কিরে ফুলটুসি এতো মনোযোগ দিয়ে কি পড়ছিস? কথাটা বলতে বলতে সোহান ভাইয়া আমার বিছানায় শুয়ে পড়লো।
— ভাইয়া তোমাকে কতবার বলছি না আমাকে এই নামে ডাকবে না।
— সোহান ভাইয়া তোর আর কোন নাম আছে নাকি?
— নাম নেই মানে কি?
— সোহান ভাইয়া আমিতো জানি তোর নাম ফুলটুসি।
— ভাইয়া ভালো হবে না কিন্তু আমি বড় হয়েছি মানুষের সামনে তুমি এখনো আমাকে ফুলটুসি ডাকো কেন? আমার কত সুন্দর একটা নাম আছে ইকরা।
— সোহান সুন্দর নাম না ছাঁই, ইকরা থেকে ফুলটুসি নামটাই সুন্দর তোকেতো আমি এই নামেই ডাকবো।
— কথা গুলো বলতে বলতে সোহান বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আমি নির্বাক সোহানের দিকে চেয়ে রইলাম। হাজার বার বললে বা বুঝালেও সে আমার নাম ধরে ডাকবে না। সেই ছোট বেলা থেকেই আমাকে এই নামে ডেকে আসছে। সোহান ভাইয়ার মুখ থেকে এই নাম শুনতে যে আমার খারাপ লাগে তাও না। আমার মন বলে কেউতো একজন থাকা দরকার যে ভালোবেসে একটা নাম দিবে।
— মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠতেই আমার ধ্যান ভেঙে গেলো। তাড়াতাড়ি ফোন রিসিভ করতেই অপরপ্রান্ত থেকে
— তরী বলতে শুরু করলো কোথায় তুই? আজ ভার্সিটিতে আসার সময় বইটা নিয়ে আসিস।
— বইটা কাল দিলে হয়না? আমার এখনো পড়া হয়নি।
— তরী তুইতো জানিস বইটা আমার না যার বই তাকে ফেরৎ দিতে হবে।
— ঠিক আছে নিয়ে আসবো। বলে মন খারাপ করে ফোনটা কেটে দিলাম।
— ফ্রেশ হয়ে নাস্তার টেবিলে মন খারাপ করেই নাস্তার টেবিলে আসলাম। নাস্তা খেতে বসেছি এমন সময় সোহান ভাইয়া পাশে বসতে বসতে বললো কিরে ফুলটুসি তোর মন খারাপ কেন?
— রাগে চেঁচিয়ে বলে উঠলাম আমাকে যদি আর একবার এই নামে ডাকছো তো তোমাকে খুন করে ফেলবো।
— সোহান ভাইয়া এমন আচরণ মোটেও প্রত্যাশা করেনি। তাড়াতাড়ি টেবিল থেকে উঠে দাঁড়ালো। আমি আর কোন কথা না বলে নাস্তা খেয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। রিক্সায় বসে মনে মনে ভাবছি সোহানের সাথে আমার এমনটা করা মোটেও উচিৎ হয়নি। বিকেলে বাসায় ফিরে সরি বলে দিবো।
— বিকেলে বাসায় ফিরে সোহান ভাইয়াকে পেলাম না বড় চাচীকে জিজ্ঞাসা করলাম সোহান ভাইয়া কোথায়?
— বড় চাচী বলতে পারি না কোথায় গেছে, সেই সকালে বের হইছে এখনো ফিরেনি। বেকার ছেলে নিয়ে এই এক যন্ত্রনা।
— যন্ত্রনার কি হলো? সে কি ইচ্ছে করে বেকার হয়ে ঘরে বসে আছে নাকি? জব পাচ্ছে না তাই, চেষ্টারতো কোন কমতি রাখছে না। কথা গুলো বলে বড় চাচীর রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে চলে আসলাম।
— মন খারাপ করে বসে আছি, আমি জানি সোহান আমার উপর রাগ করেই বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। ছাদের এক কোনে দাঁড়িয়ে ফোন দিলাম, অনেকটা সময় রিং বাজার পর ফোন রিসিভ করলো।
— হ্যাঁ ফুলটুসি বল,
— কোথায় তুমি?
— এইতো মাঠে বসে আছি কেন কিছু বলবি?
— না এমনি সারা দিন বাসায় আসোনি কেন?
— বাসায় এসে কি করবো? সবাইতো শুধু রাগ দেখায়, তার চেয়ে না খেয়ে মাঠের এক কোনে বসে থাকাই ভালো।
— এতো বড় হয়েছো লেখাপড়া শেষ করেছো একটা চাকরি নিতে পারো না? তাহলেইতো কেউ কিছু বলবে না। তাড়াতাড়ি বাসায় আসো, কথা গুলো বলেই ফোনটা কেটে দিলাম।
— চোখের কোনে জল জমে গেছে, সত্যিইতো আমরা সবাই খুবি খারাপ ব্যবহার করি সোহানের সাথে, কখনো ওর দিকটা ভেবে দেখি না। ওতো আর ইচ্ছে করে বসে নেই বাসায়। প্রতি সাপ্তায় কোথাও না কোথাও ইন্টারভিউ দিয়েই চলেছে। এতো ভালো রেজাল্ট দেখতেও সুন্দর, কত সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে তবুও কেন জানি চাকরিটা অধরাই থেকে যাচ্ছে।
— কথা গুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে সোহান পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করিনি। যখন পেছন থেকে এসে চশমটা টান দিয়ে খুলে বলতে শুরু করলো কিরে চোখে পোকা পড়েছে নাকি চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। বলেই চোখ মুছে দিতে শুরু করলো।
— কিছুটা অপস্তুত হয়েই বললাম অনেকটা সময় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম তাই এমন হয়েছে, তুমি দাঁড়াও আমি চা নাস্তা নিয়ে আসছি বলেই যখন সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম তখনি সোহান পেছন থেকে একটা হাত টান দিয়ে ফুলটুসি তোর জন্য একটা জিনিস নিয়ে এসেছি।
— অবাক চোখে সোহানের দিকে তাকালাম, সে র্যাপিং পেপারে প্যাঁচানো একটা প্যাকেট আমার হাতে ধরিয়ে দিলো।
— কি আছে এর ভিতর বলে যখন খুলতে যাবো, ঠিক তখনি সে আবার আমার হাতটা চেঁপে ধরে বলতে শুরু করলো। এখুনি না রাতে খুলবি। আমি আর কোন কথা না বলে চলে নিচে নেমে চা নাস্তা বানিয়ে ছাঁদে উঠে এলাম, পশ্চিম কর্ণারের শেষ রেলিংটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে সোহান। সূর্য তখন ডুবি ডুবি করছে। আমি চা আর নাস্তা ছোট টেবিলটার উপর রেখে দু’টো চেয়ার হাতে নিয়ে সোহানের কাছে রেখে বললাম বসো।
— চায়ের মগ সোহানের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললাম সরি ভাইয়া কিছু মনে করো না।
— কিসের জন্য সরি?
— ঐ যে সকালে তোমার সাথে চিল্লাইছি সে জন্য সরি।
— সোহান চায়ের মগে চুমুক দিয়ে দূর ফুলটুসি তোর উপর আমি কখনো রাগ করি? এই বাড়িতে একমাত্র তুইতো আছিস যে আমার এতোটা খেয়াল রাখে।
— হয়েছে যে দিন বিয়ে করে বউ নিয়ে আসবে তখন আর এসব মনে থাকবে না। তখন হয়ে যাবা বউ পাগলা বউ এর কথায় উঠবে বসবে।
— সোহান হাসতে হাসতে বিয়েতো হোক আগে তারপর বউ। তারপর দেখা যাবে কে কার কথা শুনে।
— হ্যাঁ হ্যাঁ দেখবোতো,
— আচ্ছা দেখিস এখন আমি নামছি, টিউশনিতে যেতে হবে। মাস শেষ হয়ে এসেছে না পড়ালে আবার বেতন দিতে চাইবে না।
— সারাদিন খাওনি, নাস্তাটা শেষ করে যাও।
— এখন আর খাবো না, তুই ভালোবেসে যতটুকু খায়িয়েছিস ততটুকুতেই পেট ভরে গেছে, কথাটা বলেই সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলো, হঠাৎ থেকে পেছনে ফিরে তাকিয়ে বলতে শুরু করলো ফুলটুসি, তোকে অনেক অনেক ধন্যবাদ রাতে এক সাথে খাবো। আর প্যাকেটটা কিন্তু খুলবি না রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে তবেই প্যাকেট টা খুলবি। আমি মাথা নেড়ে বুঝালাম ঠিক আছে, আমি আরও কিছুটা সময় আনমনে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর চায়ের মগ নিয়ে নিচে নেমে আসলাম।
— বড় চাচী ওকে খেয়ে যেতে বললি না।
— বলছিলাম, খায়নি রাতে এসে খাবে।
— তোর কথা ছাড়া আরতো কারো কথায় শুনতে চায় না ছেলেটা।
— কি যে বলোনা তুমি, সোহান ভাইয়ার মত ভালো একটা ছেলে তুমি পুরো মহল্লায় পাবে না।
— হো তোকে বলছে,
— বলছে কি? এখনকার ছেলেদের কত রকম চাহিদা, কত রকম আজেবাজে নেশা তার কোনটাই নেই তোমার ছেলের মাঝে। সেই কবে তোমাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে বলতে পারবে? নিজে টুকটাক টিউশনি করিয়ে নিজের খরচ চালায়, বরং টুকটাক সংসার খরচও দেয় তোমাদের। এমন একটা ছেলে কোথায় পাবে তুমি?
— হ্যাঁ তা ঠিক বলেছিস, সত্যিই এই দিক দিয়ে আমার ছেলেটা অনেক ভালো। আচ্ছা তুই বল তোর চাচারতো কম নেই, বললাম নিয়ে ব্যবসা করতে করবে না। বললাম তাহলে বিদেশ যা তাও যাবে না। তার এক কথা আজ হোক কাল হোক চাকরি একটা হবেই।
— এক কাজ করো তোমার ছেলেকে বিয়ে করিয়ে দাও।
— বিয়ে দিবো ভালো মেয়ে কোথায় পাবো? আর বেকার ছেলেকে বিয়ে কে করবে?
— আরে সারা জীবনতো আর বেকার থাকবে না, আজ হোক কাল হোক চাকরি পাবেই, আর মেয়ের কি অভাব নাকি? আমাকে বলো আমার সব বান্ধবিদের এনে বাড়ির সামনে সিরিয়াল লাগিয়ে দিবো।
— হয়েছে হয়েছে থাম, এতো সিরিয়াল লাগাতে হবে না। বলতে বলতে বড় চাচী কিচেন থেকে বেরিয়ে পড়লো।
— আমিও চলে আসলাম নিজের রুমে, রুমটা গুছিয়ে গিফটের প্যাকেটটা টেবিলের এক কোনায় রেখে বই নিয়ে পড়তে বসলাম। পড়াতে কেন জানি মন বসতে চাচ্ছিলো না। তবুও জোড় করেই পড়ার চেষ্টা চালাচ্ছিলাম, হঠাৎই পেছন থেকে সোহান এসে কান টানতে টানতে বললো এই তুি মাকে কি বলেছিসরে?
— কান ছাড়ো ব্যথা লাগছে,
— সোহান কান ধরে রেখেই না ছাড়বো না, আগে বল আর কোন দিন এমন আজে বাজে বুদ্ধি দিবি তুই মাকে?
— প্লীজ ছাড়ো না অনেক ব্যথা পাচ্ছি, [সত্যিই ব্যথায় চোখে পানি চলে এসেছিলো]
— সোহান তাড়াতাড়ি কান ছেড়ে দিয়ে এই সরি সরি আমি তোকে ব্যথা দিতে চাইনি।
— আমি জোড়ে সোহানকে ধাক্কা দিতেই সোহান বিছানায় পড়ে যায়, পড়ে যাবার ঠিক আগ মুহুর্তে সোহান আমার একটা হাত ধরার কারণে আমিও সোহানের বুকের উপর পড়ে যাই। সোহান অপলক আমার দিকে চেয়ে আছে দেখে আমার প্রচণ্ড রকম লজ্জা লাগে। আমি দ্রুত উঠে দাঁড়াই।
— তোমাকে কত বার বলেছি আমার সাথে এমন করবে না।
— সোহান উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আমার কি দোষ তুইতো আমাকে ধাক্কা দিলি।
— হয়েছে হয়েছে তাড়াতাড়ি ঘর থেকো বের হও, তোমার শার্ট থেকে ঘামের গন্ধ আসছে, ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং এ আসো।
— সোহান নিজের জামায় নাক লাগিয়ে উহ সত্যিইতো, বলতে বলতে ইকরার রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো।
— রাতে সকলে এক সাথে খাওয়া শেষ করে যার যার রুমে চলে আসলো। ঘরের দরজা লাগিয়ে এসে ইকরা টেবিলের কর্ণারে থাকা প্যাকেটটা নিয়ে খুলতে শুরু করলো। প্যাকেটটা খুলতেই ইকরা অবাক হয়ে গেলো তরীর কাছ থেকে পড়ার জন্য যেই বইটা নিয়ে এসেছিলো সেই বইটা সাথে আরও একটা বই। বই খুলতেই ছোট একটা চিরকুট বেরিয়ে আসলো তাতে লেখা,
“এখন থেকে তোর যে বই লাগবে আমাকে বলবি অন্য মানুষের বই আনতে হবে না”
শেষ বিকেলের রোদ – ১ম পর্ব
©শাহরিয়ার