#শেষের_পঙক্তি,পর্ব_২৬
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
সদ্য স্নানে স্নিগ্ধ নববধূ। লাল জামদানী গায়ে জড়িয়ে আরশিতে প্রিয়তমের ঘুমন্ত প্রতিচ্ছবি দেখে লাজুক হাসে তূর। গতকাল রাতে গল্প করতে করতে ফজরের ওয়াক্ত হয়ে গিয়েছিল তারপর একসাথে নামাজ পড়ে ঘুমিয়েছে দুজনে। সকাল ৯টা বাজে এখন। পরিপাটি হয়ে বসে আছে কেউ ডাকতে আসবে তার অপেক্ষায়। কিন্তু এখনও কেউ এলো না। তূর মিহালকে ডাকবে ভাবছে আবার ভাবছে ডাকবে না। দর্পনে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে এরকম ভাবতে ভাবতে কখন যে আনমনা হয়ে গেছে খেয়াল নেই। হঠাৎ কাঁধে কারও ঠোঁটের স্পর্শে ঘোর কাটে। আয়নায় দিকে নজর যেতে মিহালকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে যায়। মিহাল চোখে হাসে। মিহাল বলে,
–গুড মর্নিং বউজান।
প্রিয়তমের মুখ নিঃসৃত “বউজান” শব্দটা হৃদয়ে ঝড় তুলেছে প্রগাঢ় ভাবে। লোমকূপ দিয়ে শীতল উদ্দীপনা বয়ে চলেছে যার ফলশ্রুতিতে শরীর কাঁ’টা কাঁ’টা দিয়ে উঠছে। তূর আড়ষ্ট ভঙ্গিতে নতমস্তকে বসে থাকে। মিহাল তূরকে নিজের দিকে ঘুরায় অতঃপর হাঁটু ভেঙে তূরের সামনে বসে প্রেমময় স্বরে বলে,
–এই মায়াকন্যা! এতো লাজুকলতা হলে চলে? তুমি লাজুক হলে আমার যে বেশি বেশি প্রেম জাগে। তখন নিজেকে কন্ট্রোলেস মনে হয়। ইচ্ছে করে তোমাকে টুপ করে খে য়ে ফেলি! কী ভয়ংকর ইচ্ছে আমার! আবার ইচ্ছে করে, বক্ষ গহ্বরে থাকা খাঁচাতে আবদ্ধ করে ফেলি। এখন থেকে কম করে লজ্জা পাবে কাজলমায়া! নাহলে কখন তোমাকে কা ম ড়ে কু ম ড়ে খেয়ে ফেলি বলা যায় না।
তূর আর সহ্য করতে পারলো না। মিহালকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে আলতো ধা-ক্কা দিয়ে দৌঁড়ে দরজা খুলে রুম থেকে পাগারপার। রান্নাঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জড়োসরো হয়ে। মিহালের মা ও বোন রান্না করছে। আজকেই তূর ও মিহালের রিশেপশন তাই অনেক কাজ। কায়রা কী মনে করে পেছোনে ঘুরে তূরকে দেখতে পেলো তারপর হাসি মুখে এগিয়ে এসে বলে,
–আরে তূর। আসো।
তূর ভিতরে যায়। মিহালের মা হাতের কাজ থামিয়ে হাসি মুখে বলেন,
–খিদে পেয়েছে? এখনও অনেকের ঘুম ভাঙেই নি। কাল অনেকরাত করে ঘুমিয়েছে তো। তুমি বসো নাস্তা হয়ে এসেছে। দুধ চুলায় বসিয়েছি এখন চালটা দিয়ে দিবো।
তূর আমতা আমতা করে বলে,
–পায়েসটা আমি করি? এমনিতেই ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে গেছে। কোনো সাহায্য করতে পারলাম না।
মিহালের মা তাড়াহুড়ো করে বলেন,
–আরে না না। আমরা কিছু মনে করি নি। তোমাকে কস্ট করতে হবে না। তুমি রেস্ট করো একটু। আমাকে ওরকম শাশুড়ি ভেবো না যে প্রথমদিন বউকে কাজ না করার জন্য খোঁটা দিবো বা কটুকথা বলবো। আমি প্রথমে অন্যরকম থাকলেও চোখের পর্দা হটার পর আমি তোমাকে মন থেকে মেনে নিয়েছি।
তূর খুশি হয়। এবার সে একটু অধিকার নিয়েই এসে শাশুড়ির হাত থেকে চালের বাটিটা নিয়ে নিজে ধৌত করতে থাকে। মিহালের মা তূরের কাজে তাকিয়ে থেকে আলতো হেসে নিজের কাজে মন দেয়।
_______
ওদিকে নীরা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে রান্নাঘরে গিয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিলো কিন্তু কাউকে না দেখে ড্রয়িংরুমের সাথে লাগানো টেরেসে বসে আছে। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর পেছোন থেকে কেউ নীরার দিকে কফির মগ বাড়িয়ে দিলো। নীরা হকচকিয়ে গেলো কারণ অচেনা বাড়িতে তারপর সবাই ঘুমে তাই তার গা ছমছম করছিল। ইফতি নীরার পাশে একটু এঙ্গেল করে মোরা নিয়ে বসে কফির মগে চুমুক দিয়ে বলে,
–তোমাকে বুঝিয়ে লাভ নেই। সময় নেও সহজ হতে। এখন কফিটা টেস্ট করে বলো কেমন হয়েছে?
নীরা মুচকি হেসে কফির মগে চুমুক দেয়। কফিটা দারুন তবে চিনি যুক্ত না। মধু দিয়ে বানানো। নীরার ভালোই লাগে। নীরা বলে,
–ডাক্তার মানুষ চিনি খাবে না এটাই আশা করা যায়। তবে আপনি দারুন কফি বানান।
ইফতি হেসে বলে,
–হুম। মধুটাও সরাসরি লোক দিয়ে সুন্দরবন থেকে আনানো হয়েছে। বাজারজাত মধু না।
দুইজন নিরব হয়ে যায়। সকালের স্নিগ্ধ প্রকৃতি দুইজনে পাশাপাশি উপভোগ করছে। পাখির কিচিরমিচির শুরু হয়েছে। এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। ছোট বেলায় “আরলি রাইজিং” প্যারাগ্রাফে সবসময় সকালের প্রকৃতি সম্পর্কে বর্ণনা থাকতো। যা পড়ে মনে হতো হয়তো বাড়িয়ে বলছে কিন্তু সেটা সত্যই বলতো।
নীরার শাশুড়ি ঘুম থেকে উঠলে নীরা বলে সে কিছু বানাবে। তাই তার শাশুড়ি তাকে পায়েস বানাতে দেন।
______
রিসিপশনের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। তূর হালকা কমলা রঙের বেনারসি পড়েছে সাথে ক্যাজুয়াল সাঁজ। অসম্ভব সুন্দর লাগছে তূরকে। মিহাল পড়েছে নেভিব্লু ব্লেজারের সাথে সাদা শার্ট, বো টাই, নেভিব্লু প্যান্ট। চুলগুলো পেছোনের অর্ধেক পেছোন দিকে নেয়া আর সামনের গুলো কপালে ফেলে রাখা। তূর বারবার মিহালের দিকে আঁড়চোখে তাকাচ্ছে আর ভ্রুঁ কুঁচকে ফেলছে। তূরের ভাবনা মতে, “মিহালকে অতিরিক্ত সুন্দর লাগছে আর মেয়েরা মিহালকে চোখ দিয়ে গি’লে খাবে। কিন্তু নিজেকে নিজের কাছে কেমন যেনো লাগছে।”
মিহাল ও তূর দুজনে স্টেজে বসে। গেস্টরা গিফট দিয়ে যাচ্ছে। তূরের বাড়ির লোক ও নীরারা এখনও আসে নি। ওরা রাস্তায় আছে। মিহাল তূরের দিকে খানিকটা ঝুঁকে কানের কাছে চুপিসারে ফিসফিস করে বলে,
–তোমাকে পুতুল পুতুল লাগছে। আচ্ছা, কেউ নজর দিচ্ছে নাতো আমার পুতুল বউয়ের উপর? আমার কেনো জানি হিংসে হচ্ছে। কী করা যায় বলোতো?
তূর চোখ ছোটছোট করে মিহালের দিকে তাকালো অতঃপর সেও আস্তে করে বলে,
–জেলাস তো আমার হচ্ছে। কে বলেছে এতো হ্যান্ডসাম হতে? এমনিতেই মেয়েরা তোমাকে দেখে দফায় দফায় ক্রা’শ খায়।
মিহাল ভাব নিয়ে ব্লেজার ঠিক করে বাঁকা হেসে বলে,
–বুঝতে হবে!
তূর দাঁত কিড়মিড় করে সামনের দিকে দৃষ্টি সরায়। নাকের পাটা রাগে ফুলে যাচ্ছে বারবার। মিহাল তা দেখে আড়ালে দাঁত কে’লা’চ্ছে।
তূরের বাড়ির লোকেরা ও নীরারা সবাই এসে গেছে। তূর গিয়ে ওর বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরে তারপর নীরাকে, নাফিহাকে, কাকিকে ও তূর্যকে। নীরার পড়নে মিষ্টি কালার বেনারসি। খুব ভালোভাবে অনুষ্ঠান শেষ হয়। তূর ও মিহাল তূরদের বাড়িতে যায়। আগামিকাল নীরার রিসেপশন। তূরদের বাড়িতে যাওয়ার পর তূরের কাজিনরা তূরকে ঘিরে ধরলো শ্বশুরবাড়ির গল্প শুনতে। তূর কোনোমতে ওদের থামিয়ে রুমে এসে শুয়ে পড়লো। মিহাল বাহিরে গেছে তূরের কাজিন ভাইদের সাথে। তূর ভাবলো তার ব্যাক্তিগত ডায়েরিতে যে কয়েকদিন বিয়ের জন্য লিখে উঠতে পারে নি সেগুলো লিখে ফেলবে। মিহালের আসতে আরও ঘন্টাখানেক লাগবে। তূর একে একে সব সুন্দর করে লিখে ফেললো তারপর ডায়েরি বন্ধ করে বুকে জড়িয়ে ধরে স্বগোতক্তি করে,
“আমার শেষের পঙক্তির সকল স্মৃতিকথা। ”
______
পরেরদিন নীরার রিসেপশনে যায় সবাই। নীরাকেও অনেক সুন্দর লাগছে। নীরার রিসেপশনে মিহালের পরিবার গিয়েছে আলাদা ভাবে যেহেতু মিহাল তূরদের বাড়িতে। অনুষ্ঠান শেষে মিহাল তূরকে নিয়ে তূরদের বাসায় যায় নীরাদের সাথে। বিকেল হয়ে গেছে। একটু পর সন্ধ্যা নামবে। তূর ও বাকি কাজিনরা নীরাকে ঘিরে ধরেছে শ্বশুরবাড়ির মানুষজন কেমন জানতে। মিহাল, ইফতি ও তাদের শ্যালক গুষ্টির সাথে ছাদে গিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ওরা নিচে এসে তূরদের সাথে যোগ দেয়। মাগরিবের আজানের পর তূর ও মিহাল বিদায় নেয় মিহালদের বাড়িতে যাবার উদ্দেশ্যে। তূরের মা তূরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। তূর ওর মাকে সামলাতেই পারছে না। নীরা ও নাফিহা এসে কোনোমতে সামলায়। তূরের বাবা মেয়েকে বুকে আগলে নিয়ে চোখের কোনা মোছেন। উনারা রাত এগারোটায় এয়ারপোর্টে যাবে তূরদের সাথে। তূর নিজের প্রয়োজনীয় সব ও জামা-কাপড় নিয়ে নেয়। মিহাল ও তূর আজ রিকশা ভ্রমণ করে ওদের বাড়িতে যাবে ভাবলো। আবার দুই বছর পর ছাড়াতো দেশে আসতে পারবে না।
হুড খোলা রিকশা চলছে তার আপন গতিতে। তূর মিহালের কাঁধে মা’থা রেখে বাহু জড়িয়ে বসে আছে। গতকাল রিসেপশনের সময় থেকে সে মিহালের সাথে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। মিহাল রাস্তার ধারে এক মহিলাকে বাচ্চা কোলে নিয়ে বেলি ফুলের মালা বিক্রি করতে দেখে রিকশা থামাতে বলে তারপর নেমে মহিলার কাছে থাকা চারটা মালাই কিনে আনে। তূর তা দেখে মুচকি হাসে। তারপর রাস্তায় দাঁড়িয়ে সোডিয়াম লাইটের আলোয় রিকশায় বসা প্রিয়তমার হাতে মালা গুলো পড়িয়ে দিয়ে আলতো চুমু এঁকে বলে,
–ভালোবাসি।
চলবে ইন শা আল্লাহ্,