুক্ষণ পর ওরাও ওদের মায়েদের অসাবধানতার ছুট পেয়ে দৌঁড়ে ছাদে উঠে গেছে। এখন চার ভাই-বোন বৃষ্টির পানিতে ভিজছে।
তূরের মা ও চাচির খেয়াল হলে তাদের মাথায় হাত। তূরের মা ছাদের সিঁড়িতে গিয়ে রে’গে মে’গে বলছে,
–আজকে এই চারওটার জ্বর আসবে। আমার কথা মিলিয়ে নিস তোরা। এই বিকেল বেলার বৃষ্টিতে ভিজতেছিস তো। আর ভিজিস না। চলে আয়। জ্বর হলে তো সেই আমাকেই দেখতে হবে। আয়। ভেতরে আয় বলছি।
ওদের চার ভাই-বোনের কোনো হেলদোল নেই। ওরা চারজন খিলখিল করে হাসছে আর ভিজছে। আধঘন্টা ভেজার পর জবুথবু অবস্থায় ওরা ঘরে ঢুকলো। বৃষ্টির রেশ কমে এসেছে। ঘরে ঢুকে একে একে চার জনেই হাঁচি দেয়া শুরু করলো। ওরা হাঁচি দিয়ে অপরাধী দৃষ্টিতে ওদের মায়েদের দিকে তাকিয়ে আছে। ওদের মায়েরা চোখ গরম করে ওদের দিকে রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। তূর ওর তিন ভাই-বোনকে তাড়া দিয়ে বলে,
–এই এই তোরা জলদি ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। নাহলে ঠান্ডা লেগে যাবে।
তূর এইগুলো বলেই চো’রের মতো সটকে পরলো। ফ্রেশ হয়ে তূর, নীরা ও নাফিহা গরম গরম লেবুচা পান করে কিছু বিস্কিট খেয়ে দুইটা করে প্যা’রাসিটে’মল খেয়ে নিলো আগাম নিরাপত্তা হিসেবে। তূর্যকে না’পা সিরাপ খাইয়ে দিলো।
_______
বিয়ের আর দুইদিন বাকি। আজ মেহেদী দেওয়া হবে আর কাল গায়ে হলুদ হবে তিন পরিবারের একসাথে। তূর ও নীরার ফ্রেন্ডরা আজকেই কয়েকজন এসে হাজির। অর্ক, রাফি, রণক, আসফি ও তাওহীদ এসেছে কারণ ওরা ডেকোরেশনের কাজ দেখবে তূরের এক কাজিন ভাইয়ের সাথে। তূরের কাজিন ভাই তিনজন বাদে সবাই ছোট। বড় তিন জনের মধ্যে দুইজন দেশের বাহিরে তাই আসতে পারে নি।
লিরা, ফাইজা, নাদিয়া, জারিন ও নীরার কিছু বান্ধুবী মিলে ওদের দুই বোনকে মেহেদী পড়াচ্ছে সাথে হাসি-আড্ডায় মেতে উঠেছে। তূরের তিন মামারা তাদের পরিবার নিয়ে হাজির। তূরের রুমে তূর ও নীরা সহ ওদের বান্ধুবীরা গাদাগাদি করে থাকবে কিন্তু নাদিয়াকে শাফকাত অফিস থেকে ফেরার পথে এখানে এসে কিছুক্ষণ থেকে নিয়ে যাবে। নাদিয়াকে ছাড়া টানা দুইরাত থাকবে শাফকাত এটা মানতে পারছে না। হলুদের রাতে নাদিয়া তূরদের সাথে থাকবে। নীরার রুমটা ছেড়ে দিয়েছে ওদের মামিদের, মামাতো বোন ও নাফিহার জন্য। মামাদের জন্য আরেকটা রুম বরাদ্ধ। আরও কিছু আত্নীয় স্বজন ও ফুফিরা হলুদের দিন আসবে।
ওদিকে মিহালদের বাড়িতে আজকে শপিং নিয়েই মিহালের মা, বোন ও চাচিরা পরে আছে। মিহাল অফিস শেষে এসে পরে পরে ঘুমাচ্ছে। আজকেই সে অফিসে শেষবার গেলো। ইস্তফা দেওয়া হয়ে গেছে। এরপর আমেরিকায় ভার্সিটি থেকে যে জব পেয়েছে সেটা করবে। মিহাল তূরের ইউনিভার্সিটিতেই মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে।
মিহালের ভাগনি রিয়ানা মিহালের ঘরে এসে কোমড়ে হাত রেখে তার ঘুমন্ত মামার দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে আছে। রিয়ানা এবার বিছানায় উঠে মিহালের পেটের উপর চেপে বসে। তারপর মিহালের গাল দুটো হাত দিয়ে টানা শুরু করেছে। মিহালের ঘুম ছুটে যায়। মিহাল ঘুম ঘুম চোখ খুলে দেখে তার মিষ্টি পরীটা রাগ করে আছে। মিহাল আবছা ঘুম ও জাগরণের মাঝেই রিয়ানাকে জিজ্ঞাসা করে,
–কী হয়েছে আমার মামাটার? মুখ এমন ফুলিয়ে রেখেছো কেনো?
রিয়ানা সেই আগের মতো করেই তাকিয়ে আছে। মিহাল এবার চোখ হাত দিয়ে কচলিয়ে রিয়ানাকে পেটের উপর থেকে নামিয়ে বিছানায় বসিয়ে বলে,
–এতো রাগ? আমি তো ভয় পেয়ে গেছি!
রিয়ানা এবার ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে দেয়। মিহাল অবাক হয়ে গিয়ে রিয়ানাকে কোলে নিয়ে থামানোর চেষ্টাতে আছে। কিছুক্ষণ কসরত করার পর রিয়ানা থামে। মিহাল আদুরে কন্ঠে বলে,
–কী হয়েছে? মামাকে বলবে না? আম্মু ব’কেছে?
রিয়ানা আধো বুলিতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে যা বলল তাতে অর্থ দাঁড়ায়,
“সে হাতে মেহেদী দিবে। তার মামি নাকি মেহেদী দিচ্ছে সেটার ছবি তার মায়ের ফোনে সে দেখেছে। এখন সে তার মাকে কয়েকবার বলেছে কিন্তু ওর মা পাত্তা দেয় নি।”
মিহাল ওর বোনকে ডাক দিয়ে বললো,
–আপু, মেহেদী দিয়ে না রিয়ুর হাতে। বাচ্চাটা কান্না করছে।
কায়রা মুখ ঝামটা দিয়ে বলে,
–তুই দিয়ে দে। আমার কাজ আছে।
কায়রা চলে গেলে মিহাল অসহায় চোখে রিয়ানার দিকে তাকায়। রিয়ানা কাঁদো কাঁদো হয়ে চেয়ে আছে তার দিকে। মিহাল কোনো উপায় না পেয়ে তার ডেস্ক থেকে লাল মার্কার পেন নিয়ে আসে। অতঃপর রিয়ানার ছোট ছোট হাতে ফুল আঁকিয়ে দেয়। রিয়ানাতো বেজায় খুশি। সে তার মামার গালে পাপ্পি দিয়ে দৌঁড়ে চলে যায় সবাইকে হাতের ফুল দেখাবে বলে। মিহাল রিয়ানার খুশি দেখে নিজেও হাসে তারপর এশারের নামাজ পড়ে আবার ঘুম দেয়। আজকে রাতে আর সে খাবে না।
______
গায়ে হলুদের দিন সকাল বেলা তূর নিজের রুমে ঘুমিয়ে আছে। সারারাত মেহেদী দেওয়া ও শুকানো সাথে আড্ডার জন্য ঘুম হয় নি। ফজরের নামাজের সময় তূর হাত ধুয়ে ফেলেছে। ঘুম না হওয়াতে তীব্র মা’থা ব্যাথায় ফজরের নামাজ পড়েই সে ঘুম দিয়েছে। তূরের মা’থা ব্যাথার প্রবলেমটা বহু পুরোনো। হঠাৎ ফোনের রিংটোনের শব্দে তূর নড়েচড়ে উঠে। ফোনের রিংটোন কিছুক্ষণ বেজে বন্ধ হয়ে যায় এরপর আবারও বাজা শুরু হয়। তূর ঘুমের মধ্যে হাতরে হাতরে ফোনটা খুঁজে নাম না দেখেই রিসিভ করে কানে নিয়ে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে,
–হ্যালো।
অপরপাশের ব্যাক্তি নিরব। তূরের ঘুম ঘুম কন্ঠে সে মোহিত হয়ে নিজেই নির্বাক হয়ে গেছে। তূর কোনো জবাব না পেয়ে ফোন কেটে দিয়ে আবারও চোখ বুজে ফেলে ঘুমানোর উদ্দেশ্যে। আবারও তৃতীয়বারের মতো ফোন তার কর্কশ কন্ঠে চিৎকার করে উঠে। এবার তূর বিরক্ত হয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকায়। সেখানে মিহালের নামটা জ্বলজ্বল করছে। এবার কর্পূরের ন্যায় সব বিরক্তি হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে তূরের। তূর ফোন রিসিভ করে সালাম দিয়ে বলে,
–একটু আগেও কি তুমি ফোন করছিলে?
মিহাল বাঁকা হেসে জবাব দেয়,
–জি ঘুমকুমারী। আপনি তো ঘুমের ঘোরে ছিলেন।
তূর হাই তুলে বলে,
–ওহ। রাতে ওদের জ্বালায় ঘুমোতে পারি নি তাই মা’থা ব্যাথাতে ফজরের পর ঔষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছি। কী করছো?
মিহাল জবাব দেয়,
–আমিও ফজরের পর ঘুম দিয়ে আধ ঘন্টা আগে আপুর পীড়াপীড়িতে উঠে নাস্তা করেছি। তোমার মা’থা ব্যাথা কমেছে।
তূর হ্যাঁ বোধক জবাব দিলে মিহাল বলে,
–ভিডিও কলে আসো। তোমার হাতের মেহেদী দেখবো।
তূর অবাক হয়ে বলে,
–না না। সম্ভব না। বাসায় সবাই আছে। আমার রুমের মধ্যেও ওদের আনাগোনা চলছে। তোমাকে আমি ছবি তুলে পাঠিয়ে দিচ্ছি সেখান থেকে দেখে নিও। তাছাড়া কায়রা আপুকেও গতকাল পাঠিয়েছি।
মিহাল নাছোড়বান্দার মতে জেদ করে বসেছে। ভিডিও কল দিতেই হবে। তূর অনেকবার নিষেধ করার পরেও কাজ হলো না। তূর আশেপাশে নজর বুলিয়ে দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে ভিডিও কল দিলো। এক মিনিটের কম সময় ভিডিও কলে থেকে তূর নিজ থেকে কল কেটে দিলো। ভিডিও কলে ওদের দুজনের মধ্যে কোনো কথা হয় নি। শুধু হাতের মেহেদী দেখিয়েই শেষ।
চলবে ইন শা আল্লাহ্,