শেষ_থেকে_শুরু_২,পর্ব_৬
নন্দিনী_চৌধুরী
১০.
প্রাপ্তিকে কোলে নিয়ে বারান্দার দাঁড়িয়ে আছে মুগ্ধ। মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে মেয়েটা। কান্না করছিলো উঠেই। তাই মুগ্ধ কোলে করে বারান্দায় নিয়ে এসেছে। এখন মেয়েটার কান্না থেমে গেছে। মুগ্ধ প্রাপ্তিকে ফ্রেশ করিয়ে ফিটার নিয়ে ওকে খাওয়াতে বসে। প্রাপ্তিও আসতে আসতে করে দুধটা খেয়ে নেয়। সাদাফ অফিসে চলে গেছে। পুরা বাসায় এখন মিসেস হাসান আর মুগ্ধ আছে। মুগ্ধ প্রাপ্তিকে নিয়ে নিচে আসে। মিসেস হাসান রান্না ঘরে রান্না করছে। মুগ্ধ প্রাপ্তিকে নিয়ে সেদিকে যায়। মুগ্ধকে দেখে মিসেস হাসান হাঁসি দিয়ে বলে,
মিসেস হাসান:আরে তুমি এখানে?
মুগ্ধ:এইতো ওকে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করছিলাম।
মিসেস হাসান:আচ্ছা তুমি বসো তোমার জন্য একটা জিনিশ বানিয়েছি। খেয়ে বলো কেমন হয়েছে।
মুগ্ধ গিয়ে সোফায় বসলো। মিসেস হাসান বাটিতে করে গুড়ের পায়েস নিয়ে আসলো। বাটিটা মুগ্ধের দিকে এগিয়ে দিলো। মুগ্ধ বাটি হাতে নিয়ে টেবিলে রাখলো। তারপর প্রাপ্তিকে এক সাইডে কোলে রেখে বাটি থেকে একটু একটু করে পায়েস নিয়ে খেতে লাগলো। প্রথম চামচ মুখে দিয়ে মুগ্ধ অনেক অবাক হলো। মুগ্ধ মিসেস হাসানের দিকে তাকিয়ে বললো,
মুগ্ধ:উম! পায়েসটা অনেক মজা।
মিসেস হাসান:আমার সাদাফের এই পায়েস অনেক পছন্দ।
মুগ্ধ:ওহ আচ্ছা।
মিসেস হাসান:তোমার বাড়িতে কে কে আছে মা?
মুগ্ধ:আমার বাবা মা আমি ছোট থাকতে মারা গেছে। আমার ভাই আছে বড়। আমি আমার চাচার সাথে থাকি। চাচা চাচি আর দুইটা চাচাতো বোন আছে।
মিসেস হাসান:ওহ আচ্ছা।
মুগ্ধ পায়েসটুকু খেয়ে প্রাপ্তিকে নিয়ে রুমে আসে। প্রাপ্তিকে এখন গোসল করাবে তাই। ওয়াটার হিটার দিয়ে পানি গরম করে নেয় মুগ্ধ। তারপর প্রাপ্তিকে গোসল করানো শুরু করে। গোসল শেষে ভালো করে শরীল মুছে দিয়ে পাউডার, ক্রিম,লোশন শরীলে মেখে দেয়। তারপর হালকা শীতের জামা পড়িয়ে দেয় প্রাপ্তিকে।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
রুহি মেহেরের সামনে বসে অফিসের ফাইল দেখছে। মেহের তাকে এখানে বসে কাজ করতে বলেছে। মেহের এক মনে ল্যাপ্টপে কাজ করছে। রুহি ওর মতো কাজ করছে। ওদের কাজের মাঝে একটা মেয়ে আসে মেহেরের কেবিনে। মেহের তাকে দেখে হাঁসি মুখে বলে,
মেহের:কেয়া তুমি!
কেয়া মাহিরের কাছে এসে বলে,
কেয়া:হ্যা আমি। কেমন আছো তুমি?
মেহের:হ্যা ভালো আছি তুমি কেমন আছো?
কেয়া:হ্যা ভালো। দেশে আসলা জানালেও না এটা ঠিকনা।
মেহের:সরি। আসলে এসেই বোনকে নিয়ে বিজি ছিলাম।
কেয়া:আই নো দেট। তা এ কি তোমার নিউ পিএ?
মেহের:হ্যা মিট হিম। সি ইজ মিস রুহি। আর মিস রুহি এ হচ্ছে আমার ফ্রেন্ড কেয়া।
রুহি কেয়ার দিকে মুচকি হাঁসি দিয়ে বলে,
রুহি:হ্যালো ম্যাম।
কেয়া:হ্যালো। আচ্ছা যেটা বলার জন্য আসলাম শুনো। আমার বাবা তোমাকে যেতে বলেছে। আর সাথে আমার বিয়ের কার্ড দিয়ে গেলাম। আসবে কিন্তু অবশ্যই আর তোমার ওই মিষ্টি পিএকেও নিয়ে আসবে কেমন। আর সাথে মুগ্ধকেও।
মেহের:আচ্ছা যাবো। প্রমিস।
কেয়া:ওকে আসি তাহলে।
কেয়া চলে যায়। আর মেহের রুহি আবার কাজে মন দেয়।
~অন্যদিকে~
সাদাফ আজকে দুপুরে বাসায় আসছে। অফিসের কাজ আজকে দুপুরে শেষ করে চলে আসছে। সাদাফ রুমে এসে দেখে প্রাপ্তিকে নিয়ে মুগ্ধ হাঁসছে আর পাপ্তিও হাত পা ছুড়ে ছুড়ে খেলছে। সাদাফ এই দৃশ্য দেখে অনেক খুশি। কিছু সময়ের জন্য সে মুগ্ধের জায়গায় প্রিয়াকে কল্পনা করে। সাদাফের কল্পনার মাঝে মুগ্ধ সাদাফকে দেখে বলে,
মুগ্ধ:আপনি!
মুগ্ধের আওয়াযে কল্পনা থেকে বেরিয়ে আসে সাদাফ। মুগ্ধের দিকে তাকিয়ে বলে,
সাদাফ:আজকে অফিসে তেমন কাজ ছিলোনা। তাই চলে এসেছি।
সাদাফ কাবার্ড থেকে জামা নিয়ে ওয়াশরুমে যায়। গোসল করে এসে প্রাপ্তিকে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগে। মুগ্ধ দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে। এর মাঝে মিসেস হাসান ওদের খেতে ডাকে। সাদাফ প্রাপ্তিকে নিয়ে চলে আসে নিচে মুগ্ধসহ। খাওয়া দাওয়া শেষ করে প্রাপ্তিকে মুগ্ধের কোলে দিয়ে সাদাফ বারান্দায় গিয়ে বসে। মুগ্ধ প্রাপ্তিকে ঘুম পাড়িয়ে সেখানেই বসে থাকে। কিছুসময় পর সিগারেটের গন্ধ নাকে আসে মুগ্ধের। গন্ধের উৎস খুঁজে দেখে সাদাফ বারান্দায় বসে সিগারেট খাচ্ছে। মুগ্ধ সেটা দেখে অবাক হয়ে বলে,
মুগ্ধ:আপনি স্মোক করেন?
আচমকা মুগ্ধের এমন প্রশ্নে ভেঁবাচেকা খেয়ে যায় সাদাফ। তাও নিজেকে সামলে বলে,
সাদাফ:সবসময় না। মাঝে মাঝে করি।
মুগ্ধ:আপনি জানেন আপনার ঘরে বাচ্চা আছে। তা জেনেও আপনি রুমে স্মোক করছেন। কেমন মানুষ বলুনতো আপনি। আপনি জানেননা সিগারেটের গন্ধ বাচ্চাদের জন্য ক্ষতিকর।
সাদাফ:আরে আমিতো রোজ খাইনা। বললামতো মাঝে মাঝে খাই।
মুগ্ধ:মাঝে খান আর প্রত্যেকদিন খান। ঘরে কেন খাবেন। বাহিরে যেয়ে খেয়ে আসুন এসব ছাইপাঁশ।
সাদাফ:আশ্চর্য এখন আমার ঘরে আমি কি করবোনা না করবো তার জবাব আপনাকে দেবো নাকি। আপনি শুধু প্রাপ্তির দেখা শুনা করার কাজে আছেন। আমার কাজে বাধা দেওয়ার কাজে আপনাকে রাখা হয়নাই।
মুগ্ধ:শুনুন আপনার কাজে বাধা দেওয়ার মতো ইচ্ছা আমার নেই। আমি প্রাপ্তির জন্যই বলছি। আপনি এখানে স্মোক করছেন তার গন্ধ আমি রুমে বসে পাচ্ছি। তাহলে সেটাতো প্রাপ্তিও পাচ্ছে। তাইতো বলছি টাকা দিয়ে এই মরণ বাহিরে বসে খেয়ে আসবেন।
মুগ্ধের কথায় সাদাফ বুঝতে পারে সে ভুল করেছে। তাই আর কিছু না বলে বেরিয়ে আসে রুম থেকে।
মুগ্ধ সাদাফের চলে যাওয়া দেখে ভেংগিয়ে বলে,
“এহ আসছে ওনাকে পটাতে ওনার কাজে বাধা দিতে। যেই না চেহারা নাম রাখছে পেয়ারা যত্তসব।”
মুগ্ধ গিয়ে আবার প্রাপ্তির পাশে গিয়ে বসে থাকলো।
~২দিন পর ~
রুহি রেডি হচ্ছে মেহের তাকে ফোন করে বলে দিয়েছে রেডি হয়ে অফিসে এসে থাকতে। সে তার বোনকে নিয়ে একেবারে আসবে। রুহি রেডি হয়ে বেরিয়ে যায় অফিসে যাওয়ার জন্য।
১১.
মুগ্ধকে সাদাফ আজকে তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে দিয়েছে। সাদাফের কোথাও একটা দাওয়াত আছে সেখানে যাবে সেই জন্য। মুগ্ধ বাসায় এসে দেখে সামিয়ার সাথে দেখা কররে আশেপাশের আন্টি খালারা আসছে মুগ্ধ তাদের সালাম দিয়ে নিজের ঘরে যাচ্ছিলো তখন এক মহিলা বলে উঠে,
মহিলা:বুঝিনা বাবা আজকালদের মেয়েদের কোনো লজ্জা শরম নাই কেন। ডিভোর্স হয়েছে স্বামী তাড়িয়ে দিয়েছে কোথায় ঘরে বসে থাকবে তানা দেখো বাহিরে গিয়ে ধেই ধেই করছে।
আরেকজন মহিলা: হ্যা একে ডিভোর্সি তার উপর বাজা একটুতো লজ্জা থাকা উচিত। বলি ও সালমা মেয়েকে সাবধানে রেখো জানতো বাজা মেয়ে মানুষ ভালা না সংসারের জন্য।
মুগ্ধ তাদের কথাগুলো শুনে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের কার্নিশে পানি এসে জমে গেছে।
সালমা কিছু বলতে যাবে তার আগেই দরজার দাঁড়ানো মেহের মহিলাদের উদ্দেশ্যে করে বললো,
মেহের:মুখে লাগাম দিয়ে কথা বলেন আন্টিগন।
মেহেরকে দেখে সালমা আর কথা বলেনা চুপ করে বসে থাকে। মেহের মুগ্ধের কাছে গিয়ে ওর হাতে শপিং ব্যাগ দিয়ে বলে,
মেহের:এখানে ড্রেস আছে পরে রেডি হয়ে নিচে আয়।
মুগ্ধ বুঝতে পারছে ভাই তার রেগে আছে তাই সে ব্যাগটা নিয়ে রুমে চলে যায়।
মুগ্ধ যেতেই মেহের আবার সেই মহিলাদের কাছে গিয়ে বলে,
মেহের:তো কি জানি বলছিলেন যে আমার বোনের লজ্জা থাকা উচিত সে ডিভোর্সি আর জানি কি হ্যাঁ বাজা। হাউ ডেয়ার ইউ টু টক লাইক দেট। আমার বোনকে এভাবে বলার সাহস হয় কিভাবে আপনাদের। আমার বোন লজ্জা কেন পাবে সে কি চুরি করেছে না খুন করেছে না জেল খেটে এসেছে। আমার বোন তার স্বামীকে ছাড়েনি তার স্বামী তাকে ছেড়েছে অন্য নাড়ীর জন্য। তাহলে আমার বোন কেন লজ্জা পাবে কেন লুকিয়ে থাকবে। আপনাদের এই সমাজে যে নিয়ম বানিয়ে রাখছেন ডিভোর্স হলে সেই মেয়েকে কালো চোখে দেখেন। ডিভোর্স তো না জেনো কোনো পাপ করে ফেলছে সে। একবার ও চিন্তা করেন যেই মেয়েটার ডিভোর্স হয়ে যায় তার ভেতরে কি হয় কতটা যন্ত্রনা হয়। সমাজের প্রত্যেক লোক তাকে নিয়ে কথা শোনায়। চা ওয়ালা থেকে শুরু করে রাস্তার বাজে ছেলেরা আপনাদের মতো আন্টিগনরাও। মেয়েটা বেঁচে থেকেও মরে যায় আপনাদের এসব কথা শুনে। একটা মেয়ে কোনোদিন স্বইচ্ছায় ডিভোর্সি হয়না যদিনা ওই মেয়ে খারাপ হয়। আজকাল পরোকীয়ার কারণে হাজার ঘর ধ্বংস হচ্ছে। কই যখন কোনো ছেলের ডিভোর্স হয় তখন সেই ছেলেটাকেতো আপনারা এসব বলেননা। তবে কেন একটা মেয়েকে বলেন। যেখানে সে নিজ ইচ্ছায় ডিভোর্সি হয়না। আর বাজা! একবার ও কি মুখে আটকায় না এই নোংড়া শব্দটা উচ্চারণ করার সময়। একটা নারী হয়ে অন্য নারীকে কিভাবে এই শব্দটা দিয়ে আঘাত করেন আপনারা। বাজা কেউ ইচ্ছা করে হয়না। আল্লাহর ইচ্ছায় সব হয়। আল্লাহ তায়ালার যাকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে বানিয়েছেন। আল্লাহ না করুক আপনার ঘরের মেয়ে বাজা হলে তাকে জিজ্ঞেস করবেন কেউ যদি তাকে এই শব্দটা বলে তার কলিজা কতটা জ্বলে।
মেহেরের কথা শুনে মহিলারা চুপ হয়ে যায়। তারপর আসতে আসতে একজন একজন করে উঠে চলে যায়। তারা যেতেই মেহের সালমাকে বলে,
মেহের:আমি জানি আপনি আমাদের ভালোবাসেননা পছন্দ করেননা। কিন্তু তাই বলে বাহিরের লোকের সামনে আমার বোনকে অপমান করেন। সাহস পান কিভাবে আপনি
মেহেরের কথায় ভয় পেয়ে যায় সালমা। আমতা আমতা করে বলে,
সালমা:তারা তো ভুল কিছু বলেনি তাইনা।
মেহের:Shut Up. কি ভুল কিছু বলেনি। এসব কথা বলার সাহস আসে কোথা থেকে ওনাদের। আর শুনুন সময় আসলেই বুঝতে পারবেন কোনটা সঠিক কোনটা ভুল। কে যে ভালো আর কে যে খারাপ। দুধের মধ্য চুনা দিয়ে বেশিদিন চলা যায়না।
কথাটা বলেই মেহের মুগ্ধের রুমে চলে যায়। আর সালমা ভাবতে থাকে কি বলে গেলো এটা মেহের। তবে কি সে কিছু জানতে পেরেগেছে!
চলবে