আপনাদের তিন বছরের একটা মেয়ে আছে তবু ও কেন ডিভোর্স নিতে চাইছেন ?
,
সামনে বসা উকিলের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে বললাম ,
– আমার স্বামীর অবৈধ সম্পর্ক আছে ।
– আমার কিন্তু মনে হয় না আপনার স্বামী এমন কিছু করতে পারেন ।
– তাকে আমি ভাল করে চিনি। সে কতোটা অমানুষ আমার থেকে আপনি ভাল করে জানেন না।
– দেখুন মিসেস অরিত্রা , আমি কিন্তু আপনাদের পারিবারিক উকিল । আপনার শশুরের সাথে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব । আমার মনে হয় আপনি ভুল করছেন । আরো কিছুদিন ভেবে দেখুন ।
– ঠিক আছে আপনি যদি না পারেন আমি অন্য উকিল ধরতে বাধ্য হবো।
– আপনার কি মনে হয়না ! বাচ্চাটা বাবা ছাড়া হলে সমাজ ভালো চোখে দেখবে ।
– আমি সমাজের ধার -ধারিনা। এই সমাজ আমাকে কি দিয়েছে। শুধু লাঞ্ছনা আর অপমান ।আমার এটাই চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত ।
এই বলেই উকিলের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলাম। আমি অরিত্রা সাধারণ ঘরের মেয়ে । বাবা মায়ের পছন্দ করা ছেলের সাথে বিয়ে হয়। দেখতে দেখতে বিবাহিত জীবন কেটে যেতে লাগলো। বিয়ের ঠিক দু বছর পর একটা রাজকন্যা এলো কোল জুড়ে । আমার স্বামী আয়ান । খুব বড়ো বিজনেস ম্যান । গভীর জলের মাছ সে। তাইতো সমাজে কোটিপতিদের একজন হতে পেরেছে খুব সহজেই ।
যতো দিন যেতে লাগলো তাঁর ভিতরে অহঙ্কার বাড়তে লাগলো। রাত করে বাসায় আসা এটা যেন রোজকার রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে । সে দিন রাতের কথা । রাত চারটা বাজতে গেছে আয়ান এখনও ফিরেনি। আমি দীপ্তি কে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ।হঠাত্ করে ঘুম ভেঙে যেতে বুঝতে পারলাম আয়ান এখনও ফিরেনি।
ভয় ভয় করতে লাগলো। কোনও বিপদ হলো নাতো। ফোন করছি কিন্তু ধরছে না। ভয়টা আরো কঠিন রুপ ধারণ করতে লাগলো। কোনও কিছু না ভেবেই দীপ্তি কে রেখে চলে গেলাম শশুরের ঘরের দিকে । যদিও জানি এতো রাতে উনাদের ডাকা ঠিক হবে না তবু ও দরজায় টোকা দিতে ভিতর থেকে বললো ,
– কে এতো রাতে ?
– বাবা আমি অরিত্রা ।
ভিতর থেকে শশুর শাশুরি দরজা খুলে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো । উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো ,
– বউমা তুমি এতো রাতে ? কি হয়েছে আয়ান কোথায় ?
– বাবা ও এখনও আসেনি। ফোন ও ধরছে না। আমার খুব টেনশন হচ্ছে ।
– ও মাই গড। কি বলো এই সব। ভোর হতে চলেছে ও এখনও আসেনি। আমাকে আগে ডাকোনি কেন।
– বাবা আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম এখন ঘুম ভেঙে যেতে বুঝতে পারলাম ও আসেনি।
– ঠিক আছে তুমি চিন্তা করোনা আমি দেখছি কি করা যায় ।
ঠিক এমন সময় আয়ান বাসায় ফিরলো। চোখ দুটি জবা ফুলের মতো লাল টকটকে হয়ে আছে । শশুর কিছু বলার আগেই ও বললো ,
– বাবা সরি , অফিসে কিছু জরুরি কাজ ছিল তাই এতো লেট হয়ে গেছে বাসায় আসতে। যাও তোমরা শুয়ে পড়ো।
– আয়ান তুমি ফোন করে ব্যাপারটা অরিত্রা কে জানাতে পারতে ।
এরকম ভুল সামনে করবে না। কথাটা মনে থাকে যেন ।
এই বলেই শশুর শাশুরি শোবার ঘরে চলে গেলেন । আয়ান এসেই শুয়ে পড়লো। আমি ওর কাছে গিয়ে বললাম ,
– রাতে কিছু খেয়েছো ?
– বাইরে থেকে ডিনার সেরে নিয়েছিলাম ।
– তুমি জানো আমি কতো টেনশন করেছিলাম । একটা ফোন দিয়ে জানাতে পারতে ।
– অরিত্রা আমি টায়ার্ড, প্লিজ এখন আমার ঘুম দরকার ।
এই বলেই অন্য দিকে মুখ করে ঘুমিয়ে গেল । আমি ও কিছু না বলে শুয়ে পড়লাম ।
পরদিন অনেক বেলা করে ঘুম ভাঙে আয়ানের । ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে দীপ্তি কে নিয়ে খেলতে লাগলো। আমি কাছে গিয়ে বললাম ,
– আজ তুমি ফ্রি আছো?
– কেন ?
– দীপ্তির জন্য কিছু কেনাকাটা করতে হবে । অনেক দিন আমরা বাইরে ডিনার করিনা চলো আজ বাইরে ঘুরে ও আসা যাবে ।
– অরিত্রা , আমার বিকালে একটা মিটিং আছে । তুমি একাই চলে যাও। আমি অন্য একদিন যাবো।
– না আজই তোমার যেতে হবে । আয়ান তুমি দিন দিন বদলে যাচ্ছো ।আমার জন্য তোমার এখন কোনও সময় নেই।
– আমার নতুন বিজনেস ।কেন তুমি বুঝতে চাইছো না। শপিং করতে যতো টাকা লাগে তুমি নিয়ে যাও। প্লিজ আমার সময় নেই কোথাও যাওয়ার ।
,
এই বলেই হনহন করে উঠে চলে গেল । আমি ওর এমন বিহেভ দেখে হতবাক হয়ে বসে রইলাম । আয়ান অনেক বদলে যাচ্ছে অনেক । একটা অজানা ভয়ে বুকটা দুরুদুরু করতে লাগলো।
,
সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আয়ান তড়িঘড়ি করে অফিসে চলে গেল । এতোটাই ব্যস্ত ছিল যে ফোন নিতে ভুলে গেল । আমি রান্না ঘরে ছিলাম । দীপ্তি কে নিয়ে শশুর শাশুরি নিজেদের ঘরে । হঠাত্ করে আমার কানে আয়ানের ফোনের শব্দ কানে এলো। ঘরে আসতেই দেখি ওর ফোন । হয়তো কেউ জরুরি কল করছে ।
,
হঠাত্ একটা বুদ্ধি মাথায় এলো। ফোন নিয়ে আয়ানের অফিসে গেলে কেমন হয়। ওকে না বলেই সারপ্রাইজ দেওয়া যাবে ।
তৈরি হয়ে শাশুরির ঘরে গিয়ে বললাম ,
– মা , আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। এখনই ফিরে আসবো।
– হঠাত্ করে কোথায় যাবে বউমা ?
– আয়ানের ফোন টা রেখে গেছে । বার বার কল আসছে । হয়তো কোনও জরুরি কল।
– ঠিক আছে যাও। দাদুভাইকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমরা আছি তো।
,
আমি ড্রাইভার কে গাড়ি বের করতে বললাম । সত্যি আমার ভাগ্য ভাল যে এমন শশুর শাশুরি পেয়েছি । আমাকে কতো কেয়ার করে দুজন মানুষ । গাড়ি আয়ানের অফিসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে । ভিষন ভাল লাগছে আজ। আয়ান আমাকে দেখে কি করবে মনে পড়লেই হাসি পাচ্ছে । হয়তো অবাক হয়ে যাবে এভাবে দেখে ।
,
অফিসের ভিতরে ঢুকে আয়ানের রুমের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম । সামনে ওর পি এর রুম। মেয়েটা দেখতে ভিষন সুন্দরী । ইচ্ছে করে তাকিয়ে থাকি অনেক সময় । আজ আবার শাড়ি পরে এসেছে অসম্ভব সুন্দর লাগছে । আমি কাছে যেতেই হেসে দিয়ে বললো ,
,
– কেমন আছেন ম্যাম?
– ভাল আছি মোনা। তুমি কেমন আছো ?
– জী ভাল । কিন্তু স্যার তো একটু আগে বের হয়ে গেলেন ।
– কোথায় গেছে বলতে পারো ?
– ম্যাম, সেটা তো জানি না। তবে এসেই আজ স্যার বেশি সময় অফিসে ছিলেন না। কোথায় যেন বের হয়ে গেলেন । আর বললেন ফিরতে দেরি হবে ।
,
মোনার কথা শুনে একটু অবাক হলাম । কোথায় গেল হঠাত্ করে । কোনও সমস্যা হলো না তো। আমি মোনার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম,
– ঠিক আছে তোমার স্যার এলে বলো আমি এসেছিলাম । ঠিক আছে বায়। বাসায় এসে একদিন ঘুরে যেও।
– আচ্ছা ম্যাম, বায়।
,
গাড়িতে বসে নানান চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে । এমন সময় ওর ফোনের দিকে আমার চোখ গেল। বাসায় একটা ফোন দেওয়া দরকার দীপ্তি কি করছে । ব্যাগে আমার ফোন নেই। আয়ানকে সারপ্রাইজ দিতে এসে আমি নিজেই সারপ্রাইজ পেয়ে গেলাম । আয়ানের ফোন থেকে ফোন করে বাসায় জানিয়ে দেই আমি আসছি ।
আয়ানের ফোনের লক আমার জানা আছে । সেই আগের দেওয়া লক। লক খুলে আমি পুরো হতবাক হয়ে গেলাম । একটা নম্বর থেকে অনেক বার কল করা হয়েছে । আঠাশ বার রিসিভ কল এবং অনেক গুলি মিস কল উঠে রয়েছে । আমি একটু অবাক হলাম । এটা তো আমার সব থেকে বেস্ট বান্ধবী নীরার নম্বর । বেশ কিছু দিন ওর সাথে আমার যোগাযোগ নেই। কিন্তু আয়ানের ফোনে ওর নম্বর এতোবার রিসিভ কেন ?
,
যদি আমাকে নীরার দরকার থাকে তাহলে আমার ও ফোন আছে । তবে আয়ানের ফোনে এতো বার ওর নম্বর কেন?
আমার মনের ভিতরে অনেক গুলি কেন উঁকি দিতে লাগলো। এসির ভিতরে থেকে ও আমি রিতিমতো ঘেমে যাচ্ছি। আয়ান আর নীরা বাইরে কোথাও গেল নাতো। না না আমি আর কিছু চিন্তা করতে পারছি না। এটা আমার ভুল ও হতে পারে । নীরা হয়তো আমাকে ফোনে পাইনি তাই ওকে ফোন করেছে । কিন্তু ফোন গুলি বেশ কয়েকদিনের একবারও আয়না আমাকে বলেনি নীরা ফোন করেছিল ।
,
আমি আর মানতে পারছিলাম না। বুকটা ধরফড় করে কাঁপতে লাগলো। আমার সাজানো সংসারে কোনও ঘূর্ণিঝড় আসছে নাতো ?
,
,
— শেষ রাতের রঙধনু — পর্ব এক
— লেখা অধরা জেরিন
( চলবে )