শেষ_থেকে_শুরু_২,পর্ব_৩

0
1616

শেষ_থেকে_শুরু_২,পর্ব_৩
নন্দিনী_চৌধুরী

৫.
শীতের সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে বৃষ্টির আনাগোনা। বৃষ্টি পাল্লা দিয়ে নিয়ে আসছে শীতকে। চারিদিকের কুয়াশা মিশ্রিত কালো মেঘে ঘেরা।

আড়মোড়া দিয়ে ঘুম থেকে উঠলো মুগ্ধ। শীতে কুঁকড়ে যাচ্ছে সে। আস্তে করে কম্বলের থেকে পা বের করে উঠে দাঁড়ালো মুগ্ধ। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলো। এসে ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো ৬ টা বাজে। বাহিরে এখনো বৃষ্টি পরছে। মুগ্ধ আলমারি থেকে চাদর নিয়ে গায়ে জরিয়ে নিলো। তারপর চলে গেলো রান্না ঘরে। এই শীতের দিনে সাথে বৃষ্টি! চাচা তার ভুনাখিচুড়ি খুব পছন্দ করে সাথে ভর্তা আর ডিম ভাজি। মুগ্ধ তাই রান্না চাপালো চুলায়। চাচি উঠার আগেই রান্না করে দিচ্ছে। মুগ্ধ এক চুলায় খিচুড়ি বসিয়ে এখন ভর্তা বানানোর কাজে বসেছে। একে একে আলু, ধনেপাতা, সরিষা, মরিচ, শুটকি, সিম, ডিমের ভর্তা বানিয়ে নিলো। সাথে আচারের তেলও নিলো একটা বড় বাটিতে। সব রান্না শেষ করে মুগ্ধ চা বানিয়ে ফ্লাক্সে রেখে দিলো। তারপর সব খাবার টেবিলে রেখে নিজের জন্য পরিমাণ মতো প্লেটে নিয়ে নিজের রুমে গিয়ে খেয়ে নিলো। খাবার খেয়ে সব গুছিয়ে রেখে আসলো। এর মাঝেই ওর চাচি চাচা উঠে গেছে। মুগ্ধ আর নিজের রুম থেকে তাই বের হলোনা।

~এদিকে কানাডায়~

মেহের নিজের রুমে কফি মগ হাতে নিয়ে বসে আছে আগামীকাল সে বাংলাদেশে যাবে। তার চড়ুইপাখির জন্য অনেক কিছু কিনে নিয়েছে সে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। মেহেরের মেনেজার আসলো তার রুমে।

মেনেজার: স্যার আসবো?
মেহের: হ্যাঁ, আসুন।
মেনেজার ভিতরে এসে মেহেরকে বললো,

মেনেজার: স্যার আমাদের বাংলাদেশের অফিসে আপনি যে যাবেন আপনার জন্য একটা পিয়ন নিয়োগ দিবো কি?
মেহের: হ্যাঁ, দিন।
মেনেজার: আচ্ছা আমি আজকেই ফোন করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করতে বলছি।

মেনেজার রুম থেকে চলে যায়। মেহের কফি নিয়ে ল্যাপ্টপ নিয়ে বসে।

~অন্যদিকে~

হাতে দুধের গ্লাস নিয়ে মায়ের রুমে আসে রুহি। গ্লাস হাতে নিয়ে রুমে এসে মায়ের পাশে বসে রুহি। রুহির মা মেয়েকে দেখে উঠে বসে।

রুহি মাকে বলে,

রুহি: মা নেও দুধটা খেয়ে নেও।
রুহি মাকে দুধটা খাইয়ে দিলো। তারপর মেডিসিন খাইয়ে দিলো। এর মাঝেই ওদের বাড়ির দরজায় কেউ টোকা মারলো। রুহি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখে পাওনাদার এসেছে। রুহি তাকে দেখে মাথা নিচু করে নিলো। পাওনাদার রুহির মাথা নিচু করা দেখে সে চিল্লিয়ে বললো,
পাওনাদার: আজকেও মাথা নিচু করে নিচ্ছেন। ৫ মাসের পাওনা আছে আপনাদের কাছে। এতো পাওনা রেখে ঘুমান কিভাবে আপনারা? আপনাদের কাছে রোজ আসলেই বলেন আজ না কাল দিবো। বলি কি দেহ বেইচ্চা হলেও আমার টাকা আমাকে ফেরত দেন। এতো টাকা দেনা আর ওনারা সুখে বসে আছে।

পাওনাদার গালি দিতে দিতে চলে গেলো। আর রুহি নিরবে চোখের পানি ফেললো।

রুহাইতা ইসলাম রুহি। মা বাবার বড় মেয়ে সে। অনার্স শেষ করে এখন একটা চাকরির জন্য হাহাকার করছে সে। রুহির বাবা মারা গেছে ৫ মাস আগে। তারপর থেকে তাদের দুঃখের সিমা নেই। রুহিদের কাছে যা জমানো ছিলো তা প্রায় শেষের পথে। মাথার ওপর এই ছাদটুকু ওর বাবা বানিয়ে রেখে গেছে। রুহির একটা ছোট ভাই আছে ক্লাস টেনে পড়ে। রুহির মাও অসুস্থ। হার্টের রোগ আছে তার। ডাক্তার বলেছিলো অপারেশন করাতে হবে। কিন্তু তাতেও অনেক টাকা লাগবে। রুহির এখন একটা চাকরির খুব প্রয়োজন।

রুহির মা ঘরে শুয়ে সব শুনলেন। মেয়েটাকে এতো বাজে কথা বলে গেলো লোকটা হায়!

.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
আরিশ বসে আছে অফিসে তার পাশে বসে আছে সায়মা। একদম আরিশের গায়ের সাথে মিশে বসে আছে। আরিশের কেন জানি ভালো লাগছেনা কিছু। মুগ্ধকে ছাড়া কেমন জানি খালি খালি লাগছে সব। সায়মা আরিশকে অন্যমনস্ক দেখে আরিশের গালে নিজের ঠোঁট ছুয়ে বলে,,

সায়মাঃ কি ভাবছো বাবু।
আরিশঃ হ্যাঁ,না কিছুনা।
সায়মা: (আমিতো জানি তুমি কি ভাবছো। ওই মুগ্ধের কথা ভাবছো তুমি। কিন্তু তোমাকেতো তা ভাবতে দেবোনা আমি৷ মুগ্ধের জন্য আমাকে বাবা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলো। ওর জীবন থেকে সব সুখ আমি কেড়ে নেবো। যেমন তোমাকে কেড়ে নিয়েছি।)
সায়মা আরিশের গালে হাত রেখে বলে,
সায়মাঃ আরিশ আমরা বিয়ে করবো কবে?
আরিশঃ খুব তাড়াতাড়ি করবো।
সায়মাঃ আচ্ছা। তাহলে চলো ঘুরতে যাই।
আরিশঃ এখন?
সায়মাঃ হ্যাঁ, এখন চলো চলো।
আরিশঃ আচ্ছা চলো।

আরিশ সায়মার জোরাজোরিতে আরিশ চলে গেলো সায়মাকে নিয়ে ঘুরতে।

~এদিকে~
সামিয়া মুগ্ধের কাছে আসে গল্প করতে। বাসায় সারাদিন একা একা ভালোলাগেনা তার। সামিয়া মুগ্ধের রুমে এসে দেখে মুগ্ধ হুমায়ন স্যারের একটা বই পরছে। সামিয়া মুগ্ধের পাশে এসে বসলো। সায়মাকে দেখে মুগ্ধ অবাক হলো আর খুশি হলো। সামিয়া মুগ্ধকে বললো,

সামিয়াঃ কি করছিস?
মুগ্ধঃ এইতো বই পড়ছিলাম হুমায়ন স্যারের।
সামিয়াঃ ওহ। আচ্ছা মুগ্ধ আরিশের কাছে জানতে চাসনি কেন তোকে ঠকালো। শুধুই তোর অপূর্ণতাই কি কারন?
মুগ্ধ সামিয়ার কথা শুনে একটু চুপ করে থেকে বলে,

মুগ্ধঃ না কারণ আমি জানতে চাইনি। এই জন্য জানতে চাইনি কারন আমি তাকে ভালোবেসেছি বিশ্বাস করেছি। আমি যাকে ভালোবেসেছিলাম সে এমন ছিলোনা। আমি আবারো বলছি আমি তাকে ভালোবেসে ভুল করিনি কারন ভালোবাসাটা আমার। কিন্তু আমি ওকে বিশ্বাস করে ভুল করেছিলাম কারন বিশ্বাসের অংশীদার সে ছিলো। আর সে আমার বিশ্বাসটা রাখতে পারেনি। সে মানুষটা সময়ের সাথে চ্যাঞ্জ হয়ে গেছিলো। আমার অপূর্ণতা ছিলো আসল কারণ। সব ছেলেই চায় বাবা ডাক শুনতে। তাই সে বাবা ডাক শোনার জন্য অন্য কারো কাছে চলে গেছে।
সামিয়াঃ কষ্ট হচ্ছে তোর তাইনা।

মুগ্ধ আবার বলে,,
জানোতো হুমায়ন আহমেদ স্যারের একটা উক্তি আছে,,

“যাকে হারিয়েছো তার জন্য কখোনো আফসোস করোনা
কারণ সে কখোনই তোমার ছিলোনা
তাকে মনে করে এক বিন্দু চোখের পানি ফেলা বোকামি
কারন,
সে যদি তোমার হতো তাহলে তোমার কাছে থেকে তার পালানোর সাধ্য কখোনই হতোনা।”

সামিয়া কিছু বলতে যাবে তার আগেই সালমা আসে সেখানে এসেই শুরু করে গাল মন্দ মুগ্ধকে।
সালমাঃ কত বড় সাহস আমার মেয়েকে এই খানে নিয়ে আসছিস কেন অপয়া মেয়ে। বাজা মেয়েদের গর্ভবতী মেয়েদের কাছে থাকতে হয়না জানিস না। এতে গর্ভবতী মায়ের ক্ষতি হয়। নিজে তো বাজা এখন আমার মেয়েটাকে খেতে আসছে৷ এই তুই এই রুমে কেন আসছিস আয় তোর রুমে আয়।
সামিয়াঃ মা তুমি ভুল বুঝতেছো।
সালমাঃ চুপ একদম।

মুগ্ধ সালমার কথা শুনে সামিয়াকে বলে,
মুগ্ধঃ সামিয়া আপু আমার রুমে আর এসোনা তুমি। বলা যায়না যদি সত্যি কিছু হয়ে যায়। প্লিজ আর এসোনা আমার রুমে।
সালমা সামিয়াকে নিয়ে চলে গেলো। আর মুগ্ধ চোখের জমানো পানি ছেড়ে দিলো।

মুগ্ধ কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“আমিতো ইচ্ছা করে বন্ধা হইনি। আমারতো ইচ্ছা করে মা ডাক শোনার। আল্লাহ আমারো তো একটা বাচ্চার খুব শখ। আমিতো ইচ্ছা করে বন্ধ্যা হইনি।”

~এদিকে~

সাদাফ মেয়েকে মায়ের কাছে রেখে চলে আসে ভার্সিটির ক্লাস নিতে। তারপর চলে যাবে অফিসে। সাদাফ ক্লাস শেষে গাড়িতে বসে ভাবছে,
মেয়ের জন্য একটা কোনো বাচ্চা দেখাশুনা করে এমন কাউকে আনবে। কিন্তু এমন বিশ্বস্ত কাউকে কই পাবে? সেটাই ভাবছে সাদাফ। ভাবতে ভাবতে চলে আসে অফিসে। অফিসে এসে সে তার মেনেজারকে জানালে সে বলে সে দেখছে বিষয়টা। বিসস্ত কাউকে সে খুঁজে দেবে।

রাতে,,,,

মুগ্ধ তার চাচার রুমে আসলো কথা বলার জন্য। মুগ্ধকে দেখে কাছে ডাকলো মাহফুজ। মুগ্ধ চাচার কোলে মাথা রেখে বললো,,

মুগ্ধ: চাচা আমি কি আবার পড়াশুনা শুরু করতে পারি?
মাহফুজ: হ্যাঁ তুই চাইলে আবার শুরু করতে পারিস।

মুগ্ধ বাকি কথা বলার আগেই সালমা বাহির থেকে বলে,,
সালমা: বাহ বাহ কি সুন্দর। এতো বছর আমাদের ঘারে খেয়ে। এখন জামাইয়ের লাথি খেয়ে এসে এখন আবার আমাদের টাকা পয়সা ধ্বংস করার ইচ্ছা। আমি বলে দিচ্ছি এই অপয়ার পিছনে আর একটা টাকাও তুমি নষ্ট করলে তোমার খবর আছে।
মাহফুজ: আহ! সালমা থামো।
মুগ্ধ: না চাচা চাচি ঠিকই বলেছে। ভয় নেই চাচি। তুমি আমাকে ঘরে থাকতে দিয়েছো খেতে দিচ্ছো এই অনেক। আমি যেভাবে পারি টাকা জোগার করে পড়ালেখা করবো।

মুগ্ধ আর দাঁড়ায় না চলে আসে তার রুমে। আজ বড্ড ভাইয়ের কথা মনে পরছে তার। বাবা মায়ের পর বড় ভাই হয় আপন ছায়া। সেই ভাই থেকেও নেই। খুব অভিমান জমে আছে তার মেহেরর উপর।

মুগ্ধ আকাশ পানে তাকিয়ে বলে,

“মা বাবা মরে গেলে আপন বলতে কেউ থাকেনা। নিজের ভাইও না।”

মুগ্ধ আবার কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে,

“কাউকে কাঁদিয়ে কেউ ভালো থাকতে পারেনা। কারো চোখ থেকে পানি ঝড়ালে তার জবাব আল্লাহ তায়ালার কাছে দিতে হয়।”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here