শেষের_পঙক্তি,পর্ব_২৭

0
762

#শেষের_পঙক্তি,পর্ব_২৭
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী

অশ্রুসিক্ত বিদায় সম্ভাষণের পর বিমানে উঠেছে তূর, মিহাল, রিজভী, রাফিরা। আর পনেরো-বিশ মিনিট পর টেকঅফ করবে। তূরের আঁখিযুগল নোনাজলে সিক্ত হচ্ছে বারংবার। মিহাল এক হাত দিয়ে আগলে রেখেছে ওকে। স্থির বিমানের জানালা দিয়ে রানওয়ের পাশে সবুজ ঘাস গুলো রানওয়ের ঈষৎ হলুদাভাব আলোয় স্বর্ণকণার মতো লাগছে। রাত আটটার দিকে বৃষ্টি হয়েছিল বলে আমেরিকা ও কানাডা গামী ফ্লাইট পিছিয়ে রাত একটায় আনা হয়েছে। তন্দ্রা লেগে যাচ্ছে তূরের। তূর ও মিহালের পরিবার রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত থেকে ফিরে গেছে। মূলত ওরা জোর করেছে। তূরের বাবা চাইছিল বিমান এয়ারপোর্ট ছাড়ার আগ পর্যন্ত থাকবে। কিন্তু তূর ও মিহালের বারবার বোঝানোতেও লাভ হচ্ছিলো না বিধায় ইফতি তাদের বুঝিয়ে নিয়ে গেছে।

রিজভী ও রাফি নিজের সিট থেকে উঠে এসে মিহালের কাছে জিজ্ঞাসা করে,
–তানজিনাকে দেখলাম। সে কই যাচ্ছে?

মিহাল অবাক হয়ে বলে,
–কই আমি তো দেখি নি। তোরা কই দেখলি? এই মেয়ে কী আমার পেছোন ছাড়বে না নাকি! আজব একটা।

রিজভী হাত দিয়ে ইশারা করে বলে,
–কুল কুল। হাইপার হোস না। তূরের সাথে কথা বলতে দেখেছিলাম।

মিহাল যেনো আরও উত্তেজিত হয়ে গেলো।
–মানে কী! ওই মেয়ে তূরের কাছে কেনো এসেছে? তার মুখে তো কাউকে হার্ট করার সময় লাগাম থাকে না।

মিহাল তূরকে আস্তে করে ডাক দেয়। হালকা নিদ্রাতে ডুবে গেছিলো তূর। মিহালের ডাকে চোখ হালকা করে খুলে বলে,
–কী?

মিহাল উৎকণ্ঠিত হয়ে সুধায়,
–তানজিনার সাথে তোমার কী কথা হয়েছে? সে কী তোমাকে কস্ট দিয়ে কিছু বলেছে?

তূর এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর ক্লান্ত স্বরে বলে,
–তানজিনা কানাডা যাচ্ছে। ওর বাবা ওকে কানাডা পাঠাচ্ছে পড়ালেখা ও আচরণে পরিবর্তন করতে। সেখানে ও যেখানে থাকবে সেই পরিবার অনেক স্ট্রিক্ট তাই তানজিনার বাবা ওকে সেখানে পাঠাচ্ছে। আর তানজিনা দেড় মাস যাবত ঘর থেকেও বের হতো না। অনেকটা নরম হয়ে গেছে। এগুলোই বলল। তাকে মাফ করে দিতে বলল পূর্বের আচরণের জন্য।

মিহাল সিটে গা এলিয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,
–বাহ! এতো দ্রুত পরিবর্তন? অবশ্য রমজান মাসে মানুষ নিজেকে শোধরাতে চায়। যাক ভালো হলেই ভালো। তুমি ঘুমাও। তোরা যা নিজের সিটে। সিটবেল্ট বেঁধে নে। এখনই টেকঅফ করবে সময় তো হয়ে এলো।

________

সূর্যের মৃদু উত্তাপে উদ্ভাসিত ক্যালিফোর্নিয়ার নীল অন্তরিক্ষ। জুন থেকে আগষ্ট মাসে তাপমাত্রা ২০-২৫ ডিগ্রি পর্যন্ত হয়। বৃষ্টিপাতহীন থাকে এই ঋতু। তবে প্রকৃতির দোলাচল কেই বা ধরতে পারে! অবকাশ যাপনের অন্যতম সময় এখন ক্যালিফোর্নিয়ায়। সমুদ্র উপকূল সৈকতে পর্যটকসহ স্থানীয়দের অবকাশ যাপন করতে লক্ষ্যনীয়।
মুক্ত বাতাসে প্রাণ খুলে শ্বাস নিলো তূর। ক্যালিফোর্নিয়া তার সেকেন্ড হোম বলা চলে। এই অঙ্গরাজ্য তার হৃদয়ের কাছাকাছি অনেকে আছে। আত্মীয়রা বাদেও পেয়েছে কিছু বন্ধু যারা চারটা বছর তূরের ভালো-খারাপের সঙ্গী ছিল। এয়ারপোর্টে এরিক, এলেক্স, ওলিভা, ম্যাক্স, এলিনা, রিম, শারিক এসে হাজির। রিম, ওলিভা ও এলিনা এসে তূরকে জড়িয়ে ধরে। তূরও ওদের জড়িয়ে নেয়।

ওলিভা বলে,
–হেই নূর!(তূর) ইউ আর ফরগোটেন আস? হাউ কুড ইউ বেব?

তূর ওলিভার গুলোমুলো গালগুলো টেনে বলে,
–সরি ডিয়ার। আমি এলিনার সাথে যোগাযোগ করেছিলাম। তুমি ও এলেক্স নাকি আবারও ব্রেকআপ করেছিলে? তাই আমি তোমাকে নক করি নি। তোমরা এত ব্রেকআপ করে থাকো কী করে?

ওলিভা গাল ফুলিয়ে বলে,
–হোয়াই হি টক উইথ রোলিনা? আই ডোন্ট লাইক হার এট অল। সি ইজ সো মাচ এনোয়িং। টুমি জানো? অন পারপোসলি সি কিসড এলেক্স এন্ড এলেক্স ওয়াজ জাস্ট লেট হার গো! হোয়াই এলেক্স ডিডেন্ট স্ল্যাপ(থা-প্প র) হার? আমি রাগ করেছি অনেক বেশি। টুমি থাকলে রাইট জাজ করতে।
(ওলিভারা ভাঙা ভাঙা অনেকটা ভালোই বাংলা বলতে পারে ও বুঝে।)

তূর এলেক্সকে ডেকে বলে,
–তুমি এতো রাগাও কেনো ওকে?

এলেক্স মাথা চুলকে বলে,
–সি লুকস মাচ মোর বিউটিফুল, হোয়েন সি ইজ এংড়ি এন্ড ক্রাইং। দেন হোয়াট শুড আই ডু?

তূর চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলে,
–সো ডিল উইথ হার এলোন।

এলিনা তূরের হাত ধরে বলে,
–জিজু? উই ওয়ান্ট টু টক উইথ হিম। ইন্ট্রুডিউস করাবে না?

তূর সবার সাথে ওদের পরিচয় করিয়ে দিলো। এলিনার বড় ভাই এরিক তাড়া দিয়ে বলে,
–গাইস, কাম ফাস্ট। উই আর ইন হ্যারি(জলদি)।

ওরা সকলে গাড়িতে উঠলো। দুইটা মাইক্রো এনেছে ওরা। আজ ওরা এলেক্সদের বাড়িতে উঠবে। এলেক্সের বাবা-মা নিউ ইয়র্কে থাকে। এখানে মাঝে সাঝে আসে বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাতে। এলিনা ও এরিক এলেক্সের কাজিন। এরিক ও এলিনার বাবা-মা সেপারেশনে আছেন। এই বাড়িটা ওদের তিন জনের নামে লিখে দিয়েছে ওদের পেরেন্টসরা। এরিক তার বাবা-মাকে সহ্য করতে পারে না একদমই।

ফাইজা তূরের কানে কানে বলে,
–দোস্ত ওই গম্ভীর ছেলেটা এতো কিউট কেন? আর এটিটিউট তো মাশাআল্লাহ।

তূর ভ্রঁ নাঁচিয়ে বলে,
–এরিক এমনি। সে গম্ভীর হয়েছে তার পরিবারের কারণে। এটিটিউট এতো কারণ সে নিজের মত ছাড়া কারোটাই শোনে না।

ফাইজা এরিককে দেখে চলেছে। ওলিভা, এলিনা ও রিম মিলে তূর ও মিহালের জন্য এখন চটপট রুম সাঁজিয়ে ফেলেছে। বাকিদের কয়েকজন করে একেকটা রুমে রেস্ট করতে পাঠিয়ে দিয়েছে।

_______
প্রমিতি সিঙ্গাপুরের এক গাইনির ডক্টরের সামনে বসে আছে। সে জানতে এসেছে তার রোগগুলোর কারণে কী কনসিভ করতে প্রবলেম হবে কিনা? ডাক্তার বলেছে হাইলি রিস্ক থাকবে। কিন্তু প্রমিতির বাচ্চা নেওয়ার খুব ইচ্ছে। দুই মাস যাবত ওরা সিঙ্গাপুরে আছে। প্রফেসর আরিফ সিঙ্গাপুরের একটা ভার্সিটিতে নিযুক্ত হয়েছেন। প্রফেসর আরিফ ভার্সিটিতে আর এই ফাঁকে প্রমিতি ডাক্তারের কাছে চলে এসেছে। এই দুই মাসেও প্রমিতি ও প্রফেসর আরিফের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক গড়ে উঠেনি প্রমিতির অসুস্থতার কারণে। কিন্তু প্রমিতি তার স্বামীর সান্নিধ্য চেয়েছিল অনেকবার। প্রমিতির বারবার মনে হয় সে বাঁচবে না। তাই সে তার স্বামী প্রফেসর আরিফের সন্তান নিজের উদরে ধারণ করতে চায়।

প্রমিতি হতাশ হয়ে ফিরে যায়। তাও সে বেবি কনসিভ করতে চায়। দরকার পরলে প্রফেসর আরিফকে ইনটক্সিসাইট করবে। তার জীবনের শেষ চিহ্নের মাঝে সে তার ভালোবাসার মানুষটার জীবনে আজীবন থাকতে চায়।

_______
সময়ের পরিক্রমায় সবাই অগ্রসর হয়। দুইমাস কেটে গেছে। তূর ও মিহাল একটা বেডরুম, ওয়াশরুম ও কিচেন সহ ছোট ফ্লাট নিয়েছে। ওদের পাশের ফ্লাটে অর্ক, ও রিজভী। আর আরেকটা ফ্লাটে রিম, ফাইজা। রাফি, রণক, জারিন ও লিরা আরেকটা ভার্সিটিতে আর সেটা অনেকটা দূরে হওয়াও ওরা এখানে থাকে না। ওরা পরের সেমিস্টারে চেষ্টা করবে মাইগ্রেশন করার। সবাই একসাথে হলে একত্রে বড় ফ্লাট নিবে। মিহাল ও তূর সারাদিন ক্লাস, জব করে এসে দুজন একান্তে কিছু সময় কাটায়। এভাবেই দিন এগোচ্ছে। এর মাঝে রায়হান এসে তূর ও মিহালকে কনগ্রাচুলেট করে গেছে। তূর সেদিন ভয় পাচ্ছিলো যদি রায়হান মিহালকে কুটুক্তি করে? কিন্তু রায়হান সেসব কিছুই করে নি। তূররা সবাই আজকে তূরের খালার বাড়িতে যাবে। তূরের খালামনি তূরকে অনেকবার বলেছে কিন্তু তূরের সময় হচ্ছিলো না। দুই সপ্তাহ আগে ফ্রি ছিলো একদিনের জন্য তখন তূর তার প্রফেসরের বাড়িতে সবাইকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিল। প্রফেসরের বাড়ি অনেকটা কাছেই। এরিক ও এলেক্সরাও সাথে যাবে। ফাইজা এটা শুনে একটু ভালো করে পরিপাটি করলো নিজেকে। এরিক ও এলেক্সরা অন্য ইউনিভার্সিটিতে আছে তাই মাসে দুইবার কী তিনবার দেখা হয়।

তূরের খালামনি সবাইর সাথে কুশল বিনিময় করেন। তূরকে জড়িয়ে ধরে বলেন,
–তোমার এতোদিনে খালামনির কথা মনে হলো? জামাইকে নিয়ে এতোদিন পরে এলে।

তূর হাসিমুখে বলে,
–আগে বাসা ভাড়ার টেনশন ছিলো না কিন্তু এখন আছে। আর রিসার্চের কাজও অনেক। টাইম পাইনি গো। এখন তো এসেছি। আমরা আজ থেকে যাবো। ফাইজা, রিমদেরও বললাম কিন্তু ওরা থাকবে না। আমি ও মিহাল থাকবো। কাল এক্সট্রা ছুটি পড়েছে। ওরা কাল এলেক্সদের ওখানে পিকনিক করবে। আমি ও মিহাল বিকেলে জয়েন করবো তারপর রাতে ফিরে যাবো। আমি তো জানি তুমি আমাদের রাতে থাকতে বলবেই তাই সময় করে এসেছি।

তূরের খালাতো বোনেরা ও ভাবি অনেকদিন পর তূরকে পেয়ে উৎফুল্লিত। মিহালকে সবাই মিলে জামাই আদর করছে। মিহালের সাথে সাথে বাকিদেরও ভালো ভাবে আপ্যায়ন করা হচ্ছে।

রাতে তূর তার কাজিনদের সাথে গল্প করছে। তখন তূরের ভাবি বলে উঠে,
–তা আমি মামি হচ্ছি কবে?

তূর লজ্জায় আরক্ত হয়ে বলে,
–যাহ কী বলো! আমরা স্টাডির জন্য এসেছি।

তূরের ভাবি বলে,
–তো কী হয়েছে। মাস্টার্স তো তোমরা সময় নিয়ে ধীরে ধীরে করছো। তাহলে শেষের দিকে বেবি নিলে প্রবলেম কী? আরও ভালো বুঝলে। আমি ও জিহান ডাক্তারের সাথে কনসাল্ট করছি। আমার মাস্টার্সও আর ছয় মাস আছে। বেবি নিয়ে নিবো।

তূর সেখানে আর বসে না থেকে তার জন্য বরাদ্ধ করা রুমে চলে যায়। ওখানে থাকলে ভাবি আর অনেক কিছু বলবে। রুমে গিয়ে দেখে মিহাল সেখানে আগে থেকেই কপালে হাত রেখে শুয়ে ছিল। তূর গিয়ে মিহালের পাশে বসে কপালে হাত দিয়ে চেক করে শরীর খারাপ করলো কিনা। মিহাল তূরের সংস্পর্শে তন্দ্রাভাব কাটিয়ে উঠে বসে বলে,

–মা’থাটা হালকা ব্যাথা করছে। কফি হলে ভালো হতো।

তূর চটজলদি উঠে গিয়ে দুই মগ কফি করে আনে। তূর মিহালের হাতে কফির মগ দিয়ে বলে,
–কপাল টিপে দিচ্ছি তুমি কফিটা শেষ করো।

তূর সুন্দর করে আস্তে আস্তে কপাল টিপতে থাকে। মিহাল তূরের ডান হাতটা নিজের কপাল থেকে টেনে নিয়ে আলতো চুমু এঁকে বলে,

–তোমার যত্নে মাথাব্যথা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। তোমাকেই প্রয়োজন ছিল। আই ওয়ান্ট ইউ। লেটস মেক সাম লাভ ডিয়ার বউজান।

মিহাল তূরকে হাত ধরে পেছোন থেকে সামনে এনে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়। লজ্জায় রক্তিম হয় তূরের মুখশ্রী।

কৃষ্ণ অম্বরে পূর্ণ চাঁদ মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলছে ওদের প্রেমময় প্রহরের সাক্ষী হয়ে।

চলবে ইন শা আল্লাহ্

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here