#শেষ_চৈত্র [০১]
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার
কিছুক্ষণ আগে আমাকে বিয়ে করতে আসা নতুন বর আমারই ছোট ভাইয়ের দিকে তার এঁটো থালাটা ছুঁড়ে মেরেছে।
আমার ভাইয়ের অপরাধ ছিল সে খাবার সময় তার মাথায় পার্টি স্প্রে প্রয়োগ করেছিলো। যেটা খাবারেও পড়েছে। আর তিনি সেই খাবার প্লেট উল্টে আমার ভাইয়ের উপরে ছুঁড়ে ফেলে।
আর মূহুর্তেই এটা নিয়ে বেশ হুলস্থুল কান্ড বেঁধে গেলো, আমার পরিবার থেকে নয়, বরের পক্ষ থেকেই। সে থালা ছুঁড়েই শান্ত হয়নি, বেশ উঁচু গলায় বলছে এমন অসভ্য জায়গায় বিয়ে করবেনা। আমার বাবা আমার ভাই নাফিজকে এর জন্য বেশ মেরেছে। উল্টো বরপক্ষের কাছে বারবার ক্ষমা চাচ্ছে! যেন দরিদ্র বাবাদেরকে এমন বেহায়া হতে দু’বার ভাবতে নেই। বহু কষ্টে সঞ্চারিত অর্থের এই আয়োজন বৃথা যেতে দিলে যে দায়বদ্ধতার অতিরিক্ত বোজা বইতে গিয়ে উনি আর মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতেই পারবেন না।
আমি নিরবে বসে বসে চোখের জল ফেলছি! বিয়ের আগেই যদি এমন পূর্বাভাস পাই কি করে সংসারের জন্য মনস্থির করবো? তার উপর আমার বয়স কতো আর? ষোলো পেরুলো কেবল। ৬ মাস পরে মাধ্যমিক পরিক্ষা দিতাম। খুব তারাহুরো করে আমার আম্মা আব্বা বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। এর পেছনে অবশ্য কিছু কারণ ছিল।
আমার কয়েকজন প্রতিবেশী আম্মা আব্বাকে এসে জানিয়েছিলো,
‘ আপনাদের মেয়ে কিন্তু একটু বাড়তে না বাড়তেই খুব উড়তাছে, এখনি বিয়ে না দিলে ক’দিন পরে পোলা লইয়া ভাগবো।
স্কুলে যেতে আসতে ক্লাসমেট ছেলেদের সাথে কথা বলতে দেখেছে অনেকে। কিন্তু আমি জানি আমার ভেতরে কোনো গোলমাল ছিল না, তাদের সাথে বন্ধুসুলভ কথা বলতাম। কিন্তু আমি যদি একবারের জন্যও বুঝতে পারতাম এর পরিণতি কি হতে যাচ্ছে, তাহলে আমি কোনো ছেলের দিকে ফিরেও তাকাতাম না। এদিকে আমার সহজ সরল পরিবার অন্যের কথাকে কেন্দ্র করে মান সম্মান যাওয়ার ভয়ে একজন বিদেশ ফেরত নয়া কাপড় ব্যবসায়ী অমিতের সাথে আমার বিয়ের আয়োজন করেছে। বিয়ের দুইদিন আগে বড় আপাকে বলছিলাম, আপা আব্বারে কওনা আমি পড়তে চাই। আপা আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলেছিলো,
‘ পড়বার ইচ্ছা থাকলে রাস্তাঘাটে পোলাদের সাথে ফষ্টিনষ্টি করতিনা।
আপার থেকেই তখন আমি এই তারাহুরো বিয়ের আসল কারণ জানতে পারি।
খুব আদব কায়দায় বেড়ে উঠা আমি ‘না’ শব্দটা একবারের জন্যও আব্বার সামনে উচ্চারণ করতে পারিনি। আর বড়গলায় নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতেও পারিনি।
তবে এটা ঠিক, ছেলেদের সাথে কথা বলাটাই আমাদের গ্রামের মানুষের কাছে নষ্টামির খেতাবে পড়ে! যদিও কারো সাথে আমার ভাব ছিল না, কিন্তু কথা বলতে বলতে হতেও তো পারতো। এসব চিন্তা করে সব মেনে নিয়েছিলাম, ওদের সিদ্ধান্তকে যথেষ্ট সম্মান করেছিলাম।
কিন্তু কিছুক্ষণ আগে আমার সেই হবু বরের আচরণ আমার শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলছে। বিয়ে এখনো হয়নি, তবে হবে। কেননা অল্প সময়ের মধ্যে আমার বাবার মিনতিপূর্ণ করজোড়কে বরপক্ষ নিশ্চয়ই গ্রহণ করে নিবে! কিন্তু বিয়ের পরে এমন বদমেজাজী মানুষের সাথে কি করে সংসার করবো ভেবে আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছে।
আর দূর্ঘটনা বশত বিয়ে ভেঙে গেলেই বা আমার আব্বা এই যাত্রায় কীভাবে উঠে দাঁড়াবে? আমি নিজ চোখে দেখেছি আমার বিয়ের জন্য আব্বার নির্ঘুম চোখ, কপালে সারাসময় চিন্তার ভাঁজ!
আমার ফুঁপিয়ে কান্নার ভেতর হঠাৎই শুনলাম কে জানি বলছে,
‘ পর্দা টানাইয়া দেও, কাজী আসছে।
বেশ আৎকে উঠছিলাম কথাটা শুনে। বিয়ে হয়েই যাবে তাহলে! আমার বাবা মুক্তি পেয়ে যাবে। কিন্তু
আমি আবদ্ধ হয়ে যাবো!
আচ্ছা, সেই রাগী মানুষটার মধ্যে কি আমি এমন কিছু পাবো যা আঁকড়ে সংসারে টিকে থাকার সংগ্রাম করতে পারবো? জানিনা ভাগ্য আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তবে সব যন্ত্রণা পিষে কবুল করে নিলাম।
বিয়ে হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই তোড়জোড় আলাপ শুনলাম বর এখানে বউ নিয়ে আর থাকবেনা। এখনি চলে যাবে, বিয়ে হওয়ার পরবর্তীকালীন কুসংস্কারের রীতিকে সমর্থন করেনা সে।
প্রথমদিনেই আমার বর উপস্থিত সবাইকে আজীবন মনে রাখার মতো ব্যবহার দেখাচ্ছে। এখন নিশ্চয়ই সবাই বাইরে বাইরে এটা রটনা করবে। আর আমি? এই মানুষটার সাথে একজীবন কাটাবো? কি করে পারবো!
এদিকে আমার আশেপাশের আত্মীয়তার সূত্রে দুলাভাইগুলো এগিয়ে আসছিলো কোলে করে গাড়ীতে তুলে দিতে, কিন্তু বর কঠিন গলায় বললো,
‘ আমার বউকে কেউ ধরবেননা। দরকার হলে আমিই নিয়ে যাবো। কিন্তু এখন সে হাঁটতে পারছে, আর হেঁটেই যেতে পারবে।
বলেই আমার হাত ধরে সামনে যেতে লাগলো। অনেকটা দূরে ভাড়া করা মাইক্রো দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে সরু মাটির রাস্তা হওয়ার আসতে পারছেনা।
দুলাভাইদেরকে ছুঁতে না দেওয়ার বিষয়টা বেশ লাগলো আমার। আসলেই উনারা কেন আমাকে কোলে করে গাড়িতে পৌঁছে দিবে, যেখানে আমার বর নিজেই একজন সুপুরুষ হিসেবে অনায়েসে সেটা করতে পারে!
এমনিতেও গ্রামের এসব কার্য আমার পছন্দ নয়।
আর আমিও তো হাঁটতে না পারার মতো দূর্বল না।
আচ্ছা, আসলেই লোকটা বদচরিত্রের নাকি বদ কাজে অসহনশীল?
গাড়ীতে আমাদের সাথে একটা ভাবিও বসেছিলো৷ ঘোমটার ভেতর থেকে আমি তাকে ভালো করে দেখিনি, বাড়িতে থাকাকালীন অনেক কথা শুনেছি, অনেক দুষ্ট দুষ্ট আলাপ করছিলো, কিন্তু গাড়ীতে তিনি একদম চুপচাপ। তবে কি আসলেই আমার হওয়া এই মানুষটা ফাজলামোকে প্রশ্রয় দেননা? আর এটা তার আশেপাশের সবাই জানে?
অনেক চিন্তা মাথায় চাপিয়েই আমি পুরো রাস্তা পাড়ি দিয়ে সেই বাড়িতে পা রাখি।
বাড়িতে বউ দেখার আমেজ খুব স্বল্প। আমার থেকে কিছুটা দূরে বসে তিনি ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছেন। এর মধ্যে আমি টিউবওয়েল থেকে হাতমুখ ধুয়ে এসেছি। এসে অন্য রুমে শাড়ী পাল্টে বসেছি।
এর কিছুক্ষণ না যেতেই একে একে মানুষজন প্রবেশ করতে থাকলো। আমি এটা বুঝতে পারিনি যে এতক্ষণ না এসে এখন কেন মানুষের ভীড়? কিন্তু সেটার জবাব পেয়ে গেলাম সাথে সাথেই, একজন ভীড়ের মধ্যে বলে উঠলো,
‘ অমিত ভাই অক্ষন খালি বাইর হয়ছে। কোন সময় থেইকা বউ দেখার অপেক্ষা করতাছি।
খুব অদ্ভুত কথা! সবাই অমিত ভাইকে এতো ভয় পায়? এতো খারাপ তার আচরণ? আমার উপরও না এর প্রভাব পড়ে!
অনেক সময় চলে গেলো। মানুষ কমে গেছে। আমাকে যে দেখতে চাচ্ছে থুতনিতে ধরে একটু উঁচিয়ে দেখেছে। বউদের নাকি নিচু হয়ে থাকতে হয়!
আমার নিচু মাথার এক সুযোগে খালি ঘরে একজন আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
‘ জানো বউ, অমিত যে বিদেশ থাকাকালীন আরেকটা বিয়া করছিলো?
কথাটা শুনে আমি লাফ দিয়ে যেন উঠতে চাইলাম! কিন্তু ভেতরেই তা থেমে গেলো, ঠিক থেমে যায়নি, কম্পন হচ্ছে! ভয়ানক এক ভূমিকম্প ভেতরে। এটা আমি কি শুনছি!?
চলবে…..