শেষ_চৈত্র [০৩]

0
1070

#শেষ_চৈত্র [০৩]

আমার বরের মুখ দেখে বুঝাই যাচ্ছেনা যে তিনি আগে একটা বিয়ে করেছিলেন!

চরম একটা হাবভাব দেখিয়ে গলায় বেগ নিয়ে বললেন,
‘ কোথা থেকে এসব শুনো , হ্যাঁ? আর তুমি নিজেকে বাচ্চা বলছো? আমার সাথে প্রথমবারে এতো তেজে কথা বলার সাহস তো তোমাকে বাচ্চা প্রমাণিত করেনা চৈতি! জানো, আমার সাথে প্রাপ্ত বয়স্করাও কথা বলতে গেলে মেপে কথা বলে? আমাকে সবাই ভয় পায়।

আমি চোখ তুলে সরাসরি তাকালাম। সত্যিই উনাকে এখন আমার এক বিন্দু ভয় লাগছেনা। আপাতত কোনো রকম লজ্জাও লাগছেনা। উনার সম্পর্কে জানা ব্যপারগুলো আমার ভেতরকার স্বাভাবিক অনূভুতিগুলোকে পুরোপুরি গ্রাস করে দিয়েছে। এখন শুধু ভেতরে ধাবিত হচ্ছে ভয়ংকর উত্তাপ, জ্বলে যাচ্ছি আমি। সেই ক্ষোভগুলো কিছুটা প্রকাশ করতে পারলেই যেন আমার স্বস্তি!

আমাকে সরাসরি রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি কিছুটা অবাক হলেন, এরপর একবার পেছনের স্বল্প আলোটার দিকে তাকালেন। হয়তো আমাকে এই আলোয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেননা।
উনি উঠে দাঁড়ালেন,তবে কি ভেবে যেন আবার বসে গেলেন।
আমার কাছে এসে আস্তে আস্তে বললেন,

‘ চৈতি শুনো, আমার সাথে এভাবে কথা বলবেনা। আমি তোমার স্বামী! বুঝেছো?
আর আমি প্রথমদিনেই তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার দেখাতে চাইনা! কিন্তু খুব খারাপ আমি, মাথা গরম হয়ে গেলে ন্যায় অন্যায় ভুলে যাই, মনে রেখো!

এই কথা শুনে আমি এবার ঠোঁট ভেঙে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। উনি এদিক ওদিক তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করলেন। হয়তো আমাকে জোরে ধমক দিতে চাচ্ছেন, কিন্তু পারছেন না। তিনি নিজেকে যতটা সম্ভব এখনো সংযত রাখছেন । আমার কান্নার বেগ যখন আর বেড়ে উঠলো, প্রথমবারের মতো উনি আমার কাঁধ ডানহাত দিয়ে টেনে নিজের বাহুতে জড়ালেন। বিরক্ত গলাটা জোর করে শান্ত করার চেষ্টায় বললেন,
‘ আরে থামো তো। আমি কিন্তু ঘর থেকে বের হয়ে যাবো। এসব ভাল্লাগছে না একদম।

আমি নাক টেনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললাম,
‘ তাহলে কন ওই মহিলার কথা মিছা, আপনি আগে কোনো বিয়া করেন নাই!

এই কথাতে তিনি কেমন যেন থমকে গেলেন। সাথে সাথে আমাকে নিজের থেকে ছেড়ে দিলেন। চোখেমুখে আর থুতনির অল্প অল্প দাঁড়িতে হাত বুলালেন। কিন্তু নিরুত্তর!
আমি আবার প্রশ্ন করলাম,
‘ কন না এসব কথা মিছা?

তিনি জোরে একটা দম নিয়ে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলতে লাগলেন,
‘ দূর আব্বাকে আগেই বলছিলাম আমার জন্য এসব নবজাতক অবুঝ শিশু না দেখতে। দিলো তো আমাকে বিপদে ফেলে! এখন কীভাবে সামাল দিবো আমি? আল্লাহ আমাকে ধৈর্য দাও!

এই কথা শুনে চোখ কচলে আমি আরো বেশি কাঁদতে লাগলাম। আমি বুঝে গেছি উনার বিয়ের কথাটা সত্য। উনি বুঝাতে চাচ্ছেন,আমি ছোট বলে বিষয়টা মানতে পারছিনা, কিন্তু বুঝজ্ঞানে সম্পূর্ণ হলে কষ্ট করে হলেও মেনে নিতাম। ছেলেমানুষী অন্তত করতাম না!

উনি এবার উঠে লাইট অন করে দিলেন।
বিছানা থেকে এক হাতে বালিশ নিলেন, আরেক হাতে আলমারির পেছন থেকে একটা পাটি বের করলেন। তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন,
‘ ঘুমাও যাও। কান্নাকাটি বন্ধ করো, মাথা ধরে গেছে আমার।

আমি সাথে সাথেই কান্না বন্ধ করে ভার মুখে তাকালাম। আমার সাথে এখনো কোনো খারাপ আচরণ করছেনা? আবার এমন একটা মানুষ নিজের ইগো ছেড়ে নিচে পাটি বিছিয়ে ঘুমাবে? ছোট হলেও এই আপত্তিকর জিনিসটা বুঝতে পারছিলাম।
তাই আমি মিনমিন করে বললাম,,
‘ নিচে কেরে?

ভ্রু কুঁচকে জবাব দিলেন,
‘ আগে একটা বিয়ে করা লোক কি দ্বিতীয় বউয়ের সাথে থাকতে পারবে? এটা চরম অন্যায় না?

আমি থতমত খেলাম। শেষ পর্যন্ত নিজে মুখে স্বীকার করলেন বিয়ের কথা! কিন্তু আমার ছেলেমানুষীকে কি ইচ্ছে করে প্রশ্রয় দিচ্ছেন? নাকি উনাকে বুঝার জন্য সময় দিচ্ছেন?
কেন জানি মানুষটার উপর থেকে ঘৃণার মাত্রাটা একটুর জন্য মাইনাসের দিকে মোড় নিলো। তবে আমি আর কিছু না বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। কেন মানতে পারছিনা?
এই কথা জানাজানি হলে এলাকার সবাই আমাকে বিয়াইত্তা লোকের বউ বলবে বলে? নাকি আমার হওয়া এই মানুষটার ভালোবাসা আগেই কোথাও ভাগ হয়ে গেছে বলে?

বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে! বিষাদময় নতুন জীবনের শুরু আমাকে যে পরিমাণ দুঃখ দিচ্ছে, পুরো জীবনে আমি তার শত ভাগের এক ভাগও পাইনি। শুয়ে শুয়েও অনেক্ষণ কেঁদেছি। তবে এর মধ্যেও দুচোখ জুড়ে ঘুম চেপেছিল। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
যখন ঘুম ভাঙলো তখন ঘড়িতে সাড়ে সাতটা বাজে। আমি অবাক হয়ে উঠে বসলাম! আমাকে কেউ জাগায়নি?

ধিরে ধিরে আমি রুম থেকে বের হলাম। বের হতেই দেখলাম অমিত তার বোনের উপর আঙুল উঁচিয়ে কি যেন বলছে! উনার বোন ভয়ে জুবুথুবু হয়ে আছে। কিন্তু উনি যখনি আমার উপস্থিতি বুঝলেন থেমে গেলেন। আর তড়িঘড়ি পায়ে অন্যদিকে চলে গেলেন।
উনার বোন আমার দিকে একবার অসহায় চোখ করে তাকিয়ে তিনিও চলে গেলেন। কি বলছিলো অমিত? কাল রাতে বিয়ের বিষয়টা কোথা থেকে জানলাম এটা নিয়ে?

আমি কিছু না বুঝে উনার আম্মার ঘরে উঁকি দিলাম। আমাকে দেখেই উনি বলে উঠলেন,
‘ আইয়ো বউ। বও আইয়া।

আমি গেলাম। উনি আড়চোখে আমাকে পর্যবেক্ষণ করলেন। খুব বিব্রতকর একটা চাহনী। তার পরেই তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ অমিত আমার বড় আদরের পোলা বুঝছো?। অতিরিক্ত আধিখ্যেতায় ওরে আমি বড় করছি। জানো হের বিদেশের রোজগার কত্ত ভালা আছিলো, যাওয়ার দুই বছরেই আমরা এই বিল্ডিং বানাইয়া ফালাইছি। আরো কত্ত কিছু করার কথা ভাইব্বা রাখছিলাম..

তখনি রুমে ঢুকলো অমিত। আমার শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ আম্মা আমার দাদী বলতো না যে উনার ১০ বছর বয়সেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো? পরে উনি এখানে এসে দাদার আম্মার সাথে বড় হওয়া পর্যন্ত থেকেছে?

অমিতের কথায় উনি চকিত নজরে জবাব দিলেন,
‘ হ তোহ কিতা হইছে?

অমিত ঢোক গিলে বললো,
‘তেমন চৈতিকেও তুমি তোমার কাছে রাখবা। আমারে জ্বালাইয়া মারছে সারারাত। ওর জন্য একটুও ঘুমাতে পারিনি।
আর কয়দিন থাকলে আমাকে বনজঙ্গলের পাগল বানিয়ে ছেড়ে দিবে। বিরক্তিকর মানুষ শুধু আমার চারপাশে!

বলেই দরজাটা কপাট আওয়াজ করে খুলে দ্রুত গতিতে বের হয়ে গেলো।

উনার কথা শুনে আমার শাশুড়ী চোখ বাঁকিয়ে আমার দিকে তাকালো। ছেলের কথা শুনে মনে হয় বেশ অবাক হয়েছেন। আর আমাকেও তো উনার কোনোদিকে নাবালিকা মনে হচ্ছে না।
তবে আমি বুঝলাম না আমাকে নিয়ে এমন কথা বললেন কেন? আমি তো রাতে তখনি ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম!
কিসের জন্য এমন আচরণ করে মানুষটা? তখন আমার শাশুড়ীও কিছু বলতেছিলো, বিদেশে এতো ভালো অবস্থানে ছিলেন, বিয়েও করলেন। আবার হঠাৎ দেশে চলে আসলেন কেন? তাও সবকিছু ছেড়ে! ওই মেয়ে এখন কোথায় আছে?

চলবে…..

লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here