-শেষ রাতের রঙধনু
– পর্ব দুই এবং শেষ
-লেখা অধরা জেরিন
,
– অরিত্রা , তুমি ভুল বুঝছো নীরার সাথে আমার কোনও অবৈধ সম্পর্ক নেই।
– তাহলে তোমার ফোনে এতোবার ওর কল কেন ?
– আমাদের একটা জরুরি মিটিং ছিল ।
– সেই জরুরি মিটিং টাই অন্য কিছু আমি ভাল করে বুঝতে পারছি ।
– তুমি কিন্তু তোমার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছো অরিত্রা ।
– ও আমি সত্যি কথা বললেই খারাপ । তাহলে সেদিন ওতো রাত অবধি কোথায় ছিলে ?
– কতোবার বললো আমার জরুরি মিটিং ছিল ।
– আয়ান তুমি বদলে গেছে । তুমি সেই আগের আয়ান নেই।
,
কথাটা শেষ হতেই সজোরে একটা চড় দিল অরিত্রাকে আয়ান । অরিত্রা এতোটা অবাক হয়ে গেল কোনও কথা আসছে না মুখ থেকে । গালে হাত দিয়ে বিছানায় বসে পড়লো। আয়ান ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ।
,
আয়ানের বাবা মা ঘর থেকে ছেলে আর বউয়ের ঝগড়া শুনছিলেন কিন্তু বুঝতে পারেননি এটা এতোদুর গড়িয়ে যাবে । তিনি আয়ানের উপরে খুব রেগে গেলেন বললেন ,
– ছি আমি একটা অমানুষ জন্ম দিয়েছি। শেষে কিনা নিজের স্ত্রীর গায়ে হাত। ওকে আমি খুন করে ফেলবো।
আয়ানের মা অরিত্রা কে বললেন ,
– বউমা তুমি এখন নীরাকে ফোন করো। এর একটা বিহিত করতে হবে ।
অরিত্রা যেন বোবা হয়ে গেছে কোনও কথা মুখে আসছে না।
,
সেদিন অফিস থেকে বাসায় এসে সব কিছু শশুর শাশুড়িকে বলেছিল অরিত্রা । সব শুনে উনারা বললো ,
– বউমা তুমি আয়ানের সাথে কথা বলো। আসলে ব্যাপারটা কি জানা যাবে ।
অরিত্রা সেই ভেবেই রাতে আয়ান ফিরলে ওকে বললো নীরার কথা । আয়ান একটু চমকে উঠলো ওর কথা শুনে । এক কথায় দুই কথায় এটা এতোদুর চলে এলো।
,
অরিত্রা সারা দিন রাত ঘরের দরজা বন্ধ করে কেঁদেছে। আয়ানের এই ভাবে গায়ে হাত তোলা মেনে নিতে পারছে না। শশুর শাশুরি কয়েকবার এসে ডেকে গেছে কিন্তু দরজা খুলে নি। দীপ্তি কে নিয়ে ঘরের ভিতরে । ওদিকে আয়ানের ফোন বন্ধ । সারারাত বাড়িতে আসেনি। এতে করে অরিত্রা আরো বেশি অভিমানী হয়ে গেল ।
,
সিদ্ধান্ত নিল আয়ানের সাথে আর না। আয়ান অরিত্রা কে দুরে ঠেলে দিয়েছে অনেক দুরে।
পরদিন সকালে অরিত্রা শ্বশুরের কাছে গিয়ে বললো ,
– বাবা, আমাকে ক্ষমা করবেন আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি ।
– বউমা! তুমি কি পাগল হলে । কি বলছো এই সব। আয়ানের উপরে অভিমান করে এটা করতে পারো না।
– আয়ানের যদি কোনও দোষ না থাকতো তাহলে কেন সত্যি টা আমাকে বলছে না।
– অরিত্রা, আমার বিশ্বাস কোনও কিছু একটা আছে এর মাঝে ,তুমি হঠাত্ এরকম সিদ্ধান্ত নিও না।
– প্লিজ বাবা আমাকে আমার মতো চলতে দিন । আয়ানের জীবনে আমি বাধা হয়ে থাকতে চাইনা।
,
এই বলেই দীপ্তি কে নিয়ে বাবার কাছে চলে এলো। আজ এক সপ্তাহ হতে চলেছে অরিত্রা বাবার কাছে । কিন্তু একবার ও আয়ান ফোন করেনি। খোঁজ খবর নেই নি। অরিত্রা এবার পুরোপুরি বুঝে গেছে আয়ান আগের মতো নেই।
,
আমরা হঠাত্ করে চলতে চলতে যখন পথ হারিয়ে ফেলি গভীর অন্ধকারে ঠিক তেমনই অরিত্রা আজ জীবনের পথ হারাতে বসেছে । অমাবস্যার কালো মেঘ মনে হচ্ছে ওকে গ্রাস করে নিচ্ছে একটু একটু করে । দমকা হাওয়া হঠাত্ করে এসে ওকে এক পশলা বৃষ্টি ছুঁয়ে দিয়ে বলছে তুমি একা বড্ড একা।
,
গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে মানুষ একটা নিশ্চিত হাত খোঁজে যে হাত অন্য হাতকে শক্ত করে ধরে বলে আমি আছি ভয় পেও না। এলোমেলো বাতাস আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বলে তোমার ভালোবাসা তোমার আছে । কিন্তু অরিত্রা? ডুকরে ডুকরে কাঁদছে প্রতিটা রাত। ঘুম ভেঙে গেলে কেউ বলছে না আমি আছি।
,
আয়ানের উপরে প্রচন্ড অভিমান ওকে বাধ্য করলো ডিভোর্স এর মতো একটা চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে । হয়তো এটা আয়ানের প্রতি ঘৃণা রাগ অথবা গভীর ভালোবাসা থেকে হয়েছে ।
,
সেদিন উকিলের কাছ থেকে ফিরে বাসায় আসতেই অরিত্রার বাবা বললো ,
– অরিত্রা মা , তাড়াহুড়ো করে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে নেই। আরো কিছু দিন ভেবে দ্যাখ?
– বাবা ও আর ফিরবে না। ওকে আমি চিনি। আমি ও চাইনা ওদের মাঝে থাকতে ।
– তাহলে তুই নীরাকে একবার ফোন কর। নীরার কাছে জিজ্ঞাসা কর কেন এমন করছে সে ?
– নীরা এখানে থাকে না বাবা । ওর ফোন বন্ধ থাকে । আগের ঠিকানায় নেই। এখন বলো আমি কি করতে পারি। প্লিজ বাবা আমাকে আমার সিদ্ধান্ত নিতে দাও। কারো মাঝে আমি দেয়াল হতে চাইনা।
,
ঠিক এমন সময় অরিত্রার ফোন বেজে উঠলো। রিসিভ করতে ওপাশ থেকে বললো ,
,
– বউমা আয়ান এক্সসিডেন্ট করেছে । হাসপাতালে ভর্তি তাড়াতাড়ি আসো।
কথাটা শুনে অরিত্রার হাত থেকে ফোন পরে গেল । ছুটে গেল হাসপাতালে । কিন্তু কেন গেল নিজের ই অজানা । মাঝে মাঝে আমাদের এমন হয়। অনেক কিছু আমরা জানি না মানি না কিন্তু করে ফেলি। উপরে আরেকজন আছেন যিনি তাঁর সিদ্ধান্ত অনেক আগেই নিখুঁত করে সাজিয়ে রেখেছেন ।
,
সবাই হাসপাতালে অপেক্ষা করছে । আয়ান খুব গুরুতর আঘাত পেয়েছে ।বেশ কয়েক জায়গায় কাচের টুকরো ঢুকে গিয়েছে এখনও অপারেশন চলছে ।
অরিত্রা শুকনো চোখে বসে আছে । ভাল করে তাকালে দেখতে পাওয়া যাবে শুকিয়ে যাওয়া পানি এখনও দাগ ফেলে গেছে ।
ঠিক এমন সময় নীরা এলো সেখানে । ওকে দেখে অরিত্রা অবাক । নীরা এখানে কেন ?
নীরা আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলে অরিত্রার কাছে । ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,
– অরিত্রা! তুই কি জানিস আয়ান তোকে পাগলের মতো ভালোবাসে ?
অরিত্রা নীরার কথা শুনে বললো ,
– অনেক নাটক করেছিস আমার সাথে আর না। কি চাস এখন তুই ? আমি আয়ানকে ডিভোর্স দেই এইটাই তো ? সেটা ও পেয়ে যাবি।
– বাহ এই তোর বিশ্বাস আয়ানের উপরে ।
মাত্র কয়েক টা কলে ওকে এভাবে অবিশ্বাস করতে পারলি।
– কথা টা বিশ্বাস অবিশ্বাসের না নীরা । কথাটা হচ্ছে ভরসার যেটা আয়ান আমাকে করেনি। আমি বার বার কারণ জিজ্ঞাসা করেছি কিন্তু ও প্রতি বার আমার কাছে লুকিয়েছে।
নীরা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললো,
– কোনও স্ত্রী চাইবে না নিজের স্বামী অন্য কারো কাছে ছোট হোক ?
– মানে ?
– অরিত্রা তোর মনে আছে আমি আর ফয়সাল ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম । কিন্তু জানিস ওকে আমি চিনতে পারিনি। ও এতোটা অমানুষ । খুন ছিনতাই নেশা এই গুলির মাঝে ডুবে থাকতো। অনেক চেষ্টা করেছি ওর কাছ থেকে সরে যেতে কিন্তু পারিনি । বার বার আমাকে খুঁজে বের করে এনেছে ।
সেদিন ছিল একটা কালবৈশাখী ঝড়ের দিন । আমার জীবনের সব কিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল । পাশের বাসার একটা মেয়ে কে জোর করে উঠিয়ে নিয়ে সবাই মিলে রেপ করার সময় মেয়ে টা মরে যায় । ফয়সাল হয় এক নম্বর আসামি । ওকে থানায় নিয়ে যায় । এই লজ্জায় আমি বাইরে বের হতে পারতাম না। কারো কাছে গেলে অপমান করে বের করে দিতো। সমাজের চোখে আমি নর্দমার কীট হয়ে গেলাম । বাচ্চা দুটো না খেতে পেরে অসুস্থ হয়ে পড়লো। বাসা অন্য জায়গায় ঠিক করলাম । হঠাত্ একদিন আয়ানের সাথে দেখা । আমাকে দেখে চমকে উঠলো। সব কিছু খুলে বললাম তাকে । অনুরোধ করলাম আমার এই অভিশপ্ত জীবন যেন তোকে না বলে । সেই থেকে আয়ান আমাদের পরিবারটাকে আগলে রেখেছে একজন ভাইয়ের মতো। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি আমার দেওয়া কথা রাখতে গিয়ে তোদের এতো সমস্যা হবে ।
সব কিছু শুনে অরিত্রার বুক ফেটে যাচ্ছে কষ্টে। নীরাকে বললো ,
– একবার শুধু একবার আয়ান সত্যি টা আমাকে বলতো ?
– দোষটা আমার ই আমি আমার সন্তানের কসম খেয়ে বলেছিলাম আমার অভিশপ্ত জীবনের কথা যেন কেউ না জানে ।
তোকে আয়ান বড্ড বেশি ভালোবাসে।
,
অরিত্রা কেঁদেই চলেছে । এমন সময় ওর শশুর মাথায় হাত দিয়ে বললো ,
– কেদ না মা ! আয়ানের কিছু হবে না।
অরিত্রা শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে দেখে চোখে জল চিকচিক করছে কিন্তু মুখে জিতে যাওয়ার হাসি। একজন পিতার সন্তানের কাছে জিতে গেছে এর থেকে আর কি পাওয়ার থাকতে পারে ।
ডক্টর এসে বললো আয়ানের জ্ঞান ফিরেছে আপনারা দেখা করতে পারেন ।
অরিত্রা ছুটে গেল আয়ানের কাছে । কাছে যেতেই আয়ানের চোখে চোখ পড়লো। দুজনের চোখ ভিজে গেছে জলে। আয়ান অরিত্রাকে কাছে ডাকলো । অরিত্রা আয়ানের পাশে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে । কোনও কথা বলতে পারছে না। আয়ান এবার অরিত্রার হাত নিজের হাতের ভিতরে নিয়ে বললো ,
– তোমাকে ছাড়া একটা মূহূর্ত ভাল ছিলাম না ।
অরিত্রা আয়ানের হাত আরো শক্ত করে ধরে বললো ,
– তাহলে কোনও খোঁজ খবর নাওনি কেন ? জানো আমার একেকটা দিন কিভাবে কেটেছে।
– কে বলেছে খোঁজ নেয়নি। রোজ উকিল আংকেলের কাছে গিয়ে আমার নামে নালিশ করতে কি ভেবেছো আমি জানি না। অরিত্রা আমি আজই তোমার কাছে যেতাম কিন্তু তাঁর আগেই ….
-অনেক হইছে এবার থামো ? আগে সুস্থ হও তারপর সব শুনবো ।
– কেন তুমি তো আর আমার কাছে থাকবে না তাহলে শুনবে কিভাবে । ঠিক আছে দেখি অন্য কাউকে ঘরে আনতে হবে ।
– খুন করে ফেলবো তোমাকে এই কথা বললে ।
এই বলেই স্বামীর বুকের উপরে মাথা রেখে চোখের জল ফেলছে । আয়ান অরিত্রার মাথায় হাত বুলিয়ে বলছে ,
– অনেক ভালোবাসি তোমাকে পাগলি অনেক । নিজের থেকে ও বেশি । তোমার কিছু হলে আমি মরে যাবো । হারিয়ে যাবো পৃথিবী থেকে ।
,
,
(সমাপ্ত )
/মাঝে মাঝে কিছু ভালোবাসা শেষ রাতের রঙধনুর মতো হয়ে থাকে । যে রঙধনু টা শুধু রাত জাগা ভালোবাসার মানুষ গুলিই দেখতে পায়। নিজেদের ভালোবাসা গুলি রঙধনুর সাত রঙে আরো রাঙিয়ে তোলে। /