শেষ বিকেলের রোদ-১৫তম পর্ব

0
1525

শেষ বিকেলের রোদ-১৫তম পর্ব
©শাহরিয়ার

— ভাবনায় ছেদ পরলো ফুপুর ডাকে।

ফুপু:- কিরে তোরা কি রাতের খাবার খাবি না?

আফরিন:- হ্যাঁ মা খাবো, তুমি যাও আমরা ফ্রেস হয়ে আসছি।

ফুপু:- চায়ের মগ গুলো গুছিয়ে নিতে নিতে তাড়াতাড়ি আয়, বলে রুম থেকে বেরিয়ে পরলো।

— আপু ওয়াশ রুমে ঢুকে পরলো ফ্রেস হবার জন্য। আমি মনে মনে একটু খুশি হলাম দীর্ঘ সময় পর সোহানকে দেখতে পাবো। আপু বের হতেই ওয়াশ রুমে ঢুকে তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে আসলাম।
দু’জন মিলে ডাইনিং এর দিকে হাঁটা শুরু করলাম।
ডাইনিং এ এসে দেখি শুধু ফুপু আর ফুপা বসে আছে। মন খারাপ করেই ডাইনিং এ ঢুকে টেবিলে বসলাম।

আফরিন:- মা ভাইয়া কই খাবে না?

ফুপু:- পরে খাবে নাকি, ওর খাবার ঘরে দিয়ে আসতে বলছে, ওর শরীরটা নাকি ভালো লাগছে না।

— মনে মনে ভাবছি ভালোই ঢং করতে শিখেছে। কেন কি হলো আবার উনার?

ফুপু:- বলতে পারছি না তুই খেয়ে ওর খাবারটা ঘরে দিয়ে আয়।

— আমি কেন দিয়া আসবো? আস্তো একটা অলস ঢাকায় থাকলেও ডেকে ডেকে খাবার খাওয়াতে হয়।

ফুপু:- ছেলেরা এমনি হয়। বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে যখন ঘরে বউ আসবে।

— বউ পাবে কোথায়? কে বিয়ে করবে ওকে।

ফুপু:- কি যে বলিস না, শিক্ষিত ছেলে দেখতে সুন্দর মেয়ের অভাব হবে নাকি?

— হবে হবে যখন মেয়ের পরিবার জানবে আস্ত একটা অকর্মা ছেলে, ঠিক মত যে নিজের যত্ন নিতে পারে না, সে বিয়ে করবে কি করে।

ফুপু:- সে তখন দেখা যাবে যখন বিয়ে হবে।

— আগেতো বিয়ে হয়ে নিক তারপর দেখবোনি।

ফুপা:- ভাবতাছি এবার তোর বাবা মা আর সোহানের বাবা মা আসলে বলবো তোদের দু’জনের জন্যও পাত্র-পাত্রী দেখবো।

— না না ফুপা প্লীজ এই কাজটা কইরেন না। তাহলে জীবন শেষ এমনিতেই ভালো আছি।

ফুপা:- আজ হোক কাল হোক তোদের সবারই বিয়ে হবে। আর মেয়েরা কখন যে বড় হয়ে যায় দেখতে দেখতে বুঝাই যায় না।

— টুকটাক কথা হচ্ছে আর ডিনার করছি কিন্তু কেমন জানি সব পানসে লাগছে সোহান নেই হয়তো সে জন্যই। অনেক কষ্ট করে প্লেটের খাবার গুলো শেষ করলাম। ফুপু প্লেটে খাবার বেড়ে দিয়ে বললো সোহানের জন্য নিয়ে যেতে। খাবার নিয়ে যাবো কি যাবো না ভাবতে ভাবতে প্লেট হাতে তুলে নিলাম। এক’পা দু’পা করে এগিয়ে চললাম সোহানের ঘরের দিকে। দরজার সামনে এসে কয়েকবার নক করলাম ভিতর থেকে কোন সারা শব্দ আসছে না। বুঝতে পেরেছি খুব রেগে আছে এখনো সোহান। বুঝে উঠতে পারছিলাম না খাবার নিয়ে চলে যাবো কিনা। আপুকে দিয়ে পাঠিয়ে দিবো। কিন্তু খাবার নিয়ে গেলেও ফুপু খারাপ ভাবে নিতে পারে ভাববে দু’জন ঝগড়া করেছি। ভাবতে ভাবতে দরজা ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো। টেবিলে খাবার গুলো রাখতে রাখতে আমি তোমার রুমে আসতে চাইনি কিন্তু ফুপু খাবার দিয়ে যেতে বললো তাই এসেছি। সোহান কোন কথা বললো না, তাই আবার বললাম তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো? সোহান কোন রকম নড়া চড়া করছে না দেখে সোহানের পিঠে হাত দিয়ে ধাক্কা দিতে যেয়ে বড় ধরণের একটা ধাক্কা খেলাম সোহানের শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। কি করবো বুঝতে পারছি না। আরও কয়েকবার ডাক দিলাম সোহান চোখ মেলে তাকালেও কোন কথা না বলে আবারও চোখ বন্ধ করে নিলো। কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ফুপুকে জানাবো কিনা ভাবতে ভাবতে রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম। রুমে এসে দেখলাম আফরিন আপু আকাশ ভাইয়ার সাথে কথা বলছে। সেখানে যেয়ে আপুকে বললাম তোমার রুমে কি জ্বরের কোন ঔষধ আছে?

আফরিন:- হ্যাঁ আছেতো কেন তোর কি জ্বর আসছে নাকি?

— আমার জ্বর আসেনি সোহান ভাইয়ার জ্বর আসছে।

আফরিন:- বলিস কি বেশী জ্বর আসছে নাকি ভাইয়ার?

— হ্যাঁ ভালোই শরীর গরম দেখলাম।

আফরিন:- ফোনের লাইন কেটে দিয়ে বলিস কি, তুই দাঁড়া আমি ঔষধ বের করে নিয়ে আসি বলেই বারান্দা থেকে রুমের ভিতর ঢুকে ঔষধ বের করে নিয়ে এসে দিতে দিতে চল আমিও তোর সাথে যাচ্ছি।

— দু’জন মিলে আবারও সোহানের রুমে আসলাম।

আফরিন:- ভাইয়া এই ভাইয়া শুনছো?

— সোহান এক বার চোখ মেলে তাকালেও কোন কথা বললো না।

আফরিন:- তুই এক কাজ কর বালতি ভরে পানি নিয়ে আয়। আর একটা তোয়ালে নিয়ে আয়।

— দ্রুত ওয়াশ রুম থেকে বালতিতে করে পানি আর তোয়ালে নিয়ে আসলাম। সেগুলো রেখে দু’জন মিলে সোহানের মাথাটা ঘুরালাম।

আফরিন:- একটা পলিথিন দে মাথার নিচে তারপর পানি দে।

— ঘরের ভিতর কোথাও পলিথিন পেলাম না।

আফরিন:- তাহলে আস্তে আস্তে পানি দে যাতে বিছানা না ভিজে। নয়তো আবার সারা রাত ভেজাতেই ঘুমাতে হবে।

— আস্তে আস্তে পানি দিতে শুরু করলাম। আপুকে বললাম তুমি চলে যাও রুমে জ্বর কমলে আমি রুমে চলে আসবো।

আফরিন:- আমি কি মা বাবাকে জানাবো?

— না না তাহলে তারা চিন্তা করবে আর এমন আছে ঢাকাতেও ফোন দিতে পারে। তখন সকলেই চিন্তা করবে আবার তার চেয়ে বরং আজ রাতটা দেখি, যদি না কমে তখন কাল সকালে ফুপাকে বলবো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে।

আফরিন:- ঠিক আছে আমি বলছি না, তবে যদি ভাইয়ার একটু ভালো লাগে তুই খাবার খাওয়াবি আর সাথে ঔষধটাও খাওয়াবি।

— তুমি চিন্তা করো না, আমি সব কিছু ঠিক মতই করবো।

আফরিন:- আচ্ছা তাহলে আমি যাচ্ছি।

— আপু চলে গেলো, আমি মাথায় পানি দিয়েই চলছি কিন্তু জ্বর কমছে না, তোয়ালে ভিজিয়ে মাথায় জলপট্টি দিতে শুরু করলাম। রাত গভীর থেকে গভীর হতে চলেছে অথচ সোহানের জ্বর কমার কোন নাম নেই। এদিকে দু’চোখের পাতা এক হয়ে আসছে বার বার। নিজের উপর নিজের খুব রাগ লাগছে, অযথাই ওকে রাগাতে যেয়ে এই বিপদ ডেকে এনেছি, ইচ্ছে করছে মারতে মারতে জিজ্ঞাসা করি একটু কষ্ট সহ্য করতে পারো না, তবে এতো কষ্ট কেন আমাকে দাও। শেষ রাতের দিকে সোহানের জ্বর অনেকটা কমে আসলো। সোহানের মাথাটা তোয়ালে দিয়ে মুছে দিয়ে গায়ে উপর ভালো করে চাদর জড়িয়ে দিলাম। এদিকে আমার দু’চো প্রায় বন্ধ হয় হয় অবস্থা, মনে হচ্ছিল আর এক মুহুর্তও চোখ খুলে রাখতে পারবো না। সোহানের মাথার সাথে নিজের মাথাটা লাগিয়ে দু’চোখ বন্ধ করে নিলাম। এক সময় পুরোপুরি ঘুমিয়ে গেলাম।

— সোহান দীর্ঘ সময় ধরে খুব আস্তে আস্তে ডেকে চলছে, শরীর এতোটাই দূর্বল যে জোড়ে ডাক ও দিতে পারছে না। ইকরা গভীর ঘুমে মগ্ন, সোহানের ডাক কোন ভাবেই পৌছাচ্ছে না ওর কানে। সোহান চোখ বন্ধ অবস্থাতেই একটু কাত হয়ে ইকরার মুখোমুখি হতেই, গরম নিঃশ্বাস লাগতে শুরু করলো ইকরার মুখে। অনেক কষ্টে সোহান একটা হাত ইকরার কাঁধ পর্যন্ত নিয়ে সোহান ধাক্কা দিতেই লাফিয়ে উঠে কি হলো কি হলো তোমার?

সোহান:- খুব আস্তে আস্তে পানি খাবো।

— টেবিলের উপর থাকা পানি গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে বললাম কিছু খাবে?

সোহান:- গ্লাসের পানি শেষ করে, মাথা ঝাঁকিয়ে না, তুই তোর রুমে যেয়ে শুয়ে পর, সকাল হয়ে গেছে আমার শরীর এখন ভালো আছে। দরকার হলে আমি ডাক দিবো।

— জানালা খুলে দিতেই শোঁ শোঁ শব্দ করে ঘরের ভিতর বাতাস প্রবেশ করতে শুরু করলো, সারা রাতের বৃষ্টির শেষে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে, দাঁরুণ লাগছে বাহিরের পরিবেশটা, বাতাসে খোলা চুল গুলো এলোমেলো হয়ে মুখের চারিদিক ছড়িয়ে পরলো। আমি সোহানের পাশে যেয়ে বসে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম চা খাবে আমি বানিয়ে নিয়ে আসবো? আর একটু ঔষধ ও তো খাওয়া লাগবে না হলে শরীর আরো খারাপ হতে পারে।

সোহান:- ঠিক আছে বানিয়ে নিয়ে আয়।

— গত রাতের খাবারের প্লেট গুলো হাতে করে নিয়ে সোহানের রুম থেকে বেরিয়ে রান্না ঘরের দিকে রওনা হলাম। প্লেট গুলো রেখে চুলায় পানি বসিয়ে দিলাম। পানি ভালো ভাবে গরম হতেই দুই কাপ চা বানিয়ে সাথে কয়েকটা বিস্কুট বাটিতে সাজিয়ে নিয়ে চলে আসলাম সোহানের রুমে। সোহান চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে দেখে বিছানার উপর ট্রে রেখে টেবিলটা টেনে আনতে যেয়ে টেবিলের উপর ছোট একটা সাদা কাগজ পেলাম। যেখানে বার বার করে লেখা খুব ভালোবাসি তোমাক। আমি কাগজটা সরিয়ে রেখে টেবিলটা টেনে খাটের কাছে নিয়ে চায়ের ট্রে তার উপর রেখে সোহানকে ডেকে তুললাম। সোহানের দিকে একটা চায়ের মগ এগিয়ে দিলাম আর একটা মগ আমি নিয়ে আবার সেই জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। সারা রাত ঘুম হয়নি শরীর প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগছে, চায়ের মগে চুমুক দিচ্ছে আর ভাবছি এই লেখা গুলো কাকে লেখছে ও? আমাকে নাকি অন্য কাউকে? ভাবনাটা বেশী দূর এগিয়ে নিতে পারলাম না। দরজার সামনে থেকে ফুপুর ডাক শুনে ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেলাম ফুপু দরজা ঠেঁলে ঘরের ভিতর প্রবেশ করছে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here