#শেষ_ইচ্ছে,পর্ব-০৭
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
১৯।
“তোমার চোখ দুটির মাঝে আমি ভিন্ন কিছু দেখেছি। যেই চোখ দুটি যেকোনো পরিস্থিতিতেও শান্ত থাকতে পারে। আর এই শান্ত দুটি চোখ আমাকে ধীরস্থির বানিয়ে ফেলেছে।”
কথাটি বলেই হীরা উঠে দাঁড়ালো। স্মরণ হীরার দিকে তাকিয়ে বললো,
“কি হলো, দাঁড়িয়ে গেলে যে?”
“আমি আজ তোমাকে একটা আবদার করবো।”
স্মরণ মুচকি হেসে বলল,
“করো।”
হীরা হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি কি আজ আমার মাঝি হবে?”
স্মরণ দাঁড়িয়ে বলল,
“ওদের অনুমতি নিতে হবে।”
“আমি নিয়ে আসি অনুমতি?”
স্মরণ মাথা নেড়ে বলল,
“আচ্ছা, যাও।”
হীরাকে উপরে উঠে আসতে দেখে সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে থাকা দুইজন নড়েচড়ে উঠলো। দূরে আলোচনা করতে থাকা তিনজন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। তারা হয়তো ভাবছে, হীরা আর স্মরণের কথাবার্তা শেষ হয়ে গেছে। এরপর হীরা কি বলছে তা শুনার জন্য তারা এগিয়ে এলো।
হীরা প্রথম দুইজনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আংকেল, একটু যদি আমাদের নৌকা ভ্রমণের অনুমতিটা দিতেন।”
এক কোণায় একটা বাঁধা নৌঁকা দেখিয়ে হীরা বলল,
“এক ঘন্টা শুধু।”
তাদের মধ্যে একজন বলে উঠলো,
“দেখুন, আমরা এতো কিছু মেনে নিতে পারবো না। সে যদি পালিয়ে যায়, আমরা কি জবাব দেবো?”
হীরা করুণ কন্ঠে বলল,
“স্মরণ পালিয়ে যাওয়ার মতো ছেলে নয়। পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলে ওকে কেউ খুঁজেও পেতো না।”
“দেখুন, এতো কথা শুনতে পারবো না আমরা। আমাদের ডিউটি সন্ধ্যার পর শেষ।”
“আপনারা তো জানেন ওর আজকের বিকেলটাই…”
কথাটি বলতে বলতেই গলা কেঁপে উঠলো হীরার। তাদের মধ্যে বয়স্ক একজন বলে উঠলো,
“আচ্ছা, তবে ওই দিকটার বেশি যেও না। তাড়াতাড়ি চলে এসো। নয়তো আমরা গুলি চালাতে বাধ্য হবো।”
হীরা বলল,
“আপনাদের গুলি চালাতে হবে না।”
কথাটি বলেই হীরা গটগট করে নিচে নেমে স্মরণের হাত ধরে নৌকায় গিয়ে বসলো। স্মরণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“ওরা রাজি হয়ে গেছে?”
“হুম, তবে বলেছে উল্টোপাল্টা কিছু করলে একেবারে গুলি করে দেবে।”
স্মরণ হেসে বলল,
“গুলি করবে না, এমনিই ভয় দেখিয়েছে তোমাকে।”
“তুমি যা করেছো, তারপর এমন কিছু বলাটা অস্বাভাবিক নয়। তারা চাইলে গুলি করতেও পারে।”
স্মরণ মলিন হাসলো। হীরার গালে হাত রেখে বলল,
“এই পৃথিবীতে এখন একমাত্র তুমিই আছো, যে আমাকে এতোকিছুর পরও ভালোবেসে যাচ্ছো।”
“ভবিষ্যতেও বাসবো। কারণ আমি জানি তুমি যা করেছো একদম ঠিক করেছো।”
বৈঠা বেয়ে স্মরণ কিছুদূর নৌকাটি নিয়ে যাওয়ার পর হীরা বলল,
“সেইদিনের গানটি আবার গাইবে? ওই যে সেই গানটি যেই গানটি শুনে আমি প্রথম তোমার প্রেমে পড়েছিলাম!”
স্মরণ মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলো। তারপর কন্ঠে আবার সেই গানটি ধরলো।
“তুমি না এলে এই শ্রাবণ গাইবে বিরহ গান,
যদি খুব আদরে ডাকি তোমাকে,
ভুলে যেও অভিমান.. হায়!
তুমি না এলে এই শ্রাবণ গাইবে বিরহ গান।
চোখের পাতায়.. স্মৃতি ভেসে যায়.. আনমনে গায়.. তোমার গান।
মনের খাতায়.. রঙিন পাতায়.. শুধু লিখে যায়.. তোমার নাম।”
চোখ বন্ধ করেই গানটি শুনছিলো হীরা। স্মরণের কন্ঠের সুর এই নদীটিকে অর্থাৎ, অশ্রু প্রবাহিণীকে মাতিয়ে তুলেছে। নদীর সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে স্মরণের উপর নজরদারি করতে আসা লোকগুলো। তাদের চোখে মুখে অদ্ভুত বিষ্ময়। তবে সেদিকে খেয়াল নেই স্মরণ আর হীরার। তারা হারিয়ে গেছে তাদের প্রেমের রাজ্যে। যেই রাজ্যে কোনো কষ্ট নেই, আছে শুধু সুখ আর শান্তি।
হীরার কল্পনায় এখন অতীতের সেই রঙিন মুহূর্তগুলো ভাসছে। তাদের প্রেম শুরু হওয়ার পরের অধ্যায়টি।
২০।
হীরা আর স্মরণের প্রেম ছিল একদমই সাধারণ। তাদের প্রেমে এমন কিছুই ছিল না, যা দেখলে বা শুনলে তাদের বাকী প্রেমিক-প্রেমিকাদের থেকে আলাদা মনে হবে। তবে তাদের প্রেমে আসলেই কিছু একটা ছিল, যা তাদের প্রেমকে তাদের কাছেই আলাদা করে তুলেছে।
অন্যসব প্রেমিকযুগলদের মতো তাদের হাত ধরে হাঁটাহাঁটি করা আর এক রিক্সায় বসে হুড উঠিয়ে দিয়ে শহরের অলিগলি ঘোরাফেরা করা অতি সাধারণ ব্যাপার ছিল। শুধু ভিন্নতা ছিল সেই মুহূর্তের অনুভূতি প্রকাশে। স্মরণ এই প্রতিটা মুহূর্ত আলাদা ভাবে অনুভব করতো। আর সেই অনুভবটাই প্রকাশ পেতো নিরব ভাষায়। স্মরণের এই নিরব ভাষাগুলো হীরা তার পাশে বসেই পড়তো।
প্রথম স্মরণের সাথে হীরার নিরব ভাষায় কথোপকথন হয়েছিল ক্যাম্পাসের সেই পুকুর ঘাটে। সময়টা ছিল বসন্তের মাঝামাঝি। তারা দু’জনেই পুকুরের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে ছিল। হঠাৎ স্মরণ হীরার দিকে একটা ভাঁজ করা কাগজ এগিয়ে দিল। হীরা সামান্য ভ্রূ কুঁচকে সেই ভাঁজ করা কাগজটি খুলে দেখলো, একটা চিঠি।
এটি ছিল হীরাকে দেওয়া স্মরণের প্রথম প্রেম পত্র। সেই চিঠিতে স্মরণ লিখেছিল,
“প্রিয় কোমল হাতের অধিকারিণী,
আজ প্রথম আমাদের এই নিরব কথোপকথন চলছে। যেই ভাষায় কোনো শব্দ নেই, হাওয়ার তালও যেই ভাষাকে স্পর্শ করতে পারবে না, আমাদের আজ সেই ভাষায় কথা হবে। তুমি এই মুহূর্তে আমার পাশে বসে আছো। আর অদ্ভুত ব্যাপার হলো, কোনো শব্দ ছাড়াই আমার মনের কথাগুলো পড়তে পারছো। এমন আধ্যাত্মিক প্রেম বর্তমানে তুমি খুঁজে পাবে না। কিন্তু দেখো, তুমি সেই ভাগ্যবতী কোমলপ্রাণ যে আমার মনের কথা পড়তে পারছো। তুমি কি জানো পাশাপাশি বসেও চুপ থাকাটা কতোটা যন্ত্রণার? কিন্তু তোমার পাশে বসে থাকার মাঝে অদ্ভুত শান্তি আছে। ইচ্ছে করে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে যায়। আর আমি জানি সেই ঘুমটা অনেক ভালো হবে। আর অনেক সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন আসবে। আমি কিন্তু মনে মনে হাসছি। তুমি কি আমার হাসির শব্দ শুনতে পারছো? আচ্ছা, শুরুতে তোমাকে কোমল হাতের অধিকারিণী বলার কারণটা কি ধরতে পেরেছো? পারছো না? তুমি সবকিছুই একদম সোজাসুজি বোঝার চেষ্টা করো, মাঝে মাঝে একটু বাঁকা ভাবে চিন্তা করলে কিন্তু উত্তর বের হয়ে যায়। আমি জানি আমার এই কথাটা শুনে এক্ষুনি তুমি বাঁকা ভাবে ভাবতে শুরু করেছো। তোমার চোখ দুটি এখন অস্থির। তুমি মনে মনে বলছো, “কেন স্মরণ আমাকে কোমল হাতের অধিকারিণী বলেছে? আমার হাত দুটি কি তার কোমল মনে হয়েছে? কিন্তু আমার হাত মোটেও কোমল নয়।” এতোটুকু ভেবেই তুমি কপাল ভাঁজ করে আবার চিঠির দিকে তাকাবে। আর বাকি লেখাটুকু পড়ে আমার দিকে তাকাবে।”
এতোটুকু পড়ে হীরা স্মরণের দিকে তাকালো। দেখলো স্মরণ চোখ বন্ধ করে বসে আছে। হীরা স্মরণের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে মনে মনে বললো,
“যেমন তুমি লিখেছো, আমি ঠিক সেভাবেই ভেবেছিলাম। তুমি আমাকে এতো অল্প সময়ে কিভাবে পড়তে শুরু করলে স্মরণ? তোমার মতো করে কেউ কখনোই আমাকে পড়ার চেষ্টা করে নি। তুমি আমাকে একদম সূক্ষ্মভাবেই পড়তে পেরেছো।”
হীরা আবার চিঠি পড়া শুরু করলো।
“গতকাল প্রথম তোমার হাতের স্পর্শ পেয়েছি। এরপর এই অনুভূতিটা বাসায় এসে সাথে সাথেই লিখে ফেললাম। যখন প্রথম তোমার হাতটা ধরলাম, মনে হলো যেন তুলা স্পর্শ করেছি। তুমি হয়তো বলবে, তোমার হাতটা ওতো কোমল নয়। কিন্তু হীরা, তোমার হাত ধরার পর আমার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত ভালো লাগা সৃষ্টি হয়েছিল। আর এরপর সবকিছুই আমার খুব সহজ মনে হচ্ছিল। যেমন ইটের পথকে আমি সবুজ গালিচা ভাবছিলাম, আশেপাশের গাড়িগুলো দেখে মনে হচ্ছিলো ঘোড়ার গাড়ি আর আশেপাশের মানুষগুলো দেখে মনে হচ্ছিল কিছু ভাস্কর্য দাঁড়িয়ে আছে। আর আমার কাছে সেই মুহূর্তে সবকিছুই স্থির মনে হচ্ছিল। আচ্ছা হীরা, তুমি কি বলতে পারবে, মানুষ আসলেই বাস্তব জীবনে এমন কিছু কল্পনা করতে পারে কিনা? আমিও ভাবছি, আমার কেন ওমন মনে হলো! আমার আশেপাশের সবকিছুই আমি নিজের মতো করে ভেবে নিয়েছি। জানি এর উত্তর তোমার কাছে নেই। তবে আমি এর উত্তর তোমাকে দিচ্ছি। আগে চিঠিটা বন্ধ করে তোমার হাত দুটি আমার হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করো, ঠিক একই অনুভূতি যদি আমার আবার হয়, তবে আমি এর উত্তর জেনে যাবো।”
হীরা চিঠিটি বন্ধ করে তার ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল। তারপর স্মরণের দিকে ঘুরে বসলো। স্মরণ এখনো চোখ বন্ধ করে রেখেছে। কি মায়াবী লাগছে তার মুখখানা। হীরা মুচকি হেসে এবার তার একটি হাত স্মরণের হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করলো। স্মরণও হীরার হাতের স্পর্শ পেয়ে তা আলতো করে ধরে রাখল।
হীরা বলল,
“কি মনে হচ্ছে?”
স্মরণ বলল,
“হিমুর যেমন রূপা আছে, ঠিক তেমনি স্মরণের আছে হীরা। যার হাত দুটি প্রেমিকের স্পর্শ পেয়ে নরম হয়ে যায়। এই স্পর্শ হীরার মনের ভেতর থেকে এসেছে। সে বাইরে যতোটাই শক্ত, তার ভেতরটা খুব নরম। তাই আমি যখন তার হাতটি স্পর্শ করেছি, তখন তার সেই হাতটি হালকা কেঁপে উঠেছিল। আর এই কেঁপে ওঠাটাই আমার খুব পছন্দ হয়েছে। মনে হলো, আমি এক শান্তির রাজ্যে আছি, যেখানে কোনো কৃত্রিমতা নেই, কোনো দূষিত বায়ু নেই, কোনো কোলাহল নেই, শুধু আমি আর হীরা।”
স্মরণ এতোটুকু বলেই চোখ খুলল। তারপর হীরার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি হয়তো এজন্যই ওভাবে কল্পনা করেছিলাম।”
হীরা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“তুমি কিছুই কল্পনা করো নি। এসব তোমার ছল-চাতুরী। আমার হাত দ্বিতীয়বার স্পর্শ করার বাহানা। আমি কি বুঝি না ভেবেছো?”
স্মরণ বুকে হাত রেখে বলল,
“হায়! হায়! তুমি তো দেখছি আমার না বলা কথাও পড়ে ফেলতে জানো!”
তারপর স্মরণ বুকে একটা আঙ্গুল রেখে বলল,
“খবরদার, তুই হীরার সামনে আর কিছুই ভাববি না। তখন আমার ইচ্ছেগুলো কিন্তু অপূর্ণ থেকে যাবে। আর তখন আমি কষ্ট পেলে তুইও কষ্ট পাবি। বুঝেছিস?”
হীরা স্মরণের আঙ্গুলটা বুক থেকে সরিয়ে নিয়ে নিজের হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করে বলল,
“তুমি আমাকে অবশ্যই আবদার করবে৷ আমি তোমার সব আবদার পূরণ করবো। আর আমি জানি, তোমার আবদার আমার সামর্থ্যের বাইরে হবে না।”
সেদিনের এই একটা কথায় যথেষ্ট ছিল স্মরণের জন্য। এরপর আর এমন একটা দিনও যায় নি, যেদিন স্মরণ কোনো আবদার করে নি। আর হীরার স্মরণের সেই আবদারগুলোই অনেক উদ্ভট লাগতো।
স্মরণ হীরাকে প্রথম আবদার করেছিল সে যাতে চুড়ির পরিবর্তে হাতে ঘড়ি পরে বের হয়। যদিও হীরার চুড়ি বেশি ভালো লাগতো, কিন্তু স্মরণ তার জীবনে আসার পর থেকেই সে হাতে ঘড়ি পরতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এমন নয় যে হীরা চুড়ি পরা ছেড়ে দিয়েছিল। সে শুধু স্মরণের সামনেই চুড়ি পরতো না। তবে স্মরণ মেলায় গেলে হীরার জন্য বিভিন্ন রঙের চুড়ি কিনতো। আর হীরা সেই চুড়িগুলো খুব যত্নের সাথে তুলে রাখতো।
হীরা কখনো স্মরণকে জিজ্ঞেস করে নি, কেন তার চুড়ি পরা অপছন্দ। কারণ যেদিন প্রথম স্মরণ হীরাকে ভালোবাসার কথা বলেছিল, সেদিনই স্মরণ বলেছিল, তার চুড়ির শব্দ ভালো লাগে না। নিরবতায় বেশি ভালো লাগে।
স্মরণের আরো কিছু আবদার ছিল যেমন,মাঝে মাঝে হলুদ শাড়ি পরা, কমলা জামা পরে দেখা করতে আসা, হীরার জন্মদিনের দিন তাকে টিয়ে রঙের কাতান শাড়ি পরতে বলা, কানে ঝুমকোর পরিবর্তে টপ পরা। চুল খোঁপা করে রাখা, কিন্তু ফুল দিয়ে খোঁপা না বাঁধা, লাল লিপস্টিক লাগানো ইত্যাদি ইত্যাদি।
হীরার এসব আবদার প্রথম প্রথম উদ্ভট লাগলেও, সে ধীরে ধীরে এসব পছন্দ করা শুরু করে। বরং স্মরণ যখন নিজের পছন্দে হীরাকে সাজতে দেখতো, তখন তার ঠোঁটে এক ভুবন ভোলানো হাসি ফুটে উঠতো। আর সেই হাসিটাই হীরাকে বলতো, “স্মরণের পছন্দমতো সাজো। তোমাকে দারুণ লাগবে।”
চলবে–