শ্যামসুন্দর_স্বপ্ন #পর্ব_৪_ও_৫

0
933

শ্যামসুন্দর_স্বপ্ন
#পর্ব_৪_ও_৫
নুশরাত_জাহান_মিষ্টি
০৪

সাহেরা মানসিক হাসপাতালে কর্মরত সালেহা বেগমের মৃতদেহ পাওয়া গেলো তার নিজ বাড়িতে। রফিককে যেভাবে গলা কেটে মেরে ফেলা হয়েছিলো, সালেহাকে ঠিক সেভাবে মারা হয়েছে।
রাজের মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিলো। তার ধারনা ছিলো রফিকের একাধিক নারীর সাথে সম্পর্ক তার মৃত্যুর কারন। হয়তো তার প্রেমিকাদের মধ্যেই তাকে কেউ খুন করেছে। অথবা তার স্ত্রী সামিয়া তার কুকর্ম জেনে যাওয়ায় হয়তো স্বামীকে খুন করেছে। কিন্তু ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিলো। শুধু সালেহার মৃত্যুতে যে অন্যদিকে মোর নিলো তা নয়, সালেহার মৃতদেহের পাশে পাওয়া চিরকুটটা ঘটনাকে অন্যদিকে মোড় নিতে বাধ্য করলো। হ্যাঁ সালেহার মৃতদেহের পাশে একটা চিরকুট পাওয়া গেছে। চিরকুটে লেখা ছিলো,“সামিয়া সুলতানা ধন্যবাদ জানান নিজের সন্তানকে। কেননা আপনার গর্ভে ও যতদিন বেড়ে উঠবে, ঠিক ততদিন আপনি বেঁচে থাকবেন”।
এই চিরকুট দ্বারা পরিস্কার খুনি যে হোক না কেন, তার উদ্দেশ্য সামিয়াকে খুন করা। সামিয়া গর্ভবতী হওয়া খুনি তাকে ছেড়ে দিয়েছে।

চিরকুটের কথাগুলো শুনে সামিয়া হতভম্ব হয়ে গেলো। নিজের পেটে হাত দিয়ে কান্না করে দিলো। ভেবেছিলো স্বামীর মৃত্যুতেই বোধহয় সবকিছু শেষ। কিন্তু না। রাজ বারবার জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে,“আপনাদের সাথে কার এত গভীর শত্রুতা, যে আপনাদের মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতে পারে”?
“আমি আবারো বলছি, বারবার বলছি আমাদের সাথে কারো কোন শত্রুতা নেই”।
“শত্রুতা না থাকলে কেউ শুধু শুধু আপনাদের মারতে চাইছে”?
“আমি কিছু জানি না”।
“আপনি কিছুই জানেন না নাকি জেনেও বলবেন না”।
“কি বলতে চাইছেন আপনি”?
“এটাই আপনার স্বামী কোন ভালো মানুষ ছিলেন না। তিনি একাধিক নারীতে আসক্ত পুরুষ ছিলেন। সবচেয়ে আশ্চর্যকর বিষয় হলো, আপনি এই ব্যপারে সবকিছু জানতেন তবুও চুপ ছিলেন”।
“আপনি মিথ্যে বলছেন এসব সত্যি নয়। আমার স্বামী খুব ভালো মানুষ ছিলেন। আমাদের সাথে কারো কোন শত্রুতা নেই”।

রাজ শব্দ করে হেসে দিলো। মুখে হাসি ধরে রেখেই বললো,“আপনার স্বামীর মিলিত হওয়া এক নারীই বলেছেন যে তারা আপনার সামনেই নোংরামিতে লিপ্ত হতেন। কিন্তু আপনি কিছুই বলতেন কিংবা বলতে পারতেন না। স্বামী প্রেম এবং সমাজে নিজেদের সম্মান হারানোর ভয়ে চুপ ছিলেন”।
“না এসব কিছু সত্যি নয়। এগুলো মিথ্যে”।
“আমি আপনাকে সত্যি বলতে জোর করবো না, শুধু এতটুকু বলবো সময় থাকতে সত্যি বলে দিন নয়তো পরে পঁচতাবেন। মনে রাখবেন খুনির পরবর্তী শিকার আপনি”।
রাজ জোর গলায় বাক্যটি বলে চলে গেলো। সালেহার মৃত্যু দিয়ে এতটুকু পরিস্কার সাহেরা মানসিক হাসপাতাল কোন না কোনভাবে এই খুনগুলোর সাথে জড়িত। হাসপাতালে এরকম কিছু হয়েছে বা আছে যার ফলে এই মৃত্যুগুলো হচ্ছে। ঘটনা শুধুমাত্র রফিক এবং সামিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে সালেহার মৃত্যু হতো না। সালেহার মৃত্যু হাসপাতালকেই নির্দেশ করছে।

অন্যদিকে সামিয়া চিন্তিত হয়ে বসে রইলো। তার গর্ভে তিন মাসের সন্তান বেড়ে উঠছে। মাত্র কয়েক মাস পর তার সন্তান ভূমিষ্ট হবে আর তখনি…। না সামিয়া ভাবতে পারছে না তার মৃত্যু। কিছুতেই না, হতে পারে না। হঠাৎ সামিয়ার ফোন বেজে উঠলো। সামিয়া তাকিয়ে দেখলো অপরিচিত নাম্বার। প্রথমে ধরবে না ভেবেও কি মনে করে ধরলো। ফোনটি ধরতেই ওপাশ থেকে কেউ বললো,“ভয় হচ্ছে, মৃত্যুর ভয়”।
সামিয়া আতংকিত হয়ে বললো,“কে…কে তুমি”?
“আমি নিজের পরিচয় দিলে তুমি কি আমায় চিনবে? উঁহু চিনবে না৷ যদি ভাবো পুলিশের সাহায্যে আমার কাছে আসবে তবে তাও পারবে না। আমি না চাইলে আমাকে ছুঁতে পারবে না তুমি”।
“কি চাই তোমার? কেন আমাদের পিছনে পড়ে আছো”?
“আমি দুটো জিনিসের মধ্যে একটা জিনিস চাই। এখন তুমি ভেবে ঠিক করো তুমি কোনটা দেবে”।
সামিয়া ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো,“কি কি”?
“হয় তোমার মৃত্যু নয়……”।
“আমি একটা…
সামিয়াকে বাক্যটি সমাপ্ত করতে না দিয়ে বললো,“একটাও দিবো না বলে লাভ নেই। যেকোন একটা আমার চাই”।
“কেন করছো তুমি আমার সাথে এমন”?

ওপর পাশ থেকে এবার কিছুটা শান্তস্বর ভেসে এলো,“তুমি তো মা হবে তাই না? মা হওয়ার অনুভূতি কেমন হয় জানো তো তুমি তাই না”?
“মানে”?
“একটা বৈধ সন্তানকে গর্ভে নিয়ে মায়েরা খুব সুখী মনে করে নিজেদের তাই না”?
“তুমি কি বলতে চাইছো”?
“উঁহু। আমি যা বলি শুধু তার উত্তর দেও”।

সামিয়া চুপ করে গেলো। ওপর পাশ থেকে বললো,“যখন রফিক মারা গেলো তখন তুমি পেটে হাত দিয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিলে তাই না”?
“হ্যাঁ কারন আমার একটা স্বপ্ন ভেঙে গেলেও বাঁচার জন্য নতুন একটা স্বপ্ন আমার মধ্যে বেড়ে উঠছিলো”।
“মানুষ এমনি একটা স্বপ্ন ভেঙে গেলে নতুন স্বপ্ন দেখে। কারন সবাই বাঁচতে চায়”।
“আপনি আমাকে এসব কেন বলছেন”?
“কতটা কষ্ট, কতবার স্বপ্ন ভেঙে গেলে একটা মেয়ে একটা অবৈধ সন্তানকে আকড়ে বাঁচতে চায় সেটার যন্ত্রনা আপনি বুঝেন মিসেস সামিয়া শেখ”।
সামিয়া হতভম্ব হয়ে বসে পড়লো। ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তি পুনরায় বললো,“স্বপ্নগুলো পূরণ হয় না জেনেও একটা মানুষ বারবার স্বপ্ন কেন দেখে জানেন? কারন সে বাঁচতে চায়। নতুন করে বাঁচতে চায়। সেরকম একজন বাঁচতে চেয়েছিলো, হাজারটা স্বপ্ন যখন ভেঙে গেছিলো ঠিক তখন সে একটা অবৈধ সন্তানকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলো। সে জানতে সে যাকে আকড়ে ধরেছে সে অবৈধ। তবুও তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলো। তার একটা স্বপ্ন সত্যি হলে খুব কি ক্ষতি হয়ে যেতো”?
সামিয়া ভিষনভাবে ভয় পেলো, কারন ফোনের ওপারে যে ছিলো সে কান্না করছিলো। তার কান্নার গোঙানি বুঝতে পারছিলো সামিয়া। ওপাশে থাকা ব্যক্তিটি পুনরায় বললো,“আসা করি আমার উদ্দেশ্য আপনি বুঝতে পেরে গেছেন”।
সামিয়া কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,”হ্যাঁ”।
“তো চুপচাপ আমার কথামতো কাজ করুন নয়তো আপনার গর্ভে বেড়ে ওঠা ঐ নিষ্পাপ প্রানটাও আপনার সাথে বিনাশ হবে। আপনি নিশ্চয় চাইবেন না তাকে এই সুন্দর পৃথিবী দেখা থেকে বঞ্চিত করতে”?
সামিয়া থ মেরে বসে রইলো।

তার ঠিক কিছু মূহুর্ত পরে রাজের কাছে খবর গেলো সামিয়া নিখোঁজ। বাসা থেকে বেরিয়ে সে কোথায় গেছে, তা কারো জানা নেই।

অনেকটা রাত করে সুফিয়ান বাড়িতে ফিরলো। নিজের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষন কড়া নাড়ার পরও দরজা খোলার নাম গন্ধ নেই। সুফিয়ান অনাবরত কড়া নাড়তে লাগলো। ভিতর থেকে দরজা খোলার শব্দ পেয়ে কড়া নাড়া থামিয়ে দিলো সুফিয়ান। নুর দরজা খুলে দিতে সুফিয়ান ভিতরে প্রবেশ করলো। সুফিয়ান ভিতরে প্রবেশ করে কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই মাথা বেশ আঘাত পেলো। সুফিয়ান মাথায় হাত দিয়ে পিছনে ঘুরতেই দেখলো নুর চোখ বন্ধ করে হাতে একটা লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিরবির করে ‘কাছে আসবেন না’ কাছে আসবেন’ বলতে বলতে পুনরায় লাঠি দিয়ে আঘাত করতে নিতেই সুফিয়ান হাত দিয়ে ধরে ফেললো। প্রচন্ড রাগ নিয়ে বললো,“মাঝরাতে এসব কোন ধরনের অসভ্যতামি“?
সুফিয়ানের কন্ঠ পেয়ে নুর চোখ মেলে তাকালো। নিজের সামনে সুফিয়ানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাতের লাঠি ফেলে দিয়ে শক্ত করে সুফিয়ানকে জড়িয়ে ধরলো।
সুফিয়ান বেশ অবাক হলো। প্রথমদিন ঠিক এভাবেই নুর সুফিয়ানকে জড়িয়ে ধরেছিলো। সেদিন কোন একটা ছায়া দেখে ভয় পাচ্ছিলো। আজ কিসের জন্য ভয় পাচ্ছে। সুফিয়ান নিজের কন্ঠ যথেষ্ট নরম করার চেষ্টা করে বললো,“ভয় পাচ্ছো কেন? কি হয়েছে তোমার”?
নুুর সুফিয়ানকে জড়িয়ে ধরেই বললো,“আমি সত্যিটা বললে আপনি বিশ্বাস করবেন”?
নুর প্রচন্ড ভয় পেয়ে আছে সুফিয়ান বুঝতে পারলো। নুরকে আশ্বাস দিয়ে সুফিয়ান বললো,“সত্যি বললে নিশ্চয় বিশ্বাস করবো”।

নুর মুখশ্রী তুলে সুফিয়ানের চোখে চোখ রাখলো। সুফিয়ান নুরকে চোখের ইশারা আশ্বস্ত করলো। নুরকে নিয়ে সুফিয়ান বিছানায় গিয়ে বসলো।
নুর নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে বললো,“আমি আসলে ফরাজি বাড়ির বউ হওয়ার লোভে আপনাকে কলঙ্কিত করিনি”।
সুফিয়ান কৌতুহলী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করলো,“মানছো তুমি আমাকে কলঙ্কিত করেছো, আমি তোমাকে কলঙ্কিত করিনি”?
“হ্যাঁ মানছি। আমি জানি সত্যি কখনো আড়াল থাকে না”।

“তাই তাহলে আমাকে মিথ্যে দিয়ে কেন বাঁধলে”?
“যদি বলি ভালোবাসি তাই”।
সুফিয়ান বিষ্ময়কর চাহনি দিয়ে নুরের দিকে তাকালো। নুর স্বাভাবিকভাবে বললো,“আপনি হয়তো ভাবছেন আমরা তো পূর্ব পরিচিত নই তবে ভালোবাসা কোথা থেকে আসলো”।
সুফিয়ান বললো,“হ্যাঁ সেটাই”।
“তবে আপনাকে সবটা শুরু থেকে শুনতে হবে”।
“বলো আমি শোনার জন্য প্রস্তুত আছি”।

নুর একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলতে লাগলো,
“গ্রামের এক সাধারণ কৃষকের ঘরে আমার জন্ম। ছোটবেলা থেকে আমার রুপ নিয়ে আমার বাবা-মা চিন্তিত ছিলেন। সাধারণ ঘরে এরকম রুপবান নারীর জন্ম যে মানায় না। আমার মা ভয় পেতো যদি বড় হওয়ার পর আমার জীবনে দূর্যোগ নেমে আসে। এই ভয়টা কিসের জন্য তা আমার জানা ছিলো না! শুধু জানতাম মা চাইতে আমি সবসময় লোক চক্ষুর আড়ালে থাকি। নিজেকে স্বাবলম্বী করার জন্য যতটা শিক্ষার প্রয়োজন ততটা অব্দিই বাবা, মা পড়িয়েছেন।
জীবন ভালোই চলছিলো। বাবা, মা আমার বিবাহ নিয়ে ভাবছিলেন। অন্যদিকে আমি আমার জামাই হিসাবে কেমন মানুষ চাই সেটা নিয়ে ভাবছিলাম। যেদিন তমার(বন্ধুর) মুখে শুনেছিলাম, কিভাবে আপনি আপনার প্রতারক বন্ধুকে তমার সম্মান ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বাধ্য করেছিলেন। সেদিন থেকেই আপনাকে নিয়ে মনেমনে একটা আকাঙ্খা জন্ম নিয়েছিলো। তমা তাকে বাঁচানোর সাথে আপনার চরিত্রের গল্পও বলতে। সুচরিত্রের একজন ব্যক্তির গল্প শুনতে শুনতে তাকে ভালোবেসে ফেলাটা বোধহয় অপরাধের নয়।
সে যাই হোক আমি জানতাম আপনি ফরাজি বাড়ির সন্তান৷ আপনার সাথে আমার যায় না। তাই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু….”

এতটুকু বলে নুর কিছুটা সময় থেমে পুনরায় বলতে লাগলো,“যেদিন আপনার ভাই সুমন ফরাজির নজরে পড়ি সেদিন থেকে জীবনটা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো। সহজে বাসা থেকে বের হতাম না। তাই মাঝেসাঝে পাশের বাগানে একা একা সময় কাটাতাম। সেদিনও কাটিয়ে ছিলাম। সেদিন হঠাৎ কোথা থেকে সুমন ফরাজি সেখানে এসে উপস্থিত হন। আমি তাকে থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলাম তখনি সে আমার এক হাত ধরে নেয়। মাথায় ঘোমটা ছিলো বিধায় আমার মুখশ্রী তার কাছে পরিস্কার ছিলো না। তাই সে বললে,“দেখো তোমার মুখশ্রী। দেখি রহিমের মেয়ে কত সুন্দরী? যে সৌন্দর্য আড়াল করে রাখার প্রয়োজন”।
“আমার হাত ছাড়ুন”।
সুমন হাত না ছেড়ে উল্টো টান দিয়ে নুরকে নিজের বুকে নিয়ে এলো। জোর পূর্বক তার মাথা থেকে ওড়না সরিয়ে নিলো।
“সত্যি তুমি অনেক সুন্দর”।
নুর সেদিন কোনমতে পালিয়ে এসেছিলো। এরপর থেকে বাড়ির বাহিরে যাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিলাম। কিন্তু সুমন ফরাজি বারবার আমাদের বাড়িতে আসার চেষ্টা করছিলো। বাবাকে ভয় দেখাচ্ছিলো, বলেছিলো সে আমাকে বিয়ে করতে চায়।
বাবা হন্তদন্ত হয়ে আমার বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেখানেও সুমন ফরাজি বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেন, আমার জন্য ঠিক করা পাত্রকে টাকা দিয়ে বিয়ে ভাঙতে বাধ্য করলো।

সুমন ফরাজি বারবার ভয় দেখাচ্ছিলো। তখন বাবা, মা ঠিক করলো সুমন ফরাজির থেকে বাঁচতে তার ভাইয়ের সাহায্য নিবে। নিশ্চয় সুমন ফরাজি নিজের ভাইয়ের স্ত্রীকে বিরক্ত করার সাহস দেখাবে না। তাছাড়া সুফিয়ান ফরাজি সম্পর্কে যতটা জেনেছি তাতে সে নিজের স্ত্রীকে রক্ষা করতে সক্ষম।

নুর সুফিয়ানের সামনে কান্না করে দিলো এবং বললো,“এজন্যই আপনার সাথে এই নোংরা খেলাটা খেলা”।
সুফিয়ান সন্দিহান চাহনি দিয়ে বললো,“ভাইয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওনি কেন”?
“কারন কোন প্রমাণ ছিলো না আর….”
“আর”?
নুর চুপ করে গেলো। সে কিছুতেই বাকিটা বলতে পারবে না। নুর নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললো,“একটু আগেও সে এসেছিলো”।
“কে? ভাইয়া”?
নুর মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। নুর হঠাৎ করে পুনরায় সুফিয়ানকে জড়িয়ে ধরলো। আবেগমাখা কন্ঠে বললো,“দয়া করে আর রাতে দেড়ি করে আসবেন না। আজ তো বেঁচে গেছি কিন্তু পরে কখনো আসলে”।
একটু থেমে নুর পুনরায় বললো,“হয়তো আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না তবুও আমার অনুরোধটা রাখুন। একদিন ঠিক সত্যিটা আপনার সামনে চলে আসবে”।

সুফিয়ান আলতো করে নুরের পিঠে হাত রাখলো। শান্তভাবে বললো,“কালকে রাতের জন্য সরি”।
“কিসের জন্য”?
সুফিয়ান আমতা আমতা করে বললো,“ঐভাবে জোর করা উচিত হয়নি”।
নুর কিছু বললো না। চুপচাপ সুফিয়ানকে জড়িয়ে ধরে রাখলো।

খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে নুর কাজে লেগে পড়লো। মেহরুন বেগমকে কোন অভিযোগ করতে দেবে না বলে ঠিক করে নিলো।
মেহরুন বেগম ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে এসে আগে থেকে নুরকে উপস্থিত দেখে কিছুটা অবাক হলেন। কিন্তু কিছু বললেন না। নুর মুচকি হেসে মেহরুন বেগমকে বললো,“শুভ সকাল আম্মা”।
মেহরুন বেগম চুপচাপ নিজের কাজে লেগে পড়লেন। মেহরুন বেগমের দিকে তাকিয়ে নুর মনেমনে বললো,“আমি আপনার ছেলেকে কথা দিয়েছি আপনাকে সব বলবো, আমি জানি আপনি সব শুনে আমার উপর আর রাগ করে থাকতে পারবেন না”।

প্রতিদিনের মতো বাড়ির সকল পুরুষ কাজে বেরিয়ে গেলে নুর মেহরুন বেগমের ঘরে গেলো। মেহরুন বেগম ঘর গোছাতে ব্যস্ত তখন। নুর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,“আম্মা আসবো”?
মেহরুন বেগম দরজার পাণে তাকিয়ে নুরকে দেখতে পেলেন। ভিতরে আসার সম্মতি দিয়ে নিজের কাজে মনোনিবেশ করলেন। নুর ভিতরে প্রবেশ করে মেহরুন বেগমকে বললো,“আম্মা আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না”?
“কিসের জন্য ক্ষমা চাচ্ছো? তুমি কি কোন ভুল করেছো”?
“ভুল তো করেছি”।
“কি ভুল”?
“আপনার শিক্ষাকে কলঙ্কিত করে”।
“তুমি ঠিক কি বলতে চাচ্ছো”?

নুর মাথানত করে সবকিছু বললো। মেহরুন বেগম কয়েক মূহুর্ত নুরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। নুর জিজ্ঞেস করলো,“আপনি কি এখনো রেগে আছেন”?
“উঁহু। আমার বিশ্বাস ছিলো নিজের শিক্ষার উপর। বড়টাকে নিজের শিক্ষায় বড় করতে পারিনি, ছোটটাকে করেছিলাম। আমি জানতাম আমার শিক্ষা ভুল করতে পারে না”।
নুর বিষ্ময় নিয়ে বললো,“বড়টা মানে”?
মেহরুন বেগম জবাব না দিয়ে বললেন,“সবকিছু অন্যভাবে ঠিক করা যেতো, এভাবে আমার সুফিকে কলঙ্কিত না করলেও পারতে”।
নুর কিছুটা অবাক হলো। কাল যখন সুফিয়ানকে সব বলেছিলো, সুফিয়ান কথাগুলো অবিশ্বাস না করলেও বিশ্বাসও করেনি। অথচ মেহরুন বেগম খুব সহজেই বিশ্বাস করে নিলেন। কিন্তু কেন? তিনিকে আগে থেকেই জানতেন সুমন ফরাজির কথা?
নুরের মনের মধ্যে কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু কাকে জিজ্ঞেস করবে? হঠাৎ নুরের চোখ গেলো মেহরুন বেগমের বিছানার উপর পড়ে থাকা একটা কাগজের দিকে। নুর কাগজটি হাতে নিয়ে মেহরুন বেগমকে জিজ্ঞেস করলো,“এটা কি আম্মা”?
মেহরুন বেগম ভ্রু কুচকে বললো,“এটা এখানে এলো কিভাবে? দেখো তো ভিতরে কি আছে”?
মেহরুন বেগমের সম্মতি পেয়ে নুর কাগজটি খুললো। কাগজে খুব সুন্দর করে দুটো লাইন লেখা,“একটা গল্প যখন শেষ হয় তখন নতুন গল্পের সূচনা ঘটে। এভাবেই শেষ থেকে শুরুর সূচনা হয়”।
কাগজটির নিচে এক কর্নারে লেখা,“ফিরে দেখা”।
মেহরুন বেগম নুরের হাত দিয়ে কাগজটি নিয়ে লেখাগুলো দেখলেন। মেহরুন বেগমের চোখেমুখে স্পষ্ট আতংকের ছাপ দেখতে পেলো নুর।
মেহরুন বেগম কাগজটা হাতে রেখে মনেমনে বললো,“এ তো অবিকল তার হাতের লেখা”।

কাগজটি এখানে কে রাখতে পারে প্রশ্নটি ভাবতেই মেহরুন বেগমের মাথায় এলো,
একটু আগে তার ঘর থেকে রাইমা বের হয়ে গেলো, তারপর নুর প্রবেশ করলো। নুর এসে কাগজটি দেখতে পেলো। মেহরুন বেগমের মন হঠাৎ বলে উঠলো,“তাহলে কি রাইমা রেখে গেলো”?

#পর্ব_৫

মেহরুন বেগম কাগজটি নিজের কাছে রেখে নুরকে বাহিরে বের করে দিলো। নুর না বুঝতে পেরে হতভম্ব হয়ে গেলো।

নুর এবং রাইমা ঘরের কাজে ব্যস্ত। রাইমা আপনমনে কাজ করছিলো। নুর বেশ কয়েকবার রাইমার দিকে তাকালো। এক পর্যায়ে নিচু কন্ঠে বললো,“ভাবী কিছু কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?”
রাইমা নুরের মুখের পানে তাকায়। হাসি মুখে জবাব দিলো,“হ্যাঁ বলো।”
নুর বেশ আমতা আমতা করে বললো,“এ বাড়ির বড় ছেলে কে? ”
রাইমা ঘাবড়ে গেলো। রাইমার মুখে স্পষ্ট বিষ্ময় দেখতে পেলো নুর। রাইমা নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললো,“অযথা কথা না বলে কাজ করো।”
নুর মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। নুর এ বাড়িতে নতুন এসেছে, তাই বেশি কিছু বলার সাহস দেখালো না। তবে মনের মধ্যে কৌতুহল রয়েই গেলো।

সন্ধ্যা নামার কিছু মূহুর্ত পূর্বে দেলোয়ার ফরাজি বাসায় ফিরে এলেন। বাসায় ফিরে বেশ কিছুক্ষন ঘরের দরজা বন্ধ করে মেহরুন বেগমের সাথে কথা বললেন।

মেহরুন বেগম দরজা খুলে বের হয়ে রাইমাকে ভিতরে ডাকলেন। রাইমা কিছুটা অবাক হলো। সচরাচর এ সময়ে তার ডাক পড়ে না। আজ পড়লো কেন? কে জানে?
রাইমা মেহরুন বেগমের ঘরে প্রবেশ করতেই দেলোয়ার ফরাজি বললেন,“বড় বৌমার সাথে তোমার কিসের সম্পর্ক? তার সন্ধান কোথায় পেলে তুমি?”
রাইমা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। রাইমা মুখ দেখে স্পষ্ট সে কিছু বুঝতে পারছে না।
দেলোয়ার ফরাজি সকালে পাওয়া কাগজটি রাইমার হাতে তুলে দিলো। রাইমা কাগজের লেখা দেখে নিজেও কিছুটা ভয় পেলো। আমতা আমতা করে বললো,“এটা তো… ”
“এটা বড় বৌমার হাতের লেখা। এবার বলো তুমি এটা কোথায় পেলে?”
“আমি?”
“হ্যাঁ তুমি। তুমি সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর এটা মেহরুন ঘরে পেয়েছে।”

রাইমা পূর্বের চেয়ে দ্বিগুন হতভম্ব হয়ে গেলো। তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। রাইমা বেশ ভয়ে ভয়ে বললো,“বিশ্বাস করুন কাকা আমি এ ব্যপারে কিছু জানি না।”
দেলোয়ার ফরাজি বেশ বিচক্ষণ মানুষ। তার ধারনা ছিলো রাইমার কাছ থেকে এমন একটি উত্তর পাওয়া যাবে।
বেশ গম্ভীর কন্ঠে দেলোয়ার ফরাজি বললেন,“যদি কিছু জেনে থাকো আমাকে বলে দাও। সাহেদের কাছে খবরটি গেলে, এর ফল কিন্তু ভালো হবে না।”

দেলোয়ার ফরাজি চোখের ইশারায় রাইমাকে চলে যেতো বললো। রাইমা চলে যেতেই মেহরুন বেগম বললেন,“আপনি কি সাহেদকে বলতে চাইছো?”
“তাকে জানানো উচিত নয় কি?”
মেহরুন বেগম কিছুটা ভয়মিশ্রিত কন্ঠে বললেন,“আপনি তো জানেন আপনার ভাই কেমন? দয়া করে তাকে না জানানোর অনুরোধ রইলো।”

দেলোয়ার ফরাজি মেহরুন বেগমের মুখের পাণে তাকালো। কন্ঠ স্বাভাবিক করে বললো,“বেশ জানাবো না।”
মেহেরুন বেগম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

সুফিয়ান রাত আটটা নাগাদ বাড়ি ফিরে এলো। বাড়ি ফিরে হন্তদন্ত হয়ে নিজের ঘরে গেলো। নুর তখন ঘরেই ছিলো। সুফিয়ান গিয়ে সোজা গালে একটা চর বসিয়ে দেয়। নুর অবাক চাহনি দিলো সুফিয়ানের মুখশ্রীতে। সুফিয়ান খুব রাগ নিয়ে বললো,“তোমার জন্য আমি কোথাও মুখ দেখাতে পাচ্ছি না। বিদেশ থেকে পড়ালেখা শেষ করে গ্রামে এসেছিলাম, একমাত্র গ্রামের মানুষদের সুচিকিৎসা দিতে। যারা এতদিন আমার দিকে সম্মানের চোখে তাকাতো, তারা এখন আমায় ঘৃণার চোখে দেখে।”
নুর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সুফিয়ান পুনরায় বললো,“জানো আজ এক মেয়ে রোগী আমার কাছে চিকিৎসা নিতে চাইছিলো না। কেননা সে ভয় পাচ্ছিলো, আমি যদি তার সাথে কিছু করি।”

নুর বলার মতো ভাষা হারিয়ে ফেললো। সুফিয়ান একনাগাড়ে বলেই চললো,“তুমি বোঝো এটা আমার জন্য কতটা লজ্জার? তোমার কথা সত্যি বলে মেনে নিলে, দোষের জন্য তুমি নির্দোষ ব্যক্তিকে ফাঁসাতে। একজনের দোষে অন্যকে অপরাধী বানাবে?”
নুরকে মাথানত করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সুফিয়ান প্রচন্ড রাগ নিয়ে বললো,“লজ্জা করে না এমন কাজ করতে যার জন্য মাথানত করে দাঁড়াতে হয়। লজ্জা করে না নিজের ব্যক্তিত্বকে ছোট করতে।”
একটু থেমে পুনরায় বললো,“কাকে কি বলছি? তোমার আদো কোন ব্যক্তিত্ব আছে?”

নুর নিজের আঁখিযুগল বন্ধ করে ফেললো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,“ব্যক্তিত্ব তার থাকে যার কাছে তার জীবনটা বেঁচে থাকে। আমার জীবন তো হারিয়ে গেছে অন্ধকারের ভিরে।”
সুফিয়ান কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো,“মানে?”
“যে মানুষটা আমার নয় তাকে আমার যন্ত্রনা কিভাবে বোঝাবো?”
“কি বলতে চাইছো তুমি?”
“আপনার ভাই কতটা জঘন্য মানুষ সেটা আপনি যদি বুঝতেন। তবে আজ আপনাকে আমার ব্যক্তিত্ব খুঁজতে হতো না।”

সুফিয়ান নুরে মুখের পাণে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। নুর পুনরায় বললো,“সত্যি কখনো লুকানো থাকে না। সময় হলে এ গ্রামের সবাই সত্যিটা জেনে যাবে। আপনার হারানো সম্মান আপনি পুনরায় ফিরে পাবেন। চিন্তা করবেন না।”
সুফিয়ান আপনমনে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসে পড়লো। নুর কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো। নুরের চোখ দিয়ে অশ্রুকোনা গড়িয়ে পড়ছিলো। সুফিয়ান একমনে নুরের সেই গড়িয়ে পড়া চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মনেমনে বললো,“আমার ভাই খুব খারাপ কাজ করেছে কি তোমার সাথে? যার মূল্য আমাকে এভাবে দিতে হলো।”
সুফিয়ানকে একমনে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নুর বললো,“মায়া খুব খারাপ জিনিস। এভাবে তাকিয়ে থাকবেন না মায়ায় পড়ে যাবেন। শেষে বের হতে পারবেন না।”
সুফিয়ান কিছু না বলে ছাদে চলে গেলো। নুর চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়লো। মনেমনে ভাবছে,“সত্যি কি আমার কোন ব্যক্তিত্ব নেই? ভুল করেছি একজনার জন্য অন্যজনকে বাঁধনে জড়িয়ে?”

ঘরের দরজা খোলা রেখে নুর ঘুমিয়ে পড়লো। সুফিয়ান ফিরে আসবে এই ভাবনাতে বোধহয় দরজা আটকানো হয়নি। নুরের ঘরের পাশ দিয়ে সুমন ফরাজি যাচ্ছিলো। দরজা খোলা দেখে এক পা এক পা করে ভিতরে প্রবেশ করলো। আশেপাশে সুফিয়ানকে দেখতে না পেয়ে নুরের খুব কাছে চলে গেলো।
সুমন ফরাজি নুরের খুব কাছাকাছি চলে এলো। নুর গভীর ঘুমে মগ্ন। সুমন ফরাজি নুরের কাছে গিয়ে যেই নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিবে তখনি পিছন থেকে সুফিয়ান হাতটা ধরে নিলো। সুমন চমকে পিছনে ফিরে সুফিয়ানকে দেখতে পেয়ে ঘাবড়ে গেলো।
সুফিয়ান স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করলো,“তুই এ ঘরে কি করছিস?”
“সুফি আসলে আমি…..।”
“কি?”
“আমি তুই ঘরে আছিস কিনা সেটা দেখতে এসেছিলাম।”
“সে ভালো কথা। আমাকে খুঁজতে আসছিলো তো ওর দিকে হাত বাড়াচ্ছিলি কেন?”

“না মানে।”
“কি?”
“দেখলাম তোর বউটা কত সুন্দর? তুই খুব ভালো জিনিসে হাত দিয়েছিস, গরিব হলে কি হবে জিনিসটা দেখতে হেব্বি?”

সুফিয়ান নিজের রাগকে কনট্রল করে বললো,“নারীকে নারী বলতে শেখ। জিনিস এটা কোন ধরনের শব্দ? আর হ্যাঁ তোর সাথে আমার সখ্যতা কোনকালেই ছিলো না, আজও নেই। তাই তুই আমাকে খুঁজতে এসেছিস এটা ভাবতে আমার কষ্ট হচ্ছে। চুপচাপ নিজের ঘরে যা। দ্বিতীয়বার জানো কখনো তোকে এ ঘরে না দেখি।”
সুমন অপমানিত হয়ে চলে গেলো। সুফিয়ান নুরের মুখের পাণে তাকিয়ে মনেমনে বললো,“তুমি সত্যি বলেছো সেটা আজ প্রমাণ হয়ে গেলো।”

পরক্ষনেই বলে উঠলো,“তুমি সত্যি খুব সুন্দর।”
সুফিয়ানের কি হলো জানা নেই? হঠাৎ নুরের কপালে একটা ভালোবাসার পরশ দিয়ে দিলো। না এ পরশে রাগ নেই, আছে ভালোবাসা। সুফিয়ানের মন বলে উঠলো,“মেয়েটাকে কি আমার ভালো লাগতে শুরু করলো?”
সুফিয়ান নিজের মাথা নিজে চাপড়ে নুরের পাশে শুয়ে পড়লো।

সুমন প্রচন্ড রাগ নিয়ে বাবা, মার ঘরে বসে আছে। কাঠকাঠ কন্ঠে বললো,“তোমার ভাই গ্রামের প্রধান, তার ছেলে সকলের চোখের মনি। তুমি, তোমার ছেলে তাহলে কি?”
রোকসানা বেগম ছেলের কথায় তাল মিলিয়ে বললেন,“তুই আর তোর বাপ তো দেলোয়ার ফরাজির চাকর। চাকরের মতো করেই তো রাখছে। সেদিন তোর বাপকে বলেছিলাম ব্যবসায় নিজের নামটাও যোগ করতে কিন্তু করেনি৷ কি বলেছিলো ভাইয়া আমার সাথে অবিচার করবে না? তেনার তো ভাই প্রেম। ভাই প্রেম ছাড়া তেনার চলে না।(ব্যঙ্গ করে)”
সাহেদ ফরাজি বিরক্ত হয়ে বললো,“আহ থামবে।”
“কেন থামবে? তোমার ভাই প্রেমের জন্য আজ এ সংসারে আমাদের কোন অধিকার নাই। তোমার ভাতিজা আমার ছেলেরে অপমান করে ঘর থেকে বের করে দেওয়ার সাহস পেয়েছে। এই তোমার ভালো মানুষির জন্য।”
“চুপ করবে তুমি। তোমার ছেলে তো খুব ভালো কাজ করতে সুফির ঘরে গিয়েছিলো। নির্ঘাত সুফির বউয়ের দিকে কু-নজর দিতে গেছিলো। আমাকে না বলে তোমার ছেলেকে বোঝাও, এটা সুফিয়ান অন্যকেউ নয়। সুফিয়ান নিজের বউয়ের দিকে হাত বাড়ানোর সুযোগ দিবে না তাকে। এই কথাটা তোমার ছেলে বুঝলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যা। বাকি ভাইয়ার বিষয়টা, সেটা আমি দেখছি।”

সুমন রাগ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। রোকসানা বেগম বিলাপের সুরে বললেন,“আমার ছেলেটা রাগ করে চলে গেলো। তুমি বাবা হয়ে ছেলের মন বোঝো না।”

সাহেদ ফরাজি বিরক্তিমাখা চাহনি দিয়ে চলে গেলেন। রোকসানা বেগম ঘরে বসে বিলাপ করতে লাগলেন।

_____
সামিয়াকে হন্ত হয়ে খুঁজছে রাজ। পুরো পুলিশ টিম মেয়েটাকে খুঁজতে ব্যর্থ। কথায় বলে, “যে নিজে থেকে হারিয়ে যায় তাকে খুঁজে বের করা সম্ভব নয়।” সামিয়া নিজে থেকে হারিয়ে গেছে তাই তাকে খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়ে। রাজের উপর চাপ বাড়ছে, উপর থেকে কেস সমাধানের জন্য বেশ চাপ দিচ্ছে। প্রথমে তো সামিয়া একজন মেয়ে, দ্বিতীয়ত গর্ভবতী। চাপটা বেশ বড়।

সামিয়ার বাসার সামনের দোকানে একটা সিসিটিভি লাগানো ছিলো। যার ফুটেজ দেখে রাজ নিশ্চিত হলো সামিয়া নিজে থেকে চলে গেছে। কেননা ফুটেজে সামিয়াকে একা একা বের হতে দেখা যাচ্ছে। রাজ সামিয়ার জন্য একজন পাহারাদার রেখেছিলো। সামিয়াকে বলেছিলো যেখানেই যাক না কেন তাকে নিয়ে যেতে। কিন্তু সামিয়া তাকে না বলে চলে গেলো। কেন?

রাজ যখন সামিয়াকে খুঁজতে ব্যস্ত ঠিক তখন রাজের ফোনে টুন করে একটা শব্দ হলো। রাজ ফোনের দিকে দৃষ্টি রাখলো। অপরিচিত একাউন্ট থেকে মেসেজ আসায় চেক করতে ভিতরে ক্লিক করলো। ভিতরে একটি ভিডিও সেন্ট করা। রাজ ভিডিও চালু করতেই চোখ ছানাবড়া দিয়ে গেলো। ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সালেহা রফিকের চায়ে কোন একটা ঔষধ মিশিয়ে দিচ্ছে। রফিক চা খাওয়ার কিছু মূহুর্তের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো। সালেহা নিজ হাতে বড় ছুরি দিয়ে রফিকের গলা কেটে ফেলে। রাজ কয়েক মূহুর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে গেলো। ভিডিও শেষ করতে না করতে একটা মেসেজ আসলো, “পুরো খেলাটা এভাবেই সাজানো। বাকিটা তুমি বুঝে নিও। তুমি হয়তো ভাবতে পারো আমি তোমাকে এটা কেন পাঠালাম? খুব সহজ উত্তর। এত সহজে তুমি আমার কাছে আসতে পারবে না। তুমি যখন আমার কাছে আসবে তখন পুরো খেলাটা শেষ হয়ে যাবে। তবে তুমি বিশ্বাস করবো কিনা জানি না, আমি চাই তুমি আমার কাছে আসো। তুমি আমাকে খেলা শেষ হওয়ার পূর্বেই ধরে ফেলো। জানি পারবে না তবুও মন থেকে চাইছি তুমি আমার কাছে নিজ থেকে আসো। তাই তোমার জন্য একটা ছোট্ট ক্লু সামিয়া সালেহার খুনিকে মারতে গেছে। পারলে আটকাও।”
একাউন্ড ডিজেবল। বারবার চেষ্টা করেও রাজ একাউন্টে প্রবেশ করতে পারছে না। রাজের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছি। ক্লু অনুযায়ী এতটুকু পরিস্কার খুনি নিজ হাতে কাউকে খুন করছে না। সে যাদের মারতে চায় তাদের দ্বারাই তাদের খুন করাচ্ছে।

রাজের আপনমনে বিরবির করে বলে উঠলো,“খুনি বেশ চতুর। তবে সে যেই হোক তার কাছে আগে পৌঁছাব।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here