শ্যামসুন্দর_স্বপ্ন
#পর্ব_৩
নুশরাত_জাহান_মিষ্টি
সারারাত নুর জেগে কাটালো। ভোর হতেই গোসল সেরে ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবছে এখন তার কি করণীয়? নতুন বৌয়ের কি দায়িত্ব তা তো তার জানা নেই? হুট করে বাহিরেও যেতে পারে না। একবার বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা সুফিয়ানের মুখশ্রীতে তাকালো। ঘুমন্ত মানুষকে বোধহয় সবসময় খুব সুন্দর দেখায়। নিষ্পাপ লাগে তার মুখশ্রী। সুফিয়ানের মুখশ্রীও নুরের কাছে এই মূহুর্তে নিষ্পাপ লাগছে। ইচ্ছে করছে একটু ছুঁয়ে দিতে। সুফিয়ান গভীর ঘুমে মগ্ন। নুর কিছুটা সাহস নিয়ে সুফিয়ানের দিকে এগিয়ে গেলো।
বুকে অনেকটা সাহস নিয়ে সুফিয়ানের কপালে নিজের ডান হাতটা রাখলো। সদ্য গোসল করে আসা ভেজা চুল দিয়ে টপ টপ কয়েক ফোঁটা জল সুফিয়ানের মুখশ্রীতে পড়লো। সুফিয়ান সাথে সাথে জেগে গেলো। সুফিয়ানের ঘুম ভাঙতেই নুর হকচকিয়ে গেলো। সাথে সাথে নিজের হাতটা সরিয়ে নিলো। সুফিয়ান নুরের মুখশ্রীতে তাকিয়ে বললো,“স্বপ্ন ছিলো ভোরের আলোয় বৌয়ের মিষ্টি কন্ঠে ঘুম ভাঙবে”।
নুর কেঁপে উঠলো। সুফিয়ান পুনরায় বললো,“কিন্তু সব স্বপ্ন সত্যি হয় না”।
নুর কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,“চলুন না আমরা স্বাভাবিকভাবে সংসার করি”।
সুফিয়ান বিছানা থেকে উঠে পড়লো। নুরের কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বললো,“যেদিন স্বীকার করবে আমাকে কলঙ্কিত কেন করলে সেদিন ভেবে দেখবো। অবশ্য যথার্থ কারন দেখাতে পারলে মেনে নেবো এ সম্পর্ক”।
নুর চোখ বন্ধ করে নিলো। সুফিয়ান গোসলে যেতে যেতে বললো,“ফরাজি বাড়ির বৌ হওয়াই যদি তোমার একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তবে ভুলে যাও সুফিয়ান ফরাজির অর্ধাঙ্গিনী হওয়ার স্বপ্ন। সমাজের কাছে আমার অর্ধাঙ্গিনী হলেও, আমার মনে কখনো অর্ধাঙ্গিনীরুপে প্রবেশ করতে পারবে না”।
সুফিয়ান চলে যাচ্ছিলো তখনি নুর বললো,“একদিন আপনি আমার ভালোবাসার জন্য পাগল থাকবেন। আমাকে ভালোবেসে আমার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনবেন”।
সুফিয়ান এক পলক নুরের মুখশ্রীতে তাকিয়ে চলে গেলো। নুর সেখানে বসে পড়লো।
কিছুক্ষন পর রাইমা(সুমন ফরাজির স্ত্রী) এসে নুরকে বসার ঘরে নিয়ে গেলো। সেখানে মোটামুটি সবাই ছিলো। মেহরুন বেগম নুরকে উদ্দেশ্য করে বললেন,“ফরাজি বাড়ির বউরা বেলা অব্দি ঘুমায় না। সকাল সকাল উঠে বাড়ির কাজে লেগে পড়ে। বড় বউ ছোট বউকে এ বাড়ির নিয়ম-কানুন শিখিয়ে দেও”।
রাইমা মুচকি হেসে বললো,“আচ্ছা বড়মা”।
মেহরুন বেগম রান্নাঘরে চলে গেলেন। রাইমা নুরের সাথে গল্প করতে লাগলো।
“সবাই বলে জা জা কখনো বন্ধু হয় না। আমি কিন্তু এই কথাটি মিথ্যে করে দিতে চাই। তোমাকে আমার বোন বানাতে চাই”।
নুর স্নান হেসে বললো,“বাড়ির অন্যরা তো আমাকে মেনে নিতেই চাচ্ছে না, সেখানে তুমি বোন বানাতে চাচ্ছো”।
“চিন্তা করো না। আজ নয়তো কাল ঠিকই মেনে নিবে। তোমাকে দেলোয়ার ফরাজি সভায় বসে পুত্রবধূ রুপে গ্রহন করেছেন, যেহেতু কাকা গ্রহন করে নিয়েছে সেহেতু অন্যরাও গ্রহন করবে। তাছাড়া….”।
রাইমা থেমে গেলো।
“তাছাড়া”?
“তুমি খুব সুন্দরী। এ বাড়িতে সুন্দরদের কদর খুব বেশি হয়”।
“তাই তাহলে এখন মেনে নিচ্ছে না কেন”?
“আসলে তুমি এমন একজনকে দোষ দিচ্ছো, যার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আমারি বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। সেখানে অন্যরা তো অবিশ্বাস করবেই”।
“তারমানে তুমিও বিশ্বাস করো আমি মিথ্যা বলছি”?
“উঁহু। আমি জানি কোন নারী নিজের চরিত্রে দাগ লাগাতে চায় না। তাছাড়া মানুষকে যেমন ভাবা হয়, অনেক সময় সে তেমন হয় না। হয়তো সুফিয়ান ভাই আমার ভাবনার মতো নয়। তাকে ভালো মানুষ ভেবে আমি ভুল করেছি”।
নুর কিছুটা সময় নিয়ে বললো,” আমাকে তো চেনো না তবুও যাকে চেনো জানো তাকে অবিশ্বাস করছো”?
রাইমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,“সে যদি সুমন ফরাজির ভাই না হতো তবে অবিশ্বাসটা জন্ম নিতো না”।
“মানে”?
“না কিছু না”।
নুর বুঝলো রাইমা কিছু বলতে চাচ্ছে না। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে নুর বললো,“বাড়ির পুরুষদের দেখছি না যে”?
“সবাই খুব ভোরেই নাস্তা করে বেরিয়ে যায়”।
“আচ্ছা তারা কি কাজ করে”?
“তুমি জানো না”?
“না। আমি শুধু জানি তিনি(সুফিয়ান) ডাক্তার। বাকিদের কথা জানি না তো”।
“ওহ আচ্ছা। আমার শশুড় এবং কাকা শশুড়ের শহরে বড় ব্যবসা আছে। শুনেছি দু’টো বড় বড় মিল কারখানা আছে”।
“শহরে ব্যবসা তো তারা গ্রামে থাকে কেন”?
রাইমা উৎফুল্ল মনে বললো,“কাকা মানে তোমার শশুড়মশাই খুব ভালো মনের মানুষ। সে সবসময় গ্রামের মানুষদের পাশে থাকতে চেয়েছেন, তাদের ভরসা হয়ে থেকে যেতে চান। তাই তো গ্রাম ছেড়ে কখনো শহরে যাওয়ার কথা ভাবেনি”।
“তোমার স্বামী কি করে? বাবার ব্যবসায় সহযোগীতা”।
“হ্যাঁ। কি করবে বলো সুফিয়ান ভাই তো ব্যবসা করবে না বলে দিয়েছে। সে ডাক্তারি করেই জীবন পার করতে চায়। সেজন্য বাড়ির মেঝো ছেলে হিসাবে তাকেই ব্যবসার হাল ধরতে হলো”।
“মেঝো ছেলে”?
একটু থেমে নুর পুনরায় বললো,“মানে সুমন ফরাজি এ বাড়ির বড় সন্তান নয়”?
রাইমা হতভম্ব হয়ে গেলো। কি বলতে কি বলে ফেলেছে? রাইমা কথা ঘোরাতে বললো,“আম্মা অসুস্থ আমাকে যেতে হবে। দেখি তার কিছু প্রয়োজন হয় কিনা। তুমি আমার সাথে যাবে? আম্মার সাথে তো তোমার পরিচয় হয়নি”।
নুর কৌতুহল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,“আচ্ছা চলো”।
নুরকে নিয়ে রাইমা তার শাশুড়ী মায়ের কাছে এলো। নুর এসে সুন্দর ভাবে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,“শরীর কেমন আছে আপনার”?
রোকসানা বেগম ধমকের সাথে বললেন,“সেটা তোমার জেনে কাজ নেই। আমার ঘর থেকে বের হও”।
রাইমার দিকে ঘুরে বললেন,“এই ফকিন্নিকে আমার সামনে থেকে চলে যেতে বলো বৌমা”।
রাইমা আমতা আমতা করে বললো,“আম্মা ও তো….”।
“আমি কি বললাম শুনতে পাওনি”?
রাইমা কিছু বলার পূর্বেই নুর বললো,“আমি চলে যাচ্ছি”।
নুর সোজা মেহরুন বেগমের কাছে এলো। মেহরুন বেগম দুপুরের রান্নার আয়োজন করছিলেন। মনে সাহস নিয়ে বললো,“আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি”?
“সকালের খাবার খেয়েছো”?
“না”।
“বড় বৌ যে কি করে”?
বাক্যটি বলে মেহরুন বেগম উঠে গিয়ে নুরের জন্য টেবিলে খাবার বেড়ে দিলো।
“খাবারটা খেয়ে নেও”।
“আমি….”।
নুরকে থামিয়ে দিয়ে মেহরুন বেগম বললেন,“যা বললাম তাই করো”।
নুর চুপচাপ খাবার খেতে বসলো। খাবার মুখে দিতে গিয়ে থেমে গিয়ে মেহরুন বেগমকে বললেন,“আপনি খেয়েছেন”?
মেহরুন বেগম নুরের মুখশ্রীতে তাকিয়ে বললো,“আমার ছেলেটা না খেয়ে চলে গেলো, সেখানে আমি খাই কি করে”?
নুর অপরাধী কন্ঠে বললো,“আমি এসে আপনাদের মা ছেলের সম্পর্কে ভাঙন ধরাচ্ছি তাই না”?
নুর একটু থেমে পুনরায় বললো,“বিশ্বাস করুন আমি মিথ্যে বলেনি”।
মেহরুন বেগম ধীর কন্ঠে বললেন,“আমার সুফিও মিথ্যে বলে না”।
একটু থেমে পুনরায় বললেন,” খেয়ে ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নেও। আজ কিছু করা লাগবে না। কাল থেকে ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠবে”।
নুর শুধু মাথা নাড়ালো। মেহরুন বেগম নিজের কাজে মনোনিবেশ দিলো।
নুর হঠাৎ খাবার নিয়ে মেহরুন বেগমের কাছে গেলো। হাতে খাবার নিয়ে মেহরুন বেগমের মুখের দিকে বাড়িয়ে দিলো। মেহরুন বেগম চমকে নুরের দিকে তাকালো। নুর শান্তভাবে বললো,“আপনার ছেলে ঠিক বাহিরে খেয়ে নিবে, আপনি চিন্তা করবেন না। এভাবে না খেয়ে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বেন”।
মেহরুন বেগম নুরের মুখশ্রীতে এবার ভালোভাবে লক্ষ্য করলো। হঠাৎ করেই মনে হলো সে নুরের স্থানে অন্যকাউকে দেখছে৷ সেই মানুষটাকে “যার চোখে হাজার অভিযোগ উঁকি দিচ্ছিলো তবুও সে মেহরুন বেগমের মুখে খাবার তুলে দিয়েছিলো”। নুর তার মতোই। তাদের মধ্যে পার্থক্য একটাই নুর নিজ মুখে খেতে বললো, আর সে চোখের ভাষায় বলেছিলো।
মেহরুন বেগম তাকে স্মরণ করেই খাবারটা মুখে দিলো। নুর খুব খুশি হলো।
★
হলুদ পাড়ের সবুজ শাড়ী পরিহিত এক রমনীর সাথে রাজ হাতে হাত রেখে হেঁটে চলছিলো। রমনীর মুখে ছিলো মিষ্টি হাসি, চোখে এক আকাশ সমান ভালোবাসা। রাজ তার পাশে দাঁড়ানো সবুজ পরীটার মুখশ্রীতে তাকিয়ে ছিলো একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে। হঠাৎ রমনী তার হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। রাজ অবাক হলো। রমনী রাজের মুখশ্রীতে তাকিয়ে হেসে দিলো। হাসি মুখেই রমনী ছুটে গেলো সামনের দিকে। রাজ রমনীকে কিছু ডাকলো কিন্তু রমনী শুনলো না। রাজও তার পিছু পিছু যাচ্ছিলো। কিছুটা পথ যেতেই রমনী বিলীন হয়ে গেলো।
রাজ ‘প্রিয়’ বলে এক চিৎকার দিলো। রাজ ভালোভাবে চারদিকে তাকিয়ে দেখলো সে তার বিছানায় বসে আছে। রাজ নিজের দিকে তাকিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,“যাক এটা স্বপ্ন ছিলো”।
তবুও ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না রাজ। তাই নিজের মুঠোফোনে ‘প্রিয়’ বলে সেইভ করা নাম্বারটিতে কল দিলো। একবার রিং হতেই ওপর পাশ থেকে কলটি রিসিভ হলো। ওপর পাশ থেকে ‘হাই’ বলতেই রাজ বললো,“আমায় ছেড়ে যাবা না তো প্রিয়”?
ওপর পাশ থেকে হাসির শব্দ এলো।
“হেসো না গো রমনী, তোমার পাগল করা হাসি আমায় মাতাল করে দেয়”।
“তাই”?
“হু। এবার বলো ছেড়ে যাবা না তো”?
“ধরলাম কখন যে ছাড়ার প্রশ্ন আসছে”।
“হেয়ালি করো না প্রিয়। আমি সিরিয়াস”।
“যারে আমার মন চেয়েছিলো সপনে সে মানুষটা আমার না, সে মানুষটা আমার না”।
“মানে”?
“সময় আসুক বুঝে যাবে”।
“তুমি আমার সাথে মজা করছো”?
“উঁহু”।
“তো”?
“তো কি”?
“আমি যেটা শুনতে চাই সেটা কবে বলবে”?
“সময় আসুক ঠিক বলবো”।
“সময়টা কখন আসবে”?
“এসব বাদ দিয়ে কাজে মন দেও। তোমার হাতে না নতুন কেস এসেছে”?
“হু”।
“সেটায় মনোনিবেশ করো”।
“পৃথিবীর কোন কাজই আমার প্রিয়র থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়”।
“তাই। তাহলে প্রিয় বলছে কাজে মনোযোগ দিতে, এখন সেটাই করো”।
“আচ্ছা”।
“হু রাখছি”।
ফোনটা রাখতে নিতেই রাজ বলে উঠলো,“ভালোবাসি প্রিয়”।
ওপর পাশ থেকে পুনরায় হাসির শব্দ এলো। ফোনটা সাথে সাথে কেটে গেলো।
রাজ মুচকি হেসে কাজে মনোযোগ দিলো। রফিকের একটা ছবি হাতে নিয়ে রাজ বললো,“এ নিজেকে যতটা ভালো মানুষরুপে প্রকাশ করেছে, বাস্তবে এ ততটাই খারাপ মানুষ”।
চলবে