শ্যামাঙ্গণা-২৪,২৫ অন্তিম

0
480

শ্যামাঙ্গণা-২৪,২৫ অন্তিম

২৪
————-

ঘণ্টা কয়েক যাবত বিভিন্ন ধরনের শাড়ির দোকানে ঘুরে ঘুরেই সময় কাটছে খায়রুল ইসলামের। জীবনে এই প্রথম কারোর জন্য শাড়ি কিনছেন। যার কারণে কোনো শাড়িই মন মতো হচ্ছে না। বেশ কয়েকটা শাড়ি দেখে অবশেষে একটা শাড়িতে মন স্থির করলেন। ক্রিম কালারের শাড়িটাই নিবেন। আজ শাড়ি এক বিশেষ কারোর জন্য নিচ্ছেন। বিশেষ কেউ হচ্ছে ঝুমুর।

খায়রুল ইসলাম হলেন আটত্রিশ বছর বয়সী এক পূর্ণ যুবক যার বর্তমান পেশা হলো স্টুডেন্ট পড়ানো। খায়রুল ইসলাম চাকরি সূত্রে বেকার হলেও বিগত আট বছর যাবত এক টানা স্টুডেন্ট পড়ানোর কারণে টিউশন টিচার হিসেবে এলাকা জুড়ে উনার এক ধরনের খ্যাতিই আছে বলা যায়। ঝুমুর নিজেই তো উনার ছয় বছর পুরোনো ছাত্রী।

পড়াশোনার দিক থেকে খায়রুল ইসলাম অনেক তুখোড় ছাত্র। স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রিকাল ইন্জিনিয়ারিং পাশ করার পর তিন বছর ধরেই সরকারি চাকরির সন্ধানে আছেন। সরকারি চাকরির যতগুলো পরীক্ষা দিয়েছেন তার বেশিরভাগই উনার হয়ে আছে কিন্তু ঘুষ দিয়ে জয়েন করতে হবে বলে উনি আর এগিয়ে যাননি। বর্তমানে উনি বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পূর্বের দুটি পরীক্ষায় উনি অসামান্য কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করে গেছেন।

খায়রুল ইসলাম যখন শাড়ি কিনে মার্কেট থেকে বেরিয়ে ঝুমুরদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রিকশায় চেপে বসলেন তখনই ক্রিং ক্রিং শব্দে ফোন বেজে উঠলো। খায়রুল ইসলাম জিন্সের পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলেন অপরিচিত এক নাম্বার থেকে ফোন এসেছেন। ধরবেন কি ধরবেন না এই দ্বন্দ্বে ভুগতে ভুগতে ফোন একবার কেটে গিয়ে আবারও বেজে উঠলো।

খায়রুল ইসলাম ঠিক করলেন ফোনটা ধরবেন। উনি ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ব্যস্ত কণ্ঠে কেউ বলে উঠলো ‘ আসসালামু আলাইকুম স্যার। ‘
কণ্ঠের মালিককে চিনতে পারলেন না খায়রুল ইসলাম। দ্বিধান্বিত গলায় বললেন ‘ জী,ওয়ালাইকুম আসসালাম। কে বলছেন ? ‘

ফোনের ওপাশ থেকে ফাহমান বললো ‘ জি আমি ফাহমান,ঝুমুরের স্বামী। ‘
‘ ঝুমুরের স্বামী ‘ কথাটা শুনে খানিকটা ধাক্কাই খেলেন খায়রুল ইসলাম। হ্যাঁ এটা ঠিক যে ঝুমুরের নানু মনোয়ারা বেগম অনেকদিন ধরেই পাত্রপক্ষের সন্ধান করছিলেন আর সেই কারণেই খায়রুল ইসলাম ভেবেছিলেন ঝুমুরের শ্যামলা গায়ের রঙের জন্য যখন কেউই রাজি হচ্ছে না তখন উনার হাতে সময় আছে। একবার চাকরি হয়ে গেলেই মনোয়ারা বেগমের কাছে ঝুমুরকে ঘরে তোলার প্রস্তাব দিবেন।

কিন্তু খায়রুল ইসলামের স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেলো। ব্যাপারটা কি অদ্ভুত তাইনা ? মেয়ে মানুষের বৈবাহিক অবস্থা বদলাতে সময় লাগে না। যেই ঝুমুরকে কাল সকালেও পরীক্ষার পূর্বে পড়িয়ে এসেছেন সেই ঝুমুরই আজ নাকি বিবাহিত শুনলেন। খায়রুল ইসলাম মলিন হাসলেন। বললেন ‘ ওহ, আপনি ঝুমুরের স্বামী। কিছু বলতে চাচ্ছেন মনে হয়। ‘

ফাহমান বললো ‘ জী আসলে ঝুমুর কিছুদিন পড়তে পারবে না। সে খানিকটা অসুস্থ। সুস্থ হতেই আবারও পড়া শুরু করবে আপনার কাছে। ‘
ঝুমুরের অসুস্থতার কথা শুনে খায়রুল ইসলাম না চাইতেও জিজ্ঞেস করেই ফেললেন ‘ কেন অসুস্থ ও ? কি হয়েছে ? ‘
‘ জী আসলে ঝুমুরের এলার্জি হয়েছে। অবস্থা মাঝামাঝি, খারাপও না ভালোও না। তাই কিছুদিন আপাতত পড়াশোনা বন্ধ করে বিশ্রাম নিবে। ‘

ফাহমানের সঙ্গে কথাবার্তা শেষ করে রিকশা ওয়ালাকে খায়রুল ইসলাম বললেন ‘ মামা আজ সারাদিন যেই যেই জায়গায় ইচ্ছা রিকশা ঘোরান। সারাদিনের টাকা আমি দিবো আপনাকে। ‘
রিকশা ওয়ালা খায়রুল ইসলামের কথা শুনে অবাক হয়ে বললেন ‘ কি বলেন মামা ? সারাদিন তো মেলা টাকা খসবো আপনার। ‘

‘ খসলে খসবে। টাকা জমিয়ে কি লাভ। যার জন্য জমিয়েছিলাম সেই আমার হলো না। এখন টাকাগুলো জমিয়ে রাখলে দুঃখ কমবে না বরং দীর্ঘশ্বাস বাড়বে। ‘ খায়রুল ইসলাম মলিন হেসে বললেন।

—-

ঝুমুর বিছানায় শুয়ে বায়োলজি সেকেন্ড পেপার ঘাটছিল। ফাহমানও স্টাডি টেবিলে বসে তার কোনো এক ইম্পর্ট্যান্ট কেস হিস্ট্রি পড়ছে। একটু আগেই সে ঝুমুরকে ইম্পর্ট্যান্ট কিছু লাইন মার্ক করে দিয়েছে বইয়ে। ঝুমুর এখন সেগুলোই পড়ছে। দুজনেই যখন নিজেদের পড়ায় ব্যস্ত তখন বাসার কলিং বেল বেজে উঠলো। মিস মারিয়াম রান্নাঘরেই ছিলেন তাই এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন।

দরজার বাহিরে মোতালেব সাহেব দাড়িয়েছিলেন। মিস মারিয়ামকে দরজা খুলতে দেখে সালাম দিয়ে বললেন ‘ আসসালামু আলাইকুম আপা। ‘
মোতালেব সাহেবকে দেখে মিস মারিয়ামও ভদ্রতা সূচক হাসি দিয়ে বললেন ‘ ওয়ালাইকুম আসসালাম ভাইজান। বাহিরে কেন ? ভিতরে আসুন না। ‘

ঝুমুরের চোখ বইয়ের দিকে থাকলেও কলিং বেল বাজা মাত্র তার মনযোগ চলে গেছে বাহিরের ঘরের দিকে। মোতালেব সাহেবের গলা পাওয়া মাত্র সে উঠে দাড়িয়ে গায়ে ঠিক মতো ওড়না জড়িয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিল বাহিরের ঘরের দিকে। ঝুমুরকে দৌড়ে বেরিয়ে যেতে দেখে ওকে ডাকতে ডাকতে ফাহমানও ওর পিছন পিছন বেরিয়ে এলো।

বসার ঘরে ঢোকা মাত্র ঝুমুর আর ফাহমান দেখলো মোতালেব সাহেব সোফায় বসে আছেন। মিস মারিয়াম রান্নাঘরে গেছেন চা নাস্তার ব্যবস্থা করতে। এই প্রথম বেয়াই বাড়িতে এসেছেন। খালি মুখে তো আর যেতে দেওয়া যায় না। ঝুমুর ওর বাবাকে দেখা মাত্র সঙ্গে সঙ্গে বাবার পাশে গিয়ে বসলো। হাস্যোজ্জ্বল গলায় জিজ্ঞেস করলো ‘ কখন এলে বাবা ? ‘

শশুরকে দেখে ফাহমান সালাম দিয়ে মুখোমুখি সোফাতেই বসলো। ঝুমুর তার বাবার সঙ্গে কিছু কুশলাদি বিনিময় করে রান্নাঘরে তার শাশুড়ি মা মিস মারিয়ামের কাছে চলে গেলো। খানিক সাহায্য করলে সুবিধা হবে। মোতালেব সাহেব ফাহমানকে জিজ্ঞেস করলেন ‘ ঝুমুরের শরীরের কি অবস্থা এখন ? কোনো ইমপ্রুভমেন্ট ? ‘

‘ আসলে বাবা সবে ওষুধ খেয়েছে তো তাই বোঝা যাচ্ছে না। ওষুধ কাজ করছে কিনা বোঝার জন্য কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কাল সকাল হলেই বোঝা যাবে কি অবস্থা। ‘ ফাহমান না বোধক মাথা নেড়ে বললো।

মোতালেব সাহেব ফাহমানের কথায় হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে বললেন ‘ কথা ঠিক। ওষুধ হলেও কাজ করতে সময় তো লাগবে। ‘
‘ বাবা একটা কথা বলার ছিল। আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে বলতে পারি। ‘ ফাহমান একটু ভয়ে ভয়ে বললো।

‘ নির্দ্বিধায় নিঃসংকোচে বলো। এত হেসিটেট ফিল করার কিছু নেই। ‘

‘ আপনি কি আমাদের বিয়েতে রাজি ছিলেন ? না মানে আমি দেখেছি আমাদের বিয়ের কোনো কথাবার্তায় আপনার কোনো ভূমিকা ছিল না। একবারে বিয়ের দিন আপনি হাজির হয়েছিলেন। তাছাড়া ঝুমুরের বিয়েতে আপনাকে হাসিখুশি মনে হয়নি। ‘

ফাহমানের কথায় মোতালেব সাহেব এতক্ষনে খানিকটা হাসলেন। বললেন ‘ সত্যি বলবো না মিথ্যা ? ‘
মোতালেব সাহেবের কথায় ফাহমান বোকার মতো হাসলো। মাথা চুলকে বলল ‘ সত্যিটাই বলুন। ‘

‘ সত্যি বলতে তোমাদের বিয়েতে আমার আপত্তি ছিল। সব বাবাই চায় তার মেয়ে একটা ওয়েল ইস্টাবলিশড, নামী দামী ফ্যামিলিতে বিয়ে করুক। সেই ক্ষেত্রে তোমাদের পূর্বে বিষয় সম্পত্তি থাকলেও এখন আর নেই। এই জন্যই আমার আপত্তি ছিল। কিন্তু আমি নিজের খুশির কথা ভাবিনি, নিজের মেয়ের খুশি চেয়েছি। ঝুমুরকে হয়তো আমি অর্থ বিত্ত,সহায় সম্পত্তি সব দিয়েছি কিন্তু ভালোবাসা দিতে পারিনি। ও অল্প বয়সে মা হারিয়েছে। তারপর এক প্রকার বাধ্য হয়েই নিজের মামীর অত্যাচার সহ্য করে নানার বাড়িতেও পড়েছিল।

তুমি মনে করেছ তোমাদের সম্পর্কের কথা আমি জানিনা। কিন্তু তোমার ধারণা ভুল। তোমাদের সম্পর্কের ব্যাপারটা সবার আগে আমিই টের পেয়েছি। প্রথম দিনই তোমাদের একসঙ্গে রাস্তায় দেখেছিলাম। কিন্তু কিছু বলিনি কেন জানো ? আমি জানি আমার মেয়ে কখনও আমার সম্মান নষ্ট হবে এমন কিছু করবে না। যেই মানুষটা তার যোগ্য না তাকেও বেছে নিবে না। এই কারণেই আমি কখনো তোমাদের সম্পর্কে প্রশ্ন তুলিনি। আমার মেয়ে তোমার সঙ্গে সুখে আছে তাই আমি সব মেনে নিয়েছি।

সবকিছুর পরও তোমার কিছু না থাকার জন্য আমার বিয়েতে আপত্তি ছিল। কিন্তু তানিয়া আমাকে বুঝেছে এবং বুঝিয়েছে যে সংসার করতে হলে আগে ভালোবাসা থাকাটা জরুরি। ভালোবাসা থাকলে অর্থ বিত্ত তৈরি হতে সময় লাগবে না। ভালোবাসা থাকলে বিপদে আপদে একে অপরের পাশে থেকে, অপরজনকে সাহস যুগিয়ে ঠিকই অর্থ বিত্তের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। এর জন্যই আগে আমার আপত্তি থাকলেও এখন নেই। ‘

ফাহমান যেন এতক্ষণে হাসলো। কোনো বাবা নিজের মেয়ের জন্য নিজের মতামতকে এত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে পারে তার জানা ছিল না। অথচ সে কোনোদিনই ঝুমুর ও মোতালেব সাহেবকে এক সঙ্গে বসে দু দন্ড কথাও বলতে দেখেনি। আসলে ভালোবাসতে হলে সবসময় তা জাহির করার প্রয়োজন পড়ে না। কিছু কিছু সময় ভালোবাসা বুঝে নিতে হয়।

ঝুমুর ও মিস মারিয়াম সঙ্গে করে চা, নুডুলস নিয়ে এসেছেন। কথাবার্তার মাঝেই মোতালেব সাহেব চা খেয়ে একটু আধটু নুডুলস খেলেন এবং বাকিটা রেখে দিলেন। উনি জানেন উনার রাখা এই নুডুলস ঝুমুর খাবে। ঝুমুর কোনওদিন আর পাঁচটা মেয়ের মতো বলেনি ‘ আমি তোমাকে ভালোবাসি বাবা ‘। অথচ সে মুখে না বলেও সর্বদা নিজের ভালোবাসা লুকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেও নিজের ভালোবাসা লুকাতে ব্যর্থ হয়।

খাওয়া দাওয়া শেষে মোতালেব সাহেব উঠে দাড়ালেন। সবাইকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন কিন্তু কি মনে করে ফিরে এলেন। ঝুমুরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন ‘ তুই আজ পর্যন্ত কোনোকিছু চাস নি আমার কাছে। আমি নিজেও কখনও যেচে কোনোকিছু দেইনি। কিন্তু এক কথা মনে রাখিস মা এই বাবা তোকে বিয়ে দিয়ে পর করে দেইনি। তোর বিয়ে হয়েছে বলেই যে তুই আর আমার কাছে কিছু চাইতে পারবি না সেটা না।

আমি আজও এবং ভবিষ্যতেও সবসময় তোর সব ইচ্ছা পূরন করার চেষ্টা করবো। শুধু আমাকে বলবি তোর কি লাগবে। আমি সাথে সাথে এনে তোর সামনে হাজির করবো। তোকে বিয়ে দিয়ে শশুর বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি কিন্তু তুই এখনও আমার মেয়ে। হয়তো রোজ দেখা হবে না কিন্তু আমি চাই তোর মনে হোক তোর বাবা যতদিন বেঁচে ছিল কোনওদিন তোর কোনো ইচ্ছা অপূর্ণ রাখেনি। ‘

ঝুমুর উত্তর দিলো না মোতালেব সাহেবের কথার। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। মোতালেব সাহেব মেয়ের ললাটে চুমু খেয়ে অশ্রু লুকাতে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। ঝুমুরের চোখেও তখন অশ্রুর বাস। ঝুমুর ছলছল চোখে হাসি মাখা বদনে তার বাবার রেখে যাওয়া নুডুলসের বাটি থেকে নুডুলস নিয়ে খেতে শুরু করলো। মেয়েটার এমন হাল দেখে খারাপ লাগলো মিস মারিয়ামের। উনি এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন ঝুমুরকে।

‘ আর কাদিস না। বিয়ে হয়েছে তো কি হয়েছে ? তোর ইচ্ছা করলেই তুই ভাইজানকে দেখতে পারবি। কেউ আটকাবে না তোকে। ‘ ঝুমুরকে জড়িয়ে ধরে মিস মারিয়াম কথাটা বললেন।

ঝুমুরকে কাদতে দেখে ফাহমান আর বসার ঘরে দাড়ালো না। ও গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলো। ভালোবাসলে এত কেন কষ্ট ? ঝুমুরকে যেন রোজ দেখতে পায় তার জন্য বিয়ে করে নিয়ে এলো অথচ ঝুমুর এখন আর ওর বাবাকে দেখতে পারবে না বলে কান্নাকাটি করাতে সেটা দেখেও ওর কষ্ট হচ্ছে। এখন যদি আবেগের বশে এটা বলেও বসে যে সমস্যা নেই তুমি আংকেলের কাছে থাকো তাহলে ঝুমুরকে ছাড়া থাকতেও তার কষ্ট হবে।

—-

খাওয়া দাওয়া শেষে ঝুমুর ঘরে ঢুকলো। মিস মারিয়াম এবং হৈমন্তী যে যার যার মতো শুয়ে পড়েছে। ঝুমুর ঘরে ঢুকে বাথরুম থেকে জামা কাপড় বদলে এলো। হাফ হাতা জামা কাপড়ে এলার্জি আরও বেশি লাগে। তাই সে এখন ট্রাউজার আর টি শার্ট পড়েছে। বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে ঝুমুর আয়নার সামনে বসে চুলে জট ছাড়াতে শুরু করলো। ফাহমান তখন বারান্দায় দাড়িয়ে কোনো এক কলিগের সঙ্গে কথা বলছে একটা জটিল কেস নিয়ে।

ফাহমান কথা শেষে ঘরে ঢুকে দেখল ঝুমুর ড্রেসিং টেবিলে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে। ফাহমান এগিয়ে গিয়ে বেড সাইড টেবিলের উপর থেকে ওষুধের পাতাটা হাতে নিল। ওষুধ হাতে নিয়ে ঝুমুরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো এক গ্লাস পানি হাতে। ঝুমুর ততক্ষণে বেণী করা চুলে ব্যান্ড বাঁধছে। ফাহমানকে পানির গ্লাস হাতে দাড়িয়ে থাকতে দেখে হাসলো। হাত বাড়িয়ে ওষুধটা মুখে নিয়ে পানি খেলো।

‘ আচ্ছা আমার এলার্জি হওয়ার পর থেকে যে আপনি এত গায়ে ঘেঁষে ঘেঁষে থাকেন আমার সঙ্গে তাতে আপনার এলার্জি হবে না ? ‘

ফাহমানের হাতের উপর মাথা রেখে শুয়েছিল ঝুমুর। ফাহমান তার দিকেই ফিরে আছে। ঝুমুরের প্রশ্ন শুনে সে বললো ‘ উহু, এলার্জি ছোঁয়াচে না। তোমার সঙ্গে কমিউনিকেট করলেও আমার এলার্জি হবে না। ‘
‘ ওহ আচ্ছা। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করি ? ‘

‘ বলুন মহারাণী। আমার কান সারাদিন আপনার কথা শোনার জন্যই অপেক্ষা করে। ‘

‘ বলছিলাম যে আপনার কোনো মেয়ে কলিগ আছে নাকি ? ধরেন ওইসব কলিগ যারা সুদর্শন কলিগ চোখে পড়লেই পাগল হয়ে যায়। ‘ ঝুমুর ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো।

ঝুমুরের কুঞ্চিত ভ্রু দেখে নিঃশব্দে হাসলো ফাহমান। সে টের পাচ্ছে ঝুমুর কৌশলে জানতে চাইছে ফাহমানের কোনো কলিগ তাকে পছন্দ করে কিনা। ফাহমান ভাবলো একটু জেলাস ফিল করানো উচিৎ ঝুমুরকে। তাই সে বললো ‘ হ্যাঁ আছে তো। শালীন নামের একটা মেয়ে আছে। আমার সাথেই সেম ডিপার্টমেন্টে আর আমরা একসাথে ইন্টার্নশিপও করছি। ‘

ফাহমান ভেবেছিল ঝুমুর তার কথা শুনে রেগে যাবে, চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলবে কিন্তু সে ভুলে গিয়েছিল চেঁচামেচি করা ঝুমুরের ধাঁচে নেই। ঝুমুর একদমই অন্য ধরনের মেয়ে। তাই ঝুমুরের রাগ তো হলো কিন্তু প্রতি উত্তর করলো না। জায়গা থেকে নড়লো না পর্যন্ত। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলো যাতে তার রাগ কমে যায়।

ঝুমুরের কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে চমকে গেলো ফাহমান। ঝুমুর ঠান্ডা মাথার মানুষ সেও জানে কিন্তু এতটা ঠান্ডা তার স্বভাব জানা ছিল না। তবে ফাহমান ঝুমুরের রাগ ভাঙ্গানোর প্রয়োজন মনে করলো না। ঠিক করলো কাল ঝুমুরকে চমকে দিবে। তারপর আর ঝুমুর তার সঙ্গে রাগ করে থাকতেই পারবে না।

চলবে…
মিফতা তিমু

শ্যামাঙ্গণা-২৫
————-

[অন্তিম পাতা]

অভিমানে ঝুমুরের সারা রাত্তিরে আর ঘুম হলো না। সেই রাতটা ও না ঘুমিয়েই পার করলো। পরের দিন সকালে ওর রাগে,দুঃখে আরও কান্না পেলো যখন ফাহমান তাকে একবারের জন্যও ডেকে তুললো না। উল্টো নিজের মতো খেয়ে দেয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো। দুঃখের বহর সহ্য করতে না পেরে ঝুমুর বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত পড়ে পড়ে ঘুমোলো।

এর মাঝে মিস মারিয়াম আর হৈমন্তী যতবার ডেকে গেছে ততবারই শরীর ভালো লাগছে না এই অজুহাতে সে বিছানায় পড়েছিল। তবে তার এই অজুহাত বেশী কাজ করেনি কারণ মিস মারিয়াম জোর করে হলেও ওকে নিজ হাতে খাওয়ালেন, ওষুধ দিলেন, যেসব জায়গায় এলার্জি আছে তাতে ক্রিম দিয়ে দিলেন এবং সবশেষে বেকিং সোডা মেশানো পানি দিয়ে গোসল করতে পাঠালেন। ঝুমুর স্রেফ শাশুড়ির মান রাখতে মাঝে উঠে সব কাজ মিটিয়ে আবার শুয়ে ঘুম দিলো।

ঝুমুরের যখন ঘুম ভাঙলো তখন সন্ধ্যা। ফাহমান এখনও ফিরেনি। এত ঘন্টা ঘুমনোর ফলে শরীর ম্যাজম্যাজ করছিলো তাই ঝুমুর আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো। দেখলো সন্ধ্যা ছয়টা। ও দ্রুত উঠে বাথরুমে গেলো। চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়ে বেরিয়ে এলো। চুল পরিপাটি করে রুম থেকে বের হলো। শাশুড়ি মায়ের খোঁজে বসার ঘরে ঢুকতেই দেখলো আঞ্জুম আরা সোফায় বসে আছেন। উনার সামনে সাজানো চা, চানাচুর এবং বিস্কিট।

আঞ্জুম আরা এবং মিস মারিয়ামের মুখভঙ্গি দেখে ঝুমুর টের পেলো বেশ খানিকক্ষণ আগেই এসেছেন আঞ্জুম আরা। ভদ্রতা রক্ষার্থে ঝুমুর সালাম দিয়ে বললো ‘ কেমন আছেন মামী ? ‘
ঝুমুরের কথায় কাষ্ঠ হাসলেন আঞ্জুম আরা। চোখের ইশারায় কাছে ডাকলেন ঝুমুরকে। ঝুমুর আঞ্জুম আরার দিকে নির্দ্বিধায় এগিয়ে গেলো এবং সন্তপর্নে তার পাশে বসলো।

মিস মারিয়াম আঞ্জুম আরার এই বাসায় আসার কারণ জানেন তাই আঞ্জুম আরা এবং ঝুমুরকে খানিকটা সময়ের জন্য একলা ছেড়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। ঝুমুর মিস মারিয়ামের প্রস্থানে খানিকটা অবাক হলো। তবে বেশি কিছু ভাবার সুযোগ পেলো না কারণ ইতিমধ্যে আঞ্জুম আরা মলিন হেসে বললেন ‘ তোর শরীরটা এখন কেমন রে ঝুম ? ‘

ঝুমুর আঞ্জুম আরার সম্বোধনে অবাক হলো। আঞ্জুম আরা কখনও ওকে ঝুমুর ব্যতীত অন্য কোনো নামে ডাকেননি অথচ আজ ঝুম ডেকেছেন। তবে ও ওর হতবুদ্ধি ভাব কাটিয়ে উঠে বললো ‘ আলহামদুলিল্লাহ ভালো মামী। আপনি কেমন আছেন ? ‘
ঝুমুরের কথায় তাচ্ছিল্যের হাসি দিলেন আঞ্জুম আরা। মলিন কণ্ঠে বললেন ‘ তোর সঙ্গে এত বছর করা অন্যায়ের শাস্তি আমাকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। নিজের ছেলের চোখে সবচেয়ে নিচে নেমে গেছি আমি। তাফিম এখন আর আমার মুখও দেখতে চায় না। তোর মামা তোর বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা জেনে গেছে। আম্মা ঘটনা সবকিছু বলেছেন উনাকে।

ভেবেছিলাম প্রত্যেকবারের মতো এবারও উনাকে মানিয়ে নিবো কিন্তু তোর বাড়ি ছেড়ে চলে আসাতে দোষ যে আমারই সেটা টের পেয়ে গেছেন উনি। উনি জানেন তুই এমনই এমনই ঘর ছেড়ে আসিস নী। সামনের সপ্তাহে বৃহস্পতিবার রাতে অফিস থেকে ফিরে শুক্রবার সকালে আমাকে চাঁদপুর দিয়ে আসবেন। আমার মতো মহিলার সঙ্গে উনার সংসার করার ইচ্ছে মরে গেছে। তাফিম, সামি ওরাও তাদের বাবার এই সিদ্ধান্তের বিরোধ করেনি। ‘

আঞ্জুম আরার কথা শুনে ঝুমুরের তেমন বিশেষ কোনো অনুভূতি হলো না কারণ এত বছরে এমন অনেক অত্যাচার সে সহ্য করেছে যার জন্য আজ সে অনুভূতি শূন্য। তবে আঞ্জুম আরার পরিণতি শুনে খারাপ লাগলো। সে ভাবেনি ঘটনা এত দূর গড়াবে। তবে যার যা নিয়তি তাই তো হবে। ও চাইলেও যে নিয়তির লেখন আটকাতে পারবে না। ওর সেই ক্ষমতা থাকলে ও নিঃসন্দেহে আঞ্জুম আরার নিয়তি বদলে দিত। কারণ দিনশেষে আঞ্জুম আরাই এত বছর ওকে আগলে রেখেছেন।

খানিকটা থেমে আঞ্জুম আরা আবারও বললেন ‘ আমি জানি আমি যা করেছি তার কোনো ক্ষমা হয়না তবে যদি পারিস তাহলে তোর এই মামীকে ক্ষমা করে দিস। তোর মামা আর ভাইদের চোখে আমি আর কখনো উপরে উঠতে পারবো না। কিন্তু আমার একটাই ইচ্ছা আমাকে তুই অন্তত ঘৃনা করিস না। তোর ঘৃণার আগুন আমাকে শান্তিতে মরতে দিবে না। ‘

আঞ্জুম আরার কথায় ঝুমুর এবার মুখ তুলে তাকালো। দেখলো যেই আলতা বরণ নারী এক সময় রূপ, সৌন্দর্য্যে অহংকারী ছিলেন আজ তার সেই চকচকে উজ্জ্বল সৌন্দর্য যেন হারিয়ে গেছে। চোখ দুটো যেন এক দিনের মধ্যেই কোটরে ঢুকে গেছে। অনিদ্রায় চোখের নিচে কালি পড়েছে। সময়ের স্বল্পতায় শরীরে এখনও কোনো প্রভাব দেখা দেয়নি তবে এক দিনেই যেন মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে।

ঝুমুর জানতো অন্যের সঙ্গে অন্যায় করার শাস্তি দুনিয়ার জীবনেই পেতে হয়। কিন্তু সেটা যে এত শীঘ্রই হবে সেটা জানা ছিল না তার। অতীতের কথা ভেবে তিক্ত শ্বাস ফেললো ঝুমুর। পুরনো কথা সে মনে করতে চায়। মনের উপর পাষাণ ভার কমাতেই সে আঞ্জুম আরাকে ক্ষমা করে দিতে চায় তাই আঞ্জুম আরার করজোড়ে উঠে আসা হাত আগলে ধরলো।

‘ আমি আপনার উপর কখনোই অসন্তোষ ছিলাম না আর কোনোদিন আপনাকে ঘৃনা করেছি। আমার কাছে মায়ের আরেক রূপ আপনি। আমার পক্ষে আপনাকে ঘৃনা করা কিংবা আপনার উপর রাগ হওয়া সম্ভব না। তাই ক্ষমা করার প্রশ্ন উঠে না। ‘

আঞ্জুম আরা মলিন হেসে ঝুমুরের কাছে আরেক দফা ক্ষমা চেয়ে বিদায় নিলেন। আঞ্জুম আরা যেতেই ঝুমুর মিস মারিয়ামের সঙ্গে মিলে কিছু কাজ করলো। অবশ্য মিস মারিয়াম বলেছিলেন সাহায্যের দরকার নেই কিন্তু ঝুমুর জোর করে কাজ করলো। কাজ শেষে সন্ধ্যা সাতটার দিকে ঝুমুর ঘরে এলো। ঘরে এসেই সঙ্গে সঙ্গে সে বারান্দায় চলে গেলো। অন্ধকার এই সন্ধ্যায় বারান্দার খোলা হাওয়ায় দাড়াতে তার ভালই লাগছে।

কিছুক্ষণ বারান্দায় দাড়িয়ে থাকার পর ঝুমুরের কানে বাথরুমের কলের শব্দ এলো। ঝুমুর জানে ফাহমান এসেছে আর সে এখন গোসলে ঢুকেছে। ফাহমানের এই নিঃশব্দ চলাচল ও ঝুমুরকে কাল রাত থেকে বারবার এড়িয়ে চলার ব্যাপারটা ঝুমুরের মনে জমে থাকা অভিমানের পারদ আরও গাঢ় করলো। ঝুমুর অভিমানে এগিয়ে গিয়ে ফাহমানের খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজনও মনে করলো না।

ঝুমুর তখন বারান্দায় দাড়িয়ে দখিনা হাওয়া উপভোগ করতে ব্যস্ত। চকিতে ওর নাকে এক ফুলেল সুবাস এসে ঠেকলো। ও সঙ্গে সঙ্গে ভ্রু কুচকে ফেললো। মুখ নামিয়ে দেখলো কেউ একজন তার সামনে কয়েক গুচ্ছ সাদা গোলাপের তোড়া ধরে আছে। ঝুমুরের সাদা গোলাপ খুব পছন্দ। বিশেষত সব শুভ্র রঙ্গা ফুলই তার পছন্দের তালিকায় আছে।

‘ বাগানের রাজকুমারীর অভিমান ভাঙাতে শুভ্র গোলাপের শুভেচ্ছা ‘

ফাহমানের কথা শুনলো ঝুমুর তবে কথায় আছে মান যায় তো যায় কিন্তু নারীর দেমাগ না যায়। ঝুমুর তার ইগো বজায় রাখতে কাঠ কাঠ গলায় বলল ‘ অঙ্গণা ঝুমুরের মন এত দূর্বল না যে সামান্য কথায় অভিমান করবে। তার থেকে ফুলগুলো ওই শালীনকে দিয়ে দিলে খুশি হবে বেচারি। নিজের ক্রাশের কাছ থেকে ফুল পেতে কে না চায়। ‘

ফাহমান ঝুমুরের মেজাজের বহর টের পেলো। ম্যাডাম যে অসম্ভব রেগে আছে এবং হিংসায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে সে ভালই টের পাচ্ছে সেটা। তাই ঝুমুরকে আরেকটু জ্বালাতে ও বললো ‘ ঠিকাছে তাহলে আমি কাল নতুন ফুল কিনে শালীনকে দিবো। এই ফুল নিয়ে কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করলে সব শুকিয়ে যাবে। ‘

ফাহমানের এই কথাগুলো যেন ঝুমুরের রাগের আগুনে ঘৃতাহুতি দিলো। ঝুমুর জ্বলন্ত উনুনের মতো জ্বলে উঠে দাতে দাত চেপে বললো ‘ তাই ? কেন আপনার শালীন কি তার ক্রাশের হাত থেকে শুকিয়ে যাওয়া ফুল নিবে না ? আমি হলে তো আমার ক্রাশ যা দিত তাই নিয়ে নিতাম। ‘

ফাহমান এবারও ঝুমুরকে আরও রাগিয়ে দিতে বলল ‘ হয়তো আমার কাছ থেকে ও শুকনো ফুলই নিয়ে নিত কিন্তু ও স্পেশাল একটা মানুষ। শুকনো ফুল ধরিয়ে দিলে কেমন লাগে। আজ পর্যন্ত কতবার আমাকে তাজা ফুল দিয়ে প্রপোজ করলো অথচ আমি কিনা ওকে শুকিয়ে, মরে যাওয়া ফুল দিবো। ইমপসিবল… ‘

ফাহমান ভেবেছিল ঝুমুর ওর কথায় রেগে গিয়ে চেঁচামেচি করবে কিন্তু এর ধারণা এবারও ভুল কারণ ও রেগে তো গেলই না উল্টো পিছন ফিরে ফাহমানকে জড়িয়ে ধরে কাদতে কাদতে বললো ‘ আপনি এভাবে কথা বলবেন না প্লিজ। আপনার কি আমাকে আর ভালো লাগছে না ? বিয়ের দুই দিন হতে না হতেই কি আমি আপনার কাছে পুরনো হয়ে গেছি ? প্লিজ ওই মেয়ের কাছে যাবেন না। আপনি কি আমাকে আর ভালোবাসেন না ? আমাকে ভালো লাগছে না আপনার ? ‘

ঝুমুরের আকস্মিক কান্নাকাটিতে থম মেরে গেলো ফাহমান। ও কথা বলার ভাষা হারিয়েছে। ঝুমুরকে রাগিয়ে দিবে ভেবেছিল কিন্তু এখন তো উল্টো ঝুমুরই কাদঁছে। ঝুমুরকে এভাবে কান্নাকাটি করতে দেখে ফাহমান প্রথমে চমকে গেলেও এবার ওর পেট ফেটে হাসি আসছে। ও হো হো করে হেসে দিল। হাসতে হাসতে ওর দম বেরিয়ে যাওয়ার যোগাড় আর ওকে এভাবে হাসতে দেখে ঝুমুর চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আছে।

‘ আপনি এভাবে হাসছেন কেন ? ‘

‘ সিরিয়াসলি অঙ্গণা, তুমি আমার কথায় এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে। আমি বললাম আর তুমি বিশ্বাস করলে ? আরে বাবা আমার মতো সাধারণ দেখতে ছেলেকে কে পছন্দ করবে ? আর আমি যার কথা বলছি উনি তো আমার সিনিয়র। অলরেডি দুটো ছেলে আছে। আরে বাবা তুমি এত বোকা কেন ?’ ফাহমান হাসতে হাসতে বললো।

‘ তারমানে আপনি আমাকে রাগিয়ে দিতে এসব বলছিলেন ? ‘ ঝুমুর সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বললো।

ফাহমান জোর করে হাসি আটকে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোধক উত্তর দিলো। ফাহমানের ইশারা দেখে ঝুমুর যেন সস্তির নিশ্বাস ফেললো। ও ফাহমানকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা ঠেকিয়ে বললো ‘ আজ করেছেন করেছেন কিন্তু আর কখনো এমন করবেন না। আমি আপনাকে কারোর সাথে ভাগ করতে পারবো না। খবরদার যদি কোনো মেয়ের কথা মুখে তুলেছেন তো দেখবেন কি করি। ‘

ঝুমুরের হুমকি শুনে ফাহমান ভয় পাওয়ার ভান ধরে বললো ‘ ওমা ভয় পেয়ে গেলাম তো। আচ্ছা ঠিকাছে কোনো মেয়ের দিকে তাকাবো না। আই প্রমিজ। ‘ কথাগুলো বলে ফাহমান ঝুমুরকে জড়িয়ে ধরলো। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেলো ওভাবেই নীরবতায় একে অপরকে জড়িয়ে। হঠাৎ ফাহমানের কিছু একটা মনে পড়লো। ফাহমান ঝুমুরকে নিজের কাছ থেকে ছাড়িয়ে সরে গেলো। ঝুমুর দাড়িয়ে দাড়িয়ে ওর কার্যকলাপ দেখছে।

ফাহমান ঘরে ফিরে গিয়ে ওর স্টাডি টেবিলের সামনে থাকা চেয়ারটা নিয়ে এসেছে। বারান্দায় যে টিমটিমে হলুদ আলোর বাল্ব ছিল ফাহমান সেটাও জ্বালিয়ে দিয়েছে। ঝুমুরকে টেনে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে নিজে হাঁটু মুড়ে বসলো ঝুমুরের সামনে। ঝুমুর এতক্ষণ নীরবে সবকিছু দেখছিল কিন্তু ফাহমানকে মেঝেতে ওর সামনে বসতে দেখে অধৈর্য্য হয়ে বললো ‘ কি ব্যাপার ? আপনি নিচে বসছেন কেন ? ‘

‘ ধৈর্য্য ধরো অঙ্গণা। একটু অপেক্ষা করলেই দেখতে পাবে। ‘ ঝুমুরের নরম ঠোঁটে নিজের রুক্ষ ঠোঁট জোড়া হালকা ছুঁয়ে দিয়ে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল ফাহমান।

ঝুমুর ভ্রু কুচকে ফাহমানকে দেখছে। ফাহমান ওর ট্রাউজারের পকেট থেকে একটা চারকোনা ছাই রঙ্গা বক্স বের করেছে। বক্সের উপর ছোট আর্টিফিসিয়াল শিউলি ফুল ডিজাইন করা। দেখে মনে হচ্ছে কোনো গয়নার বাক্স। ফাহমান এবার বক্সটা খুললো এবং বক্সের ভিতর থেকে ছোট আংটির মতো কিছু একটা নামিয়ে আনলো। তারপর আংটিটা নিজের উরুর উপর ঝুমুরের রাখা বাম পায়ের দ্বিতীয় আঙ্গুলে পড়িয়ে দিল।

ঝুমুর হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর পায়ের আংটির দিকে। ওটা যে টো রিং বুঝাই যাচ্ছে। রিংটা রুপার কারুকার্য খচিত সাধারণ এক পায়ের আঙ্গুলের আংটি অথচ আংটির মধ্যে কত মায়া জড়ানো। ঝুমুর জানে ফাহমানের পক্ষে সোনার কোনো কিছু দেওয়া সম্ভব নয় তাই ও রুপার আংটিই বানিয়ে এনেছে। ঠিক কতটা ভালোবাসলে প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য সোনার গয়না আনতে না পেরে তার বিকল্প হিসেবে রুপা এনেছে।

‘ ওহ মাই গড। এটা আপনি কখন কিনলেন ? জিনিসটা এত সুন্দর কেন ? আমি না আজ থেকে রোজ এটা পড়ব। ‘

ঝুমুরের অবাক কণ্ঠে বলা কথা শুনে হাসলো ফাহমান। ও জানে ঝুমুর ওকে এতটা ভালোবাসে যতটা ভালোবাসলে সোনার বদলে রুপা পেয়েও অত খুশি হওয়া যায়। ফাহমান জানে ঝুমুরের নিজেরই অনেক সোনার গয়না আছে যার কাছে ওর রূপার তৈরি কিনে আনা পায়ের আংটি কিছুই না। তবুও ও ভালোবেসেই কিনে এনেছে আংটিটা যাতে এর উসিলায় হলেও ঝুমুরের মুখে হাসি দেখতে পারে।

ঝুমুরের জন্য এই আংটি বানাতে ফাহমানকে তার জমানো টাকা থেকে চার হাজার টাকা ভাঙাতে হয়েছে। ফাহমান খুব অল্প বয়স থেকেই টাকা জমাতো কারণ পড়াশোনায় তুখোড় হওয়ায় ক্লাস সিক্স থেকেই সে বৃত্তির টাকা দিয়ে পড়াশোনা করে এবং বাকি কিছু রয়ে গেলে সেগুলো জমিয়ে রাখত। আর আজ সেগুলোই কাজে লেগেছে ঝুমুরের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য।

‘ কয়েকদিন আগেই বানাতে দিয়েছিলাম। আজ হসপিটাল থেকে ফেরার সময় নিয়ে এলাম। বিয়ে করেছি এখন বউকে কিছু তো দেওয়া মাস্ট। রোজ যাতে পড়তে পারো তাই এটা এনেছি। ‘

ঝুমুরের আনন্দ আর দেখে কে। ও খুশিতে কিছুক্ষণ আংটি খুটাখুটি করলো তারপর ক্ষণে ক্ষণে ফাহমানকে ধন্যবাদ দিলো এবং সব শেষে ফাহমানকে জড়িয়ে ধরে তার কোলে বসে রইলো। ফাহমানের বোতাম খোলা লোমশ বুকে আঁকিবুকি করতে করতে বলল ‘ আপনি একবার বলেছিলেন না আমার বাগানে এত ফুল আছে অথচ লাল গোলাপ নেই কেন ? ‘

ঝুমুরের কথা শুনে ফাহমান মাথা নেড়ে সায় দিল যে হ্যাঁ সে বলেছিল। ঝুমুর উত্তরে হাসলো এবং বললো ‘ আমার এই সতেরো বছরের বসন্তে কেউ কখনো ডাকেনি শ্যামাঙ্গণা বলে। এই দশ বছরের জীবনে অমনির পর কেউ অঙ্গণা বলে সম্বোধন করেনি। অথচ জীবনের সতেরোটা বছর পেরিয়ে এখন বিশেষ একজন আমাকে শ্যামাঙ্গণাও ডাকেন সঙ্গে অঙ্গণাও। সর্বোপরি আমার এত বছরের জীবনের প্রেমের লাল রং ছিল না তাই কখনও বাগানে লাল গোলাপ লাগানো হয়নি।

কিন্তু এখন আমার জীবনেও প্রেম আছে, আছে আমার ভালোবাসা তাই সুযোগ বুঝে দুম করে একদিন চমকে দিয়ে বাগানে লাল গোলাপ গাছ লাগাবো। তারপর ফুটে উঠা সেই লাল গোলাপ কানে গুঁজে টকটকে লাল শাড়ি পড়ে প্রেমিক পুরুষের সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজে শিউলি কুড়ানো বিকেলে ঠান্ডা লাগিয়ে কাপতে কাপতে বাড়ি ফিরব। বলুন রাজি ?’

ফাহমান ঝুমুরের কথা শুনে হাসলো। ঝুমুরের এগিয়ে দেওয়া হাতে হাত রেখে পূর্ণিমার গোল থালির মতো চাঁদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো ‘ রাজি শ্যামাঙ্গণা। আপনাকে নিয়ে দূর দূরান্তে হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন আমার বহু পুরনো। এই সুযোগ আমি হাতছাড়া করবো না। ‘

ঝুমুর যেন ফাহমানের হাসির অপেক্ষাতেই ছিল। ফাহমানের সেই সাধারন হাসির প্রেমে সে আবারও অসাধারণভাবে হারিয়ে যেতে যেতে ফাহমানের বুকে মাথা রেখে আদুরে গলায় বলল ‘ ভালোবাসি ডাক্তার সাহেব। ‘
উত্তরে ফাহমান ঝুমুরকে আগলে ধরে বললো ‘ ভালোবাসি অঙ্গণা ‘

সমাপ্ত….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here