শ্যামসুন্দর_স্বপ্ন #পর্ব_১০_১১

0
760

শ্যামসুন্দর_স্বপ্ন
#পর্ব_১০_১১
নুশরাত_জাহান_মিষ্টি
১০

সময়ের সাথে সাথে যখন বড় হয়ে উঠছিলাম তখন সমাজ নানা কথায় জর্জরিত করতো আমার হৃদয়টাকে। একে তো কালো তার উপর বোবা। বাক্যটি বেশ শোনা হয়েছে। একই বাবা, মায়ের সন্তান হয়ে একজন সুন্দর, স্বাভাবিক অন্যজন কালো, বাকহীন। পার্থক্যটা সমাজের চোখে বেশ জোরালো ছিলো। তবে পার্থক্যটা আমাদের ঘরে কখনো ছিলো না। বাবা, মায়ের পাশাপাশি আমার বোন প্রিয় আমাকে খুব ভালোবাসতো। আমার স্বপ্ন ছিলো সুস্থ পৃথিবীতে প্রানখুলে বাঁচা আর আমার বোনের স্বপ্ন ছিলো আমাকে ভালোভাবে বাঁচতে দেখা।

আমার বোন সবসময় বলতো, “হৃদয়ের আয়না চোখ আর আমার আয়না তুই। আমি তোর চোখ দিয়ে নিজেকে দেখতে পাই।”

তখন বোন পড়ালেখার জন্য অন্য শহরে ছিলো। বারবার পাত্রপক্ষের কাছে প্রত্যক্ষখান হতে হতে বিয়ের স্বপ্নটা বাদ দিয়েছিলাম। বিয়ে করে স্বাভাবিক একটা জীবন-যাপন করা আমার জন্য নয়। কিন্তু বাবা, মা বুঝেনি। বাবা,মায়ের কাছে মেয়ে বড় হলে বিয়েটাই একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। বাবা-মায়ের দোষ দিবো না, সমাজ এভাবেই আমাদের শিক্ষা দেয়। বিয়েটা সবকিছুর উর্ধে।

ভেবেছিলাম এ জীবনে বিয়েটা বোধহয় হবে না। নিজের ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে বিয়ের ফুল ফুটলো। বাবা নিজের সমস্ত ব্যবসা পাত্রর বাবার নামে করে দিয়ে আমার বিয়ের ব্যবস্থা করলো। কন্যপ্রেমে অন্ধ বাবা বুঝতে পারেনি টাকা দিয়ে সুখ কেনা যায় না।

বধু হয়ে প্রবেশ করলাম ফরাজি পরিবারে। স্বামীর সাথে একটা যৌথ পরিবারও পেলাম। বাবার মতো আমিও ভেবেছিলাম হয়তো জীবন সুন্দর হতে যাচ্ছে।

ধারনাটা মিথ্যে হয়ে গেলো বাসর ঘরে। বাসর ঘরে সাইফুল(স্বামী) বলে দিলো,“তোমার মতো কালো তার উপর বাকহীন একটা মেয়ের সাথে আমি আমার জীবন কল্পনাও করতে পারি না। তোমাদের মতো মেয়েদের আমি ঘৃণা করি, এরিয়ে চলি। বাবার কথায় বাধ্য হয়ে তোমাকে বিয়ে করেছি তাই আমার ধারেকাছে আসার চেষ্টা করিও না। আমাকে আমার মতো থাকতে দেও।”

পরী মুচকি হেসে সাইফুলের দিকে তাকালো। সাইফুল বেশ বিষ্ময় নিয়ে বললো,“শুনেছিলাম তুমি কানে শুনতে পাও কিন্তু হাসি দেখে তো মনে হচ্ছে শুনতেও পাও না।”

পরী তৎক্ষনাৎ নিজের হাতে থাকা নোটপ্যাড এবং কলম নিয়ে লিখলো,“আমি শুনতে পেয়েছি।”

লেখাটা সাইফুলের সামনে তুলে ধরলো। সাইফুল পড়ে নিশ্চিত হলো পরী তার কথা শুনেছি।
“শুনতে পেলে হাসছো কেন? হাসার মতো কিছু বলছি?”

পরী পুনরায় লিখতে লাগলো। লিখে সাইফুলের সামনে ধরলো। এবার লেখা ছিলো,“সব হাসি সুখের হয় না গো সখা, কিছু হাসি বেদনার নামেও ঝরে।”

সাইফুল কিছু না বলে চুপচাপ শুয়ে পড়লো৷ পরীর একমন বলে উঠলো,“দুঃখ যার জীবন সে জীবনে স্বামীর ভালোবাসা আসা করিস কিভাবে?”

পরী গিয়ে মিররের সামনে দাঁড়ালো। মিররের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের রুপের প্রশংসা নিজেই করতে লাগলো।

কাজল কালো দু’টো আঁখি। কালো গরনের মুখশ্রী। মুখে একরাশ মায়া। আচ্ছা এত মায়া থেকে কি হলো যদি না কেউ এ মায়া ছুঁয়ে দিতে চায়? পরীর নিজেকে নিজে হঠাৎ আয়নায় সত্যিকারি পরীর মতো মনে হলো। পরী মনেমনে বললো,“আমরা যে যেমনি হই,আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বকে নিজের কাছে পরীই মনে হয়।”

পরেরদিন সকালবেলা খুব খুব ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে পরী সকলের জন্য নাস্তা তৈরি করলো। রাইমার থেকে শুনেছে তার শাশুড়ী মা সকাল সকাল চা খান। যেটা রুমেই দিয়ে আসতে হয়। তাই পরী চা নিয়ে কাকী শাশুড়ী মার ঘরে গেলো।

প্রতিদিন চা নিয়ে রাইমা আসে আজ পরীকে দেখে রেগে গেলেন রোকসানা বেগম। চা হাতে নিয়ে সেটা পরীর মুখে ছুঁড়ে মারলেন। তারপর বললেন,“সকাল সকাল নিজের পেত্নী মুখশ্রী না দেখাইলে নয়। তুমি জানো আমি কতটা ভয় পেয়েছি। একটুর জন্য হার্ট অ্যাটাক করেনি।”

পরী মুখ কালো করে চলে এলো। সবাই নাস্তা করে যার যার গন্তব্য চলে গেলো। পরী দেখলো সবাই খাবার খেলো শুধু মেহরুন বেগম খায়নি। পরী তার জন্য খাবার নিয়ে রান্নাঘরে গেলো। খাবারটা মেহরুন বেগমের সামনে রেখে কাগজে লিখে রাখা লেখাটা দেখালো। তাতে লেখা ছিলো,“আম্মা প্রথমে নিজের শরীরের প্রতি যত্নশীল হতে হয় তারপর অন্যদের কথা। আপনি নিজের কথা না ভাবলে অন্যদের দেখাশুনা কিভাবে করবেন।”

মেহরুন বেগম মুচকি হেসে নিজের ডান হাতটা পরীর মাথায় রাখলো। আশ্বাস দিয়ে বললো,“সংসার বড় জটিল খেলা রে মা। ধৈর্য ধরে সব সামলাতে হয়। কখনো পিছু ফিরে যাস না, সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস নিয়ে এগিয়ে যাবি।”

পরী সাথে সাথে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।

সেদিন রাতে সাইফুল ঘরে ফিরতেই পরী তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। সাইফুলের সামনে তার লেখা তুলে ধরলো। যাতে লেখা ছিলো,“আমি কালো আমি জানি। আমি বাকহীন তাও জানি। তবুও কি আমায় একটা সুযোগ দেওয়া যায় না?”

দ্বিতীয় আর একটি কাগজ ধরলো। যাতে লেখা ছিলো,“ভালোবেসে আমার হাতটা ধরুন, বিশ্বাস করুন এক আকাশ সমান ভালোবাসা দেবো আপনাকে। কখনো কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না আমার ভালোবাসা নিয়ে।”

সাইফুল যথেষ্ট রাগ নিয়ে বললো,“তোমার বাবা তার সম্পত্তির বিনিময় তোমাকে আমার হাতে গছিয়ে দিয়ে গেছে। বুঝলে তুমি। নয়তো তোমার মতো মেয়ের ছায়া আমরা পেরাতাম না। আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা বাদ দেও। তোমার উদ্ভট স্বপ্ন সত্যি হওয়ার নয়।”

পরী সাথে সাথে কাগজে লিখলো,“উঁহু আমার উদ্ভট স্বপ্ন নয়তো। আমার স্বপ্নটা তো #শ্যামসুন্দর।”

সাইফুল পরীকে ধাক্কা মেরে চলে গেলো।

দুদিন বেশ কয়েকবার সাইফুলের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করেছে পরী। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে। রাইমা এবং সুমনের প্রেমের বিয়ে ছিলো। রাইমা পরীকে বেশ কিছু পদক্ষেপ শিখিয়ে দিয়েছিলো তাতেও কাজ হয়নি। মেহরুন বেগম এবং রাইমা ছাড়া ফরাজি বাড়ির কেউ পরীকে মেনে নিতে পারেনি। তাদের কাছে পরী একটা বোঝার নাম।

বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। পরীর স্বপ্নগুলো আজও সত্যি হলো না। বিয়ের সময় কত স্বপ্ন দেখেছিলো, স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমাবে। তার সাথে চোখে চোখে কথা বলবে। সেগুলো শুধু স্বপ্নই রয়ে গেলো।

সেদিন রাত ১১ টা পের হয়ে গেলো তাও সাইফুল ঘরে ফিরলো না। দরজা টোকা মারার শব্দ পেয়ে পরী ভাবলো সাইফুল ফিরে এসেছে। তাই হাসি মুখে দরজা খুললো। কিন্তু দরজার ওপারে সুমন ছিলো। সুমনকে পরীর ঘরের সামনে দেখে পরী বেশ ভয় পেলো। সুমন ধীরে ধীরে ঘরে ডুকে গেলো।
ঘরে ডুকে দরজাটা দিয়ে দিলো। পরী কিছু বলতেও পারছে না। মন বলতে চাইলেও মুখ যে তার কথা শুনছে না। সুমন ধীরে ধীরে পরীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পরী বেশ ভয় পাচ্ছে।

পরী ভয়ে দৌঁড় দিতে নিলে সুমন হাত ধরে নিলো। নোংরা কন্ঠে বললো,“ভাইয়াটা বড় অবুঝ, তুমি কালো তো কি হয়েছে মেয়ে তো। শারীরিক তৃপ্তি মেটানোর জন্য তো যথেষ্ট। কিন্তু সে বুঝলো না। এখনো তোমাকে ভার্জিন করে রাখলো।”

পরী ভয়ে কান্না করে দিলো। সুমন মুখে শয়তানী হাসি দিয়ে বললো,“চিন্তা করো না আজ আমি তোমাকে শারীরিক মিলনে কত তৃপ্তি সেটা শেখাবো।”

বাক্যটি বলেই সুমন পরীকে বিছানায় ফেলে দিলো। পরী কান্না করছে। ভিতর থেকে চিৎকার আসছে কিন্তু শব্দ হচ্ছে না। শব্দহীন চিৎকারগুলো কেউ শুনতে পায়নি বলেই পরীর আর্তনাদ সেদিন কেউ দেখেনি।

আবার একবার স্বপ্নগুলো ভেঙে গেলো। পরেরদিন সকালবেলা পরী মেহরুন বেগমের কাছে গিয়ে বায়না করলো তার বাবাকে আসতে বলতে। মেহরুন বেগম পরীর বাবাকে কল দিয়ে আসতে বললো৷

পরীর বাবা এসে সোজা মেয়ের ঘরে গেলো। মেয়ের পানসে মুখ দেখে কিছুটা ব্যথিত হলেন তিনি। মেয়ের মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,“কি হয়েছে আমার মায়ের?”
পরী বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো। পরীর বাবা বুঝতে পারলো তার মেয়ে ভালো নেই।

পরী নিজেকে সামলে কালরাতের সবকিছু তার বাবাকে বলে দিলো। পরীর বাবা রেগেমেগে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিলো।

দেলোয়ার ফরাজি এসে শান্তকন্ঠে বললো,“আপনি চিৎকার করছেন কেন?”
“আপনার বাড়িতে আমি মেয়েকে বোঝা হিসাবে নয় বৌ হিসাবে পাঠিয়ে ছিলাম। আপনারা আমার মেয়ের সাথে এত নোংরা কাজ কি করে করলেন?”

“আপনি কি বলতে চাইছেন আমরা কিছু বুঝতে পারছি না?”

এরমধ্যে সেখানে সুমন এবং সাহেদ চলে এলো। পরীর বাবা তৎক্ষনাৎ সুমনের গলা চেপে ধরলেন আর বললেন,“তোর সাহস কি করে হয় আমার নিষ্পাপ মেয়েকে অপবিত্র করার?”

দেলোয়ার ফরাজি গিয়ে পরীর বাবাকে আটকালো। জানতে চাইলো কি হয়েছে? পরীর বাবা কান্নারত অবস্থায় বললেন নিজের মেয়ের দূর্ভোগের কথা। সেখানে সাইফুলও উপস্থিত ছিলো। পরীর সাথে কালরাতে কি হয়েছে শুনে তারও মাথা গরম হয়ে গেছে। কালরাতে সে শহরে একটা কাজে গিয়েছিলো। সাইফুল সুমনকে লাথি মেরে বললো,“তোর এরকম একটা কাজ করার সাহস হয় কি করে?”

পরী সাইফুলের সামনে একটা কাগজ ধরল। যাতে লেখা ছিল,“আপনি তো তাকে এসব করতে বলেছেন।”

সাইফুল না বলার পূর্বে পরী দৌড়ে ছাদে চলে গেলো। সাইফুল ও পরীর পিছু পিছু গেলো।

এদিকে সুমন সব অস্বীকার করছে। পরীর বাবা সবাইকে পুলিশের হুমকি দিচ্ছে। পুলিশে ফোন করতে যাবে এমন সময় পিছন থেকে সাহেদ ফরাজি তাকে আঘাত করলো। পরীর বাবা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।

সাহেদ ভাইয়ের উদ্দেশ্য বললো,“একে বাঁচিয়ে রাখা এখন বিপদ ভাইয়া। মেরে ফেলি চলো।”

কিছুটা দ্বিমত থাকলেও দেলোয়ার ফরাজি না করলেন না। মেহরুন বেগম, রাইমা বারবার বারন করছিলো কিন্তু কেউ শুনলো না।

অন্যদিকে পরী ছাদ থেকে লাফ দিতে উদ্ধৃত হতে সাইফুল ধরে নিলো।
“বিশ্বাস করো আমি সুমনের কর্মকান্ড সম্পর্কে জানতাম না তুমি এরকম করো না।”

পরী একমনে সাইফুলের চোখে চোখ রাখলো। পরীর চোখ জোড়া বলছে,“আমি তো কালো, বাকহীন। এখন তো অপবিত্র। আপনি কি মানবেন এই অপবিত্র মেয়েটাকে। মানবেন না তো।”

পরীকে অবাক করে দিয়ে সাইফুল তার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে বললো,“মানবো। আমি কাল সারারাত শান্তি পাইনি জানো। বারবার আমার মন আমার কালো মায়াবী বউকে মিস করছিলো। আমি মানুষটা বড্ড খারাপ। তবে এই খারাপ মানুষটা তোমাকে মেনে নিতে চাইছে। আমি তোমার সাথে বাঁচতে চাই সারাজীবন। অবহেলা করতে করতে কোনদিন জানি না তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।”

পরীর চোখ মুখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠলো। তার স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে। সে ও ভালোবাসা পেতে চলেছে। কিন্তু দুঃখ যার সাথী তার কি ভালোবাসা দেখা মেলে।

সাইফুল পরীকে বলতে নিলো,“ভালো…..”
সম্পূর্ণ করার পূর্বেই সুমন পিছন থেকে তাকে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দিলো। পরী কান্ডাজ্ঞান হারিয়ে ফেললো। চিৎকার করতে চাইছে কিন্তু পারছে না। সুমনকে আঘাত করার জন্য এগিয়ে গেলো কিন্তু পারলো না।

ফরাজি বাড়ির সবাই মিলে পরীকে মানসিক হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলো। রটিয়ে দিলো পুরো গ্রামে পরী পাগল হওয়ায় নিজে বাবা এবং স্বামীকে খুন করে অস্বাভাবিক আচরণ করতে লাগলো। তারা তাকে সামলাতে না পেরে মানসিক হাসপাতালে পাঠালো।

মেহরুন বেগম প্রতিবাদ করতে চাইলে দেলোয়ার ফরাজি তার গায়ে হাত অব্দি তুলেন।

সাহেরা মানসিক হাসপাতালে পরীর নতুন জীবন শুরু হয়। বারবার স্বপ্ন ভেঙে যেতে দেখে, স্বপ্ন দেখতেও আজ বড়ো কষ্ট হয় পরীর। কেন জানি না তার মনে হয়, তার চোখের জলে তার স্বপ্নগুলো খুশি হয়।

জীবন তাকে শিখিয়েছে “চোখের জলে শ্যামসুন্দর স্বপ্ন হাসে”।
তাই তো মানসিক হাসপাতালে তাকে যে ঘরটিতে রাখা হয়েছে সেটায় সে নিজের হাত কেটে রক্ত দিয়ে লিখেছিলো বাক্যটি।
জীবন জীবনের মতো এগিয়ে যাচ্ছে। পরী ভেবেছিলো তাকে বোধহয় ঔষধ দিয়ে পাগল বানানো হবে। কিন্তু না সেরকম কিছুই ঘটেনি তার সাথে।
ঘটেনি কেন সেটা সে পরে জানতে পেরেছি যখন রফিক তার ঘরে এসেছিলো।

ডাক্তার রফিক সম্পর্কে ভালোই শুনেছিলো পরী। তাই তো তার আগমনে বিচলিত হয়নি। রফিক পরীর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,“কেমন আছো?”
পরী বেশ অবাক হলো। একজন মানসিক রোগীর সাথে কেউ বুঝে এভাবে কথা বলে। রফিক মুচকি হেসে বললো,“আমি জানি তুমি পাগল নও। তবে বাকহীন।”
পরী সম্মতি জানালো। রফিক তার দিকে কাগজ কলম এগিয়ে দিলো। পরী লিখলো,“আমাকে আমার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিবেন?”
“হ্যাঁ দিব।”
“তো দেন না প্লীজ।”
“শুধু শুধু সাহায্য নেবে?”
“মানে?”
“বিনিময় ছাড়া কেউ কারো জন্য কিছু করে।”

পরী বুঝতে পারলো না। বিষ্ময় নিয়ে রফিকের দিকে তাকিয়ে রইলো। রফিক শয়তানী হাসি হেসে বললো,“সুমন বললো তুমি নাকি সেই রকমের সার্ভিস দেও?”
পরী ভয় পেলো। রফিক পরীর ভয়ময় মুখশ্রী দেখে হেসে দিলো। সে হাসির অর্থ খুব খারাপ ছিলো। সেদিন থেকে পরীর যন্ত্রনাময় দিন শুধু হলো। রফিক তার সাথে পশুর মতো ব্যবহার করতে লাগলো। তার বাকহীনতার সুযোগ রফিকের পাশাপাশি ডাক্তার কামালও নিলো।

হঠাৎ একদিন পরী অসুস্থ হয়ে পড়লো। বমি করলো বেশ কয়েকবার। সালেহা পরীর চেকাপ করানোর পর বুঝতে পারলো সে গর্ভবতী।

সালেহা গিয়ে খবরটি সামিয়াকে দিলো। সামিয়া ভেঙে পড়লো, সে নিশ্চিত এটা রফিকের কাজ। কিন্তু সেটা প্রকাশ করলে তাদের মান-সম্মান সব চলে যাবে। হাসপাতালে যদি জানাজানি হয় মানসিক রোগী গর্ভবতী তবে তার ক্ষতি। তার হাসপাতালের ক্ষতি।

সামিয়া পরীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। সামিয়া শান্তকন্ঠে বললো,“তুমি গর্ভবতী। তুমি নিশ্চয় চাইবে না একটা অবৈধ সন্তানকে জন্ম দিতে। তাই আমি তোমার জন্য জন্ম নিরোধক ঔষধ এনেছি। এটা খেয়ে নেও।”

পরী বেশ কিছুক্ষন বসে কলম দিয়ে কাগজে লিখলো। লেখাটা সামিয়ার হাতে দিলো৷ সামিয়া দেখলো তাতে লেখা ছিলো,“স্বপ্নরা বারবার ভেঙে যায় তবুও মানুষ নতুন নতুন স্বপ্ন দেখে। বাঁচার জন্য নয়তো মনকে বোঝাতে। আমিও বারবার স্বপ্ন দেখেছি, বারবার হেরেও গেছি। আমি জানি আমার গর্ভে অবৈধ একটা সন্তান বেড়ে উঠেছে। তবে আমি চাই সন্তানটা পৃথিবীর আলো দেখুক। স্বামীর ভালোবাসা পাওয়ার সময়ে সে হারিয়ে গেলো, সন্তানের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করবেন না দয়া করে। আমাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করুন। আমি কখনো কোনদিন আপনাদের কোন ক্ষতি করবো না।”

সামিয়া বললো,“সন্তানটার সাহায্য আমার বাড়ি প্রবেশ করার স্বপ্ন দেখছো তাই তো? তোমার এ স্বপ্ন সত্যি হবে না।”

পরী মাথা নাড়িয়ে বোঝালো সামিয়া যা বলছে তা সত্যি নয়। কিন্তু সামিয়া শুনলো না। সে সালেহাকে পরীকে জোর করে ধরতে বললো। এক প্রকার জোর করেই পরীকে ঔষধ খাওয়ানো হলো। পরী ঔষধটা মুখ থেকে ফেলে দিতে চাইলো। সামিয়া পরীর মুখ চেপে ধরলো। ততক্ষণ অব্দি চেঁপে ধরলো যতক্ষণ না ঔষধ গিলেছে।

সামিয়া যদি তখন পরীর চোখের অশ্রুর দিকে একবার তাকাতো, তাহলে হয়তো দেখতে পেতো পরীর চোখের ভাষা চিৎকার করে বলছে,“আমাকে বাঁচতে দেও। স্বামীর ভালোবাসা পেতে গিয়েও পাইনি, অন্তত সন্তানটা নিয়ে বাঁচতে দেও। আমাকে বাঁচতে দেও। আমি বাঁচতে চাই।”

একটা মানুষ কতবার স্বপ্ন ভাঙার যন্ত্রনা সহ্য করলে একটা অবৈধ সন্তানের জন্ম দিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখতে চায় তা যদি সামিয়া বুঝতো। তাহলে গল্পটা অন্যরকম হতো।

বেশ কয়েকদিন পরী অসুস্থতা ভোগে। ততদিনে গর্ভের সন্তানটাও নষ্ট হয়ে যায়। পরীর কষ্ট বোধহয় রমা(সেবিকা) সহ্য হয়নি। তাই তো রমা পরীকে মানসিক হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করলো। রাতের অন্ধকারে রমা পরীকে হাসপাতালের বাহিরে বের করে দিলো। যাবার সময় হাতে কিছু টাকা আর একটা দিনপঞ্জি এবং একটি কলম দিলো। পরী কৃতজ্ঞতা দৃষ্টি দিলো রমার দিকে। পরীর দৃষ্টিতে আক্ষেপও ছিলো। পরীর দৃষ্টি হয়তো বলছিলো,“এখন পালিয়ে কি করবো যখন সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে?”
রমা হয়তো চোখের ভাষা বুঝতে পারে তাইতো বললো,“একটা স্বপ্নের মৃত্যুর পর নতুন একটা স্বপ্নের সৃষ্টি হয়। এখন তুমি তার কাছে যাও, যার হাত ধরে তুমি এই সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবে। যার সাহায্যে তুমি তোমার সাথে হওয়া অন্যায়ের জবাব দিতে পারবো।”
একটু থেমে রমা পুনরায় বললো,“ দিনপঞ্জিটাতে নিজের গল্পটা লিখো। তোমার গল্প পড়ে একজনও যদি চোখের অশ্রু ফেলে তবে মনে রেখে তোমার স্বপ্নরা তোমার চোখের অশ্রুতে কান্না করছে। চোখের জলে শ্যামসুন্দর স্বপ্ন হাসে বাক্যটি সত্যি নয়।”

রমার থেকে বিদায় নিয়ে পরী নতুন গন্তব্যে পা রাখলো। সে জানে না সে কোথায় যাবে। যাবার পথে দিনপঞ্জিটা লিখতে বসলো।

এটাই আমার গল্প। আমার স্বপ্ন। নতুন পথে পা বাড়াচ্ছি। নতুন কোন স্বপ্নের খোঁজ পেলে লিখবো এখানে।

আমি পরী। আমার অসমাপ্ত গল্পটা এ অব্দি ছিল। বাকিটা লেখার সুযোগ পাই কিনা কে জানে?
_______
পড়া শেষে সুফিয়ানের অনুভব হলো তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। সুফিয়ান অশ্রুকোনায় হাত দিয়ে মনেমনে বললো,“তোমার স্বপ্নরা কাঁদছে ভাবী। তোমার কষ্টে কাঁদছে।”

সুফিয়ান তার মায়ের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হলো যা লেখা আছে সব ঠিক কিনা। মানসিক হাসপাতালে কি হয়েছে তা মেহরুন বেগম জানেন না কিন্তু বাকিটা স্বীকার করলেন। তিনি নিরুপায় ছিলো। তাই চুপ করে ছিলেন।

সুফিয়ান এবং নুর দু’জনেই আহত হলো অনেকটা। সুফিয়ান তো ভেবেই পায় না তার আড়ালে এতকিছু হয়েছে।

সুফিয়ানের কাছে যে নাম্বার থেকে মেসেজ আসতো সেটায় সুফিয়ান একটা মেসেজ দিলো,“আমি আমার পরিবারের বিরুদ্ধে স্টেপ নিবো। নিজে পুলিশের কাছে সবকিছু বলবো, প্লীজ আপনি যেই হন সামনে আসুন।”

এরমাঝে সুফিয়ানের কাছে খবর এলো তার বাবা, কাকা, ভাই কারো সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। তিনজনেই নিঁখোজ।
সুফিয়ান বেশ ঘাবড়ে গেলো। তাড়াতাড়ি করে ঘরে প্রবেশ করলো। যেখানে রাইমা, নুর বসে কথা বলছিলো।

সুফিয়ান সোজা গিয়ে বললো,“প্রিয়”?
_____
রাজ হন্তদন্ত হয়ে তার বাসায় এলো। রাজ কল্পনাও করতে পারেনি তার কাছের মানুষটা তার সাথে এতবড় খেলা করবে। সে স্বপ্নেও ভাবেনি যাকে সে এত ভালোবেসেছে সে তার ভালোবাসা প্রিয়কে আটকে রাখতে পারে।

হন্তদন্ত হয়ে তার বাসায় ডুকে জোরে চিৎকার দিয়ে সে বললো,“প্রিয়”।

বাসার ভিতরে ডুকে রাজ হতভম্ব হয়ে গেলো। কারন ভিতরে তার জন্য আরো বড় চমক অপেক্ষা করছিলো।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here