শেষ বিকেলের রোদ- ২৫তম পর্ব
©শাহরিয়ার
— সোহান হাত ধরে হাঁটতে শুরু করলো, আমি সোহানের দিকে তাকিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করলাম।
সোহান:- এমন করে আমার দিকে না তাকিয়ে থেকে সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁট নয়তো পরে যাবি।
— পরবো না তুমি ধরে রেখেছো না? কি করে পরবো। আজ তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।
সোহান:- উহু তোকে খুব সুন্দর লাগছে ঠিক যেন আসমানের পরী মাটিতে নেমে এসেছে।
— ইস ঢং করো নাতো, কি সব বলো না তুমি।
সোহান:- সত্যি বলছি, আজ সব ছেলেরা তোর পিছু লাগবে রে।
— কথা বলতে বলতে সকলের সাথে যেয়ে যোগ দিলাম, গায়ে হলুদে যাবার জন্য দু’টো গাড়ি আনা হয়েছে ছেলেদের জন্য একটা আর মেয়েদের জন্য একটা গাড়ি, সোহান ছেলেদের গাড়িতে আর আমি যেয়ে মেয়েদের গাড়িতে বসলাম। আপুর কাজিনরা আর রুমি আপুরা এ গাড়িতে বসেছে।
রুমি:- ইস আমার মনেই ছিলো না ফুলের কথা, তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে ইকরা।
— ধন্যবাদ আপু তোমাদেরকেও খুব সুন্দর লাগছে,
ফারিয়া:- আপুর সেই মোটা ফ্রেমের চশমা পরা কাজিন, কোথায় পেলে ফুল? ইস আমাদের জন্যও নিয়ে আসতে।
— হুম ভুল হয়ে গেছে সোহানকে বলার দরকার ছিলো তোমাদের জন্যও নিয়ে আসতে। আসলে ব্যস্ততার মাঝে কি আর এতো কিছু মনে থাকে বলো।
ফারিয়া:- ওহ সোহান ভাই এনে দিয়েছে?
— হ্যাঁ ওইতো এনে দিলো। কথা বলতে বলতে গাড়ি এগিয়ে চলছে আকাশ ভাইয়াদের বাড়ির পথে, এদিকে ফারিয়া মুখ ভার করে বসে আছে, দেখে মনে হচ্ছে খুব কাছের কারো সাথে প্রচণ্ড রকম ঝগড়া হয়েছে যার কারণে এমন ভাবে বসেছে, রুমি আপুদের সাথে গল্প করতে করতে এক সময় আমাদের দু’টো গাড়িই ঢুকে পরলো আকাশ ভাইয়াদের বাড়ির ভিতর। বিশাল বড় বাড়ি বিশাল জায়গা জুড়ে লাইটিং করা হয়েছে। মিউজিক বেজে চলেছে, আমরা গাড়ি থেকে নামতেই আকাশ নীলা আরও কয়েকজন এগিয়ে এসে আমাদের স্বাগতম জানিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকালো।বিশাল বড় করে স্টেজ বানানো হয়েছে, সেখানেই বসে আছে আকাশ ভাইয়া। তার চারিপাশে বন্ধুবান্ধব আত্মীয় স্বজনরা ঘিরে রেখেছেন। একে একে সকলে এগিয়ে গেলো হলুদ দেবার জন্য আমি ছবি তুলছি প্রচণ্ড ভীর লেগে গেছে সেখানে, হঠাৎ করে কাপড়ের ভিতর দিয়ে পেটের উপর কারো স্পর্শে কেঁপে উঠি। মনে করি যে সোহান দুষ্টমি করছে, কিন্তু ঘুরে তাকাতেই চমকে উঠি, অপরিচিত কেউ একজন যাকে এর আগে কখনোই দেখি নি, হাতে হলুদ লাগানো। আমি কিছুটা বিরক্ত হয়েই তাকে বললাম কি সব অসভ্যতা করছেন।
— খিলখিল করে হাসতে হাসতে লোকটা বললো বিয়ে বাড়িতে এমটা হবেই সুন্দরি মেয়েদের সাথে, চলো নিরিবিলি কোথাও যাই অনেক মজা হবে।
— তার এমন নোংড়া ইঙ্গিতে মনে চাচ্ছিলো পা থেকে জুতা খুলে সোজা গালে চালিয়ে দিতে, কিন্তু লোক লজ্জার ভয়ে তা না করে তাকে সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম। তাকে বললাম এ নোংড়া কথা বন্ধ করে সেখান থেকে চলে যেতে।
— রাগী রাগী ভাব নিয়ে তোমার খুব দেমাগ দেখছি, এখুনি সব ভেঙে চূরমার করে দিচ্ছি, বলেই হলুদ মাখা হাত নিয়ে এসে মুখের সামনে ধরতেই, সোহান কোথা থেকে এসে দু’হাত চেপে ধরলো।
সোহান:- হাত দু’টো মোচড় দিয়ে খুব সখ মেয়েদের গায়ে হলুদ দেবার?
— ছেড়ে দে না হলে খুব খারাপ হবে তোর।
— লোকটার মুখ থেকে প্রচণ্ড রকম বাজে গন্ধ বের হচ্ছিলো। মনে হচ্ছে লোকটা নেশা করেছে, আমি সোহানের দিকে তাকিয়ে বললাম ছেড়ে দাও।
সোহান:- এক হাত ছেড়ে দিয়ে লোকটার মুখ বরাবর প্রচণ্ড জোড়ে থাপ্পর মেরে দিয়ে কি খারাপ করবি বল?
— চিৎকার চেঁচামেচিতে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেলো। সবাই জিজ্ঞাসা করছে কি হয়েছে কি হয়েছে, এমন সময় ঐ লোকটাই চিৎকার করতে করতে বললো, একটুইতো হাত দিয়েছি বেশী কিছুতো করিনি, তবে সুযোগ পেলে ছাড়বো না। লোকজনের আর বুঝতে বাকি রইলো না ঘটনা কি ঘটেছে। আমি সকলের সামনে মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করেছি। আরমান ঐ লোকটাকে মারতে মারতে সেখান থেকে বের করে দিলো। আকাশ ভাইয়া স্টেজ থেকে নেমে এসে ক্ষমা চাইলো।
সোহান:- আরে এ কি করছো? তোমার কোন দোষ নেই, আর উনি নেশায় ছিলো নেশার মাঝে নিজের সেন্স হারিয়ে এমনটা করেছে।
— সোহান আমাকে নিয়ে সাইডে চলে আসলো, ঐ বাড়িতে হলুদের পর্ব শেষ হতেই আমরা রওনা হলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। গাড়িতে উঠার সময় সোহান সবাইকে বলে দিলো এ বাড়িতে যা হয়েছে তা যেন ঐ বাড়িতে কাউকে না জানাই, বিয়ে বাড়িতে অশান্তি সৃষ্টি হবে। গাড়িতে বসে থাকতে থাকতে আকাশ ভাইয়া আর আরমান ও দু’বার করে ফোন দিয়েছে, এবং বার বার দুঃখ প্রকাশ করেছে। সকলে বাড়িতে চলে আসলাম, দুমদাম মিউজিক বাজছে বাড়িতে, মুরুব্বিদের ভিড় সব কিছুর মাঝ দিয়ে নিজের রুমে চলে এসে দরজা লাগিয়ে দিয়ে সোজা ওয়াশ রুমে চলে আসলাম। মুখ চেপে ধরে কান্না করে দিলাম। কোথায় থেকে কি হলো বিয়ে বাড়িতে এমন জগন্য একটা ঘটনা ঘটে যাবে কোন ভাবেই ভাবতে পারি নাই। ফ্রেস হয়ে ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে আসলাম। আসতেই আপুকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখলাম।
আফরিন:- কিরে কেমন মজা করলি ঐ বাড়িতে?
— মুখে মিথ্যা হাসি ফুটিয়ে তুলে হুম আপু অনেক মজা করেছি, ইস গ্রামে না আসলেতো জানতেই পারতাম না বিয়ে বাড়ি গুলোতে এতো মজা হয়।
আফরিন:- আর তোর দুলাভাইকে কেমন দেখলি? ছবি তুলিস নাই নাকি?
— ওহ দুলাভাইতো পুরো হিরোর মত ছিলো, মেয়েনা যে ভাবে ঘিরে রেখেছিলো চারিদিক থেকে তুমি দেখলে হিংসেয় মরে যেতে।
আফরিন:- থাক থাক আমার এতো হিংসা করে মরে মরার দরকার নেই, দেতো দেখি এখন কি কি ছবি তুললি।
— ওহ হ্যাঁ এই নাও ফোন, তুমি ছবি দেখো আমি সবার সাথে দেখা করে আসি বলে ফোনটা আপুর হাতে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসলাম। বাবা মাকে খুঁজতে বের করলাম।
বড় চাচী:- কিরে ইকরা তোর মুখটা এতো শুকনো দেখাচ্ছে কেন?
— কই আমিতো ঠিকই আছি, জার্নি করে এসেছি তাই হয়তো এমন লাগছে।
বড় চাচী:- না নিশ্চই কিছু হয়েছে, সোহান কিছু বলেছে? শুধু আমাকে একবার বল, এই বিয়ে বাড়ি থেকেই ওকে বের করে দিবো।
— বড় চাচীর গলা জড়িয়ে ধরে উহু ও আমাকে কিছুই বলেনি, সত্যি বলছি তোমার ছেলে এখানে আসার পর আমাকে একটুও জ্বালায়নি, বরং অনেক অনেক কেয়ার করেছে।
বড় চাচা:- কই তোমরা বাড়িতে কত কাজ আর তোমরা এখানে বসে গল্প করছো, ইকরা তোর শরীর ভালো না যা মা গিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে নে।
— সকলে রুম থেকে বের হয়ে যেতেই আমিও রুম থেকে বেরিয়ে আমার রুমের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। প্রচণ্ড মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেলো। চারিদিকটা অন্ধকার হয়ে আসছে মনে হচ্ছে যে কোন মুহুর্তে পরে যাবো, অনেক কষ্টে হেঁটে রুমে যেয়েই বিছানায় শুয়ে পরলাম।
আফরিন:- কিরে ঘুমিয়ে পরবি নাকি?
— চোখ বন্ধ অবস্থাতেই আপু আমার ভালো লাগছে না।
আফরিন:- তোর কি হয়েছো বলেই কপালে হাত দিয়ে একিরে তোরতো আবার জ্বর এসেছে ইস ডাক্তারের দেয়া ঔষধ গুলোও খাসনি। আমি পানি নিয়ে আসছি তুই শুয়ে থাক ঔষধ গুলো খেয়ে ঘুমাবি।
— অল্প সময়ের ভিতর আপু পানি আর ঔষধ আমার দিকে এগিয়ে দিলো। আমি ঔষধ খেয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পরলাম। একটা সময় ঘুমিয়ে পরলাম। সকালে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি মা পাশে বসে আছে। আমি উঠে বসতে বসতে জিজ্ঞাসা করলাম কখন এলে তুমি?
মা:- সারা রাত এ ঘরেই ছিলাম তুইতো বেহুশ হয়ে ছিলি, আর আমরা সারা রাত জেগে তোর মাথায় পানি দিয়েছি, শরীর মুছে দিয়েছে। ইস কি যে ভয় পেয়েছি, তার উপর বাহিরে যাবার মত কোন অবস্থাই ছিলো না, সারা রাত কি বৃষ্টিটাই না হয়েছে।
— চিন্তা কইরোনাতো মা আমি এখন পুরোপুরি সুস্থ আছি দেখছো না।
সোহান:- ঘরে ঢুকতে ঢুকতে তাড়াতাড়ি নাস্তা করে নে, পার্লারে যেতে হবে আফরিনকে নিয়ে সেই সাথে তোকেও ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে আসবো।
— আমি যেয়ে কি করবো তুমি সাথে গেলেইতো হবে।
সোহান:- বেশী কথা বলিস নাতো আমি কি পার্লারের ভিতর ঢুকবো নাকি? মেয়ে মানুষ তুই ঢুকবি তাছাড়া তোকেওতো টুকটাক রেডি সাজতে হবে আজ পার্লার থেকে। সব চেয়ে বড় কথা বাহির থেকে ঘুরে আসলে মন ভালো হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি নাস্তা করে কোন শাড়ি পরবি নিয়ে বের হয়ে নে। বলে সোহান বের হয়ে গেলো রুম থেকে,
— আম্মুও বললো সোহান ঠিকই বলেছে তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে নাস্তা করে ঔষধ খেয়ে যা পার্লার থেকে ঘুরে আয়। আমি উঠে ফ্রেস হয়ে নাস্তা করে এসে ঔষধ খেয়ে ব্যাগ থেকে নীল রঙের শাড়িটা বের করলাম আর সোহানের জন্য কেনা পাঞ্জাবীটা এক বার বুকে জড়িয়ে আবার ব্যাগের ভিতর রেখে রুম থেকে বের হলাম। আপু আর সোহান আগে থেকেই রেডি হয়ে বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিলো আমাকে দেখে সোহান বলতে শুরু করলো তাড়াতাড়ি চল বাহিরে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, আল্লাহ জানে কয় ঘন্টা লাগবে তোদের রেডি হতে ইস বসে বসে আমিতো বোরিং হয়ে যাবো।
আফরিন:- কেন কেন বোরিং হবে তুমি বরং বাহিরে এসে ঘুরবে ফিরবে মেয়েদের সাথে ইটিস পিটিস করবে।
সোহান:- থাক সাথেই দু’টো সুন্দরি আছে আর কয়টা লাগে শুনি?
— কথা বলতে বলতে গাড়িতে উঠবো এমন সময় কেউ একজন বলে উঠলো দাঁড়াও দাঁড়াও। সকলে এক সাথে পেছনে ফিরে তাকাতেই আমি চমকে গেলাম।
চলবে..