শ্যামাঙ্গণা-১৭,১৮
১৭
————-
কান ধরে মুরগি হয়ে বসে আছে ঝুমুর। তার সামনে হাতে স্কেল নিয়ে শক্ত পোক্ত চেহারা নিয়ে ফাহমান বসে আছে। তার শীতল দৃষ্টি ঝুমুর পানে। ঝুমুর সেই দৃষ্টি দেখে আবারও শুকনো ঢোক গিললো। তার অপরাধ হলো সে কাল পড়া স্কিপ করার আগে ফাহমানকে জানায় নী। কাল রবিবার ছিল। ঝুমুর যদি পড়তেই না পারে তার অন্তত জানানো উচিত ছিল। ফাহমান ঝুমুরের উপর যতই দূর্বল হোক না কেন পড়াশোনার ব্যাপারে সে বড্ড সিরিয়াস। এহেন ধারার ইররেসপনসিবল ব্যবহার তার পছন্দ নয়।
ঝুমুরকে বিশ মিনিট এভাবে কান ধরে বসে থাকার শাস্তি দিয়েছে ফাহমান। আপাদমস্তক শাস্তিটা দেখতে সহজ হলেও ঝুমুরের জন্য ব্যাপারটা খুবই কষ্টের। এতক্ষণ কান ধরে বসে থাকা তার জন্য বেশ কষ্ট সাধ্য ব্যাপার। তাই সে বেশিক্ষন পারলও না বসে থাকতে। বাধ্য হয়ে পা ধরে বসে পড়লো মেঝেতে।
ঝুমুরকে বসে পড়তে দেখে ফাহমান ভ্রু কুচকে তাকালো ওর দিকে। মুখে বললো ‘ হোয়াই ইউ আর সিটিং অন দা ফ্লোর ? ইউর পানিশমেন্ট ইজ নট ওভার ইয়েট ‘
ঝুমুর কাতর কন্ঠে বলল ‘ আর পারছি না। পা ব্যথা করছে আমার। ‘
মিস মারিয়াম ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন বোতলে পানি নিতে। ঘর থেকে বেরিয়ে ঝুমুরকে মাটিতে আর ফাহমানকে স্কেল হাতে বসে থাকতে দেখে হতবাক তিনি বললেন ‘ একি!! ঝুমুর মাটিতে কেন আর ফাহমান তোর হাতে স্কেল কেন ? ‘
‘ কাল পড়তে পারবে না সেটা জানায়নি আমাকে ও। তাই পানিশমেন্ট দিয়েছি। ‘ মায়ের প্রশ্নের জবাবে একরোখা ফাহমান উত্তর দিলো।
ছেলের কথা শুনে মিস মারিয়াম ভ্রু কুচকে বললেন ‘ বললেই বা কি হতো ? তুই নিজেও তো বাড়িতে ছিলি না। তাছাড়া তুই তো দেখেছিস ও ফাংশন অ্যাটেন্ড করেছে। তাহলে এখন এসব বলছিস কেন ? ‘
মায়ের কথায় অধৈর্য্য ফাহমান বললো ‘ প্রশ্ন ও আসেনি কেন সেটার না। কথা হলো ও জানাইনি কেন পড়তে আসবে না। এখন এই বয়সেই যদি এত কেয়ারলেস হয় তাহলে বড় হয়ে তো কাউকে আর চোখেই দেখবে না। আর মা তুমি আমাদের মাঝে এসো না। ঝুমুর আমার স্টুডেন্ট কাজেই ওকে শাসন করার রাইট আমার আছে। ‘
ছেলের কথায় ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললেন মিস মারিয়াম। উনি আর কিছু বললেন না। নিজের কাজ শেষ করে আবার রুমে চলে গেলেন। হৈমন্তী নিজের পড়া করছে তাই তার মনযোগ এদিকে নেই। নাহলে সেও বেরিয়ে আসতো। মিস মারিয়াম বেরিয়ে যেতেই ঝুমুর অসহায় চোখে ফাহমানের দিকে তাকালো তবে ফাহমান সেটা পাত্তা দিলো না। চোখের ইশারায় ঝুমুরকে আবারও কান ধরে বসতে পড়লো।
ঝুমুর তার অভিমানী মন নিয়েই তার শাস্তির সময়টা পার করলো। শাস্তি শেষে সে তার নির্ধারিত চেয়ারে গিয়ে বসলো। তার অভিমানে ফুলে যাওয়া মুখ দেখে হাসলো এবার ফাহমান। মুখে বললো ‘ ডাক্তার সাহেবা মনে হচ্ছে রেগে গেছেন ? তা এই রাগ কি কারণে ? ‘
ফাহমানের কথায় রেগে গেলো ঝুমুর। তবে শান্ত গলায় বললো ‘ আপনি বুঝি জানেন না আমি কেন রেগে আছি ? এমনই সময় তো কত মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেন আর আজ সোজা কান ধরে বসিয়ে দিলেন। এখন আবার জিজ্ঞেসও করছেন কেন রাগ করেছি ? আপনি জানেন না আমি কেন রাগ করেছি ? ‘
ঝুমুরের কথায় ফাহমান বললো ‘ দেখুন অঙ্গণা, আমি আপনাকে ভালোবাসি। কিন্তু তারমানে এই না আপনাকে ভালোবেসে আপনার ভুলগুলো আমি ধরিয়ে দিবো না। আমি ভালোকে ভালো আর খারাপকে খারাপ বলতে জানি। আমার যদি মনে হয় তোমার কোনো কাজ ঠিক হয়নি তাহলে অবশ্যই আমি তার জন্য প্রতিবাদ করবো। হতে পারে সেটা বুঝিয়ে কিংবা শাস্তি দিয়ে।
তুমি কাল আমার কাছে পড়বে না ব্যাপারটা না জানিয়ে যেই দায়িত্ব জ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছো তার শাস্তি না দিলে এই ভুলটা ভবিষ্যতে তুমি আবারও করবে যেটা আমি চাইনা। তোমার কোনো কাজে যাতে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে তার জন্যই তোমাকে শক্ত হয়ে সামলে রাখছি। আমি প্রয়োজনে তোমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবো, মিষ্টি কথা বলবো আবার আমিই প্রয়োজনে শক্ত ব্যবহার করবো। এটাই আমার নিয়ম। ‘
ফাহমানের নরম কথায় ঝুমুরের মনে জমে থাকা পাহাড়সম অভিমান সঙ্গে সঙ্গে গলে গেলো। তবে সে কপট রাগ দেখিয়ে বললো ‘ আগে আপনি ঠিক করুন আমাকে আপনি বলবেন নাকি তুমি। একেক সময় একেকটা বলেন। ‘
‘ সেটা তো বলতে পারছি না মিস অঙ্গণা। আমার মুডের ওপর ডিপেন্ড করে সেটা। যখন যেটা ডাকতে মন চাইবে তখন সেটাই ডাকবো। এবার কথা বাদ দিয়ে পড়তে বসো। এক ঘন্টা কিন্তু দ্রুত পেরিয়ে যাবে। ‘
ফাহমানের কথায় ঝুমুর আর কথা বাড়ালো না। সে বাকি সব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে পড়ায় মন দিল। তবে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে কয়েকবার ফাহমানকে দেখলো। কিন্তু তার এই লুকোচুরি ভাব প্রত্যেকবারই ধরে ফেলছে ফাহমান। তাকিয়ে তাকিয়ে বারবার তাকে দেখায় ঝুমুরের উপর রুষ্ঠ হয়ে গরম চোখে বললো ‘ পড়ায় মন দিন ঝুমুর নাহলে কমপ্লেইন সোজা আংকেলের কাছে যাবে। ‘
ফাহমানের কথায় চট জলদি বইয়ের দিকে নজর দিল। ফাহমানের মুখে ‘ ঝুমুর ‘ ডাকটা শুনে তার বোঝা হয়ে গেছে ফাহমান তার এহেন পড়া ফাঁকি দেওয়াতে রেগে যাচ্ছে। কিন্তু সাহেবকে রাগালে তো চলবে না। তাই সে পড়ায় মন দিয়ে বারবার ফাহমানকে দেখার অদম্য ইচ্ছে তার ছোট হৃদয়েই পুষে রেখে দিল।
—-
দিনগুলো কেটে যাচ্ছে পাতা ঝরার মতো। ঝুমুরের এখন মডেল টেস্ট চলে। সে এখন পুরো দস্তুর পড়াশুনায় মনযোগী। পড়াশোনা ছেড়ে অন্য কোথাও মন দেওয়ার তার সুযোগ নেই। এই কারণেই ফাহমানের সঙ্গে দেখা এবং কথা দুটোই তার কম হচ্ছে। সেই এক্সামের প্রথম দিন দেখা হয়েছিল তারপর আর তাদের মধ্যে তেমন দেখা হয়নি। মাঝেসাঝে হয়তো বারান্দা দিয়ে এক পলক চোখাচোখি হয়েছে।
আজকাল নিজের পড়াগুলো ঝুমুর নিজেই করে নিচ্ছে। ইম্পর্ট্যান্টগুলো খায়রুল স্যার,মিস মার্জিয়া ফোনে ম্যাসেজ করে দিচ্ছেন আর ঝুমুর তা তুলে নিচ্ছে। এরকমটা আগেও হয়েছে। সারা বছর ফোন প্রয়োজন না পড়লেও এক্সামের সময় ঝুমুরের ফোন প্রয়োজন পড়ে। এই কারণেই ওই সময়টা তার চালানোর জন্য তার কাছে ফোন রাখা থাকে।
ঝুমুরের নিজস্ব কোনো ফোন নেই এমনটা না। তার ফোন আছে কিন্তু ফোন চালানোর ব্যাপারটা বা ফোনের ইউজড টু হয়ে যাওয়া ঝুমুরের মোটেই পছন্দ নয়। ওর মনে হয় এতে ও প্রযুক্তির প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে এবং প্রযুক্তির দাসত্ব করছে। কোনো জড় বস্তুর প্রতি এত নির্ভরশীলতা ঝুমুরের পছন্দ নয়। তাই তার ফোন প্রায় সারাবছরই তোলা থাকে। শুধু এক্সামের দিনগুলোতে সে ফোন নামিয়ে আনে।
ক্লান্ত পায়ে সবে এক্সাম দিয়ে বেরিয়েছে ঝুমুর। আজ বাংলা সেকেন্ড পেপার ছিল। কোয়েশ্চন ইজি ছিল কিন্তু নাম্বার কতটা কি পাবে সেটা তো উপরওয়ালাই জানেন। তবে সে ব্যাপারে মাথা ব্যথা নেই ঝুমুরের। তার চিন্তা ইংলিশে। ইংলিশের কোয়েশ্চন কেমন হবে তা নিয়েই ভয় তার। ঝুমুর সব বিষয়ে অনেকটাই এগিয়ে কিন্তু ইংলিশ নিয়েই তার ভয় কারণ লাস্ট দুই তিন সপ্তাহ ফাহমানের কাছে পড়ে সে কতই বা উন্নতি করতে পেরেছে তা নিয়েই সন্দেহ তার।
এক্সাম নিয়ে ভয়, বিষণ্ণতা,সারাদিনের ক্লান্তি যেন নিমেষেই উবে গেল যখন ঝুমুর দেখলো কলেজের বাইরে ফাহমান হাসিমুখে দাড়িয়ে আছে। তাদের এতদিনের প্রণয়ে এই প্রথম ফাহমান তার কলেজের সামনে এসেছে। তবে ফাহমানও ক্লান্ত যেটা তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সর্বদা পরিপাটি থাকা চুলগুলো উস্কখুস্ক ও ইনক করে রাখা শার্টটা বেরিয়ে এসেছে। কাধে ব্রাউন ব্যাগ যার মধ্যে তার সব প্রয়োজনীয় ডাক্তারি জিনিসপত্র।
ফাহমানকে দেখামাত্র ঝুমুরের চোখে মুখে এক অন্যরকম দীপ্তি ছড়িয়ে পড়লো। তার যেই মুখে এতক্ষণ ক্লান্তি বিরাজ করছিলো সেই মুখেই এক টুকরো হাসি ঝুলে পড়লো। হাস্যোজ্জ্বল ঝুমুর এক্সাম ফাইল হাতে দৌড়ে গেলো ফাহমানের দিকে। ফাহমানও ঝুমুরকে দেখা মাত্র এগিয়ে এলো।
‘ আপনি ? আপনি সত্যিই এসেছেন ডাক্তার সাহেব ? ‘
চমকিত ঝুমুর ফাহমানের কাছে গিয়ে কথাটা বললো। ফাহমান ঝুমুরকে ইশারা করলো বাড়ির পথে হাঁটতে। ফাহমানের ইশারা মতো ঝুমুর কদম বাড়ালো। ফাহমানও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললো ‘ সত্যিই এসেছি নাহলে কি আপনি আমার ভুত দেখলেন অঙ্গণা ?আপনার কি বিশ্বাস হচ্ছে না আমি আসলেই এসেছি ? তাহলে চিমটি কেটে দেখতে পারেন। ‘
ফাহমানের কথায় ঝুমুর সত্যি সত্যিই চিমটি মেরে দিল। আর সঙ্গে সঙ্গে ফাহমান যেন লাফিয়ে উঠলো। ও ঝুমুরের চিমটি দেওয়া জায়গাটাতে হাত বুলিয়ে চোখ মুখ কুচকে ব্যাথাতুর গলায় বললো ‘ বললাম বলে সত্যি সত্যি দিয়ে দিলে ?দেওয়ার হলে আরেকটু আস্তে দিতে। খুব লেগেছে আমার। ‘
‘ বেশি লেগেছে নাকি ? আসলে আপনি তো কখনও আমার কলেজের সামনে আসেন না তাই বিশ্বাস হচ্ছিল না। সরি হ্যাঁ ? রাগ করবেন না প্লিজ। আমি জেনে বুঝে করিনি। ‘ ফাহমানের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল ঝুমুর।
‘ তুমি শুধু শুধুই এত ভাবছো। বেশি লাগেনি আমার। অনেকদিন তো দেখা হয়না তার উপরে তুমি অনেক চাপে আছো। ভাবলাম এক পলক তোমাকে দেখে যদি তৃষ্ণা মেটানো যায় তাই হসপিটাল থেকে ছুটি নিয়েছি। ‘ ঝুমুরের কাছ থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললো ফাহমান।
ফাহমানকে আগাতে দেখে ঝুমুরও এগিয়ে গেলো। তারা দুজনে এক সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে হাঁটছে। সারাদিনের হুড়োহুড়িতে ক্লান্ত ঝুমুর যেন ফাহমানের কথা শুনে তার শক্তি ফিরে পেয়েছে। সে বলল ‘ আপনি আমাকে দেখার জন্য ছুটি নিয়েছেন ? ‘
‘ এনি ডাউট ? আই থিঙ্ক আমি তোমাকে দেখার জন্য না তোমার ক্লাসের অন্য মেয়েদের দেখার জন্য ছুটি নিয়েছি। আমি শুনেছি ছেলেরা নাকি মেয়ে দেখলেই গলে যায়। ‘ ফাহমান মৃদু কৌতুকের সুরে বলল।
তবে ফাহমানের এই মজা ঝুমুরের ভালো লাগলো না। ও রাগ দেখিয়ে মুখ ফুলিয়ে ফেললো। গরম চোখে বললো ‘ তাহলে ওই মেয়েদের কাছেই যান না। আমার সঙ্গে বাড়ি ফিরছেন কেন ? ওদের সঙ্গে বাড়ি ফিরুন। আমি কে হই আপনার ? আমার সঙ্গে কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই আপনার। ‘
ফাহমান চমকে উঠলো ঝুমুরের রাগ আঁচ করতে পেরে। হাতে হাত ভাঁজ করে হাঁটতে হাঁটতে বললো ‘ রাগ করলে নাকি ? তুমি যদি জানতে আমি তুমি ছাড়া আর কারোর কথা ভাবতে পারিনা তাহলে আজ প্রশ্ন করতে না তুমি কে হও আমার। তুমি আমার অনেক কিছু অঙ্গণা যা তুমি নিজেও জানো না এমনকি আমিও জানিনা। আমি আমার অজান্তে তোমাকে আমার মন দিয়ে বসেছি। ফর গড সেক এমন কিছু করো না যাতে আমার তোমাকে বাধ্য হয়েই ছুঁয়ে দিতে হয়।
তোমার ঐ নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ মুখ চেয়ে আমার বড্ড ইচ্ছা করে তোমায় ছুঁয়ে দিতে কিন্তু আমি যে অপারগ। সমাজে আমাদের এই সম্পর্কের কোনো নাম নেই। আমি এটাও জানিনা আদৌ এই সম্পর্কের কোনো নাম হবে কিনা। তুমি এবং তোমার পরিবার অর্থবিত্তের দিক থেকে আমাদের অনেক বড়। কে জানে ভাগ্য কোনওদিন আমাদের সহায় হয় কিনা। কিন্তু মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে খুব করে তোমায় ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু আমার অপবিত্র ছোঁয়া দিয়ে আমি আমার পবিত্র অঙ্গণাকে অপবিত্র করতে চাই না। ‘
ফাহমানের কণ্ঠে থাকা বিষণ্ণতার ছাপ ঝুমুরকেও ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিলো। ঝুমুরের মনটা মুহূর্তে বিষিয়ে গেলো। তার আর ফাহমানের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কি হবে সে নিজেও জানেনা। হ্যাঁ হয়তো ফাহমানের প্রতি ভালোবাসা সে প্রকাশ করতে পারেনা কারন সে ছোট থেকেই একটু ইন্ট্রোভার্ট ধরনের কিন্তু সত্যি তো এটাই ফাহমান ছাড়া সে নিজেকে কল্পনাও করতে পারেনা।
ঝুমুর আর ফাহমান বাকিটা পথ আর কোনো কথা বললো না। তাদের পথ চলছে নীরবে অথচ অন্তরে জমে আছে অনেক কথা। যেই সম্পর্কের পথই নীরব সেই সম্পর্ক কি আদৌ ভবিষ্যতে প্রকাশ পাবে নাকি প্রকাশ পাওয়ার আগেই নীরবে ঝরে পড়বে ?
প্রায় মাস ছয়েক পর বাপের বাড়িতে এসেছেন তানিয়া শাহজাহান। সঙ্গে এসেছে তার মেয়ে অনামিকা ও ছেলে অনিলও। কিন্তু তানিয়া শাহজাহানের স্বামী মাসুদ সাহেব আসেননি। ব্যবসায়িক কাজে তিনি ফার্মগেটেই থেকে গেছেন। এতদিন পর তানিয়া শাহজাহানের বাপের বাড়ি আসাও মনোয়ারা বেগমের জরুরি তলবে। মনোয়ারা বেগম জরুরি ভিত্তিতে তলব করেছেন উনাকে।
তানিয়া শাহজাহান তার ছেলে মেয়েকে নিয়ে এসেছেন দুপুরে। এখন বিকাল, ছাদে কাপড়গুলো শুকোতে দেওয়া হয়েছে। তাই তানিয়া শাহজাহান ভাবলেন কাপড়গুলো নিয়ে এলে কাজ একটা কমে যাবে। সেই ভেবেই উনি ছাদে উঠেছিলেন কিন্তু ছাদে উঠে যে এমন একটা দৃশ্য দেখবেন ভাবতে পারেননি। ঝুমুর আর ফাহমানের প্রণয়ের কথা উনি জানেন কিন্তু স্বচক্ষে যে উনি ওদের একসাথে দেখবেন সেটা ভাবেননি।
ঝুমুর আর ফাহমান তাদের মাঝে খানিকটা দূরত্ব রেখে পাশাপাশি হেঁটে বাড়ির দিকে আসছে। দুজনের মুখই মলিন। দুজনের মলিন মুখ দেখে তানিয়া শাহজাহানের ভ্রু কুচকে গেলো। ঝুমুরের কি মন খারাপ ? কিন্তু কেন ? ওই ছেলে কি ওকে ধমক দিয়েছে ? ফাহমান ঝুমুরকে ধমক দিয়েছে ভাবতেই তানিয়া শাহজাহানের মেজাজ চড়ে গেল। কিন্তু পরমুহূর্তেই ভাবলো তাহলে ফাহমানের মুখেরও একই অবস্থা কেন ? কি চলছে টা কি তাদের মাঝে ?
ঝুমুর ফাহমানের পাশে হাঁটতে হাঁটতে তাদের বাড়ির ছাদের দিকে নজর দিল। সঙ্গে সঙ্গে চোখে পরে গেলো তানিয়া শাহজাহানের দিকে। যদিও উনাকে সেখানে আশা করেনি ঝুমুর কিন্তু তানিয়া শাহজাহান তাকে আর ফাহমানকে একসঙ্গে দেখে ফেলেছে ভাবতেই ওর মুখ জুড়ে আতঙ্ক নেমে এলো। ও ভীত চোখে তাকিয়ে আছে তানিয়া শাহজাহানের দিকে অথচ তানিয়া শাহজাহানের মুখভাব স্বাভাবিক।
চলবে….
মিফতা তিমু
শ্যামাঙ্গণা-১৮
————-
তানিয়া শাহজাহান শান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় বসে আছেন। তার স্থির দৃষ্টি ঝুমুরের দিকে। ঝুমুর চোখ মেঝেতে তাক করে দাড়িয়ে আছে তার সামনে। ভয়ে ঝুমুরের অন্তর আত্মা কাপছে। তার একটাই ভয়। তানিয়া শাহজাহান কি মনোয়ারা বেগমকে বলে ফাহমানদের বাড়ি থেকে বের করে দিবে ? তাহলে ওরা যাবে কোথায় ?
ঝুমুরকে দীর্ঘক্ষণ মনযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করলেন তানিয়া শাহজাহান। ভাগ্নির ভীত মুখ ও তার চোখ মুখের লুকোচুরি ভাবই বলে দিচ্ছে ধরা খেয়ে সে এখন আতঙ্কিত। এই ভয় সামান্য ভয় না। এর পিছনে লুকিয়ে আছে অনেক কিছু হারিয়ে ফেলার আতঙ্ক।
‘ ছেলেটার সঙ্গে পরিচয় কখন থেকে ? ‘ গলা খাকারি দিয়ে প্রশ্নটা করলেন তানিয়া শাহজাহান।
ঝুমুর তার ইমোর গুরুগম্ভীর গলায় করা প্রশ্ন শুনে শুকনো ঢোক গিললো। কম্পিত কণ্ঠে বলল ‘ মাস খানেক আগে। ‘
‘ এক মাসের পরিচয়ে তুই ছেলেটার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে গেলি ? সবকিছু কি তোর এত সহজ মনে হয় ?’
ঝুমুর এবার দৃষ্টি উঠিয়ে তাকালো তানিয়া শাহজাহানের দিকে। তার চোখে মুখে অন্ধকার। যেই চোখে ঝুমুর সবসময় তার জন্য স্নেহ দেখেছে আজ সেই চোখে তার জন্য অসন্তুষ্টি। ঝুমুর চোখ নামিয়ে নিলো। মুখে বললো ‘ আমি উনাকে অনেক আগে থেকে চিনি। পাঁচ বছর ধরে এই বাড়িতে ভাড়া থাকেন উনারা। ‘
‘ এক ঘরে সারাজীবন সংসার কাটিয়েও মানুষ একজন আরেকজনকে চিনতে পারেনা আর তুই পাঁচ বছরে চিনে ফেলেছিস ওই ছেলেকে ?তোর কেন মনে হলো ওই ছেলে তোর যোগ্য ? ‘
ঝুমুর আবারও তার নামিয়ে রাখা দৃষ্টি তুললো। স্বাভাবিক গলায় নিজের সমস্ত ভয় দূর করে বললো ‘ যারা প্রতি নিয়ত মিথ্যে ভালোবাসার লেবাস পড়ে থাকে তাদের চেনা খুব কঠিন কিন্তু যারা আসলেই মন থেকে পবিত্র তাদের চিনতে সময় লাগে না ইমো। যেই মানুষটা হাজারবার আমাকে হাতের নাগালে পেয়েও আমাকে সামান্য ছুঁয়ে দেখেনি তার থেকে বড় যোগ্য এই পৃথিবীতে আর কেউ নয়। এমনও হতে পারে উল্টো আমিই তার যোগ্য নই। ‘
ঝুমুরের ফাহমানের প্রতি এত বিশ্বাস দেখে হোচট খেলেন তানিয়া শাহজাহান। ঝুমুর যে এতটা গভীর ভাবে প্রেমে ডুবেছে সেটা উনি ধরতে পারেননি। কে জানে এই প্রেমের ভবিষ্যৎ কী। প্রেমে ডুবে কি তার ভাগ্নি তলিয়ে যাবে নাকি ভারসাম্য বজায় রেখে ভেসে উঠবে ? তবে উনি নিজেকে সামলে বললেন ‘ তোর আপি জানে তোর আর ওই ছেলের ব্যাপারে ? ‘
এতক্ষণ যাও বা সাহস করে দাড়িয়েছিল ঝুমুর এখন তাও করতে পারলো না। তানিয়া শাহজাহানের কথায় সে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। তার পা ধরে বসে পড়লো। কাদতে কাদতে বললো ‘ প্লিজ ইমো আপিকে বলো না। আপি জানলে উনাকে বাড়ি থেকে বের করে দিবে। উনার আর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। প্লিজ তুমি এমনটা করো না। উনার কষ্ট হলে আমি শান্তি পাবো না ইমো। প্লিজ এমন করো না। উনাকে কষ্ট দিও না তুমি। উনি কষ্ট পেলে আমি শান্তিতে থাকতে পারবো না। ‘
ঝুমুরের এহেন ধারার কান্নাকাটিতে হতভম্ব তানিয়া শাহজাহান। এমন ধারার কান্নাকাটি করতে ঝুমুরকে আগে দেখেননি। হয়তো ঝুমুর অন্যসব মেয়েদের মত না। সে কথায় কথায় কেঁদে ভাসায় কিন্তু তার এই চোখের পানি মূল্যবান। তার নোনাজল বিনা কারণে ঝড়ে না। মূল্যবান সেই অশ্রু ঝরার পিছনেও লুকিয়ে থাকে হাজারটা বুক ভাঙ্গা যন্ত্রণা।
তানিয়া শাহজাহান নিজেকে সামলে নিলেন। মুখে গম্ভিরতা বজায় রেখে বললেন ‘ এটা তোর থেকে আশা করিনি ঝুম। প্রেম করে তোর এতটা অধঃপতন হবে আমি ভাবতে পারিনি। আমি ভেবেছিলাম তুই হয়তো এমন কিছু করবি না। কিন্তু সেই তুইই আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করলি। আমার বিশ্বাস ভেঙে দিলি তুই। ‘
কথাগুলো বলে তানিয়া শাহজাহান ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে ঝুমুর মৃদু স্বরে কাদঁছে। সে চাইলেও জোরে কাদতে পারছে না। যদি পারতো গলা চড়িয়ে কেঁদে নিজের সব দুঃখের আশ মিটাতে তাহলে হয়তো আজ এই ছোট বুকে এত যন্ত্রণা জমা হতো না। কাদতে না পেরে ঝুমুরের মনে জমা হলো আরও এক যন্ত্রণাময় ভালোবাসার মানুষকে হারানোর দুঃখ।
ঝুমুর নিশ্চল ভঙ্গিতে রুমে ঢুকলো। শাওমি বিছানায় বসে গান শুনছিল কিন্তু ঝুমুরকে দেখা মাত্র কান থেকে ইয়ার পড খুলে ফেললো। তবে ভালো করে খেয়াল করে দেখলো ঝুমুরকে কেমন যেন অদ্ভুত দেখাচ্ছে। তার চোখ মুখ উদভ্রান্তের মত লাগছে, হাতে পায়ে মনে হচ্ছে শক্তি নেই এমন ভঙ্গিতে হাঁটছে।
ঝুমুর এগিয়ে এসে বিছানায় বসলো। সে মুখে না বললেও শাওমি ঠিকই বুঝতে পেরেছে কিছু তো একটা হয়েছে নাহলে চঞ্চল ঝুমুর এরকম নেতিয়ে পড়া ফুলের মতো নিস্তেজ হয়ে পড়েছে কেন। ও উঠে গিয়ে ঝুমুরের কাধে হাত রাখলো। শাওমি কাধে হাত রাখা মাত্র ঝুমুর তার কোমর জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। মুখে বললো ‘ আমি উনাকে ছাড়া বাঁচব নারে শাওমি, বাঁচব না আমি। ‘
শাওমি জানেনা আসলে কি ঘটেছে কিন্তু ঝুমুরের কান্না দেখে টের পেয়েছে কিছু একটা হয়েছে। ঝুমুর তার ভালবাসার মানুষকে হারানোর ভয়ে ভীত। সখিকে কাদতে দেখে শাওমিরও চোখে পানি এলো। আর কেউ না জানুক সে তো জানে ভালোবাসার মানুষটাকে ভালোবেসে না পাওয়ার যন্ত্রণা কতটা কঠিন। সে নীরবে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ঝুমুরের মাথায়। হয়তো ঝুমুরের যন্ত্রণার ভাগীদার হতে পারবে না কিন্তু পাশে থেকে সাহস দিতে পারবে।
‘ কাদিস না, তোর প্রিয়কে কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না। সে শুধুই তোর… ‘
—-
তানিয়া শাহজাহানকে মনোয়ারা বেগম জরুরি তলবে ডেকেছেন কারণ ইদানিং তার মাথায় নতুন একটা চিন্তার ভার উঠে এসেছে। এই কদিন ঝুমুরের বিয়ের জন্য উনি জন বিশেক পাত্র খোঁজ করেছেন কিন্তু সকলেই দেখা যায় ঝুমুরের গায়ের রং নিয়ে আপত্তি করে নয়তো লক্ষ লক্ষ টাকা যৌতুক চেয়ে বসে। এহেন অবস্থায় এমন নিম্ন মানসিকতার কোনো মানুষের সঙ্গে বিয়ে না দিয়ে একটা ভালো ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করছেন তিনি। এই বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করতেই মেয়েকে ডেকে পাঠিয়েছেন।
আদোপান্ত সবকিছু শুনে তানিয়া শাহজাহানকে নীরব দেখা গেলো। উনি কপালে আঙ্গুল ঘষছেন। তার ঠোঁট নড়ছে যেন মনে মনে কিছু একটা বলছেন। মেয়ের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে আছেন মনোয়ারা বেগম। উনি জানেন মেয়ে তার ভাগ্নির জন্য ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে তবেই ভাগ্নিকে সঠিক পাত্রস্থ করবে। এইটুকু বিশ্বাস মেয়ের উপর তার আছে।
খানিক ভাবনা চিন্তা করে কথাগুলো মনের মধ্যে সাজিয়ে নিয়ে তানিয়া শাহজাহানকে কথা বলতে দেখা গেলো। উনি বললেন ‘ আমার কাছে একটা যোগ্য পাত্রের নাম তো আছে কিন্তু অর্থ বিত্তে ওরা আমাদের মতো ধনী নয়। সামান্য মধ্যবিত্ত পরিবার। তবে ছেলের পরিবার একক পরিবার। শুধু মা আর বোন আছে। বাপ,ভাইয়ের ঝামেলা নেই। ‘
মেয়ের কথায় বিন্দু মাত্রও বিচলিত হলেন না মনোয়ারা বেগম। উনি স্বাভাবিক গলাতেই জিজ্ঞেস করলেন ‘ যৌতুক ? ছেলের পরিবারের কোনো দাবি আছে ? ‘
মায়ের কথার জবাবে তানিয়া শাহজাহান বললেন ‘ নাহ্, আলাদা কোনো দাবি নেই। যদিও ছেলের বয়স অল্প, সবে পঁচিশ কিন্তু ছেলের বোনের বিয়ে হয়ে গেছে এবং কয়দিন পর উঠিয়েও দিবে। ‘
মেয়ের এত কথার জবাবে কিছু বললেন না মনোয়ারা বেগম। চিন্তা ভাবনা করার জন্য সময় দরকার। নাতনীকে উনি পাত্রস্থ করবেন। কাজেই দেখে শুনে ভালো দেখে ছেলের কাছে দিবেন। হোক ছেলে মধ্যবিত্ত। তবে পাত্রের চরিত্র সম্পর্কে আরও খোজ নেওয়া দরকার। যদিও তানিয়া শাহজাহান সেটা নিয়েছেন কিন্তু আত্ম তৃপ্তির জন্য নিজেও যাচাই বাছাই করতে চান।
‘ ছেলে কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য তার উপর প্রেম ট্রেম নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই। ক্যারিয়ার গড়তে গিয়ে ওসব করার সময় কোথায়। মা,বোন নিয়েই সংসার। তার উপর কোনো আলাদা চাহিদাও নেই। এমন পাত্র সহজে পাওয়া যায় না। ‘
মেয়ের কথার পৃষ্টে এবার মনোয়ারা বেগম বললেন ‘ ছেলে কে ? তুই চিনিস ? ‘
‘ শুধু আমি না তুমিও চিনো। আমাদেরই এক আত্মীয়… ‘ শেষের কথাগুলো খানিকটা টেনে বললেন তানিয়া শাহজাহান। তার চোখে মুখে অদ্ভুত হাসি যেন সেই হাসিতে লুকিয়ে আছে কোনো এক অজানা রহস্য।
—-
দিনগুলো আবারও কেটে যাচ্ছে ঝড়ের গতিতে। দুঃখি জ্বালাময় দিন কাটছে চোখের পলকে আর রাত কাটছে মাঘ মাসের পড়ন্ত বিকেলের মতো। ঝুমুরের আজ শেষ পরীক্ষা। এরপর সে আরও পড়াশুনায় ব্যস্ত হয়ে পড়বে। এই মডেল টেস্টের পর সে নতুন প্রাইভেট কোচিং শুরু করবে। এই কোচিংয়ে পড়াশুনার চাপ থাকবে অনেক।
সারাদিনের ক্লান্তি, পড়াশোনার চাপ, দীর্ঘ দিনের পরীক্ষার চাপ সঙ্গে ভালোবাসার মানুষটাকে অনেকদিন না দেখার তৃষ্ণাতে জর্জরিত ঝুমুর যেন ক্লান্ত হয়ে গেছে। সে যেন টাল মাটাল ভঙ্গিতে হাঁটছে। তার পা জোড়া আর চলতে চাইছে না। এই কয়দিনের মানসিক দ্বন্দ্বে সে এক রকম অসুস্থই হয়ে পড়েছে। সেদিনের পর থেকে ফাহমানের সঙ্গে আর দেখা হয়নি তার। রোজ সকালে ফাহমান ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়েছে কিংবা একদিন পরীক্ষা চলাকালীন কলেজের সামনে এসেও দাড়িয়েছে কিন্তু প্রতিবারই ঝুমুর তাকে এড়িয়ে গেছে।
ফাহমানকে ছাদে দেখে সে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বাগানে যায়নি। বাসায় ফারুকের সঙ্গে ফাহমানকে দেখেও যেন না দেখার ভান করে এড়িয়ে গেছে। সেই সঙ্গে কলেজের সামনে এসে যেদিন দাড়িয়েছে সেদিন উপায় না পেয়ে এক প্রকার কলেজের পিছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে গেছে বড় রাস্তায়। এভাবেই তো এতদিন সে এড়িয়ে গেছে ফাহমানকে।
এই কয়দিন তানিয়া শাহজাহান ঝুমুরকে চোখে চোখে রেখেছেন। ঝুমুরের সমস্ত গতিবিধি, তার চলা ফেরা, কথা বার্তার ধরণ সবই তিনি পর্যবেক্ষণ করছেন তীক্ষ্ণ নজরে যা স্পষ্ট বুঝতে পারছে ঝুমুর। হয়তো ঝুমুর যাতে ফাহমানের সঙ্গে আর কোনও যোগাযোগ রাখতে না পারে তার জন্যই এই ব্যবস্থা। উনি মুখে কিছু না বললেও ঝুমুরের প্রেমের ব্যাপারটা যে উনার পছন্দ হয়নি সেটাই ঝুমুরের ধারণা।
সারাদিনের ক্লান্তি, বিষণ্ণতা সব মিলিয়ে যেন ঝুমুর মানসিক অবসাদে ভুগছে। তার উপর বাসায় ঢুকতেই সবার হাউকাউ। অনামিকা,অনিল, সামি, তাফিম, আমির সব মিলে যেন বাসায় কেওয়াস শুরু করে দিয়েছে। এর মাঝে আঞ্জুম আরাও অনামিকা সামিকে কেন মেরেছে বলে অভিযোগ করছেন। অনামিকা আবার সেই কথার উত্তরে ভালো হয়েছে বলেছে।
এতকিছুর পর ঝুমুর আর এসব নিতে পারলো না।এমনিতেই মনে শান্তি নেই তার উপরে অনামিকার আঞ্জুম আরার কথায় মুখে মুখে তর্ক করা। কাপতে থাকা শরীরে সে তেড়ে গেলো অনামিকার দিকে। যা কোনওদিন করেনি তাই করে বসলো। এই প্রথম সে তার আদরের বোনের গায়ে হাত তুললো। উত্তেজিত জনতা ততক্ষণে থাপ্পড়ের শব্দে থেমে গেছে। কারোর শব্দ আর শোনা যাচ্ছে না। আঞ্জুম আরাও অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন ঝুমুরের দিকে। শব্দ পেয়ে মনোয়ারা বেগমও ছুটে এসেছেন।
উপস্থিত জনতার মাঝে ঝুমুর থম মেরে দাড়িয়ে আছে। তার হাত পা থরথর করে কাপছে। শরীর কেমন ঠান্ডা হয়ে গেছে। ঝুমুর মারবে এমনটা আশা করেনি অনামিকা। সে হতবাক চোখে তাকিয়ে আছে। এর আগে কখনো এমনটা হয়নি। ঝুমুর ভাই বোনদের গায়ে হাত তোলা পছন্দ করেনা তাই দুষ্টুমি করলে বকাবকি করে ঠিকই কিন্তু কোনওদিন মারে না।
থমকিত অনামিকা এবার ডুকরে কেঁদে উঠলো। গালে হাত দিয়ে কাদতে কাদতে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বললো ‘ আমি তোমাকে ঘৃনা করি বড় আপি। ‘
ঝুমুর এসব আর নিতে পারছে না। সে জড় বস্তুর মতোই নিষ্প্রাণ অনুভূতিতে ঘরে ঢুকলো। ঘরের দরজায় খিল এঁটে এক্সাম ফাইলটা জায়গা মতো রেখে জামা কাপড় বদলে শাওয়ার ছেড়ে গোসল করলো। তারপর কোনো মতে দরজার সিটকিনি খুলে দিয়ে বিছানায় কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো।
চলবে….
মিফতা তিমু