শেষের_পঙক্তি,পর্ব_৫,৬

0
810

#শেষের_পঙক্তি,পর্ব_৫,৬
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৫

মিহালকে রিজভী কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে বলে,
–দোস্ত, চল এবার। রেস্টুরেন্টে যাবো খুব খিদে পেয়েছে। সামনেই একটা ভালো রেস্টুরেন্ট আছে। চল সেটাতে যাই।

মিহাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাজি হয়ে যায়। তারপর ওরা সেই রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে রওনা হয় কিন্তু পথিমধ্যে একটা কফিশপের বাহিরে মিহাল কাউকে দেখে থমকে দাঁড়ায়। মিহাল দেখে অতি পরিচিত হাস্যজ্জল রমণী কোন এক অচেনা পুরুষের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন ওরা দুইজনে কফিশপ থেকে বের হয়েছে মাত্র। তবে কি ওরা দুইজন কফিশপে দেখা করতে এসেছিল? কিছুক্ষণ আগের রাগের স্ফুলিঙ্গ এখন আরো ধপধপ করে উঠলো। মিহাল রাগে হনহনিয়ে রেস্টুরেন্টের ভিতর ঢুকে গেলো। রেস্টুরেন্টের দরজাটা একটু জোরে খোলার কারণে তাইজুল ও রিজভী দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে। অতঃপর ডান পাশে চোখ যেতে দেখে তূর ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। রেস্টুরেন্টের পাশেই কফিশপ না। একটা দুইটা দোকান ব্যাবধান। মিহাল তখন তূরকেই দেখেছিল কারো সাথে হেসে কথা বলতে। মিহাল তূরকে পরিচিত বন্ধুদের ছাড়া কারো সাথে দেখলে সহ্য করতে পারে না। আর যেই ছেলেটার সাথে তূর কথা বলছিল সেই ছেলেটার হাতে এপ্রোন ও স্টেথোস্কোপ ছিল।

তূর রিজভী ও তাইজুলের কাছে এসে হাসি মুখে বলে,
–কি ব্যাপার? তোমারা এখানে?

মিহাল ওদিকে রেস্টুরেন্টের ভিতরে রাস্তার সাইডে বসেছে। হাফ থাই গ্লাস দেয়াতে বাহিরের দৃশ্য দেখা যায়। তূরকে সে রিজভী ও তাইজুলের সাথে কথা বলতে দেখছে কিন্তু শুনতে পাচ্ছে না। তূরের ঠোঁট এলিয়ে লাস্যময়ী হাসি যেন মনমুগ্ধকর। হাসিতে যার চোখ হাসে সাথে ঠোঁটের কোনে টোল পরে। না হোক সে গৌরবর্ণের অধিকারী! খানিকটা শ্যামলতা হলে ক্ষতি কি! তার উজ্জ্বল গায়ের রং সূর্যের আলোয় যেন ঝলমল করে। লতানো চুলগুলো উড়ে মুখের উপর পরার পর সেটা সরানোও একটা মুগ্ধতার শিল্প যেনো।

তূরের করা প্রশ্নে তাইজুল জবাব দেয়,
–শপিং করলাম। ট্যুরে যাবো তো দেখলাম ভালো কোনো স্নিকার্স ও ড্রেস নেই।

তূর মুখ বাঁকিয়ে বলে,
–আসলেই তোমাদের স্নিকার্স নেই! অবশ্য স্নিকার্স প্রেমিদের যতোই থাকুক তাও ওদের নাকি নেই!

রিজভী হেসে বলে,
–এটা তুমি ঠিকই বলেছো। আমি আবার স্নিকার্স নেই নি। তিনটার মতো তো বাসায় পরেই আছে। ওগুলোই ব্যাবহার করবো। তা তুমি এখানে?

তূর হেসে জবাব দেয়,
–একজনের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।

রিজভী বলে,
–ওহ আচ্ছা। আসো একসাথে লাঞ্চ করি। ১২ টা তো বাজে।

তূর ভদ্রতা রেখে বলে,
–আসলে বাসায় গোছগাছ করতে হবে। কালকেই তো দেশে আসলাম আবার আজকে রাতে ট্যুরে যাবো। একটু প্রিপারেশন নিতে হবে। আর একটা লং জার্নির পর আরেকটা লং জার্নি। শরীর ধকল নিতে পারবে কিনা কে জানে! তোমাদের জবের জয়েনিং এর জন্যই আজকে যেতে হচ্ছে। নাহলে কিছুদিন পর যেতাম। তাহলে আসি। টাটা।

রিজভী ও তাইজুল বুঝে তারপর তূরকে বিদায় দিয়ে রেস্টুরেন্টের ভিতর ঢুকে। মিহালের সাথে এসে বসার পর ওরা দেখে মিহাল কাঁটাচামচ ঘুরাচ্ছে। ওয়েটার এসে অর্ডার নিয়ে গেলো। এখনও যেহেতু পুরোপুরি লাঞ্চ টাইম হয়নি তাই ওরা বেকড পাস্তা অর্ডার করলো। একটা থেকেই তিনজন খাবে। পাস্তার কোয়ান্টিটিও বেশি। অর্ডার আসার আগ পর্যন্ত মিহাল কাঁটাচামচ হাত থেকে সরালো না। রিজভী ব্যাপারটা না বুঝে জিজ্ঞাসা করে,

–তখন ওভাবে চলে এলি কেনো? জানিস তূরের সাথে দেখা হয়েছিল।

মিহাল কাঁটাচামচ দেখতে দেখতে বললো,
–ওহ!

রিজভীর কাছে আজব লাগলো। তারপরেও দুঃখ করে বললো,
–বেচারির জন্য টাফ হবে অনেক জার্নিটা। একটা জার্নির ধকল না কাটতেই আরেকটা জার্নি।

মিহাল হুট করে ভাবলেশহীন ভাবে বলে ফেলে,
–তাহলে সে না যাক! এতো কস্ট করে যাওয়ার দরকার কি? গুরুত্বপূর্ণ কারো সাথে দেখা করার সময় তো তার ক্লান্তি থাকে না। তাই না!

রিজভী ও তাইজুল দুইজনেই বে*কুবের মতো নিজেদের দেখছে। মিহাল কি মিন করছে তা ঠিকভাবে তাদের বোধগম্য হচ্ছে না। তাইজুল জিজ্ঞাসা করে,

–কি বলতেছিস তুই? তোর কথার মানে বুঝতেছি না আমরা।

মিহাল এবার কাঁটাচামচটা টেবিলের উপর সজোরে রেখে সিটের সাথে হেলান দিয়ে বুকের উপর দুইহাত আড়াআড়িভাবে রেখে ভাবলেশহীনভাবে বলে,

–ওই ছেলেটা কিন্তু গুড লুকিং এন্ড স্মার্ট ছিল। ওর পছন্দ খুব পারফেক্ট!

এবারও দুই বে*কুবের মাথার উপর দিয়ে গেলো। দুজনের ঠোঁটে সেন্টি মার্কা হাসি। মিহাল সেসব তোয়াক্কা না করে আবার বলে,

–এইজন্যই কালকে তার ব্যাবহার কেমন চেঞ্জড লাগছিল। আমার উপস্থিতি তাকে বিরক্ত করছিল। যেন আমি তার কাছে ম্যাটার করি না। হাউ ফানি না! নতুন কেউ তার জীবনে এসে গেছে। তারউপর সেই নতুন কেউ স্মার্ট এন্ড প্রফেশনটাও স্মার্ট। তূরের পছন্দের প্রফেশন বলে কথা।

রিজভী অবাক হয়ে তাইজুলের দিকে একবার তাকায়। তাইজুলও একই ভাবে তাকায়। তারপর রিজভী বোকার মতো প্রশ্ন করে,

–তূরের কথা বলছিস? তূর কাকে ভালোবাসে? কার সাথে রিলেশনে আছে?

মিহাল বিরক্তই হলো। সে বললো,
–যাকে সে ভালোবাসে!

রিজভী ও তাইজুল বে’ক্কল বনে গেলো। বেকড পাস্তা এসে গেছে। ওরা তিনজনেই একটু একটু করে খাচ্ছে। এরপর দুপুরের লাঞ্চ করে ওরা যার যার বাড়িতে রওনা হলো।

_________

বাড়ি ফিরে তূর বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। টায়ার্ড লাগছে তার। ভাবছে দুপুরের খাবার খেয়ে দুপুর ৩ টা থেকে ৫.৩০ টা পর্যন্ত ঘুমাবে। মাগরিবের সময় তো ৬.১০ এ। এখন বাজে দুপুর ২টা। নীরা তাড়াহুড়ো করে তূরের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় তারপর তূরের পাশে এসে বসে। তূর নীরার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। দরজা তাড়াহুড়ো করে লাগাতে যাওয়ার দরুন কিছুটা শব্দের সৃষ্টি হয়েছে। নীরা মনের মধ্যে উত্তেজনা নিয়ে তূরকে জিজ্ঞাসা করে,

–ডাক্তার ইফতিকে তোর কেমন মনে হলো? ইজ হি রাইট ফর মি?

তূর শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে বলে,
–হুম খারাপ না। কথার ধরন ও ব্যবহার খুবই ভালো, প্রশংসনীয়। অহংকার লক্ষ্যনীয় ছিল না। প্রথমে তার চেম্বারে গিয়েছি তারপর চেম্বারে গিয়ে তাকে তোর পরিচয় দিয়ে বলেছি যদি একটু কফিশপে আসে। সে হাতে থাকা কয়েকটা রোগী দেখে আমার সাথে গেলো। তারপর তোর কথা ও কখনো আর কাউকে ভালো লেগেছিল কিনা তা জিজ্ঞাসা করেছি। আরও টুকটাক পরিচয় ও স্টাডি নিয়ে কথা হলো। সে সবকিছুর সুন্দর করে জবাব দিয়েছে। আমার তার কথা বলার ধরনে মিথ্যা মনে হয় নি।

নীরা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
–তার কি কখনো আগে কারো সাথে রিলেশন ছিল?

তূর আফসোস করে বলে,
–ছিল!

নীরার চোখ-মুখ কেমন যেনো হয়ে গেলো। তূর আবারো বলে,
–কিন্তু সেই মেয়েটা আর এই ইহজগতে নেই। ১০ বছর আগে কানাডাতে কার এক্সিডেন্টে মেয়েটা মা*রা যায়। তখন ডাক্তার ইফতি ১৯ বছরের আর মেয়েটা ১৬ বছরের ছিল। মেয়েটা ছিল ডাক্তার ইফতির ফুফির মেয়ে। ডাক্তার ইফতির যখন দুই বছর তখন তার বাবা-মা, ফুফিরা কানাডা চলে গিয়েছিলেন। তার বাবার কানাডাতে বিজনেস ব্রাঞ্চ আছে আর তার ফুফারও তাতে ৫০% শেয়ার। ডাক্তার ইফতির অতীতের ভালোবাসার মানুষটার নাম ছিল নীরা! হ্যাঁ। ওই মেয়েটার নামও তোর নামের সাথে মিল ছিল।

নীরা অবাক হয়। ওই মেয়েটার মৃত্যুর খবরে দুঃখ পেলেও কিছু একটা ভেবে নীরার হৃদয় ব্যাথিত হলো। নীরা কম্পমান স্বরে বললো,

–নামের মিলের কারণে কি সে আমার বিয়ে করতে চায়?

তূর অবাক হলো না নীরার প্রশ্নে। এরকম প্রশ্নই তূর আশা করছিল।

চলবে ইন শা আল্লাহ,

#শেষের_পঙক্তি
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৬
তূর নীরার হাত ধরে বললো,
–ডাক্তার ইফতি কিন্তু তার অতীতের ভালোবাসার মানুষটার নামের মেয়ে আরো অনেক দেখেছে। প্রথম প্রথম নাম শুনে থমকে গেলেও নামের অধিকারিণী তার হৃদয় কাড়ে নি। ১০ বছর তো কম সময় নয়। সে অনেক কম বয়সি সুন্দর নীরা নামের মেয়ে দেখেছে কিন্তু কাউকে ওই নামটা ছাড়া আর ভালো লাগাতে পারে নি নিজের কাছে। কাউকে দেখে তার মনে হয় নি জীবনে কাউকে আনা উচিত। কিন্তু তোকে দেখে মনে হয়েছে তার। আর সে তোকে কেনো বিয়ে করতে চায় তা তার কাছে সঙ্গা এমন ছিল যে,
“তার কস্ট গুলো আমাকে খুব গভীর ভাবে ছুঁয়েছিল। যখন তার কান্নারত ও ক্লান্ত মুখ নিয়ে হসপিটালের করিডরে ঢলে পরছিল তখন তাকে আগলানো আমিটা যেনো ভিতর থেকে বলছিল, সারাজীবন আগলাতে হবে একে!”

নীরা বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। মাস চারেক আগে যখন নীরা ওর মাকে নিয়ে হসপিটালে গিয়েছিল আর ডাক্তার ওর মায়ের অনেকগুলা টেস্ট করতে দেয়, সেই ডাক্তার টা ছিল ইফতি। নীরার মায়ের বলা সমস্যা অনুসারে চেকআপ করতে দিলে। নীরা সব চেকআপ করায় আর তখন ইফতি নীরার নাম জানতে পারেন। পরেরদিন নীরা ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে রিপোর্ট নিয়ে আবার ডাক্তার ইফতির কাছে গিয়েছিল। ডাক্তার ইফতির তখন বিকেলের কেবিনে রোগী দেখার প্রায় শেষ সময় ছিল। নীরার পর আরেকটা পেশেন্টের পর রাউন্ডের সময় ছিল তার। নীরার মায়ের রিপোর্টে এসেছিল, হাই LDL, হৃৎপিন্ডে কপাটিকাতে চর্বি জমেছে মানে ব্লকের কাছাকাছি আর ফ্যাটি লিভার।
ডাক্তার ইফতি তখন নীরাকে একন লিভার স্পেশালিষ্ট সাজেস্ট করার পর হৃৎপিন্ডের জন্য প্রয়োজনীয় মেডিসিন ও ডায়েট চার্ট দেয়। নীরাকে তার মায়ের অসুস্থতার কথা বলার পর ডাক্তার ইফতি খেয়াল করেছিল যে নীরার শরীর কাঁপছে আর চোখ মুখের অবস্থাও ভালো না। কেবিন থেকে বের হয়ে নীরা করিডোরের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল যাতে অন্য রোগীর প্রবলেম না হয়। বাবা-মায়ের অসুস্থতা সন্তানের জন্য কতোটা কস্টের তা বলে বোঝানো যাবে না। ইফতির রোগী দেখা শেষ হবার পর করিডোরের জানালার দিকে নজর যাওয়ার পর নীরাকে দেখেছিল কাঁদতে। ডাক্তার ইফতি সেখানে এগিয়ে যাওয়া ধরতেই নীরা সেন্সলেস হয়ে ঢলে পরতে নিয়েছিল। সারাদিন ভার্সিটিতে থেকে না খাওয়া ছিল আর টেনশনে প্রেশার ফল করেছিল।

তূরের ধা*ক্কাতে বাস্তবে ফেরে নীরা তারপর সেখান থেকে উঠে চলে যায়। তূর নীরার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ক্লান্তির নিঃশ্বাস ফেলে গোসল করতে চলে যায়। তারপর নামাজ ও খাওয়ার পর এলার্ম দিয়ে ঘুম দেয়।

________
রাত ১০ টা। সবাই গাবতলিতে বাসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তূর ঘুমে ঢলে পরছে। সন্ধ্যার নামাজের পর সে আরো এক ঘন্টা ঘুমিয়ে ৮ টার সময় উঠে রেডি হয়ে রওনা হয়েছে। এখন বাসে বসা নিয়ে বিড়ম্বনা চলছে। ৭টা ডাবল সিট নিয়েছে। লিরা ও ফাইজা, রিজভী ও তাইজুল, রাফি ও অর্ক, তাওহীদ ও আসফি, নাদিয়া ও তার হাসবেন্ড শাফকাত, এবার রণক বলে সে জারিনের সাথে বসবে। আর তূর ঘুমে ঢলে পরছে বলে তূর জারিনের সাথে বসবে। জারিন রণককে বুঝিয়ে মিহালের সাথে বসায়। জারিন ও তূর একসাথে।

যাত্রা বিরতিতেও তূর ঘুমাচ্ছে। জারিন তূরের পাশে বসেছিল। তূর জারিনের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়েছে এতক্ষণ। এখন জারিনের ঘুম পাচ্ছে বলে জারিন মিহালকে তূরের পাশে বসতে বলে সে রণকের পাশে বসে। মিহাল আর রণক এতোক্ষণ ঘুমিয়েছে এখন ওরা ঘুমাবে না। মিহাল গিয়ে তূরের পাশে বসে। জারিনরা সবাই জানে তূরকে মিহাল ভালোবাসে কিন্তু অনিশ্চয়তার মধ্যে সে তূরকে জানাতে নারাজ। তূর কিছুক্ষণ জানালার সাথে মা’থা ঠেকায়, কতক্ষণ সিটের সাথে এরপর মিহালের কাঁধে। জার্নির ধকল সে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পুষাচ্ছে।

সকাল ৮ টায় ওরা সিলেট মেইন টাউনে পৌঁছায়। মিহাল তূরের ঘুম ভেঙে যাওয়ার আগেই জারিনকে আবার তূরের পাশে বসিয়ে দেয়। ওরা সবাই সেখানে ২ ঘন্টার জন্য হোটেলের দুইটা ডাবল বেডের রুম ভাড়া করে ফ্রেশ হয় ও নাস্তা করে। তারপর হযরত শাহজালাল ও শাহপরানের মাজার দর্শনে বেরিয়ে পরে। যেহেতু দুই দিনের ঘোরাঘুরিতে এসেছে তাই প্রথম দিনই ঘোরাঘুরি শুরু করেছে। দুইটা মাজার দর্শন করতে করতে দুপুর হয়ে যাচ্ছে। মাজার এরিয়াতে দুপুরের খাবার খেয়ে ওরা আবারও বাস স্ট্যান্ডে আসে। বাস স্ট্যান্ড থেকে লাক্কাতুরা চা-বাগানের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

লাক্কাতুরা চা বাগানে এসে তো মেয়েদের ছবি তোলার ধুম পরে গেছে। চা বাগানের পাশ দিয়ে ও ভিতর দিয়ে মাটির রাস্তা এতো সুন্দর আর পুরো চা বাগানটা এতোটা মনোমুগ্ধকর যে বারবার এই সবুজের সমারোহে হারাতে মন চায়। পাহাড়ের ঢালের মতো চা বাগান। তার মাঝে মাঝে কিছু বৃক্ষরাজি তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। ওরা সবাই নিজের মনের আহ্লাদ মিটিয়ে পরিবেশ উপভোগ করছে। চা বাগানের পাতা সংগ্রহকারীদের সাথে সবাই দুই একটা পাতা তুলে হাতে নিয়ে ছবি তুলেছে অনেক। মিহাল কিছুটা দূর থেকে তূর দুই হাত দিয়ে “দুইটি পাতা একটি কুঁড়ি” যখন তুলছিল আর হাসছিল, তখন মিহাল ওর ছবি তুলে নেয়। আকস্মিক তোলা ছবিটা অসম্ভব সুন্দর উঠে। মিহাল ছবিটার দিকে তাকিয়ে আলতো হেসে সগোউক্তি করে,

“তার স্নিগ্ধ হাসিতে মুগ্ধ হোক আমার হৃদয়। এই ওষ্ঠকোনে হাসির রেশ যেন অম্লিন থাকে।”

ঘন্টা দুয়েক চা বাগানে ঘোরাঘুরি করে চা বাগানের আশেপাশের চায়ের দোকান থেকে ওরা সবাই ফ্রেশ চা-পাতি দিয়ে বানানো চা পান করে শ্রিমংগলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা করে। শ্রিমংগলে একটা কাঠের বাংলা টাইপ হোটেলে ওরা বুকড করে রেখেছে। হোটেলটা চা বাগানের মধ্য আর অনেক গুলো বাংলো টাইপ কিছুটা দূরে দূরে। সেখানে রাতে থাকবে এরপর সকালে শ্রিমংগল ঘোরাঘুরি করবে। বাংলোটাতে চারটা রুম। দুইটা মেয়েদের দখলে আর দুইটা ছেলেদের। বিবাহিতদেরও এখানে সিঙ্গেলের মতো থাকতে হবে।

সন্ধ্যার পর ওরা বাংলোতে পৌঁছায়। বাংলোর সামনে বন ফা’য়ার করা আছে। বন ফা’য়ারের মধ্যে চিকেন গ্রিল করার ইচ্ছে ওদের তাই কেয়ারটেকারকে বলে সব বন্দোবস্ত করে আনে। বন ফা’য়ারের চারপাশে পাটি বিছিয়ে ওরা গান-আড্ডা দিচ্ছে আর খানিকটা দূরে আরেকটা বন ফা’য়ার করে তাতে কেয়ারটেকার কয়েকজন হেল্পিং হ্যান্ড আনিয়ে চিকেন গ্রিল করছে। এই বাংলোটা কাল দুপুর ১২ টার মধ্যেই ছেড়ে দিবে। বন ফা’য়ারের ঈষৎ হলুদাভাব আলোতে দুই জোড়া চোখ লুকুচুরি খেলছে আড়ালে। চোখে চোখ পড়লেই দৃষ্টি সরানোর যেনো এক অনবদ্য প্রতিযোগীতা! নাদিয়া ও শাফকাত, রণক ও জারিন তো পাশাপাশি বসেছে। অর্ক গিটার এনেছে সাথে। অর্ক গিটারের টুংটাং মিউজিক তুলছে। ওরা একটা খেলা খেলবে। যেখানে দুইটা বক্সে চিরকুট থাকবে। একটাতে ওদের প্রত্যেকের নামের চিরকুট আরেকটাতে কিছু করে দেখাতে হবে সেসব নাম। প্রথমে এলো শাফকাতের নাম আর তার পড়লো গান। শাফকাত কোনোমতে দুই লাইন গান গেলো জেমস ব্র্যান্ডের। তারপর একে একে সবার নাচ, আবৃতি, অভিনয়, জোকস, যেকোনো একটা লুকানো সত্য বলা এসব আসলো। তূরের পড়েছে আবৃতি।

তূর কবি সুফিয়া কামালের “তাহারেই পড়ে মনে” কবিতার কিছু লাইন আবৃতি করে।

“কুহেলি উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী-
গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে
রিক্ত হস্তে! তাহারেই পড়ে মনে ভুলিতে পারি না কোনমতে। ”

কবিতাটার এই কয়েকটা পঙক্তিই যেনো পুরো কবিতার ভাবার্থ নির্দেশ করে।

মিহালের বেলায় গান পড়াতে মিহাল গায়,
“আমি পারি নি তোমাকে, আপন করে রাখতে।
আমি পারি নি তোমাকে, আবার আমার করে রাখতে।
তুমি বুঝোনি, আমি বলি নি,
তুমি স্বপ্নতে কেন আসোনি?
আমার অভিমান তোমাকে নিয়ে সব গেয়েছি।”

তূর গানটা মিহালের কন্ঠে শুনে মনে মনে তাচ্ছিল্য হাসে। যে গাইছে তার পুরো বিপরীত এই গানটা তূরের কাছে। মিহাল গানটার এক প্যারা গেয়ে আর গায় না। মিহালের মনে চলতে থাকে,
“তোমাকে সেদিন রিজেক্ট করারও কারণ ছিল তূর। ইনায়া তানজিনাকে সব বলেছে যানো! তানজিনাকে নিজের জীবন থেকে না সরিয়ে তোমাকে আমি আমার জীবনে আনতে পারবো না। আমার মা তখন তোমাকে সহ্য করতে পারবে না। তানজিনার জন্য তো আম্মু আমাকে কম মানসিক যন্ত্রনা দেয় না! তানজিনা নিজ থেকেই আমার জীবন থেকে সরে যাবে সেটার বন্দোবস্ত করতে হবে।”

চলবে ইন শা আল্লাহ,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here