শ্যামাঙ্গণা-১,০২

0
889

শ্যামাঙ্গণা-১,০২

০১
———–

চৈত্রের খরতাপে অতিষ্ট জনজীবন। চারদিকে শুধু খা খা রোদ্দুর। কোথাও বাতাসের নামমাত্র অস্তিত্ব নেই। মাথার উপর সূর্যটা তীব্র তাপ ছড়াচ্ছে সেই সঙ্গে ফুরফুরে মেজাজটাও চুলার প্রেসার কুকারের মতোই ক্ষণে ক্ষণে ফুঁসে উঠছে। শরীর বেয়ে ঘাম ঝরছে। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ। একটু পানি খাওয়ারও ফুরসৎ নেই ঝুমুরের। এখন সে ব্যস্ত,মহা ব্যস্ত। তার ব্যস্ততার অন্যতম কারণ হলো সিড়ি ঝাড়ু দেওয়া।

ঝুমুরের বাবা মোতালেব সাহেব সৌখিন মানুষ। পুরনো জিনিস সংগ্রহ করার ভীষন রকমের শখ আছে তার। প্রায়ই তাকে পুরনো জিনিস নিয়ে আসতে দেখা যায়। আজও এনেছেন। একটু আগেই লোক এসে একটা পুরনো সময়ের বিপুল কারুকার্য খচিত লম্বা ঘড়ি তুলে দিয়ে গেছে তিন তলায়। সেই ঘড়ি তোলার সময় তার গায়ে যত ঝুল ছিল সব সিড়িতে পড়েছে। আর এখন সেসবই ঝুমুরকে পরিষ্কার করতে হচ্ছে।

ঝুমুরের মেজাজ একটু পরপর চিড়বিড় করে উঠছে। দাতে দাত চেপে ঝাড়ু দিচ্ছে সে। বাবার সঙ্গে তার এখন কঠিন যুদ্ধ ঘোষণা করতে ইচ্ছা করছে। তিন দিন মুখ দেখাদেখি,কথা বলাবলি সব বন্ধ। মুখও দেখবে না ওই লোকটার। কি পেয়েছে কি ? কয়দিন পরপর এটা ওটা বাড়িতে আনবে আর সেসব ঝুমুর দেখা শুনা করবে তাইতো ? না এখন আর এসব চলবে না। এখন থেকে সে ওগুলোর দিকে ফিরেও তাকাবেনা।

ঝাড়ু দিতে দিতেই চিন্তায় পড়ে গেল ঝুমুর। ঠিক তো করে নিলো মোতালেব সাহেবের সঙ্গে কথা বলবে না কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব ?সে তো রোজ একবার করে হালমনির(দাদু) কাছে যায়। আর হালমনির কাছে যাওয়া মানেই মোতালেব সাহেবের সঙ্গে দেখা হওয়া। ঝুমুর তার বাবাকে ভালো করে চিনে। তার রাগ হয়েছে ধরতে পারলেই ভদ্রলোক তার রাগ ভাঙ্গানোর একটা সুযোগও ছাড়বেন না।

বাবার সঙ্গে তাহলে যুদ্ধটা করা হবে না ভেবে ঝুমুর রাগে ফোঁস করে উঠলো। গজগজ করতে করতেই সে ঝাড়ু দিচ্ছে সিড়ি। সে যখন ক্রোধের দুনিয়ায় নন্দিনী হয়ে নিজের সমস্ত ক্রোধ বেচারা ঝাড়ুর উপর ঝাড়তে ব্যস্ত তখনই কানে এলো অপরিচিত কণ্ঠস্বর। ঝুমুর পরিষ্কার শুনতে পেলো কোনো এক ছেলে তাকে বলছে ‘ দেখি খালা একটু সরে দাঁড়ান, আমি উঠবো। ‘

—-

ছেলেটার কথা শুনে নির্বাক ঝুমুর। তার শব্দেরা তাদের অবস্থান হারিয়েছে। চোখ দুটোতে বিস্ময়ের ছড়াছড়ি। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে সে একবার নিজেকে দেখে নিল। পরখ করলো তাকে কোন দিক থেকে খালা মনে হয়। কোথায় তার বেশভূষা তো বলছে না তাকে খালা মনে হয়। সে এবার সামনে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে তাকালো।

ছেলেটার বেশভূষা আপাদমস্তক সাধারণ। পড়নে আকাশী রঙের শার্ট এবং কালো জিন্স। শার্টের হাতাগুলো কনুই অব্দি গুটানো। এক হাতে সাদা এপ্রন আর কাধে ব্যাগ, পায়ে কেটস। ছেলেটার পায়ে কেটস দেখে ঝুমুরের এবার গলা উপচে কান্না এলো। তার দুই চোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ল।

আচমকা সামনে দাড়িয়ে থাকা শ্যামাঙ্গণাকে কাদতে দেখে ভরকে গেলো ফাহমান। ও আতঙ্কিত দৃষ্টিতে ঝুমুরের দিকে তাকালো। ভীত গলায় বললো ‘ একি আপনি কাদছেন কেন ? কি হয়েছে ? ‘

ঝুমুর কাদতে কাদতে হেচকি তুললো। হেচকি তুলেই সে বললো ‘ আপনি কেটস নিয়ে সিড়িতে উঠেছেন কেন ? আপনি জানেন না জুতো নিয়ে সিড়িতে ওঠা নিষেধ ? ঐযে ওখানে তো পরিষ্কার করে লেখা আছে জুতো নিয়ে সিড়িতে উঠা যাবে না। ‘ কথাগুলো বলে হাতের ইশারায় নোটিশ বোর্ডটা দেখালো ঝুমুর।

ঝুমুরের কথায় ফাহমান সস্তির নিশ্বাস ফেললো। বড় করে দম নিয়ে বললো ‘ বুঝলাম আমার ভুল হয়ে গেছে। আসতে সময় নোটিশ খেয়াল করিনি। তাই বলে আপনি কাদবেন ? ‘

ফাহমানের কথায় ঝুমুর হেচকি তুলতে তুলতে বললো ‘ আমি কাদবো নাকি না সেটা আমাকে ভাবতে দিন। তার আগে এটা বলেন আমাকে আপনার কোন দিক দিয়ে খালা মনে হয় ? আমি কি দেখতে আন্টিদের বয়সী ? এখনও ফুপুই হলাম না আর আপনি খালা বানিয়ে দিলেন। ‘

ঝুমুরের কথা শুনে এবার ফাহমান অসস্তিতে পড়লো। আসলে সে ওই অর্থে খালা বলেনি। যেই অর্থে বলেছে সেটা জানলে এই কাদুনে মেয়ে আবারও কেঁদে দিবে। এমনিতেই তো কাদতে কাদতে চোখের জলে নাকের জলে করে ফেলেছে। তার থেকে আসল কারণটা না বলাই শ্রেয়। ফাহমান ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল ‘ আপনি ঝুঁকে ছিলেন তাই বুঝতে পারিনি। ক্ষমা করবেন, আই অ্যাম সরি। ‘

ঝুমুর আরও কিছু বলতে চাচ্ছিল ফাহমানকে। তার ইচ্ছা করছে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিতে। লোকটার জন্য তাকে এখন আবার পুরো সিড়ি ঝাড়ু দিতে হবে। কিন্তু তার আর কথা শুনানো হলো না। ততক্ষনে ওর মামা ফারুক এসে হাজির। বন্ধুকে সিড়িতে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ফারুক বললো ‘ কিরে তুই এখানে কেন ? ‘

ফারুকের কথার জবাবে কি বলবে বুঝতে পারলো না ফাহমান। কিয়ৎক্ষণ পূর্বে যা ঘটে গেছে তা বলাটা সমীচিন হবে না ভেবেই সে বললো ‘ খেয়াল করিনি বলে আসতে সময় উনি ঝাড়ু দিচ্ছিলেন আর উনার ঝাড়ু দেওয়া জায়গা আমি জুতো পায়ে পাড়িয়ে এসেছি। ‘

ফাহমানের কথায় ফারুক বললো ‘ আরে তুই ওকে উনি উনি করছিস কেন ? ও তোর অনেক ছোট। ফেলে দিলেও সাত বছরের ছোট তো হবেই। ‘

ফারুকের কথায় অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো ফাহমান। বন্ধুর এহেন দৃষ্টি দেখে ফারুক হেসে বললো ‘ ওভাবে তাকাস না। ও আমার ভাগ্নি। আমার আপু তাসনুবার বড় মেয়ে। ও শুধু দেখতেই অমন লম্বা। আসলে অত বড় নয়। সবে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। ‘

ফারুকের কথায় ফাহমান ঠোঁট গোল করে ‘ ও ‘ বললো। ফারুক আবারও বললো ‘ তুই চিন্তা করিস না। তুই তো জানতি না সিড়িতে জুতা পড়ে ওঠা নিষেধ। নেক্সট টাইম খুলে নিলেই হবে। আর ঝুম তুই কাদিস না। ও আমার বন্ধু ফাহমান। ওই যে তিন তলার মারিয়াম আন্টি আছে না ? ওনার ছেলে ও। আমার সঙ্গে মেডিকেলেই ইন্টার্নশিপ করছে। ‘

ফারুকের কথায় ঝুমুর এবার ধরতে পারলো রোজ তবে এই লোকটাই জুতো পায়ে নেমে সিড়ি ময়লা করে দিয়ে যায় আর সেসব তার পরিষ্কার করতে হয়। ইচ্ছে করলো লোকটাকে দুই চার ঘা লাগিয়ে দিতে। কিন্তু মামার বন্ধু বলে ছেড়ে দিল। আরেকবার এরকম করলে ছেড়ে দিবে না সেও। মুখে বললো ‘ আমি জানি উনি মারিয়াম আন্টির ছেলে,কয়েকবার দেখেছি ‘

ফারুক ওর কথা শুনে ওর কপালে টোকা দিয়ে বলল ‘ বুঝলাম। তো বুড়ি সকালে তো ঝাড়ু দিয়েছিস। তাহলে এখন আবার দিচ্ছিস যে ? ‘

‘ বাবা আবারও একটা পুরনো জিনিস ঘরে এনে তুলেছে। এবারের টা পুরনো লম্বা ঘড়ি। ফ্ল্যাটে তুলতে সময় ঘড়ির গায়ে যত ঝুল ছিলো সব পড়েছে সিড়িতে। এখন এগুলো আমাকে পরিষ্কার করতে হচ্ছে। আমি বলে দিচ্ছি মামা এবার আমি বাবার সঙ্গে কথাই বলবো না। হালমনিও বিরক্ত তার এই কাজে। ‘ ঝুমুর কাদো কাদো গলায় বললো।

‘ তাহলে নিঝুমকে দিয়ে ঝাড়ু দেওয়ালেই পারিস। ওরও একটু কাজ করা উচিত। তিন তলার সব কাজ আন্টি করেন আর দোতলার কাজগুলো তো তুই করিস। ওর তো কিছুই করতে হয় না। ‘

‘ থাক আমি করছি তো। ওর করতে হবে না। ও ফর্সা মানুষ, কাজ করলে শরীরে ছাপ পড়ে যাবে। আমার শরীরে পড়লেও সেসব দেখা যাবে না। ‘ ঝুমুর জল চিকচিকে চোখে বললো।

‘ হ্যাঁ যতসব ফাউ কথা। নিজে কাজ করবে আবার নিজেই কাদবে। তুই তাহলে ঝাড়ু দে আর কাদতে থাক। আমি ফাহমানকে নিয়ে উঠছি। ‘

ফারুকের কথায় ঝুমুর একবার আড়চোখে ফাহমানকে দেখলো। সে এখনও এক দৃষ্টিতে তাকেই দেখছে। ঝুমুর দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো আর অসস্তিতে পড়লো। লোকটা এভাবে দেখছে কেন ওকে ? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই ঝুমুর আবারও কাজে লেগে পড়লো আর ফারুক, ফাহমান সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল।

—-

বাসায় ঢুকেই ঝুমুর মনোয়ারা বেগমকে খাবার ঘরে টেবিল সাজাতে দেখল। অন্যদিকে রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ আসছে। মনে হয় আঞ্জুম আরা রান্না করছেন। খাবার ঘরে ঢুকে চেয়ার টেনে ফ্যান ছেড়ে বসলো ঝুমুর। মনোয়ারা বেগম তরকারিতে চামুচ দিতে দিতে বললেন ‘ পা নামিয়ে বস ঝুম। ভদ্রতা বলে কিছু আছে। ‘

সঙ্গে সঙ্গে পা নামিয়ে নিবিড় ভঙ্গিতে বসলো ঝুমুর। মনোয়ারা বেগমের উদ্দেশ্যে বললো ‘ আপনাকে এত গম্ভীর দেখাচ্ছে কেন আপি ? ‘ নাতনির কথার জবাবে মনোয়ারা বেগম বললেন ‘ তাড়াতাড়ি গিয়ে গোসল সেরে আয়। আজ তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া শেষ করতে হবে। বিকালে লাবিবা আসছে। ‘

‘ বড় খালামণি ? কিন্তু কেন ? ‘ অবাক হয়ে সুধাল ঝুমুর।

‘ মানুষ একজনের বাড়িতে কেন আসে ? ‘ মনোয়ারা বেগম পাল্টা প্রশ্ন করলেন ।

আর কথা বাড়ালো না ঝুমুর। ক্লান্ত পায়ে উঠে তার ঘরের দিকে গেলো। সে বুঝে গেছে তার আপিকে পাত্র পক্ষের সন্ধান দিতেই আসছেন লাবিবা বেগম। লাবিবা বেগম হলেন ঝুমুরের মা তাসনুবার চাচাতো বোন। উনি এলেই দেখা যায় এক গাদা নাতি নাতনী নিয়ে আসেন। বাচ্চা কাচ্চা ঝুমুরের পছন্দ নয় তানা কিন্তু লাবিবা বেগমের নাতি নাতনী সবকটা প্রচন্ড ফাজিল। আসলেই ঝুমুরের ঘর বিছানা ময়লা করে দিয়ে যায়। তখন আর তার কান্নাকাটি করা ছাড়া উপায় থাকে না।

ঘরে ঢুকতেই ঝুমুর দেখলো মেঝেতে তার ইম্পর্ট্যান্ট নোটসের গুষ্টি উদ্ধার করা হয়ে গেছে ততক্ষনে। সেগুলো টুকরো টুকরো হয়ে মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে। দুঃখে ঝুমুরের আবারও কান্না এলো। সে কাদতে কাদতে কাগজগুলো তুলে ঘরের পেপার ডাস্টবিনে ফেললো। এখন তাকে আবারও নোটস করতে হবে। অনেক কষ্টে লিখেছিলো ওগুলো অথচ ওর বিচ্ছু ভাইটা সব ছিঁড়ে ফেললো। দোষ তো ওরই। আমির দেখলে ছিঁড়ে ফেলবে জানার পরও টেবিলের উপর রেখে গেছে। তাই এটা তো হওয়ারই ছিলো।

ছেলেটাকে যে একটা কঠিন ধমক দিবে সেটাও সে পারে না। সে ধমক দিবে কি তার আগেই আদরের ভাইকে ধমক দিতে হবে এই কষ্টে সে কেঁদে ফেলবে। তাই মনের দুঃখে কাগজগুলো ফেলে জামা কাপড় নিয়ে বাথরুমে গোসলে ঢুকলো। গোসল সেরে বারান্দায় জামা কাপড় মেলে দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়ালো ঝুমুর। চুলগুলোতে চিরুনির আঁচড় লাগাতেই আঞ্জুম আরা ঘরের দরজায় কড়া নাড়লেন।

ঝুমুর বললো ‘ কিছু বলবেন মামী ? ‘ আঞ্জুম আরা এবার ঘরের দরজা খুলে এক পলক ভাগ্নিকে দেখলেন তারপর বললেন ‘ কলা পাতা রঙের জামাটা পড়লি না ? ওটাতে তোকে সুন্দর লাগে। ‘

‘ ভাবলাম ওটা আজ কাল পড়ি। আপনি কিছু বলবেন নাকি ? ‘ ঝুমুর চুল ঝেড়ে বলল।

‘ হ্যাঁ তাড়াতাড়ি খেতে আয়। মা বলেছে খাওয়া দাওয়ার পাট তাড়াতাড়ি শেষ করতে ‘ আঞ্জুম আরা বললেন।

‘ আচ্ছা আপনি যান। আমি আসছি। ‘

‘ তাড়াতাড়ি আসবি কিন্তু। মা তোর জন্য প্লেট নিয়ে বসে আছে। ‘ আঞ্জুম আরা কথাটা বলে বেরিয়ে গেলেন।

ঝুমুর আয়নার সামনে দাড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ নিজের শ্যামলা অদলের দিকে তাকিয়ে হাসলো আনমনে। ভেজা চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিয়ে ড্রেসিং টেবিল থেকে মুক্তো দেওয়া সোনার কানের দুল দুটো তুলে নিলো। দুলগুলো আজও চিকচিক করছে অথচ এগুলো দশ বছর পুরোনো। ঝুমুরের মা তাসনুবার ছিল এগুলো। ঝুমুর মায়ের কানের দুলগুলো হাতে নিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তারপর আলতো হেসে দুলগুলো পড়ে ঘরের বাইরে এগিয়ে গেলো।

চলবে….
মিফতা তিমু

শ্যামাঙ্গণা-২
———–

আচানক খাবার ঘরে একটু আগের সেই অভদ্র ছেলেটাকে দেখে এক রকমের ধাক্কাই খেলো ঝুমুর। এই মুহূর্তে ওই ছেলেটাকে এখানে আশা করেনি সে। তাকে দেখতে পেয়ে আঞ্জুম আরা ইশারায় তাকে কাছে ডেকে ফাহমানকে উদ্দেশ্য করে বললেন ‘ ও আমার ননাসের মেয়ে, ফাহমান। এইবার ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে। ওর স্বপ্ন ও একদিন একজন বড় ডক্টর হবে। ‘

আঞ্জুম আরার কথায় বিরক্ত হলো ঝুমুর। কি দরকার ছিল ওর কি স্বপ্ন সেটা ওই ছেলেকে বলার ? এইদিকে ওর আপিও ছেলেটাকে সেধে সেধে খাবার দিচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন জামাই আদর চলছে। চেনা নেই,জানা নেই একটা ছেলেকে বাড়িতে ডেকে খাওয়াচ্ছে। ঝুমুর বুঝলো তার মায়ের গুষ্টি পুরাই পাগল। গুষ্টিতে সব কটা পাগলের মেলা।

ঝুমুর এগিয়ে গিয়ে সবার মাঝের চেয়ারটাতে বসলো। সব কাজিনদের মধ্যে বড় হওয়ায় নানার বাড়িতে তাকে একটা আলাদা মর্যাদা দেওয়া হয়। সেই সম্মান থেকেই তার জন্য মাঝের চেয়ারটা বরাদ্দ করা। এই চেয়ারে সে ব্যতীত একমাত্র তার মামা ফারুকই বসে। চেয়ারে বসতেই মনোয়ারা বেগম এগিয়ে এসে ঝুমুরের মুখে ভাতের লোকমা তুলে দিলেন।

ঝুমুরকে খাইয়ে দিতে দেখে অবাক হলো ফাহমান। এত বড় একটা মেয়েকে এই বয়সে খাইয়ে দিচ্ছে ? ফারুক ভাগ্নির এত খাতিরদারি দেখে মনোয়ারা বেগমকে বললো ‘ এই বুড়িকে তুমি এখনও রোজ লোকমা তুলে খাইয়ে দাও কেন বলতো ?’

মনোয়ারা বেগম ঝুমুরের মুখে খাবার তুলতে তুলতে বললেন ‘ তার কারণ নিশ্চই নতুন করে বলতে হবে না। তুমি তো জানো তাইনা ? ‘
মনোয়ারা বেগমের কথায় হাসলো ফারুক। এইদিকে ঝুমুর খাওয়ার মাঝে আড়চোখে কয়েকবার ফাহমানকে দেখলো। যতবারই সে ফাহমানের দিকে তাকাচ্ছে ততবারই ছেলেটার চোখে চোখ পড়ে যাচ্ছে তার। বাধ্য হয়ে সে অসস্তিতে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।

ঝুমুরের বারবার আড়চোখে তার দিকে তাকানোর ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছে ফাহমান। এই শ্যাম মোহিনীর কাজল চোখগুলো ঘুরে ফিরে তার খোঁজেই পরিশ্রান্ত হোক এটাই তো তার চাই। ভালো লাগে যখন ডাগর ডাগর চোখ দুটো তার পানে চেয়ে অসস্তিতে দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নেয়। মুগ্ধ হয় সে ওই চোখের চাহনিতে।

চৈত্রের এই জনজীবন অতিষ্ট করা দুপুরে যখন কাজল দীঘির মতো চোখ দুটোর গভীরে ফাহমান কান্নার উপচে পড়া ঢেউ দেখল তখনই তার মনে হলো তার এই দীর্ঘ পঁচিশ বছরের সন্ন্যাসী জীবনে প্রেমের গ্রহণ বুঝি লেগেই গেছে। ক্লান্ত মরুর কুল চাপিয়ে বন্যার বিধ্বংসী প্রেমের জোয়ার আসছে ঘনিয়ে।

‘ তুমি তাহলে এতদিন হোস্টেলে থেকেই মেডিক্যালটা পড়েছ তাইনা ফাহমান ? ‘ মনোয়ারা বেগম ঝুমুরের ভাত খাওয়া প্লেটে হাতের উচ্ছিস্টাংশগুলো পানি দিয়ে ধুয়ে বললেন।

‘ জি আন্টি, আমি, সিফাত আর সাদি তিনজন বন্ধু মিলে একটা তিন রুমের ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে কলেজের কাছে ছিলাম। সেখান থেকে কলেজে যেতে সুবিধা তাই ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া। ‘

‘ বুঝেছি। টঙ্গী থেকে ডিএমসি অনেকটা দূর হয়ে যায়। তা সারাদিন কলেজ শেষে ঘরের কাজগুলো কে করতো ? সারাদিন পর নিশ্চই ইচ্ছা করতো না করতে ? ‘

‘ সেটা ঠিক। সারাদিন ক্লাস, প্রাকটিক্যাল তারপর সিনিয়র ডক্টরদের ঝাড়ি খাওয়ার পর ঘরের কাজ করতে একদমই ইচ্ছা করতো না। কিন্তু আমাদের তিন জনের কাজই আমি সমানভাবে ভাগ করে দিয়েছিলাম। আমি রান্না করলে সিফাত ঘর পরিষ্কার করতো আর কাপড় ধোয়ার কাজ ছিল সাদির। এভাবেই আমরা চেঞ্জ করে করে কাজ করতাম। তাছাড়া সাপ্তাহিক ছুটির দিনও শেয়ার করে কাজ করা হতো। ‘ ফাহমান খেতে খেতে বললো।

‘ তারমানে রান্না থেকে শুরু করে ঘরের সব কাজই তুমি পারো ? ‘ আঞ্জুম আরা খানিকটা অবাক হয়েই বললেন।

‘ রান্নার সবকিছু পারিনা তবে উপায় না থাকলে রেধে খাওয়ার মতো কাজ পারি। আমার থেকেও ভালো রান্না তো ফারুক করে। আপনারা নিশ্চয়ই ওর হাতের হোয়াইট চিকেন কারি খেয়েছেন। ওর ঐ ডিশটা আমার একটু বেশিই ভালো লাগে। ‘

ঝুমুর ততক্ষনে খেয়ে উঠে গেছে। সে রান্নাঘরে জমানো থালাবাসনগুলো ধুচ্ছে সঙ্গে কান খাড়া করে মনোয়ারা বেগম আর ফাহমানের কথা শুনছে। ফাহমান রান্না পারে!! কথাটা শুনে সে পুলকিত। একজন ছেলে মানুষ এত নিখুঁত। এ যেন তার বিশ্বাসই হতে চাইছে না। ফাহমানের বেশভূষা, চাল চলন দেখতে সাধারণ হলেও তার ব্যক্তিত্ব অসাধারণ। সাধারণতার মোড়কে মোড়ানো তার চেহারাও মায়াবী।

ফাহমানের চোখ দুটো দেখলে ঝুমুরের মনে হয় ওই চোখে তাকিয়ে থেকে সহস্রাধিক কবিতার রচনা করা যাবে। পরমুহূর্তেই মনে পড়ে ফাহমান তার মামার বন্ধু। মামার বন্ধু ইজ ইকুয়েল টু মামা। তার মানে ওই অসভ্য, অভদ্র ছেলেটা ওর মামা ?

নাআআআ… নো নেভার। ঝুমুর মরে গেলেও ওই বোকাসোকা ধরনের সাধারণ দেখতে এই ছেলেকে মামা বানাবে না। নো মিনস নো। নো, নেভার। দুনিয়ায় কি আর ছেলে নেই যে বেছে বেছে ফাহমানকেই তার মামা বানাতে হবে ? তার নিজের মামার কি অভাব আছে ? তার নিজেরই দুটো মামা। তার উপর তার মায়েরও কতগুলো মামাতো, চাচাতো, খালাতো ভাই আছে। তারাও তো তার মামাই হয়। তাহলে যেচে কেন ওই অভদ্র, অসভ্যকে মামা বানাবে ?

খাওয়া দাওয়া শেষে মনোয়ারা বেগম সবার প্লেট তুলে নিচ্ছেন ঝুমুরকে ধুতে দেওয়ার জন্য কিন্তু ফাহমান বললো সে নিজেই প্লেটগুলো নিয়ে যাবে, মনোয়ারা বেগমের আর কষ্ট করার প্রয়োজন নেই। যদিও মনোয়ারা বেগম তাতে রাজি হননি কিন্তু ফাহমান একটু আধটু কাজ কিন্তু ছেলেদেরও করা উচিত বলে তাকে মানিয়ে নিলো। বাধ্য হয়ে মনোয়ারা বেগম রাজি হলেন। ফাহমান প্লেট নিয়ে রান্নাঘরে গেলো।

রান্নাঘরে তখন ঝুমুর প্লেট ধুচ্ছে। একসঙ্গে জমানোর কারণে অনেক জমে গেছে। আঞ্জুম আরা সময় করে ধুতে পারেননি বলে আজ এই অবস্থা। ভদ্র মহিলার পক্ষে সময় করে ওঠাও কঠিন। একেতো প্রথমে ঝুমুরের ভাই আমির এবং তার ছোট ছেলে সামিকে একবার স্কুলে দিয়ে আসেন তারপর আবার সাড়ে দশটার দিকে আনতেও যান। সেই সঙ্গে বড় ছেলে তাফিমকেও বারোটার দিকে স্কুলে দিয়ে আসেন। দেখা যায় সারাদিন তার দৌড়াদৌড়ি করেই কাটে।

আঞ্জুম আরাকে কাজে এতসময় ব্যস্ত থাকতে দেখে ঝুমুর চেষ্টা করে তার পক্ষে যতটা সম্ভব কাজ এগিয়ে দেওয়া। এসব সে নিজ আগ্রহেই করে। কাজ করতে তার ভালো লাগে। তাইতো সে রোজ নিয়ম করে যতটা সম্ভব বাড়ির সিড়ি ঝাড়ু দেওয়া থেকে শুরু করে টুকিটাকি সব কাজ করে। নিয়মিত কাজ করার আর সর্বক্ষণ আঞ্জুম আরার কাছাকাছি থাকার কারণে সে রান্নাও পারে মোটামুটি।

কারোর আগমণ টের পেয়ে পিছনে ফিরলো ঝুমুর। তার হাতে তখন সাবানের ফেনা। কপালের কোণেও বেখেয়ালে সাবান লেগে আছে। লম্বা চুলগুলো তেল দিয়ে বেণী করা। কানে জ্বলজ্বল করছে ছোটো মুক্তোর সোনার কানের দুল। এহেন অবস্থায় ঝুমুরকে দেখে ফাহমান অসহায় বোধ করলো। বিধাতার কাছে অভিযোগ করলো কেন মেয়েটাকে এমন বিধ্বংসী রুপে এখনই তার সামনে এনে দিলো।

ঝুমুরের শ্যাম মুখখানার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে ফাহমান। ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঝুমুর বললো ‘ কিছু বলবেন আপনি ? ‘
ঝুমুরের কথায় কল্পনার রাজ্য থেকে মর্ত্যলোকে নেমে এলো ফাহমান। এগিয়ে গিয়ে আমতা আমতা করে বলল ‘ না মানে আন্টি বললেন প্লেটগুলো তোমার কাছে দিতে। ‘

‘ আচ্ছা, আপনি আনতে গেলেন কেন ? আমাকে বললে আমিই নিয়ে আসতাম। আপনি মেহমান মানুষ। আপনি সিংকে হাতটা খলিয়ে বেসিনে ভালো করে হাত ধুয়ে নিন ‘ কথাগুলো বলতে বলতে সিংক ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়ালো ঝুমুর।

ঝুমুরের কথা শুনে ফাহমান সিংকের কল ছেড়ে হাতটা খলিয়ে নিতে নিতে বলল ‘ আমি মেহমান হলেও আমার কাজ আমার নিজের করতে আর অন্যদের কাজে সাহায্য করতেই আমার ভালো লাগে । তুমি যেমন রোজ নিয়ম করে সিড়ি ঝাড়ু দাও তেমনই আমিও রোজ নিয়ম করে দুপুরে কিংবা রাতে থালাবাসন ধুই কাজেই এই কয়টা প্লেট উঠানোর অভিজ্ঞতা আমার আছে। কখনও কখনও মায়েদেরও বিশ্রামের প্রয়োজন পড়ে। ‘

ফাহমানের কথায় মুগ্ধ চোখে ওর দিকে তাকালো ঝুমুর। ভাবলো মানুষটা কত ভালো। নিজের মায়ের কত চিন্তা করে তাইনা ? এমন সন্তান তো লাখে একটা। এমন সন্তান থাকলে অন্য কারোর আর প্রয়োজন পড়েনা। আসলেই মারিয়াম বেগম অনেক ভাগ্যবতী যে এমন একটা ছেলে পেয়েছেন।

ফাহমানের কথায় ঝুমুর হেসে মাথা নাড়িয়ে তার কথায় সায় দিয়ে আবার প্লেট ধুতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
ফাহমান এবার হাতটা ভালো করে ধুতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বেসিনে গেলো। হাত মুখ ধুয়ে সে গেলো ফারুকের ঘরে। আজ অনেকদিন পর দুজন সময় পেয়েছে বলে একটু আড্ডা দিবে।

—-

দ্রুত গতিতে পেঁয়াজ কাটছে ঝুমুর। হাতে অনেক কাজ পড়ে আছে। আঞ্জুম আরা চুলায় সমুচা টালছেন। মনোয়ারা বেগম ফল কাটছেন। সবারই হাত চলছে খিপ্র গতিতে। এত তাড়াহুড়োর কারণ হলো লাবিবা বেগম তার নাতি নাতনী নিয়ে আসছেন। ভদ্র মহিলা অদ্ভুত কিসিমের মানুষ। ঝড়ের গতিতে আসেন তারপর ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে যান। মাঝখানে থাকেন পনেরো মিনিট। এমন কি আসেনও মাগরিবের সময়।

এই লাবিবা বেগম আর তার গুষ্টিকে ঝুমুর দুই চোখে দেখতে পারেনা। ধুম তানানা করে আসবে আবার ধুম তানানা করেই চলে যাবে। সঙ্গে ঘরটাকেও ময়লা করে দিয়ে যাবে। আর সেই ময়লা ঘর পরিষ্কার করতে হবে তাদের তিন রমণীকে।

দরজার কলিং বেল বাজতেই ঝুমুর হাতের গতি বাড়ালো। এখনও নুডুলসে ক্যাপসিকাম দেওয়া বাকি। লাবিবা বেগমকে বিশ্বাস নেই। এসেই যাওয়ার গো ধরবেন। ঝুমুর ভেবে পায়না অদ্ভুত সব মানুষের বাস এই পার্থিব পৃথিবীতে।

মনোয়ারা বেগম গিয়ে লাবিবা বেগমকে তাদের বসার ঘরে বসালেন। এক হয়ে চাচী ভাতিজি গল্প জুড়ে দিয়েছেন। সবই ঝুমুরের বিয়ে প্রসঙ্গে। লাবিবা বেগম আফসোসের সুরে বলছেন ‘ ঝুমুরের গায়ের রঙের জন্য পাত্র পক্ষ বিয়ে করতে চাইছে না হ্যাঁ ? অথচ দুনিয়ায় যে ওর থেকেও আরও কালো মানুষ আছে তার হিসাব নেই। কাকী আপনি বিশ্বাস করবেন না এইসব কথা শুনলেই মেজাজ খিচড়ে যায়। কি যে শুরু করেছে মানুষজন ? মহিলা মানুষরা কালো ছেলের জন্য ধলা বউ খুঁজে। এইদিকে নিজের ছেলে যে কালো সেটা দেখে না। ‘

ঝুমুর তাড়াতাড়ি হাত চালাচ্ছে। তার এত দিকে নজর দেওয়ার সময় কোথায়। সব নাস্তা এক ট্রেতে করে অবশেষে সে লাবিবা বেগমের সামনে নিয়ে রাখলো। লাবিবা বেগম তাকে দেখে আলতো হেসে কথা প্রসঙ্গে মনোয়ারা বেগমকে বললেন ‘ কাকী আরেকটা সম্বন্ধ পেয়েছি। ছেলে বুয়েটিয়ান, বর্তমানে বড় কোম্পানিতে চাকরি করছে। আপনি রাজি থাকলে তাদের সাথে কথা বলে দেখবো। ‘

মনোয়ারা বেগম শান্ত ভঙ্গিতেই বললেন ‘ তাহলে তাই করো লাবিবা। উনাদের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করো কখন সময় করে আসতে পারবেন। ‘
‘ খালামণি আপনি খান না ‘ লাবিবা বেগমকে অনুরোধ করলো ঝুমুর।

‘ খাচ্ছি, এতকিছু তুমি করলে নাকি ? ‘ লাবিবা বেগম হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন।

লাবিবা বেগমের কথার জবাবে ঝুমুর সহজ কথায় হু বললো। লাবিবা বেগম শুনে খুশি হয়ে বললেন ‘ কাকী ঝুমুর তো দেখি সবই পারে। ওর এসব গুণও যদি পাত্র পক্ষ দেখত তাহলে বিয়ে হতে সমস্যাই হতো না। ‘
ঝুমুর লাবিবা বেগমের কথায় বিরক্ত হলো। এসে থেকে এই ভদ্র মহিলা শুধু তার বিয়ে নিয়েই পড়ে আছে। আর কি কাজ নেই নাকি উনার ?

আরও দুয়েক কথা বলে লাবিবা বেগম উঠে দাড়ালেন। এগিয়ে গেলেন সদর দরজার দিকে। গলা চড়িয়ে ডাক দিতেই উনার দুই নাতনি ঝুমুরের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। একেতো লাবিবা বেগম তার করা নাস্তার একটাও খায়নি তার উপরে উনার দুই নাতনি ঝুমুরের ঘর থেকে বেরিয়েছে। এসব দেখে ঝুমুর হতবাক। মেয়ে দুইটা এতক্ষণ তার ঘরে ছিল ? খোদা জানে ঘরের কি অবস্থা।

লাবিবা বেগম বেরিয়ে যেতেই ঝুমুর ওর ঘরে উকি দিলো। দেখলো বিছানা জুড়ে চানাচুরের মেলা। মেয়েগুলো চানাচুর নিলো কখন। মেঝেতে তার আরও কয়েকটা নোটস পড়ে আছে যেগুলো সে বিকালেই করেছে। জানালা খোলা অথচ সন্ধ্যা বলে মশা এসে ভরে যাচ্ছে। ঘরের এই হাল দেখে ঝুমুরের বুক ফেটে কান্না আসলো।

ঝুমুর নিজের রুম থেকে বেরিয়ে বসার ঘরের কাছে এলো। মনোয়ারা বেগম সোফায় বসে তজবি জপছেন। ফারুকের ঘরের দরজা খোলা, তা ঝুমুরের চোখে পড়েনি। ফারুক ঘর থেকে বেরিয়েছে বোতলে পানি নিতে। ঝুমুর কাদো কাদো গলায় বললো ‘ মানুষ এরকম কি করে হয় আপি ? সারা বিকাল ধরে এতকিছু বানালাম অথচ একটা চামুচও মুখে দিল না। তার উপরে নাতনী দুটোকে আমার ঘরে ছেড়ে দিয়েছে। বজ্জাত দুটো বারোটা বাজিয়ে ফেলেছে আমার ঘরের। আই প্রমিজ আমি আর ওই মহিলা আসলে কোনো নাস্তা বানাবো না। মিনিমাম কার্টেসি বলে কিছু আছে। ‘

নাতনির কথার জবাবে কিছু বললেন না মনোয়ারা বেগম। বস্তুত উনি নিজেও লাবিবা বেগমের এই ব্যবহারে আশাহত। একজন মানুষের বাসায় এলো অথচ কিছু খেয়ে গেলো না। এটা কোন সমাজের ভদ্রতা ?

বোতল ভর্তি পানি নিয়ে ঘরে ঢুকে ঘরের দরজা লাগাতেই ফাহমান জিজ্ঞেস করলো ‘ কি ব্যাপার ? তোর ভাগ্নি কাদঁছে কেন ? ‘

‘ ঝুম ? ওর কথা আর কি বলবো ? কিছু হলেই তো কাদে। কিন্তু না কেদেও উপায় নেই। আমার চাচাতো বোন এসেছিলেন নাতনী নিয়ে। নিজের নাতনীদের ঝুমের ঘরে ছেড়ে দিয়ে নিজে বসার ঘরে বসেছিলেন। ঝুম নাস্তা হিসেবে যা বানিয়েছিল একটাও তো মুখে তুললোই না উল্টো নাতনিগুলো ঝুমের ঘর সাড়ে সর্বনাশ করে ছেড়েছে। সেই দুঃখেই কাদঁছে। ‘

ফারুকের কথা শুনে কপালে হাত ঠেকিয়ে ফাহমান বললো ‘ তোর ভাগ্নি আসলে বোকা। দুনিয়ায় সব মানুষ এক না। সবার কাছ থেকে ভদ্রতা আশা করা বোকামি। কোথায় না এখন ঘরদোর গুছাবে তানা ও কাদঁছে। ‘

‘ ও এমনই। ছোট থেকেই অনেক শান্ত। শুধু অনেক রাগ কিংবা কষ্ট হলে এভাবে কাদে। ‘ ফারুক ঠোঁট উল্টে বললো।

ফাহমান মনে মনে বললো ‘ প্রেয়সী তুমি কেন বুঝো না তোমার ঐ কাজল চোখের দু ফোঁটা অশ্রুও আমায় কষ্ট দেয় ? ‘

চলবে…
মিফতা তিমু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here