শ্যামাঙ্গণা-৩,০৪

0
293

শ্যামাঙ্গণা-৩,০৪

০৩
———–

বসার ঘরে বিচার সভা বসেছে। অপরাধী সকলের মধ্যমনি হয়ে বসে আছেন। অপরাধীর অপরাধ হলো তিনি কিছুদিন পরপরই পুরনো এন্টিক জিনিস তুলে আনেন আর তার দেখভাল সব ঝুমুরকে করতে হয়। ঝুমুর ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে মোতালেব সাহেবের দিকে। তিনি একবার অসহায় চোখে তার মা মালিনী বেগমকে দেখছেন তো একবার ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়ে ঝুমুরকে দেখছেন। দুই জনের এই কঠোর চাহনির কাছে মিইয়ে যাচ্ছেন তিনি।

‘ অমনি(মা), তুমিও ঝুমুরের মতো আমার সঙ্গে এমন করছো ? তুমি না আমার মা ? ‘ মোতালেব সাহেব কিছুটা দুঃখী গলায় বললেন।

মোতালেব সাহেব হলেন কোরিয়া ও বাংলাদেশী নাগরিক। মোতালেব সাহেবের বাবা মান্নান সাহেবের পূর্ব পুরুষ ছিলেন কোরিয়াবাসী। সেই সূত্রে কোরিয়ার বংশগত বৈশিষ্ট্য তার মাঝেও আছে। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী মোতালেব সাহেবকে দেখলে আজও তিরিশ বছরের জোয়ান বুদ্ধিদীপ্ত পুরুষ মনে হয়। উনার মা মালিনী বেগমও বাবা মান্নান সাহেবের মতোই জন্মসূত্রে কোরিয়ান। অবশ্য উনার জন্ম কোরিয়াতে হলেও আদতে উনি সম্পূর্ণ বাঙালি। গায়ের রং তামাটে বর্ণের। জন্মসূত্রে কোরিয়ান হলেও বাংলা ভাষা অনেকটাই মালিনী বেগমের আয়ত্তে আছে।

মোতালেব সাহেবের স্ত্রী অর্থাৎ ঝুমুরের মা তাসনুবা ছিলেন বাঙালি। পড়ালেখার সূত্রে কোরিয়া গিয়ে সেখানে মোতালেব সাহেবের সঙ্গে তার দেখা। তারপরই পরিবারের সকলের মত নিয়ে ইসলামী রীতিতে বিয়ে করলেন মোতালেব সাহেবকে। মোতালেব সাহেবের বড় মেয়ে ঝুমুর আর ছোট মেয়ে নিঝুম। সেই সঙ্গে ছোট ছেলে আমিরও আছে।

ঝুমুরের গায়ের রং ঠিক তার দাদির মতোই তামাটে বর্ণের তবে নিঝুমের গায়ের রং টসটসে টমেটোর ন্যায় আলতা বর্ণের। চেহারায় কিছুটা কোরিয়ান ভাবও আছে। রুপে সে মা তাসনুবার গুণ পেলেও সাংসারিক গুণে সে বেগুন। ঘরের কোনো কাজই তার আয়ত্তে নেই। সেই দিক দিয়ে ঝুমুর মায়ের রূপ না পেলেও গুণ ঠিকই পেয়েছে। ঘর বাড়ির প্রত্যেকটা কাজ তার নক্ষ দর্পণে।

নিঝুম আর ঝুমুরের মা তাসনুবা গত হয়েছেন দশ বছর পূর্বে। তখন নিঝুমের তিন বছর আর ঝুমুরের সাত। আমির তখন সদ্য জন্মেছিল। মোতালেব সাহেব স্ত্রী এবং সন্তানদের মাকে হারিয়ে যখন অথৈ সাগরে পড়লেন তখন মনোয়ারা বেগম তাকে উপদেশ দিলেন সে যেন মা আর মেয়েদের নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে। তারপরই এক বছরের মধ্যে তারা সকলে বাংলাদেশে চলে এলো। সেই থেকে ঝুমুররা নানু বাড়িতেই আছে। মা হারা মেয়েদের আত্মীয় স্বজন যেমন বোঝা রুপে নেন তাদের সঙ্গে তেমনটা হয়নি কারণ মোতালেব সাহেবের আর্থিক অবস্থা ভালো।

বাঙালি মা আর স্ত্রীয়ের গুনে গুণান্বিত মোতালেব সাহেব বাংলায় অনেকটাই দক্ষ। কাজেই নিজের ধ্যান,জ্ঞান, পুঁজি সব কাজে লাগিয়ে কলেজ গেটে একটা বড় ড্রাগ হাউজ দেন যার ব্যবসা এখন রমরমা চলছে। সেইদিক থেকে উনি ছেলে মেয়েদের নিয়ে বেশ সাচ্ছন্দে আছেন। তবে উনার শাশুড়ি মা মনোয়ারা বেগম উনার বড় মেয়ে ঝুমুর আর ছোট ছেলে আমিরকে শখ করে নিজের কাছে রেখেছেন কারণ ঝুমুরকে দেখলে উনার তার মৃত মেয়ের কথা মনে পড়ে আর আমির একটু বেশিই ছোট।

ছেলের কথায় গম্ভীর মেজাজে দেখা গেলো মালিনী বেগমকে। উনি বিরক্তিকর কণ্ঠে বললেন ‘ তো আর কি করবো মোতালেব ? তুমি কি আর কোনো উপায় রেখেছ ? ঘরে আর জায়গা নেই কিছু রাখার অথচ তুমি জিনিস এনে এনে ঘর ভরে ফেলেছো। এসব তো আমার আর ঝুমুরকেই দেখতে হয়। তুমি তো বাসায় থাকো না। যতক্ষণ থাকো অতক্ষণ নাহয় যত্ন নাও কিন্তু দোতলা থেকে তিন তলায় রোজ এসে জিনিসগুলো পরিষ্কার করা কি ঝুমুরের জন্য কষ্টের না ? ‘

মায়ের কথায় মুখ নত করলেন মোতালেব সাহেব। এবার বেয়াইনের কথায় সায় দিয়ে শশুর আজমাঈন সাহেব বললেন ‘ তোমার মা কথাটা ভুল বলেনি মোতালেব। তোমার এসব দিকে খেয়াল রাখা উচিত। ঝুমুরের পড়াশুনা আছে। এখন ও ইন্টারে উঠেছে। এরকম চলতে থাকলে ওর অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। ‘

আজমাঈন সাহেবের কথায় ঝুমুর একটু যেন ঘাবড়ে গেলো। আজ সে রাগ করেছে বলেই তার বাবাকে সবার সামনে কথা শুনতে হচ্ছে। তার এই সতেরো বছরের জীবনে কখনো মোতালেব সাহেবকে তার জন্য কথা শুনতে হয়নি অথচ আজ শুনতে হচ্ছে। তার খারাপ লাগলো। মনে হলো মা তো গেলই এখন বাবাও তার জন্য কষ্ট পাচ্ছে।

ঘর ভর্তি লোকের সামনে নিজের বাবাকে অসম্মানিত করার জন্য লজ্জায় ঝুমুর তার তিরতির করে কেপে উঠা ঠোঁট দুটো চেপে কোনোভাবে বললো ‘ নানু আপনি রাগ করবেন না। আমি কিছু মনে করিনি। আপনি তো জানেন কাজ আমি মন থেকেই করি। আনুক না বাবা জিনিস। ওটা তো বাবার শখ বলেন। আমার কোনো ক্ষতি হবে না একটু কাজ করলে। ‘

নাতনির কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আজমাঈন সাহেব। নাতনির জন্য তার খারাপ লাগে। অল্প বয়সেই মা হারা হলো। এরপর যখন বাবাকে আকড়ে ধরতে চাইল তখন উনার প্রিয়তমা স্ত্রী দোতলায় নিয়ে এলেন। সেই দূরত্বে বাবার সঙ্গে আর সম্পর্কটা সহজ করতে পারেনি তবে নাতনী যে তার আপ্রাণ চেষ্টা করে বাবাকে আগলে রাখতে সেটা উনি ভালো করেই বুঝেন। উনি উঠে নিজের ঘরের দিকে গেলেন। স্বামীর প্রস্থান দেখে মনোয়ারা বেগমও আর থাকার প্রয়োজন মনে করলেন না।

—-

‘ হালমনি, তুমি বাবার সাথে রাগ করো না। মাকে ছাড়া তো ভালো লাগে না তার। তাই এমন করে। তুমি না বুঝলে কে বুঝবে বলো ? ‘

ঝুমুর মালিনী বেগমের চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছে। নাতনির কথা শুনে মালিনী বেগম বললেন ‘ তোর অমনিকে হারিয়ে তোর বাবা যেভাবে নিঃসঙ্গতায় দিন কাটাচ্ছে তেমনভাবেই আমারও দিন কেটেছে ঝুম। আমি জানি নিঃসঙ্গতা কতটা কষ্ট দেয়। কিন্তু মোতালেবকে বুঝতে হবে এসব করে ও তোর ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে পারে না। ‘

দাদুর কথা মন দিয়ে শুনলো ঝুমুর। বললো ‘ বাবার জন্য কিছু করতে পারলে তাতে আমার ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে না। মায়ের জন্য তো পারলাম না এখন নাহয় বাবার জন্যই করি। যদি কোনোদিন বাবাও চলে যায় তখন তো আফসোসটা থেকে যাবে। তাই ইচ্ছেটা পূরণ করছি। ‘

ঝুমুরের কথা চুপচাপ শুনলেন মালিনী বেগম। মোতালেব সাহেব উনার একমাত্র ছেলে। সেই হিসেবে উনার স্ত্রী তাসনুবা মালিনী বেগমের কাছে অতি প্রিয় ছিলেন। তাই যখন আদরের ছেলের বউকে হারালেন তখন মনে হলো উনি মাঝ নদীতে পড়ে গেছেন। ছেলেকে সামলাবেন না নাতি নাতনীদের। কিন্তু উনাকে বেশি কষ্ট করতে হয়নি। ছেলে মেয়েদের কথা চিন্তা করে উনার ছেলে নিজেকে সামলে নিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে ঝুমুর বেশ বুঝদার মেয়ে ছিল। তার মা যে আর নেই সেই সত্যি সে মেনে নিয়েছিল মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই।

পুরনো স্মৃতি মনে করে মালিনী বেগমের মনটা বিষিয়ে গেলো। উনি ঝুমুরকে দোতলায় যেতে বললেন। ঝুমুর এখানে আসার পর থেকে দোতলায়ই থাকে। কিন্তু রোজ নিয়ম করে সময় মতো এসে মালিনী বেগমকে কাজে সাহায্য থেকে শুরু করে ঘর গুছিয়ে রাখা পর্যন্ত সবই করে।

—-

মোবাইলের আলোতে মোতালেব সাহেবের মুখ জ্বলজ্বল করছে। স্ক্রিনে উনার, তাসনুবার আর ঝুমুরের ছবি। ছবিটা উনারা তুলেছিলেন যখন ঝুমুরের এক বছর। তোলা হয়েছিলো সিওল টাওয়ারের সামনে। খুব পুরনো স্মৃতি অথচ আজও যেন জীবন্ত চোখের সামনে ভাসছে।

মোতালেব সাহেবের চোখের কোণে নোনা জল। আজ তাসনুবাকে তার খুবই মনে হচ্ছে। এত বছরে আজ উনার প্রথম মনে হচ্ছে তাসনুবাহীন ঝুমুরকে উনি আগলে রাখতে পারছেন না। নিজের হাতে মেয়ের জীবন নষ্ট করছেন। কিন্তু এটাও ঠিক দোকান ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন এন্টিক জিনিস দেখা এবং কেনা তার শখ। এসবে আর ব্যবসায়ে ডুবে থাকলে তাসনুবাহীন জীবনের কথা উনার মনে কম পড়ে। তবুও মাঝে মাঝে দমকা হাওয়ার মতো পুরনো স্মৃতিগুলো উড়ে আসে মনে। লাগিয়ে দেয় ভালোবাসাহীন জীবনে দুঃখ।

—-

ফাহমানরা দুই ভাই বোন। ফাহমান বড় আর ওর বোন হৈমন্তী ছোট। হৈমন্তী বর্তমানে অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে। ঝুমুরের থেকে বয়সে বড় হলেও ঝুমুরের সঙ্গে তার অনেকটা খোলা মেলা সম্পর্ক। একে অপরের মনের কথা তারা অকপটে একজন আরেকজনকে বলতে পারে। ঝুমুর একটু চুপচাপ
স্বভাবের বলে তার তেমন কোনো বন্ধু নেই কিন্তু হৈমন্তীর সঙ্গে তার দারুন সখ্যতা। তার বড় বোনের অভাব হৈমন্তীই যেন পূরণ করেছে।

কালো, সোজা পিঠ ছাড়ানো চুলগুলো পিঠের উপর ছেড়ে দিয়ে হাতে বই নিয়ে বাগানে ত্রস্ত পায়ে হাঁটছে ঝুমুর। তার কাজল চোখ দুটো বইয়ে নিবদ্ধ। মনযোগও বইয়ের মাঝেই। তার আর কোনদিকে খেয়াল নেই। সে মুগ্ধ আপন জগতে বইয়ের পাতায়।

ছাদ থেকে বাগানে পায়চারি করতে থাকা ঝুমুরকে দেখছে ফাহমান। সারারাত পেশেন্টদের কেস হিস্ট্রি পড়ে যখন ভোরবেলা ক্লান্তি দূর করতে বাড়ির ছাদে এসে দাঁড়ালো তখনই বাগানে ঝুমুরকে পায়চারি করতে দেখলো। এই বাড়িতে ফাহমানরা এসেছে পাঁচ বছরের মতো।

অন্য ফ্ল্যাটে থাকার সুবাদে ছুটির দিন ছাড়া ফাহমান তেমনভাবে বাড়িতে আসতো না। কখনও কখনও ছুটির দিনও সম্ভব হতো না। প্রায় সপ্তাহের সাতটা দিনই তার কোনো না কোনোভাবে ব্যস্ততায় পেরিয়ে যেত। কিন্তু বছর পাঁচেক আগে যখন সে সদ্য এমবিবিএস ফার্স্ট ইয়ারে তখনই হঠাৎ করে তার বাবা মারা যায়। বাধ্য হয়ে তখন বাবার ধার দেনা মেটাতে নিজেদের দোতলা বাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে এই ভাড়া বাড়িতে এসে উঠে।

সেই থেকে এই বাড়িতেই মা বোনকে নিয়ে থাকছে। অবশ্য সে থাকছে বললে ভুল হবে কারণ সে কলেজের কাছে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েই থেকেছে। তার ফ্ল্যাট ভাড়ার টাকা থেকে শুরু করে ঝুমুরদের বাড়িতে থাকার ভাড়া সবকিছুই চলছে তার মা মারিয়ামের ছোট ব্যবসা দিয়ে। জীবিকা নির্বাহ এবং অবসর সময় কাটাতে মারিয়াম অনলাইন বেকারির বিজনেস করছেন। উনার রান্নার ধাতই অন্যরকম তাই অনলাইনে উনার বানানো কেক পেস্ট্রির চাহিদা বরাবরই সরব।

প্রথম প্রথম দুই ফ্ল্যাটের ভাড়া সঙ্গে করে ছেলে মেয়েসহ নিজের খরচ চালাতে অনেক কষ্ট হতো। দেখা যেত প্রতি মাসেই কারোর না কারো থেকে ধার নিতে হয়েছে। কিন্তু আস্তে আস্তে যখন উনার বানানো কেক, পেষ্ট্রির চাহিদা বাড়তে লাগলো তখন উনার আর মাস শেষে কারোর থেকে টাকা ধার নিয়ে চলতে হয়নি। এখন অনলাইন ডেলিভারি দেওয়ার সাথে সাথে আশেপাসের বেকারীগুলোতেও উনার বেকারী আইটেমের অনেক চাহিদা।

এই পাঁচ বছরে ঝুমুরের মুখোমুখি প্রায়ই হয়েছে ফাহমান। কিন্তু দেখা হলে কখনও বাক্য বিনিময় করেনি তারা। একজন আরেকজনকে দেখে ভদ্রতা সূচক হাসি দেওয়া ছাড়া তাদের মধ্যে আর কথা চালাচালি হয়নি। ফাহমানরা যখন ঝুমুরদের বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে উঠেছিল তখন বোধ করি ঝুমুরের বয়স বারো। আসলে চেনা নেই,জানা নেই তাই কি বলবে ? তাছাড়া কথা বলার মতো অত সময় কখনোই ছিল না ফাহমানের।

এই কারণেই হয়তো দেখা হওয়ার পর প্রথম দফায় ঝুমুর ওকে দেখে ভ্যাবাছ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। এমনটা হওয়ারই কথা। যার সঙ্গে কোনওদিন বাক্য বিনিময় হয়নি সে হঠাৎ নিজ থেকে কথা বললে ওরকম প্রতিক্রিয়াই প্রত্যাশিত।

তবে সে যখন এমবিবিএস ফাইনাল ইয়ারের পর ইন্টার্নশিপে জয়েন করে স্বাভাবিক ভাবেই মাস দুয়েক আগে বাড়িতে ফিরে আসে তখন থেকেই শ্যামাঙ্গণা ঝুমুর ধীরে ধীরে তার নজরে পড়তে শুরু করে। রোজ ভোরবেলা বাগানে বই হাতে হাঁটার সময় ঝুমুরের খিলখিল ধ্বনি ফাহমানের মনে প্রেমের ঝুম বৃষ্টি নামিয়ে দেয়। বিবশ হতে শুরু করে ঝুমুরের প্রতি। তবে এই শ্যামাঙ্গণা ঝুমুরকে কখনও নিজের করে পাওয়ার আশা দেখেনি ফাহমান কারণ এই শ্যামাঙ্গণা যে ইস্পাতের মতোই নিস্পৃহ। তার চঞ্চলতা, মুখরতা সবই একান্তে নিজের জন্য গুছিয়ে রাখা। সেখানে সে কি করে নিজের দখলদারি বসায় ?

মজার ব্যাপার হলো এতদিন ঝুমুরকে এই বাড়িরই কোনো ভাড়াটিয়া ভাবতো ফাহমান। কিন্তু কাল যখন জানতে পারলো ঝুমুর তাদের বাড়িওয়ালা আংকেলের নাতনি এবং তার বন্ধুর ভাগ্নি তখন মুহূর্ত কয়েকের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিলো। ফারুকের কথায় হুশ ফিরলে বুঝতে পারলো এতদিন যেই প্রেম পাখিকে দুর্বোধ্য এবং দুর্লভ ভেবেছিল সেই পাখি ও চাইলেই নিজের করে নিতে পারে। নিজের ভালোবাসার মানুষ, পছন্দের মানুষকে হাতের কাছে পেয়েও ছেড়ে দেওয়ার মতো ভুল সে করবে না।

ঝুমুর যখন বই পড়তে পড়তে মিটিমিটিয়ে হাসে তখন ফাহমানের মনে হয় সে তার নামের মতোই ঝুমঝুম করে হাসছে। তার সঙ্গে যেন ভুবনও হাসে। ফাহমানের অভিলাষ হয় যদি পারতো ঝুমুরের ওই কাজল চোখে ডুব দিতে তাহলে কতই না ভালো হতো। ডুবে যেত ওই গভীর চোখের অনন্ত মায়ায়।

—-

বাগানে খুব মনযোগী ভঙ্গিতে বইয়ের পাতায় চোখ বুলাচ্ছে ঝুমুর। রোজ ঘুম থেকে উঠে ভোরবেলা বাগানে বই হাতে পায়চারি করা তার পুরনো অভ্যাস। বাগানের এই ভেজা মাটি তাকে খুব টানে। ঝুমুর নাক টেনে বাতাসে কাঠগোলাপের সুমিষ্ট ঘ্রাণ নিলো।

ঝুমুরের নানুর বাড়ির পাশে দুই কাঠা জায়গা জুড়ে ঝুমুরের এই শখের বাগান। এই বাগানের কৃতিত্ব আগে ঝুমুরের নানু আজমাঈন সাহেবের ছিল না। কিন্তু আদরের নাতনিকে শখ করে তার দশম জন্মদিনে এই জায়গাটা কিনে দিয়েছিলেন কারণ বাগান করার অনেক শখ ছিল ঝুমুরের।

এরপর থেকে আজ পর্যন্ত সমস্ত বাগান জুড়ে ঝুমুর অনেক গাছ লাগিয়েছে। বাগানের এক কোণায় পাঁচ ফুট উচ্চতার একটা আম গাছ এবং আরেক কোণায় তাদের চারতলা বাড়ির উচ্চতার সমান একটা কাঠাল গাছ আছে। সেই সঙ্গে আছে ঝুমুরের প্রিয় কাঠগোলাপ, বেলি, শিউলি,নয়নতারা, সন্ধ্যা মালতীসহ আরও অনেক নয়নাভিরাম ফুলের গাছ। এত এত ফুল গাছে পরিপূর্ণ এই বাগানে ঢুকলেই বাতাসে ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ পাওয়া যায়। এছাড়াও পাওয়া যায় লেবু ফলের গন্ধ। সেই ঘ্রাণ ঝুমুরদের পুরো বাড়ি জুড়ে।

দুই কাঠা জমিনের এই বাগানের কারণেই তাদের এলাকায় বাড়িটাকে বাগান বাড়ি বলে অভিহিত করা হয়। নামটা শুনতে অনেকটা ভুতুড়ে হলেও ঝুমুরের এই নাম পছন্দ। কাজেই আজমাঈন সাহেব নাতনির পছন্দের জন্য বাড়ির নাম বাগান বাড়ি বলে উদ্ভোধন করেছেন।

বর্তমানে ঝুমুরের বয়স আঠারো বছরের কম বলে তার বাগানের উপর আইনিভাবে কৃতিত্ব আজমাঈন সাহেবের। তবে তার আঠারো বছর হতে আর মাত্র এক বছর বাকি। তারপরই সে নিয়ে নিতে পারবে এই বাগান বাড়ির পুরো বাগানের কৃতিত্ব। তখন থেকে এই বাগানে হবে শুধু তার রাজত্ব। যদিও এখনও তারই রাজত্ব চলছে কিন্তু তখন তো সে আইনিভাবেও এর অধিকার পেয়ে যাবে তাই ঝুমুরের মেজাজ ফুরফুরে।

চলবে…
মিফতা তিমু

শ্যামাঙ্গণা-৪
———–

ঝুমুর গুনগুন করতে একবার হাতের হাত ঘড়িতে নজর বুলালো। তার হাতে একটা পুরনো রংচটা চেইন ঘড়ি। ঘড়ির ডায়ালের গ্লাসও ফেটে গেছে। এই ঘড়ি জুড়ে তার অনেক স্মৃতি আছে। তার আগলে রাখা কানের দুলের মতো এই ঘড়ির বয়সও অনেক। হয়তো দশ বছরেরও বেশি। কিন্তু এই ঘড়ি তার কাছে অনেক মূল্যবান সম্পদ। তার সমস্ত আবেগের কেন্দ্র। মা নামক আবেগ সেটা।

ঘড়িতে সাতটা বাজে। ঝুমুর এবার বই হাতে নিয়ে বাগান থেকে বেরিয়ে গেলো। এখন তাকে খেয়ে রেডি হতে হবে তারপর কলেজ যেতে হবে। কলেজ আটটায়। তাকে কমপক্ষে আধা ঘণ্টা আগে বের হতে হবে। ঝুমুরকে বিল্ডিংয়ে ঢুকে যেতে দেখে ফাহমানও নেমে এলো ছাদ থেকে।

ফাহমান বাসায় ঢুকে দেখল সাতটা বাজে। দ্রুত হিসাব কষে নিলো তার খাওয়া দাওয়া করে রেডি হতে সব মিলিয়ে বিশ মিনিট লাগবে। এতক্ষণে তো মনে হয় ঝুমুরও রেডি হতে পারবে না। মেয়ে মানুষের তো এমনিতেই একটু বেশি সময় লাগে। কিন্তু ফাহমানের এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো যখন ও সিড়ি দিয়ে নেমে দেখলো সিড়িতে বসে ঝুমুর পায়ে মোজা পড়ছে।

ঝুমুরকে এত আগে এখানে দেখে ফাহমান হতবাক। এই মেয়ে এত তাড়াতাড়ি খেয়ে দেয়ে, রেডি হয়ে নিচেও চলে এলো। একজন মেয়ে মানুষের পক্ষে এত তাড়াতাড়ি কি করে সম্ভব ? ফাহমানের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করলো কিন্তু কিছু বললো না যদি পাছে ঝুমুর কিছু মনে করে। সেও ত্রস্ত পায়ে সিড়ি দিয়ে নেমে এলো। ঝুমুর ততক্ষণে মোজা পড়ে উঠে দাড়িয়েছে। সে শু রেক থেকে তার হোয়াইট কেটস নামাতে ব্যস্ত।

ফাহমানকে সকাল সকাল নামতে দেখে অবাক হলো ঝুমুর। সে এখন ফাহমানকে আশা করেনি। তবে সে আগ বাড়িয়ে কিছু বললো না। পাছে যদি অসভ্য ছেলেটা মনে করে সে গায়ে পড়া মেয়ে, তার ছেলে দেখলেই কথা বলতে মন চায়।

কাধে ব্যাগ চাপিয়ে বাড়ির বাইরে রাস্তায় নেমে আসতেই পিছন থেকে ফাহমানের ডাক শুনতে পেলো ঝুমুর। ও পিছন ফিরে ভ্রু কুটি করলো। ফাহমান ওকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে তার গতি বাড়িয়ে দ্রুত এগিয়ে এলো। অবাক হয়ে বললো ‘ মেয়ে মানুষ হয়ে এত দ্রুত কি করে হাটো তুমি ? আমাকে রীতিমত পিছনে ফেলে দিলে। ‘

ফাহমানের কথায় ঝুমুর তার ভ্রু জোড়া স্বাভাবিক করলো। ধীর পদক্ষেপে আগাতে আগাতে বললো ‘ আমি অত আস্তে হাঁটতে পারিনা। আমার মামা,নানু সবাই এর থেকেও দ্রুত হাটে। ‘
ফাহমান দ্রুত পায়ে ঝুমুরের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বললো ‘ বুঝলাম, তোমার গুষ্টি ঘোড়ার স্পিডে হাঁটা গুষ্টি। ‘

জবাবে বরাবরের মতোই ঝুমুর চুপ রইলো। সে কিছুই বললো না। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করলো। কিন্তু কিছুক্ষন পরে যখন পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে ফাহমানকে তার পিছনেই দেখলো তখন বললো ‘ আপনি কি আমায় ফলো করছেন ? ‘
‘ আরে না। আমি জাস্ট জানতে চাইছিলাম ফারুক কি করছে ? আজ ওর ডিউটি কটায় ? ‘ রয়েসয়ে বললো ফাহমান।

ফাহমানের কথায় ঝুমুর বললো ‘ মামা ঘুমাচ্ছে। তার ডিউটি কয়টায় সেটা তো আমার থেকে বেশি ভালো করে আপনার জানার কথা তাইনা ? ‘
ঝুমুরের কথায় ফাহমান মাথায় হাত রেখে বোকার মতো হাসলো যেন চোরের চুরি ধরা পড়ে গেছে। ওর হাসি এক পলক দেখে আবারও হাঁটতে শুরু করলো ঝুমুর। ফাহমান দ্রুত ঝুমুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললো ‘ আচ্ছা তোমার পুরো নাম কি ? ‘

‘ অঙ্গনা ঝুমুর ‘ ঝুমুর সহজ স্বাভাবিক গলায় সোজাসাপটা জবাব দিলো।

ঝুমুরের নাম শুনে মুচকি হাসলো ফাহমান। বললো ‘ অঙ্গনা!! বেশ সুন্দর নাম। এই নামে কেউ তোমাকে ডাকে না ? ‘

‘ মা ডাকতো ‘

এরপর কিছু পথ পেরিয়ে গেলো নিস্তব্ধতায়। একসময় ঝুমুর তার হাটা থামিয়ে দিল। তাকে থেমে যেতে দেখে ফাহমান বললো ‘ কি ব্যাপার ? থেমে গেলে যে ? ‘

‘ এখান থেকে যে আপনাকে বাকিটা পথ একাই যেতে হবে ডাক্তার সাহেব। আমাদের পথ এতটুকুই একসঙ্গে ছিল। ‘ ঝুমুর ফাহমানের চোখে চোখ রেখে বললো।

ঝুমুরের কথায় ফাহমানের আফসোস হলো। ইশ তাদের পথ এত অল্প সময়ের কেন ছিল ? আরেকটু লম্বা হলে ক্ষতি কি হতো ? আজ যেটুকু সময় সে ঝুমুরের সঙ্গে কাটিয়েছে তার জন্য তাকে আবারও কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষার প্রহর যে কত যন্ত্রণাময় তার সেই অভিজ্ঞতা আছে। আগে যখন রোজ ঝুমুরকে ছাদ থেকে বাগানে ভোরবেলা দেখার জন্য গোটা চব্বিশ ঘণ্টা অপেক্ষা করতো তখনই এর জ্বালা বুঝেছিল।

ফাহমানের থেকে উত্তর না পেয়ে ঝুমুর এগিয়ে গেলো তার গলির দিকে। এখন এই গলি দিয়ে কলেজের সামনে যেতে তাকে আরও পাঁচ মিনিট হাঁটতে হবে। ফাহমান ঝুমুরের যাওয়ার পথে তাকিয়ে মনে মনে বললো ‘ আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো শ্যামাঙ্গণা। হয়তো বাড়ি থেকে তোমার কলেজ অব্দি রাস্তাটাই আমাদের একান্ত সময়ের উৎস হবে কিন্তু আমি রোজ এইটুকু সময়ের জন্যই চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করবো। সুযোগ থাকলে আবারও দেখা হবে অঙ্গনা ‘

ঝুমুর হাঁটতে হাঁটতে একবার পিছনে ফিরলো। ফাহমান এখনও তার পথ চেয়ে দাড়িয়ে আছে। ফাহমানের চোখে মুখে মন খারাপের ভাব। ঝুমুর তা দেখে হাসলো। হাসলে তার দুই গালে টোল পড়ে। ফাহমান দূর থেকে তার টোল পড়া হাসির দিকে তাকিয়ে আবারও মুগ্ধ হলো। ঝুমুর বললো ‘ দেখা হবে ডাক্তার সাহেব। সূর্য যখন তার চিকন রশ্মির মতো আভা ছড়িয়ে জেগে উঠবে তখন বাগান থেকে ছাদে তাকিয়ে দেখা হবে আমাদের। ‘

কথাগুলো বলে ঝুমুর দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো। হাতের পুরনো ঘড়ির ডায়ালে ঘড়িতে এখন সকাল সাতটা পঁয়তাল্লিশ। সাধারণত তার এত সময় লাগেনা তবে আজ ফাহমানের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বেশি সময় লেগেছে। ঝুমুর আর পিছন ফিরল না। ফিরলে হয়তো দেখতে পেত এক জোড়া প্রেমিক দৃষ্টি মুগ্ধ চোখে তার প্রস্থান দেখছে।

—-

ক্রইসান্ট তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী দেখে নিচ্ছেন মারিয়াম। কাল হাতে একটা বড়সড় অর্ডার আছে। জন্মদিন উপলক্ষে পার্টি সেন্টারে ডেলিভারি দিতে হবে। তাই অ্যাডভান্স পেয়েই সব আইটেম নিয়ে এসেছেন তিনি। পাশের চেয়ারে বসে হৈমন্তীও বাটারগুলোর এক্সপায়ার ডেট দেখে নিচ্ছে। মা মেয়ে যখন নিজের কাজ করতে ব্যস্ত তখনই বাসার কলিং বেল বেজে উঠলো।

হৈমন্তী এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ঝুমুরকে দেখলো। তার হাতে কাচের বাটি কাচের ঢাকনা দিয়ে ঢাকা। প্রিয় সখিকে দেখে হৈমন্তীর আনন্দের শেষ নেই। ঝুমুর তার থেকে বয়সে ছোট হলেও সে তার প্রিয় বান্ধবী। হৈমন্তী ঝুমুরের হাত টেনে ঘরে ঢুকিয়ে সদর দরজা লাগিয়ে দিয়ে বললো ‘ কতদিন পর দেখলাম তোকে। তোর তো দেখাই পাওয়া যায় না। কি এত করিস তুই ? রোজ তো ঠিকই বাগানে হাটিস অথচ সময় করে দেখা করতে পারিস না। ‘

‘ কিছুদিন পরেই ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল শুরু হবে আপু। ক্যামেস্ট্রি, বায়োলজী, ফিজিক্স সবকিছুর ভিড়ে একেবারে ঠেসে গেছি। মাত্র স্যারের কাছে পড়ে এলাম। তিনজনের কাছে টিউশনি পড়ি তারপরও মনে হয় পড়া হয়না। ইংলিশের জন্য দেখি বাবাকে টিচার করে দিতে বলবো। ইন্টার লেভেলে ইংলিশটা মন দিয়ে পড়া দরকার। ‘ ঝুমুর ক্লান্ত গলায় বললো।

ঝুমুরের ক্লান্ত কণ্ঠস্বর শুনে মারিয়াম ডাক দিলেন ওকে। নিজের পাশে বসিয়ে বললেন ‘ এত প্রেসার নিচ্ছিস কেন ? আস্তে ধীরে কর। তোকে তো জর্জ ব্যারিস্টার হতে বলছে না কেউ। এত প্রেসারের কি আছে ? ‘

ঝুমুর ক্লান্ত হাসলো। মারিয়ামের হাতে হাত রেখে বলল ‘ এভাবে বললে কি হবে মণি ? মা চেয়েছিল আমি যেন ডাক্তার হই। তার ইচ্ছা তো পূরণ করতেই হয়। তার প্রথম এবং শেষ ইচ্ছা। পূরণ না করলে যে মরেও শান্তি পাবো না। ‘

‘ বুঝলাম তুই আন্টির ইচ্ছা পূরণ করতে চাস। তা এই বাটিতে কি ? ‘ হৈমন্তী পাশে চেয়ার টেনে বসে বললো।

‘ ডিমের হালুয়া বানিয়েছিলাম। ভাবলাম তোমাকে দেই, তোমার তো প্রিয় হালুয়া। ‘ কাচের বাটির ঢাকনা খুলে বাটিটা হৈমন্তীর দিকে এগিয়ে দিল।

‘ হালুয়া!! বাহ্ ঝুমুর তুই তো দেখি রাধুনী আল্ট্রা ম্যাক্স প্রো হয়ে যাচ্ছিস। দিলটা গার্ডেন গার্ডেন করে দিলি। একটু টেস্ট তো করতেই হবে। কতদিন পর তোর হাতের হালুয়া। ‘ রান্নাঘর থেকে চামচ আনতে আনতে বললো হৈমন্তী।

হৈমন্তী চেয়ারে বসে হালুয়ার সুমিষ্ট ঘ্রাণ নিলো। আহ্ শব্দ করে বললো ‘ হায় ঘিয়ের গন্ধ। মনটাই ভরে গেছে। মনে হচ্ছে খেতে না জানি কত ভালো হবে। ‘
হৈমন্তীকে হালুয়ার ঘ্রাণ নিতে দেখে হাসলো ঝুমুর। হৈমন্তী হালুয়া চামচে নিয়ে মুখে পুড়ল। ঝুমুরকে থাম্বস আপ দেখিয়ে বললো ‘ জোস হইসে দোস্ত। মা তুমিও নাও। ‘

হৈমন্তী মারিয়ামের দিকে হালুয়ার বাটি এগিয়ে দিল। হালুয়া খেয়ে মারিয়ামও প্রশংসা করলেন ঝুমুরের রান্নার হাতের। বললেন ইন্টার পরীক্ষার পর ঝুমুরকে তিনি নিজে বেকিং শিখাবেন। নতুন কিছু শিখতে পারার লোভে মাথা ঝাকিয়ে সায় দিল। আরও কিছু প্রয়োজনীয় কথা সেরে ঝুমুর উঠে দাঁড়ালো বাসায় ফেরার জন্য। তখনই ফ্ল্যাটের লক চাবি দিয়ে খুলে ফ্ল্যাটে ফাহমান ঢুকলো।

ফাহমানকে দেখে মিইয়ে গেলো ঝুমুর। নিজের সকালে বলা কথাগুলো মনে পড়লো। ভাগ্যিস সে শ্যাম বর্ণা তাই তার লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া গাল দুটো ধরতে পারলো না ফাহমান। ঝুমুরকে এই সময় এখানে দেখে সেও হতবাক। আপাতত সে ভাবেনি বাড়ি ফিরেই প্রেয়সীকে দেখতে পাবে।

ভাইকে দেখে হৈমন্তী সরব হয়ে উঠলো। এগিয়ে এসে ঝুমুরকে দেখিয়ে বললো ‘ ও আমার বান্ধবী ঝুমুর। এবার ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে। বাড়িওয়ালা আংকেলের ছেলে ফারুক ভাই আছেন না ?তোমার বন্ধু ফারুক ভাই ? উনার ভাগ্নি ? ‘

বোনের কথায় ফাহমান বললো ‘ এত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে হবে না। কাল দোতলায় যখন দুপুরে খাচ্ছিলাম তখনই দেখেছি। তা তুমি এখন এখানে ?’
ফাহমানের কথায় কিঞ্চিৎ অপমানবোধ করলো ঝুমুর। অকপটে বললো ‘ ওহ আমার বুঝি এই বাড়িতে আসা বারণ ? তাহলে চলে যাচ্ছি। ‘

ঝুমুরের উত্তরের ঝাঁঝে ফাহমান টের পেলো মাত্র সে কোন ভুল করে বসেছে। আচমকা অপ্রত্যাশিতভাবে প্রেয়সীকে পেয়ে তার কুশল বিনিময় করতে গিয়ে উল্টো তাকে রাগিয়ে দিয়েছে। ও মুখে বললো ‘ আয় কি মুশকিল!! রেগে গেলে… ‘

তবে ঝুমুর ওর কথা শুনলো না পুরোটা। তার আগেই বেরিয়ে গেলো হনহন করে। ঝুমুরকে এভাবে বেরিয়ে যেতে দেখে মারিয়াম এবার ছেলেকে এক প্রস্ত বকাবকি করে বললেন ‘ এভাবে কেউ বলে ? কি বললি ? তা তুমি এখন এখানে ? এটা কি কোনো ভদ্র ঘরের ছেলে মেয়ের কাজ ?শুধু শুধু মেয়েটাকে রাগিয়ে দিলি। যতসব গাধা আমার ঘরেই জন্ম হলো। ‘

—-

ঝুমুরকে ধপ করে সদর দরজা লাগাতে দেখে ভ্রু কুচকে ফেললেন মনোয়ারা বেগম। নাতনির মুখ আদ্যপান্ত জরিপ করছেন তিনি। ঝুমুরের মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে না তার মনের ভাব কি। তাই তিনি মুখেই জিজ্ঞেস করলেন ‘ কিছু হয়েছে নাকি ?’

‘ নাহ্… কি হবে ? হালুয়া দিতে গিয়েছিলাম, সেটাই দিয়ে এলাম। ‘
ঝুমুরের কথার জবাবে আর কিছু বললেন না মনোয়ারা বেগম। উনি আর এ বিষয়ে মাথা ঘামালেন না। ঝুমুরের হুটহাট মন পরিবর্তনের ঘটনা নতুন না। এই মেয়ের প্রায়শই মুড সুইংস হয়।

রাগান্বিত ঝুমুর নিজের ঘরে এসে ফিজিক্স বই নিয়ে বসলো। তার মনে হলো রাগের বশে একটু বেশিই ওভার রিয়েক্ট করে ফেলেছে। ফাহমান তো তখন তাকে সেখানে আশা করেনি কাজেই হুট করে তাকে পেয়ে হয়তো জিজ্ঞেস করে বসেছে ঝুমুরের হঠাৎ আগমনের কারণ। আর সেই প্রশ্নটা শুনেই অবিবেচকের মতো শুধু কারণে রেগে গেলো ঝুমুর। যা হলো ঠিক হয়নি। এর জন্য তার ক্ষমা চাওয়া উচিৎ।

কিন্তু ক্ষমাই বা চাইবে কি করে সেটা ধরতে পারলো না ঝুমুর। ফাহমানরা তাদের ভাড়াটিয়া। বাড়িওয়ালা হওয়ার সুবাদে বাড়িওয়ালার ভাড়াটিয়াদের বাড়িতে এত ঘন ঘন আগমন স্বাভাবিক দৃষ্টিতে অভদ্রতা। কাজেই সে চাইলেই যখন তখন যেতে পারছে না। তাই ক্ষমা চাওয়ার একমাত্র উপায় হলো কালকে স্কুল যাওয়ার সময়টা। এখন কাল ফাহমান তার স্কুল যাওয়ার পথে তার সঙ্গে যাবে কিনা এটাই দেখার পালা। নাকি ঝুমুরের কথায় রেগে গিয়ে সে যাবে না ?

—-

ভেজা চুলে গলায় গামছা পেচিয়ে ঘর থেকে বের হলো ফাহমান। বাইরে থেকে এসে সে মাত্রই গোসল সেরে বেরিয়েছে। তার আবার কোথাও গেলে বাসায় ফিরে গোসল না করলে হয়না। মনে হয় ঘামে জবজবা শরীরে অসস্তি করে। রুমের বাইরে বের হয়েই ফাহমান দেখলো টেবিলের উপর হালুয়ার বাটি রাখা আর সেটা থেকে একটু করে হৈমন্তী খাচ্ছে। এই সময় হঠাৎ হালুয়া দেখে ফাহমান অবাক হলো। জিজ্ঞেস করলো ‘ হালুয়া ? কে দিলো ? ‘

‘ ঝুমুর দিয়ে গেছে ‘ খেতে খেতেই উত্তর দিলো হৈমন্তী। সে এখন ব্যস্ত ভার্সিটির এসাইনমেন্ট নিয়ে। সে তিতুমীর কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী।

‘ ঝুমুর!! ওই পিচ্ছি কি রান্নাও পারে নাকি ? ‘ ফাহমান অবাক গলায় বললো।

‘ ও না দেখতে পিচ্ছি, আসলে পিচ্ছি না। রান্না থেকে শুরু করে বাসার যত কাজ আছে সব পারে। ‘

‘ ওহ ‘ শব্দ করে ফাহমান চেয়ার টেনে বসল। এক চামুচ হালুয়া নিয়ে মুখে দিল। মুখে দিতেই তার মনে হলো অমৃত খাচ্ছে। চিনি আর লবণের কি সুন্দর ব্যালেন্স। ফাহমান মিষ্টি জাতীয় খাবার খায় না। কিন্তু ঝুমুরের বানানো এই ডিমের হালুয়া খেয়ে মনে হলো মিষ্টি মনে করে না খেলে বুঝি সে কত কিছুই না মিস করতো।

চলবে…
মিফতা তিমু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here