শেষ_থেকে_শুরু_২,পর্ব_৫
নন্দিনী_চৌধুরী
৮.
ছাদে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে মেহের। শীতের রাতে কনকনে শীত না পরলেও বেশ ভালো ঠান্ডাই লাগছে। মেহের একটা কালো হুডি ওয়ালা জ্যাকেট পরে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তার আকাশের পানে। মেহেরের আজ খুব আফসোস হচ্ছে। কেন সে মামার সাথে গেলো? কেন সে বোনটাকে একা রেখে গেলো? আজ সে না গেলে, তার বোনের সাথে থাকলে তার বোনের এই অবস্থা হতোনা। আজ তার বোনের চোখে সে অপরাধী হতোনা। আজ তার চড়ুইপাখি তার থেকে দূরে থাকতোনা। মেহেরের খুব কষ্ট হচ্ছে।
দুপুরে মুগ্ধ মেহেরের সাথে না যেতে চাইলে মেহের একাই চলে যেতে চাইলে মেহেরের চাচা ওকে আটকে দেয়। এতো বছর পর এসেছে এভাবে চলে যেনো না যায়। মাহফুজের অনেক অনুরোধে থেকে যায় মেহের। মুগ্ধ একবারো আর আসেনি মেহেরের কাছে। এক বুক অভিমান নিয়ে বোন তার ভাইয়ের থেকে দূরে আছে।
মেহের এসব ভাবতে ভাবতে ওর ফোনে কল আসলো। মেহের ফোন হাতে নিয়ে দেখে ওর অফিসের মেনেজার ফোন করেছে। মেহের ফোন রিসিভ করলো।
মেনেজার: হ্যালো স্যার!
মেহের: হ্যাঁ বলুন।
মেনেজার: স্যার আপনার পিএ নিয়োগের জন্য যে ইন্টারভিউ রেখেছিলাম সেখানে ৬ জন ইন্টারভিউ দিয়েছেন।
মেহের: আচ্ছা আপনি ৬ জনের নাম, ফোন নাম্বার, ছবি, ডিটেইলস আমার হোয়াটসেপ পাঠিয়ে দেন। আমি চেক করে সিলেক্ট করে নিবো।
মেনেজার: আচ্ছা স্যার।
মেহের ফোন কেটে পকেটে রেখে ছাদ থেকে চলে আসে। মুগ্ধের পাশের রুম হলো মেহেরের। মেহের রুমে যাওয়ার আগে বোনের রুমে উঁকি দিয়ে দেখে মুগ্ধ ঘুমিয়ে গেছে। শীতে ঠিকভাবে কম্বল্টা গায়ে দেয়নি। মেহের রুমে এসে কম্ববলটা বোনের গায়ে দিয়ে কপালে একটা ভালোবাসা দিয়ে লাইট নিবিয়ে দিলো। যাওয়ার আগে বোনের দিকে তাকিয়ে বললো,
মেহের: তোর অভিমান আমি ভাংগাবোই। তোকে যে এতো কষ্ট দিয়েছে ওর জীবন আমি জাহান্নাম বানিয়ে দেবো। তোর পায়ে এসে কাঁদবে সে দেখিস তুই চড়ুইপাখি।
মেহের নিজের রুমে এসে বসলো। তারপর হোয়াটসেপে গিয়ে ৬ জনের সব চেক করলো। সব চেক করে মেহেরের একজনকেই ভালো লাগলো সেটা হলো রুহি। মেহের রুহির নাম্বারে জব কনফার্ম ম্যাসেজ পাঠিয়ে দিলো।
তারপর বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরলো।
~এদিকে~
রুহি বিছানায় বসে বই পড়ছিলো। ফোনে ম্যাসেজ আসায় ম্যাসেজ চেক করে দেখে জব কনফার্ম ম্যাসেজ এসেছে। খান ইন্ডাস্ট্রি থেকে। রুহি তো খুশিতে আত্মহারা। অবশেষে ওর একটা চাকরি হলো। এবার ইনশাআল্লাহ ওর জীবনের সব সমস্যা সমাধান হবে। রুহি গিয়ে মাকে জানালো কথাটা। রুহির মাও শুনে অনেক খুশি হলো। আগামীকাল সকাল ১০ টা থেকে রুহির অফিস। রুহি তাই আর রাত জাগলোনা। তাড়াতাড়ি বিছানা করে শুয়ে পরলো। সামনে ওর ভালো দিন আসছে এই আশাই এখন ওর বুকে।
সকালে,,,,
মুগ্ধ আজকেও তাড়াতাড়ি উঠলো। উঠে নামাজ পরে নিলো। তারপর রান্না ঘরে গেলো। ভাইটা তার এসেছে যতই রাগ অভিমান হোক ভাইকেতো অনেক ভালোবাসে ও। তাই ভাইয়ের পছন্দের খাবার রান্না করতে লাগলো। মেহেরের মুরগির মাংস আর পরাটা অনেক পছন্দ। তাই মুগ্ধ নিজ হাতে ঝাল ঝাল মুরগির মাংস আর পরাটা বানিয়ে রাখলো। নিজের টুকু খেয়ে বাকিটা টেবিলে সাজিয়ে রুমে আসলো। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে ৯টা বাজতে চলেছে। মুগ্ধ তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিলো। ভার্সিটিতে কথা বলে নিয়েছে সে। আজ থেকে ক্লাস করতে পারবে সে। মুগ্ধ একদম রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলো।
ভার্সিটি এসে নিজের ডিপার্টমেন্ট চলে আসে মুগ্ধ। আজকে প্রথম ক্লাস মুগ্ধের ভালোই লাগছে ওর। মুগ্ধ সব ক্লাস করে ১১টায় বের হলো। এবার যাওয়ার পালা ওর সাদাফের বাসায়। মুগ্ধ একটা রিকশা নিয়ে সাদাফের বাসার জন্য বেরিয়ে পরে।
সাদাফের বাসায় এসে কলিং বেল দিতেই সাদাফের মা দরজা খুলে। মুগ্ধ তাকে দেখে সালাম দেয় সেও সালামের উত্তর দেয়। তারপর মুগ্ধ বাসার ভিতরে ঢুকে।
সোফায় বসে আছে প্রাপ্তিকে কোলে নিয়ে সাদাফ। ফিটার খাওয়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু প্রাপ্তি খাচ্ছে না কাঁদছে। মুগ্ধ সেটা দেখে সাদাফকে বলে,
মুগ্ধ: আমার কাছে দিন আমি খাওয়াচ্ছি।
সাদাফ মুগ্ধের কথা শুনে প্রাপ্তিকে মুগ্ধের কাছে দেয়। প্রাপ্তিকে কোলে নিয়ে এক আলাদা অনুভুতি হচ্ছে মুগ্ধের। এক মা মা অঅনুভুতি হচ্ছে ওর। প্রাপ্তিকে বুকে নিয়ে এই হাহাকার করা বুকটা যেনো প্রশান্তি পাচ্ছে ওর। মুগ্ধ প্রাপ্তিকে কোলে নিয়ে হাঁটতে লাগলো আর একটু একটু করে দুধ দিতে লাগলো। প্রাপ্তি দুধ খাচ্ছে। দেখতে দেখতে দুধটা খেয়ে নিলো প্রাপ্তি। সাদাফের মা আর সাদাফ অবাক হলো এতে। কারন তারা আশা করেননি প্রথমদিনেই প্রাপ্তিকে সামলে নিতে পারবে মুগ্ধ। মুগ্ধের সমস্যা হবে ভেবে সাদাফ আজকে বাসায় থেকে গেছে। প্রাপ্তিকে নিয়ে মুগ্ধ এবার সোফায় বসলো তারপর খেলতে লাগলো প্রাপ্তির সাথে। প্রাপ্তিও এতে আনন্দ পাচ্ছে। কারণ প্রাপ্তিও হাত পা নেড়ে নেড়ে খেলছে। খেলতে খেলতে প্রাপ্তি ঘুমিয়ে যায়। মুগ্ধ ওকে কোলে করে সাদাফকে জিজ্ঞেশ করে কোথায় শোয়াবে? সাদাফ বলে দেয় ওর রুমে দোলনায় শুয়ে দিতে। মুগ্ধ প্রাপ্তিকে নিয়ে দোলনায় শুইয়ে দিলো। তারপর নিজে পাশে চেয়ার টেনে বসে রইলো।
.
.
.
.
.
.
.
৯.
রুহি অফিসে এসে বসে আছে। মেনেজার ওকে ওর কেবিন দেখিয়ে দিয়েছে। রুহি নিজের কেবিনে এসে বসে আছে। মেহেরের আসতে লেট হবে তাই। মেহেরের সামনেই রুহির কেবিনে। মেহেরের রুমের জানালা দিয়ে রুহির পুরো কেবিন দেখা যায়। কিছু সময়ের মাঝে মেহের অফিসে আসে। অফিসের সবাই মেহেরকে ওয়েলকাম জানায়। মেহের নিজের রুমে এসে চেয়ারে বসে। তারপর টেলিফোন হাতে নিয়ে কল লাগায় রুহির কেবিনের ফোনে। টেলিফোনের আওয়াজ পেয়ে রুহি ফোন ধরে। রুহি হ্যালো বলতেই মাহির ওপাশ থেকে বলে,
মেহেরঃ আমার কেবিনে আসুন।
রুহি ফোন রেখে মেহেরের কেবিনে যায়।
মেহেরের কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় টোকা দিয়ে বলে,
রুহিঃ May I Coming Sir?
মেহেরঃ Yes, Coming.
রুহির মেহেরের কেবিনে ঢুকে। মেহের রুহির দিকে তাকিয়ে বলে,
মেহেরঃ মিস রুহি রাইট?
রুহিঃ জ্বি।
মেহেরঃ তো আপনি আজ থেকে আমার পিএ। অফিসে সব সময় টাইমলি আসবেন। আর কোনো সমস্যা থাকলে সেটা জানিয়ে দেবেন আগেই।
রুহিঃ জ্বি স্যার।
মেহেরঃ ওকে আপনি এখন আমার জন্য এক কাপ কফি করে দিয়ে। ওই সেল্ফ থেকে চারটা ফাইল আছে সেগুলা নিয়ে গিয়ে লাঞ্চ এর আগে চেক করে দিন।
রুহিঃ জ্বি আচ্ছা স্যার।
রুহি মেহেরকে কফি দিয়ে ফাইল নিয়ে কেবিনে চলে আসে। তারপর ফাইলগুলো চেক করতে থাকে। লাঞ্চ এর সময় হলে রুহি মেহেরের কেবিনে গিয়ে ওকে লাঞ্চ ঠিক করে দিয়ে আসে।
লাঞ্চ টাইম শেষ হলে রুহি ফাইল নিয়ে মেহেরের কাছে সেগুলা দিয়ে আসে। ৫টায় শেষ হয়ে যায় অফিস টাইম। রুহি অফিস থেকে বেরিয়ে বাজারে যায় কেনাকাটা করতে ঘরের জন্য। কেনাকাটা করে রিকশা নিয়ে বাসায় চলে আসে।
~এদিকে~
সায়মা আরিশকে বিয়ে করার জন্য পাগল করে দিচ্ছে। আরিশ বলছে কিছুদিন পর করবে কিন্ত সায়মা শোনার মেয়েই না। আরিশ বাসায় এসে বসে আছে। সায়মা বিয়ের জন্য পাগল হয়েগেছে। আরিশ ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।
এদিকে সায়মা হোটেলে নিজের আরেক বয়ফ্রেন্ডের সাথে রং লিলায় মেতে আছে। সায়মার কাছে আরিশ জাস্ট একটা টাকার খোরাক। মুগ্ধের থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আরিশকে ব্যবহার করেছে সে।
সায়মা ওর প্রেমিকের বুকে নগ্ন অবস্থায় শুয়ে আছে। নিলয় সায়মার ৪ নাম্বার প্রেমিক। টাইম পাস বলাও চলে। সায়মার কাছে এসব যেনো কিছুই না। সায়মা এক সাথে আরিশকে বোকা বানাচ্ছে আর একদিকে রংলিলা চালিয়ে যাচ্ছে।
রাত ১০টা,,,
মুগ্ধ সাদাফের বাসা থেকে বেরিয়েছে। সাদাফ দাড়োয়ানকে বলেছে ওকে একটা রিকশা ঠিক করে দিতে রোজ। দাড়োয়ান মুগ্ধকে একটা রিকশা ঠিক করে দেয়। মুগ্ধ রিকশায় করে চলে আসে বাসায়।
মুগ্ধ বাসায় এসে সোজা নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। মুগ্ধ আগেই জানিয়েছে এই চাকরির কথা তাই কেউ ওকে কিছু বলেনাই। তবে মেহের অমত করছিলো। কিন্তু মুগ্ধ তা শুনেনি। মুগ্ধ রান্না ঘরে গিয়ে দেখলো খাবার রাখা। মুগ্ধ খাবার খেয়ে নিলো। মেহের চলে গেছে এ বাসা থেকে। এটা শুনে মুগ্ধ আবার কষ্ট পেলো। তবে কি বললোনা।
মেহের নিজের রুমে বসে আছে। একটু পর একজন লোক ওর রুমে আসে। লোকটাকে দেখে মেহের জিজ্ঞেস করে,
মেহেরঃ জানতে পেরেছো কিছু?
লোকটাঃ হ্যাঁ। স্যার আরিশ যেই মেয়েটার সাথে এখন বর্তমানে আছে সে আপনার চাচার ছোট মেয়ে সায়মা খান।
সায়মার নাম শুনে আকাশ থেকে পরে মেহের। সব শেষে কিনা তার চাচার মেয়েই তার বোনের সংসার ধ্বংস করলো। কিন্তু মুগ্ধ কাউকে এটা বলছেনা কেনো। মেহের বুঝে উঠতে পারছেনা এই কারণ।
পরেরদিন,
যথাযথ সময় মুগ্ধ ক্লাস করে বেরিয়ে পরে সাদাফের বাসার জন্য। রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে রিকশার জন্য। মুগ্ধ আশেপাশে তাকিয়ে রিকশা খুঁজছে তখন ওর চোখ যায় ওপর সাইডে দিয়ে যাওয়া আরিশের দিকে। আরিশ ফোনে কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। মুগ্ধ আরিশকে দেখা মাত্রই একটা কষ্ট ফিল করলো। মাস্কের আড়ালে থাকা মুখটা নিমিষেই বিষিয়ে গেলো। মুগ্ধ তাড়াতাড়ি একটা রিকশা নিলো। গন্তব্য সাদাফের বাসা।
চলবে