শেষ বিকেলের রোদ-২০ তম পর্ব
©শাহরিয়ার
— নাস্তার পর্ব শেষ হতেই আফরিন আপু আমাকে ডাক দিয়ে বললো আয়তো আমার সাথে রুম গুলো গুছিয়ে দেই। আমি সোহানের দিকে তাকিয়ে চোখ দু’টো বড় বড় তাকাতেই সে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আমরা দু’জন রুম থেকে বের হয়ে গেস্টদের জন্য রুম গুলো গুছাতে শুরু করলাম। ঘর গুছাতে গুছাতে আপু প্রশ্ন করলো
আফরিন:- কাল এতো রাত পর্যন্ত বাহিরে কি করেছিস?
— কত রাত পর্যন্ত?
আফরিন:- আমিইতো প্রায় সাড়ে বারোটা পর্যন্ত জেগে ছিলাম তারপর আর কত রাত বাহিরে ছিলি আমি কি করে বলবো।
— আপুকে জড়িয়ে ধরে পুকুর ঘাটে বসে ছিলাম তোমার ভাইয়ের সাথে। গতরাতটা ছিলো আমার জীবনের সব চেয়ে সেরা রাত।
আফরিন:- মানে কি? কিছু করছিস নাকি?
— আরে ধুর কে যে বলো না তুমি, কাল রাতে তোমার ভাই আমাকে প্রপোজ করছে।
আফরিন:- শক্ত করে চেপে ধরে সত্যি?
— হ্যাঁ আপু সত্যি বলছি।
আফরিন:- বাহ তাহলেতো হয়েই গেলো, খুব তাড়াতাড়ি তোদের বিয়েটাও খেতে পারবো মনে হচ্ছে।
— আগেতো তোমারটা খাই তারপর আমারটার চিন্তা, আগেতো চিন্তা করতাম কি করে সোহানের ভালোবাসা পাবো আর এখন চিন্তা হচ্ছে এই ভালোবাসা সারা জীবন আগলে রাখতে পারবোতো?
আফরিন:- কি সব উল্টাপাল্টা কথা, কেন পারবি না শুনি?
— আসলে আপু, বাবা মাকে কোন না কোন ভাবে মানানো যাবে। কিন্তু বড় চাচা আর চাচীকে কোন ভাবেই হয়তো মানানো যাবে না। সব চেয়ে বড় কথা আমাদের রিলেশনের কথা যদি বাবা মা জানে তবে খুশি হবে। আর বড় চাচা চাচী জানলে ভয়ংকর রকম রাগ করবে। কেন জানি তারা সোহানকে দেখতে পায় না।
আফরিন:- আরে ঐসব কিছু না, দেখবি জানলে পরে সব ঠিক হয়ে যাবে।
— হ্যাঁ আপু দোয়া কইরো তাই যেন হয়। আসলে ওর একটা চাকরি থাকলে আমার এতো টেনশন লাগতো না।
আফরিন:- বুঝছিরে দেখ তুই কোন চিন্তা করিস না দেখবি সব ভালোই ভালো হবে।
— আচ্ছা আপু তুমি ঘরে যাও আমি ওর রুম থেকে বই দু’টো নিয়ে আসি।
আফরিন:- আচ্ছা তাড়াতাড়ি আছিস, তোরতো ভাইয়ার রুমে গেলে আর আসতে ইচ্ছেই করে না।
— শুধু শুধু আমাকে দোষ না দিয়ে, তোমার ভাইটাকেও একটু মানুষতো করতে পারো। সে যদি তার রুম থেকে না আসতে দেয় তাহলে আমি কি করে আসবো?
আফরিন:- হয়েছে হয়েছে সবই বুঝি আগে আমার বিয়ের ঝামেলাটা শেষ হোক তারপর তোদেরটা দেখতাছে।
— থাক থাক তুমি বরং এখন ফোনে আকাশ ভাইয়ার সাথে কোন এক রোমান্টিক শহরে হারিয়ে যাও। বলতে বলতে রুম থেকে বের হয়ে সোহানের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম, বারান্দায় এসে বুঝতে পারলাম পুরো আকাশ মেঘে কালো হয়ে গিয়েছে যে কোন মুহুর্তে বৃষ্টি নামবে। আমি তাড়াতাড়ি পা বাড়ালাম সোহানের রুমের উদ্দেশ্যে। দরজার সামনে যেয়ে নক করতেই সোহান বললো ভিতরে যাবার জন্য। আমি ভিতরে ঢুকতেই সোহান কিরে কিছু বলবি? তুমি আমাকে তুই তুই করে কেন বলছো?
সোহান:- তো কি আপনাকে আপনি আপনি করে বলতে হবে নাকি?
— মানে কি তুমি আমার সাথে এমন করে কেন কথা বলছোে আমি কিন্তু কান্না করে দিবো।
সোহান:- এই আমার সামনে নেকি কান্না করবি না। কেন এসেছিস তা বল।
— আচ্ছা ভালোবাসার মানুষকে কি কেউ তুই করে বলে?
সোহান:- তো তুই আমার ছোট তোকে কি আপনি করে বলবো?
— ধ্যাত আমি কি বলছি তুমি আমাকে আপনি করে বলো, একটু আদুরে তুমি করেওতো বলতে পারো।
সোহান:- কান টেনে ধরে ওরে আমার তুমিটারে, নাক বুচি ফুলটুসি কোথাকার ওরে নাকি তুমি করে বলতে হবে।
— উফ ছাড়ো ব্যথা লাগছে তোমার আমাকে তুমি করে বলতে হবে না, দেশে কত মানুষ আছে আমাকে তুমি করে বলার জন্য।
সোহান:- কথাটা শোনার সাথে সাথেই ধাক্কা মেরে খাটের উপর ফেলে দিয়ে, দু’হাত দিয়ে দু’হাতের কব্জি চেপে ধরে কতজন আছে শুনি তুমি করে বলার জন্য।
— বাহিরে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে, টিনের চালায় টপটপ শব্দে বৃষ্টির পানি পড়ছে। হঠাৎ করেই কারেন্ট চলে যাওয়ায় পুরো রুম অন্ধকার হয়ে এলো। সোহানের হাত থেকে একটি হাত ছাড়িয়ে ওর কলারটা টান দিয়ে ধরে মুখটা ওর কানের কাছে নিয়ে ভিজবে আমার সাথে? সোহানের মুখ থেকে কোন কথা বের হচ্ছে না ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ হচ্ছে। আমি প্রশ্ন করলাম ভিজবে?
সোহান:- উঠার চেষ্টা করতে করতে না জ্বর এসে যাবে কাল বাদে পরশু বিয়ে। এখন জ্বর বাধানো যাবে না, তোর যত ইচ্ছে হয় ঢাকায় যেয়ে ভিজবি।
— বলেই উঠার চেষ্টা করতেই হাত দিয়ে কলার টেনে রাখার কারণে উঠতে পারলো না, বরং ঠোঁটের উপর এসে পরলো সোহানের ঠোঁট জোড়া। নিজের মানুষ ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে নিজেকে সামলে রাখা সত্যিই খুব কষ্ট কর। নিজেকে কখনো কখনো শত বাঁধা দিয়েও আটকে রাখা যায় না। সোহানের ভারী নিঃশ্বাসে আমার সমস্ত শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছিলো। সমস্ত শক্তি দিয়ে সোহানকে বিকের সাথে লেপ্টে নিতেই, দরজার সামনে কারো পায়ের শব্দ পেলাম। দ্রুত সোহানকে ছেড়ে দিয়ে দু’জনেই উঠে দাঁড়ালাম। যে এসেছিলো সে চলে গিয়েছে, আমি সোহানকে বললাম বই দাও।
সোহান:- ফোনের ফ্লাস জ্বালিয়ে টেবিলে ড্রয়ার খুলে বই দু’টো বের করে হাতে দিয়ে ফুলটুসি ভালোবাসি।
— আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি এখন যেতে দাও আপু জানে আমি তোমার রুমে এসেছি আর এতো সময় একটা ঘরে থাকা অনেকেই খারাপ চোখে নিবে। যদিও আপু জানে আমরা একজন আরেকজনকে অনেক ভালোবাসি, কিন্তু বাকিরাতো আর তা জানে না।
সোহান:- আচ্ছা যাবি যা কিন্তু যাবার আগে একটা দিয়ে যা না?
— কি দিবো বলতেই কারেণ্ট চলে আসলো আমি সোহানের নাকের উপর লিপিস্টকের দাগ দেখে হাসতে শুরু করলাম।
সোহান:- এমন করে হাসতেছিস কেন?
— তুমি যা চাইসো তা তোমার নাকের উপর লেগে আছে, ঐখান থেকেই নিয়ে নিও বলে দৌঁড়ে রুম থেকে বের হয়ে এলাম। রুমে এসে আপুকে না দেখে মনে মনে বললাম বেঁচে গেছি। বই দু’টো টেবিলের উপর রেখে ফ্রেস হবার জন্য ওয়াশ রুমে ঢুকে পরলাম। ওয়াশ রুমে ঢুকার পর পরই আপুর ডাক শুনতে পেলাম। ভিতর থেকে উত্তর দিলাম।
আফরিন:- তাড়াতাড়ি বের হো মা ডাকছে।
— আসছি তুমি যাও, আপু চলে যেতে তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে রেডি হয়ে রুম থেকে বের হয়ে ফুপুর রুমের দিকে রওনা হলাম। রুমে ঢুকতেই ফুপু কাছে ডেকে বসালেন, আমার কিছুটা ভয় আর শরম লাগতেছিলো এটা ভেবে যে ফুপু কি সে সময় সোহানের রুমের সামনে গিয়েছিলো নাকি? এক প্রকার লজ্জা পেয়েই মাথা নিচু করে ফুপুর সামনে বসে আছি।
ফুপু:- কিরে মা তোর কি মন খারাপ?
— কই নাতো ফুপু কেন ডাকছো বলো?
ফুপু:- কালতো গায়ে হলুদ, বিকেলে তুই সোহান তোর ফুপা আর উনার ভাই বোনের ছেলে মেয়েরা মিলে যেয়ে গায়ে হলুদের শাড়ি আর পাঞ্জাবী কিনে নিয়ে আসবি তাই তোকে আসতে বলেছি।
— মনে মনে একটা দীর্ঘশাস্ব ছেড়ে যাক বাবা বাঁচা গেলো ফুপু তাহলে কিছুই বুঝেনি। আমি মাথা নাড়িয়ে ফুপুর কথায় সম্মতি দিলাম। এরপর তিনজন মিলে অনেকটা সময় গল্প করলাম। তখনো মুশুলধারে বৃষ্টি হচ্ছে, আর আমরা তিন জন নানান রকম গল্প করে চলেছি। ফুপু আপুকে বুঝাচ্ছে বিয়ের পর মেয়েদের কিভাবে মানিয়ে নিতে হয় ফুপু কিভাবে মানিয়ে নিয়েছে, এমন সব বিষয়ে ফুপু আপুকে বলছে সেই সাথে কথা গুলো আমাকেও বলছে। আপু গভীর মনোযোগে ফুপুর কথা শুনলেও আমি তার কথায় কেন জানি মনোযোগ দিতে পারছি না। আমার খুব চিন্তা হচ্ছে এখন সোহানকে নিয়ে একরোখা মানুষ সে। কারো কোন কথাই শুনবে না। নিজের মত চলবে এই অবস্থায় পরিবারকে ওর কথা জানানোরও কোন উপায় নেই। দীর্ঘসময় ফুপুর সাথে সময় কাটালাম। আপুকে সঙ্গে নিয়ে রুমে ফিরে আসলাম। বৃষ্টি অনেকটাই কমে এসেছে।
আফরিন:- কিরে তখন থেকে দেখছি তুই কি যেন ভাবছিস।
— কিছু না আপু, তুমি কি কোথাও বের হবে নাকি?
আফরিন:- আমি একা না তুই ও আমার সাথে বেন হবি।
— কোথায় যাবে?
আফরিন:- বেশী দূর না নাস্তা ছেড়ে পাশেআ যাবো আমার বান্ধবির বাসায় ওর সাথে কিছু কথা আছে বলতে বলতে আপু রেডি হয়ে নিলো। দু’জন চলে আসলাম ডাইনিং এ সেখানে সবাই বসে আছে, অল্প সময়ের ভিতর সোহানও এসে আমার সামনের চেয়ারে বসলো। সোহান এক মনে আমার দিকে চেয়ে আছে। দেখে টেবিলের নিচ দিয়ে ওর পায়ে পা দিয়ে খোঁচা দিলাম। ইশারায় প্রশ্ন করলাম অমন করে তাকিয়ে আছে কেন?
সোহান:- মাথা নেড়ে বুঝালো কিছু না।
— মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া আপুর কাজিন সোহানের দিকে চেয়ে আছে দেখে অনেকটা বিরক্ত লাগছিলো। মেয়েটাকে মনে মনে অনেক গুলো গালি দিলাম, জীবনে মনে হয় ছেলে মানুষ দেখে নাই কেমন করে তাকিয়ে আছে বেহায়ার মত। নাস্তার পর্ব শেষ হতেই সকলে বের হলাম। আপু আর আমি বাড়ি থেকে বের হচ্ছি এমন সময় পেছন থেকে ডেকে সোহান জিজ্ঞাসা করলো কোথাও যাচ্ছি কিনা।
আফরিন:- হ্যাঁ ভাইয়া একটা বান্ধবির বাসায় যাচ্ছি তুমি যাবে?
সোহান:- তোর বান্ধবির বাসায় যাবো না তবে আমিও একটু হেঁটে আসি। বাসায় বসে থাকতে থাকতে বোরিং হয়ে গিয়েছি।
— মনে মনে খুশিই হলাম ঐটা ফ্রেমের চশমা পড়া মেয়েটার সামনে থেকেতো দূরে থাকবে সোহান।
সোহান:- কিরে ফুলটুসি কিছু ভাবছিস নাকি?
— কই নাতো কিছু ভাবছি না বলে সোহানের দিকে তাকালাম।
আফরিন:- আর বলো না ভাইয়া ও কি জানি ভাবে কিন্তু জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দেয় না। বলে শুধু কিছু না।
সোহান:- কি জানি তোর বোনের কই হইছে তুই খুঁজ নিয়ে দেখ, আমি আর কি বলবো।
আফরিন:- তোমাদের সমস্যা তোমরা বুঝ আমি আর কারো কাছে কিছু জানতে চাইবো না।
— উফ কি শুরু করলা তোমরা চলোতো যাই, কিছু হলেতো আমি বলবো যে আমার কিছু হইছে। কথা বলতে বলতে এগিয়ে চললাম আপুর বান্ধবির বাসার দিকে।
চলবে..