#শেষ_ইচ্ছে,পর্ব-০৯ (রহস্যের উন্মোচন)
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
২৩।
একটা কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ি পরে হীরা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে সে স্মরণকে অনুভব করার চেষ্টা করছে। তার ইচ্ছে করছে পৃথিবীকে জানাতে যে স্মরণের কোনো অপরাধ নেই। কিন্তু প্রমাণের অভাব।
হীরা আনমনে ভাবছে,
“স্মরণ খুনী, কিন্তু আমার দৃষ্টিতে সে খুনী নয়। তবে আইনের চোখে তো স্মরণের ফাঁসি আটকানোর কোনো উপায়ও নেই। আর স্মরণ তো স্বীকার করেই নিয়েছে যে সে খুন করেছে।”
হীরা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে চাইলেও আর এই যন্ত্রণা থেকে নিজেকে মুক্তি দিতে পারবে না।
কিছুক্ষণ পর সে ব্যাগ থেকে একটা ছোট কাঠের বক্স বের করলো। স্মরণের আরেকটি শেষ ইচ্ছে ছিল, হীরা যাতে তার সব চিঠি নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে, তারপরই তার লাশ নিতে আসে। আর আজ হীরা স্মরণের সেই আবদারটি অনেক কষ্টে পূরণ করতে যাচ্ছে। কারণ এই চিঠিগুলো পড়েই সে স্মরণকে অনুভব করতো। অথচ স্মরণ চায় না, হীরা তাকে অনুভব করুক! কি অদ্ভুত প্রেম তাদের! একজন বলেছে চিঠিগুলো নদীতে ভাসিয়ে দিতে, আর আরেকজন সত্যি সত্যিই তা করতে চলে এলো।
কেন যে স্মরণ এমন উদ্ভট আবদার করে বসে তা হীরার বোঝার বাইরে। কিন্তু যতোই তার কষ্ট হোক, সে তবুও এই আবদার পূরণ করবে। কারণ এটিই তার প্রিয় মানুষটির শেষ আবদার। আর হীরা কি পারবে এই আবদারটুকু ফেলে দিতে?
হীরা চিঠিগুলো শেষ বার পড়তে শুরু করলো। আর প্রতিটি চিঠি পড়া শেষে সেই চিঠি দিয়ে নৌকা বানিয়ে সেই নদীর জলে ভাসিয়ে দিতে লাগলো। হীরার মনে এক মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে। চিঠি পড়ে কখনো তার হাসি পাচ্ছে, আবার কখনো চোখের কোণে জল ভারী হচ্ছে। আবার সেই চিঠিই পড়া শেষে স্মরণকে অনুভব করে অশ্রু ঝরাচ্ছে, আর নৌকা বানিয়ে খুব মজাও পাচ্ছে। শেষমেশ সেই নৌকা ভাসিয়ে নিজের মনকে একটু একটু করে পাথর বানিয়ে দিচ্ছে। এভাবেই সে একটা একটা চিঠির বিসর্জন দিতে লাগলো।
অন্যদিকে স্মরণ শুষ্ক মুখে বসে আছে। মৃত্যুর ভয় তার মনে খুব তাড়া করছে। এই মুহূর্তে তার কোনো আবেগ কাজ করছে না। সে শুধু ভাবছে, তাকে সৃষ্টিকর্তা কিভাবে শাস্তি দেবেন? এই পৃথিবীতে না হয় কয়েক সেকেন্ড যুদ্ধ করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হবে, কিন্তু এরপর কি হতে পারে, তা ভাবতেই তার শরীর ভারী হয়ে আসছে।
সে জানে, কাউকে খুন করার শাস্তি পৃথিবীতে যেমনই হোক না কেন, পরবর্তী জীবনে খুনীদের শাস্তি আরো ভয়াবহ হয়। পরক্ষণেই স্মরণ জায়নামাজে বসে সৃষ্টিকর্তাকে বলল,
“আমি তাকে খুন করতে চাই নি। এইটা শুধু একটা এক্সিডেন্ট। কিন্তু কে বিশ্বাস করবে আমাকে? সবাই তো দেখেছে, আমি নিজেই সেই পিস্তল হাতে তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সবাই দেখেছে আমি তাকে গুলি করেছিলাম। কিন্তু কেউ দেখে নি, আমি কেন গুলি করেছি? সবাই আমাকে ধর্ষক বানিয়ে দিয়েছে! অথচ আমার জীবনে নারীদের মধ্যে যদি গুরুত্বপূর্ণ কেউ থেকে থাকে, তাহলে মা আর হীরার পর লাবণ্যই ছিল। আর কিভাবে সবাই মনে করলো আমি লাবণ্যের সাথে এমনটা করবো? বোন হয় আমার! আমাকে ভাইয়া বলে ডাকতো সে। আমি তো তাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম। একটা দুশ্চরিত্র লোকের হাত থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার সব শেষ হয়ে গেল। পৃথিবীতে মূল অপরাধীদের গায়ে একটুও দাগ লাগে না। আমার মায়ের মৃত্যুর পর সবাই তাকে দুশ্চরিত্রা বলেছে, রফিক মামাকে খুনী বানিয়েছে, লাবণ্যকে ধর্ষিতা, আর আমাকে বানিয়েছে ধর্ষক আর খুনী। অথচ এইসব কর্মকান্ডের মূল আসামী আজ সবার করুণার পাত্র। এমন আসামীদের খুন করে আমার আফসোস করার কোনো প্রয়োজন নেই। এমন আসামীদের মৃত্যুর পরই তসলিমা বেগমরা আরো কয়েক যুগ শান্তিতে বাঁচতে পারে, রফিক নামের মানুষগুলো তাদের অপূর্ণ স্বপ্নগুলো পূরণ করতে পারে, লাবণ্যরা নির্ভয়ে রাস্তায় চলাফেরা করতে পারে, আর স্মরণরা একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ ফিরে পায়। আমি মেনে নিচ্ছি, আমি অপরাধী। আমি একজন খুনি। আমি আমার বাবাকে খুন করেছি। আজ আমার ফাঁসি হয়ে যাবে। কিন্তু আমার মা কখনো তার জীবন ফিরে পাবেন না। কিন্তু আজ আমি আমার মাকে ন্যায় দিতে পেরেছি। আজ আমি অনেক শান্তি পাচ্ছি। একটা রাক্ষসকে মেরে নিজেকে যোগ্য পুত্র প্রমাণ করতে পেরেছি। যদিও সোশ্যাল মিডিয়াতে আর সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় লেখা হয়ে গেছে, ছেলের হাতে বাবা খুন। লোকে আমাকে নিয়ে নিন্দা করছে। কিন্তু আমি জানি আমি একটা মেয়েকে ন্যায় দিয়েছি।”
স্মরণ নিজের মনকে শক্ত করলো।
হঠাৎ তার সাথে শেষ বার দেখা করতে এলো জান ও জারিফ। দু’জনই একটা চেয়ার টেনে স্মরণের মুখোমুখি বসলো। জান এবছর কলেজ পাশ করেছে। আর জারিফ সদ্য কলেজে উঠেছে। দুজনই তাদের বড় ভাইকে প্রচন্ড ভালোবাসতো। কিন্তু আজ সেই ভাইটি তাদের বাবার খুনি।
জান অনেক কথায় জিজ্ঞেস করতে লাগলো স্মরণকে। কিন্তু স্মরণ চুপ করে বসে রইলো। ছোট ভাইদের মুখোমুখি হওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না তার। তবুও তার ইচ্ছের সবটা তো আর পূরণ হবে না।
অন্যদিকে জারিফ কিছুই বলছে না। সে শুধু শুনতে এসেছে। বাবাকে সে প্রচন্ড ভালোবাসে, আবার ভাইকেও। সে স্মরণকে এখন মনে মনে ঘৃণা করলেও, সম্মানটা এখনো মরে যায় নি। তাই সে মূলত চুপ করে আছে। কারণ মুখ খুললে অসম্মানজনক শব্দ বেরিয়ে আসবে।
জান এবার শান্ত কন্ঠে বলল,
“ভাইয়া, তুমি চুপ করে আছো কেন? তুমি কেন মেরে ফেলেছো বাবাকে?”
জানের কন্ঠে ভাইয়া ডাক শুনে স্মরণ জানের মুখের দিকে তাকালো। জারিফ যেন স্মরণের এই দৃষ্টির অপেক্ষায় ছিল। সে স্মরণের চোখে অনুশোচনা আশা করেছিল। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, সেই চোখে অনুশোচনা নেই। আছে যন্ত্রণা। জারিফ ভাবছে,
“তাহলে কি ভাইয়া বাবাকে মেরে কষ্ট পাচ্ছে? তাহলে কি সেদিন ভাইয়ার কোনো ভুল হয়েছিল?”
স্মরণ শান্ত কন্ঠে বলল,
“আমি তাকে মেরে মোটেও কষ্ট পাচ্ছি না। আমি তখনও বলেছি, এখনও বলবো, আমি লাবণ্যের সাথে কোনো অন্যায় করি নি। তোমরা আমাকে প্রশ্ন না করে মিসেস রোজাকে প্রশ্ন করতে পারো। একমাত্র তিনিই এই ঘটনার সাক্ষী ছিলেন।”
কথাটি বলেই স্মরণ দাঁড়িয়ে গেল। জান বলল,
“তাহলে তুমি বলতে চাইছো, মা তোমাকে ফাঁসিয়েছে? কিন্তু বাবাকে কে মেরেছে? গুলি তো তুমিই চালিয়েছিলে।”
“হ্যাঁ, আমি চালিয়েছি। কিন্তু এর বাইরেও অনেক সত্য আছে, যা তোমরা বুঝবে না। দেখো, আমি চাই না তোমরা বাবাকে ঘৃণা করে বাকি জীবন কাটাও। কারণ আমি জানি বাবাকে ঘৃণা করা কতোটা কষ্টের। আর তোমরা যতোটুকু জানো, এতেই তোমাদের এতো প্রশ্ন! বাকিটা জানলে জীবন পার করবে কিভাবে? কিছু সত্য কুয়াশার আড়ালেই হারিয়ে যাওয়া ভালো।”
“তুমি কিছু না বললে, আমরা তোমাকেই ঘৃণা করবো। আজকে অন্তত আমাদের মুক্তি দিয়ে যাও।”
“ঘৃণা করো। ঘৃণা করা উচিত। এমন সন্তান ঘৃণারই যোগ্য।”
২৪।
স্মরণের হাতে আর মাত্র দু’ঘন্টা সময়। স্মরণ শুনেছে, মৃত্যু কখনো বলে আসে না। অথচ সে অবাক হচ্ছে এটা ভেবে যে সে দু’ঘন্টা পর মারা যাবে। আর সে এই মুহূর্তে অনুভব করছে, যে তার মৃত্যুতে হীরা ছাড়া কারোই কোনো বিশেষ কষ্ট হবে না। ক্ষণিকের জন্য হয়তো তার ভাই ও কাছের আত্মীয়রা দুঃখী হবে, কিন্তু দাগ থেকে যাবে শুধু হীরার মনে।
স্মরণ স্থির হয়ে বসে মায়ের কথা ভাবতে লাগল। মৃত্যুর পর কি তার মায়ের সাথে দেখা হবে? যদি দেখা হয়ে যায়, তাহলে সে মায়ের মুখোমুখি কিভাবে দাঁড়াবে? এসব ভাবতে ভাবতেই অতীতে হারিয়ে গেল সে।
স্মরণ সেদিন স্কুল থেকে একটু তাড়াতাড়িই বাসায় ফিরেছিল। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে শুনতে পেলো ভেতর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। তাই সে আর ভেতরে ঢুকার সাহস পেল না। ভাবলো আরো কয়েক ঘন্টা পর বাসায় ফিরবে। কিন্তু যেই মুহূর্তে সে চলে যেতে নিবে সেই মুহূর্তে একটা পরিচিত মহিলা কন্ঠের স্বর বলে উঠল,
“ভাই, দয়া করে আমাদের ছেড়ে দিন। আমাদের একটু বাঁচতে দিন। আপনার কথামতো রফিক মিথ্যে স্বীকারোক্তি দিয়েছিল। আপনি বলেছিলেন, আপনি তাকে বাঁচাবেন। কিন্তু আপনি রফিককে বাঁচান নি। সে শুধু আমাদের জন্য চুপচাপ সেই মৃত্যু মেনে নিয়েছিল। ভাই এখন তো আপনার সব শর্ত মেনে নিয়েছি৷ এখন তো নবনীতার ভিডিওগুলো ডিলিট করে দিন। মেয়েটার ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে।”
জয়নাল ফিচেল হাসি দিয়ে বলল,
“আমি এই ভিডিও ডিলিট করে দিলে তো তুমি সবাইকে জানিয়ে দেবে যে আমিই খুন করেছিলাম তসলিমাকে। কিন্তু আমি তো তা হতে দেবো না। তবে আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারো। আমি তোমার ননদীর কোনো ক্ষতি করবো না। শুধু সে যদি মাসে একবার আমাকে সময় দেয়, আমি তাতেই সন্তুষ্ট থাকবো। দেখো, মাসে একবারই বলছি। প্রতিদিন কিন্তু আবদার করছি না।”
স্মরণ আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়ালো না। কারণ সে কথাগুলো হজম করতে পারছিল না। নিজের বাবা সম্পর্কে এসব জানার বয়স তখনও তার হয় নি। সে তো সবেমাত্র সপ্তম শ্রেণিতে উঠেছিল। আর এতো অল্প বয়সে বাবাকে ঘৃণা করে, বাবার সাথে এক ঘরে বসবাস করাটা তার জন্য দিন দিন মারাত্মক ভয়ংকর হয়ে উঠছিল।
স্মরণ ধীরে ধীরে জানতে পারলো, তার বাবা একজন ভয়ংকর মানুষ। তিনি রফিককে ফাঁসানোর জন্য নবনীতার কিছু গোপন ছবি ও ভিডিও ক্লিপ তৈরী করেন। রফিকও বোনের সম্মান রক্ষার্থে চুপচাপ জয়নালের কথামতো সব মিথ্যে অবিচার মেনে নিয়েছিল। আর তারপর রফিকের পরিণতি ছিল মৃত্যু। কিন্তু যেই বোনের জন্য তার মৃত্যুকে মেনে নিতে হয়েছিল, সেই বোনের মুক্তিটাও আত্মহননের মাধ্যমেই হয়েছিল।
জয়নালের অপ্রীতিকর প্রস্তাব বছরের পর বছর সহ্য করতে করতে একদিন সে মৃত্যুকেই মুক্তি হিসেবে বেছে নেয়।
স্মরণ নবনীতার মৃত্যুর খবর পেয়ে অনেক কেঁদেছিল। তার মনে হয়েছিল, সে দ্বিতীয়বার মাকে হারিয়েছে। সেদিন স্মরণ নবনীতাকে দেখতে ছুটে গিয়েছিল।
নবনীতার মলিন মুখটা একদম রক্তে মাখানো ছিল। আর স্মরণ সেদিনই ঘুমন্ত নবনীতার হাত ধরে প্রতিজ্ঞা করেছিল, সে আর কোনো অন্যায় মেনে নেবে না। আর কোনো নবনীতাকে এভাবে চুপচাপ মরতে দেখবে না।
মৃত্যুর আগে নবনীতা মাঝে মাঝেই স্মরণদের বাসায় আসতো। যদিও জয়নালের কথাতেই বাধ্য হয়ে তাকে আসতে হতো। মিসেস রোজা যখন বাসায় থাকতেন না তখনই নবনীতাকে ডেকে আনতো জয়নাল। তবে মিসেস রোজা সবই জানতেন। তবুও কিছুই বলতেন না।
নবনীতা বাসায় যতোক্ষণ থাকতো, স্মরণের সাথে গল্প করতো। আর স্মরণ অবাক দৃষ্টিতে নবনীতার চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে থাকতো। এই চোখে কতোই না স্বপ্ন! কিন্তু একটা কালো ছায়া এসে স্বপ্নগুলো আড়াল করে দিচ্ছে। নবনীতাকে স্মরণ মা বলেই ডাকতো। কারণ নবনীতাই ছিল তার মায়ের একমাত্র মেয়ে কাজিন। আর সে শুনেছে খালারা নাকি মায়ের মতোই হয়।
নবনীতার মৃত্যুর পর রফিকের স্ত্রী তার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যান। কারণ স্বামী-ননদী ছাড়া তার শ্বশুড় ঘরে কেউই তার আপন ছিল না। স্বামীর নামে খুনের মামলা থাকায়, তিনি অনেকের কটুকথা শুনেছিলেন। এমনকি তার সন্তানদেরকেও অনেক নোংরা কথা শুনতে হয়েছিল। একমাত্র নবনীতার জন্যই তিনি এতোদিন সব সহ্য করেছিলেন। কারণ তার স্বামী তো এই বোনটির জন্যই সব ত্যাগ করেছিল। তাহলে সে কিভাবে এই মেয়েকে একা ফেলে চলে যাবে?
মাঝে মাঝে সম্পর্কের বন্ধনগুলো খুব দৃঢ় হয়। সেই সম্পর্কে কাঁটা থাকলেও মানুষ তা গলায় পেঁচিয়ে রাখে। সেই কাঁটায় গলা কেটে গেলও যেন আপত্তি নেই।
চলবে-