শ্যামাঙ্গণা-৫,০৬

0
300

শ্যামাঙ্গণা-৫,০৬

০৫
———–

রোজকার মতোই বাগানে এসে দাড়িয়েছে ঝুমুর। তার হাতে আফিফা পারভীন আপুর তুমুল পাঠক প্রিয় উপন্যাস ফেরারি বসন্ত। বই পড়া ঝুমুরের নিত্য দিনের উপন্যাস। রোজই সে দিনের শুরুটা ভোরবেলায় বই পড়া দিয়ে করে। দিনের এই শীতলতম প্রহরে তার সময় কাটে হিম ধরানো বাতাসের আদ্রতা গায়ে মেখে।

বই পড়তে পড়তে আড়চোখে ঝুমুর কয়েকবার ছাদের দিকে তাকালো। কিন্তু একবারও ফাহমানকে তার চোখে পড়লো না। মনে হলো আজ এলো না কেন অসভ্য ছেলেটা ? রোজই তো আসে সে। তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে দেখে। তাহলে আজ এলো না কেন ? আজ কি আসবে না মানুষটা ?

ঝুমুরের মন খারাপ হলো। আজ তবে ফাহমান আসবে না। তার নির্ধারিত সময় সে বইয়ের মাঝে কাটিয়ে বাসায় ফিরে এলো। রোজকার মতো প্রথমে রুটি ভেজে নিলো। তারপর আলু ভাজির সাথে প্লেটে রেখে ছুটলো ঘরে রেডি হতে। ঝড়ের গতিতে রেডি হয়ে সে খাবার টেবিলে গিয়ে বসলো নাস্তা করতে।

এই সময়টাতে কলেজে যাওয়ার আগে ঝুমুর রোজ দুটো রুটি খেয়ে বের হয়। সকালে ঘুম থেকে উঠেই কলেজের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার আগে ভাত খাওয়া তার পছন্দ না। ভাতের থেকে রুটিটাই তার বেশি পছন্দ। তার এই স্বভাবের কারণে মনোয়ারা বেগম বলেন সে আর তার নানু দুজনেই পাকিস্তানীদের বংশধর।

দ্রুত খেয়ে তার কোমড় অব্দি নেমে আসা চুলে দুই বেণী করে কাধে ব্যাগ নিয়ে ছুটলো ঝুমুর। তার চুল লম্বা হলেও মোটেও ঘন না। উল্টো রোজ চুল পড়তে পড়তে চুলের গোছা পাতলা হয়ে এসেছে। ঝুমুর সিড়িতে বসে সাদা শুভ্র মোজাটা পড়ে পায়ে কেটস পড়লো। ব্যাগ কাধে নিয়ে বাড়ির বাইরে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইলো ঝুমুর।

কিন্তু ঝুমুরের অপেক্ষার প্রহর সুফল বয়ে আনলো না। তার অপেক্ষার প্রহর বাড়তে লাগলো আর ধৈর্য্যের বিচ্যুতি ঘটতে লাগল। বাধ্য হয়ে ঝুমুর তার নোনা সিক্ত চোখ নিয়ে স্কুলের পথে হাঁটা দিলো। তার ভীষন রকমের অভিমান হলো। কেন এলো না লোকটা ? অথচ কাল বলেছিল আবারও তাদের দেখা হবে।

ঝুমুর আপন খেয়ালে হাঁটতে হাঁটতেই আচমকা লক্ষ্য করলো কেউ তার হাত টেনে ধরলো। মুহূর্তেই নিজেকে সে রাস্তার ধারে আবিষ্কার করলো। সঙ্গে সঙ্গে পাশ দিয়ে একটা মোটর সাইকেল শা শা গতিতে পেরিয়ে গেলো। ঝুমুরের চোখে মুখে আছড়ে পড়ছে কারোর গরম নিশ্বাস। সে তার চোখের জলে টইটুম্বুর মুখ তুলে দেখলো ফাহমান বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে। নিশ্চই ভয় পেয়ে গেছে।

ফাহমান এবার বড় বড় চোখে ঝুমুরের দিকে তাকালো। তার বলিষ্ঠ, রুক্ষ হাত দুটো এখনও ঝুমুরের দুই হাত আকড়ে ধরে আছে। চোখ দুটো তার ঝুমুরের কাজল চোখে ডুব দিয়েছে। ঝুমুর সবে লক্ষ্য করলো ফাহমানের চোখ দুটো স্বচ্ছ বাদামি রঙের। ফাহমানের ওই স্বচ্ছ কটা চোখের দিকে অনিমিখ তাকিয়ে রইলো ঝুমুর।

‘ এভাবে কেউ অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তায় হাটে অঙ্গণা ? ‘

ফাহমানের গম্ভীর গলা শুনে নিজের মনোজগৎ থেকে বেরিয়ে এলো ঝুমুর। খেয়াল করলো কথা বলার সময় ফাহমানের গলা কেপে উঠেছে। তার চোখ মুখও শক্ত অথচ গলার স্বর নামানো। ফাহমানের এহেন ব্যক্তিত্বে ঝুমুর আবারও মুগ্ধ হলো। তার বেখেয়ালিতে মানুষটা কত রাগান্বিত অথচ তার গলার স্বর এক মুহূর্তের জন্য লক্ষণ সীমা পার করেনি। বরাবরের মতই একই রকম ভাবে খাদে নামানো।

ফাহমানকে ছেড়ে সরে দাড়ালো ঝুমুর। সতর্ক দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকালো। কেউ দেখেনি দেখে সস্তির নিশ্বাস ফেললো। অতঃপর ঝুমুর চলতি পথ ধরে হাঁটতে শুরু করলো। হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিল। এখন সাতটা তিরিশ অথচ সে আজকে কালকের থেকেও দ্রুত বের হয়েছিল। ফাহমানের জন্য অপেক্ষা করতে গিয়েই এত দেরি তাই সে ঠিক করলো ওর সঙ্গে কথা বলবে না।

ঝুমুরের তার কথার জবাবে কিছুই না বলে নিজের মতো হাঁটা দেখে রাগে হতবাক ফাহমান। এটা কেমন ধারার ব্যবহার ? প্রশ্ন করলো অথচ জবাব পেলো না। ফাহমান দ্রুত পায়ে এগিয়ে ঝুমুরের সাথে সমান তালে হাঁটতে হাঁটতে বললো ‘ জবাব দিলে না কেন ? ‘

‘ যেই মানুষের সময় জ্ঞান নেই তার কোনো প্রশ্নের উত্তর অঙ্গণা দেয় না। ‘

ঝুমুরের কথায় হেসে দিল ফাহমান। সে যে আজ ছাদে যায়নি, ঝুমুরের জন্য বাড়ির গ্যারেজে অপেক্ষা করেনি তাতে ঝুমুরের রাগ হয়েছে সেটা সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে। মুখে বলল ‘ কাল সারারাত ঘুম হয়নি। ফারুককে দেখে নিশ্চই বুঝেছ ডাক্তাররা প্রায় রাত ঘুমোতে পারেনা পড়াশুনা করতে গিয়ে। সেই অনিদ্রা যখন অভ্যাস হয়ে যায় তখন আর রাতে ঘুম আসে না। ঘুম আসে দিনে। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তাই দেরি হলো। ‘

ঝুমুর এবার চুপ করে রইলো। কিছু বললো না সে। কথাটা ফাহমানই শুরু করলো। দুঃখী গলায় বললো ‘ অঙ্গণা, রেগে আছো ? ‘
ফাহমানের কথায় ঝুমুর একটু অবাক হলো। জিজ্ঞেস করলো ‘ কিসের জন্য ? ‘
ফাহমান রয়েসয়ে বললো ‘ ঐযে কাল তোমাকে দেখে বললাম তুমি এখানে। আসলে তুমি যা মনে করেছ আমি সেটা বোঝাইনি। হুট করে তোমাকে দেখে অবাক হয়েছিলাম তাই বললাম তুমি এখানে ‘

ফাহমানের কথায় ঝুমুর ফিক করে হেসে দিল। ফাহমান দেখলো হাসলে ঝুমুরের গালে গভীর টোল পড়ে। তার গজদন্তি হাসি যেন আরও গভীর হচ্ছে। ঝুমুরের আঁকাবাঁকা দাতের মনোমুগ্ধকর হাসি দেখে ফাহমানের দমবন্ধ লাগলো। ও দৃষ্টি এদিক সেদিক ফিরিয়ে মন অন্য কোথাও সরাতে চাইলো। কিন্তু এই পোড়া দৃষ্টি তো ঘুরে ফিরে ওই ভয়ংকর রূপবতী মেয়েটার দিকেই যায়।

ঝুমুর হাসি থামিয়ে চমৎকার গলায় বললো ‘ আচ্ছা আমি আপনার চুলে হাত দিতে পারবো ? ‘
ঝুমুরের এই কথায় ভ্যাবাছ্যাকা খেয়ে গেলো ফাহমান। ঝুমুর এরকম কিছু একটা বলবে আশা করেনি সে। তবে নিজের হতবুদ্ধি ভাব কাটিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বললো ‘ অবশ্যই ‘

পরমুহূর্তেই তার ঘন চুলে ঝুমুরের মোলায়েম হাতের স্পর্শ টের পেলো। ঝুমুর তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। অবাক হয়ে ঝুমুরের দিকে তাকিয়ে আছে ফাহমান। ঝুমুর সেই দৃষ্টি দেখে হেসে বললো ‘ আপনি আসলেই অনেক ভালো মানুষ ডাক্তার সাহেব। দোয়া করি আপনি সবসময় এভাবেই থাকুন। ভালো,ভালো,অনেক ভালো আর একটু বোকাসোকা থাকবেন। ‘

ফাহমান বুঝলো না ঝুমুরের কথার মানে। কেনই বা এই রূপসী তাকে বোকা বললো। তবে ঝুমুরকে হাঁটতে দেখে সেও এগিয়ে গেলো। ঝুমুর এবার বললো ‘ আজকে আমাকে দেখতে আসবে ‘
ঝুমুরের কথায় অবাক হয়ে ফাহমান বললো ‘ কেন ?’

‘ মেয়েদের মানুষ কেন দেখতে যায় ? ‘

ঝুমুরের কথায় ফাহমান বুঝলো ঝুমুরকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। কিন্তু ও অবাক হলো। মুখে বললো ‘ এই বয়সে বিয়ে দিবে নাকি তোমাকে ? আঙ্কেল জানে ? উনি কিভাবে মেনে নিচ্ছেন এসব ? ‘

‘ আপির কথা বাবা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। একটা কথাও ফেলে না তার। তাই আমাকে যদি সারাজীবন বিয়ে না দিয়ে বাড়িতে বসিয়ে রাখার সিদ্ধান্তও নেয় আপি,বাবা সেটাও নিঃসন্দেহে মেনে নিবে। ‘ ঝুমুর ঠোঁট উল্টে বললো।

‘ ওহ ‘ বলে চুপ করে গেলো ফাহমান। ঝুমুরকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে শুনে তার মন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। ইচ্ছা করছে বলতে যেন ঝুমুর পাত্রপক্ষকে না করে দেয়। কিন্তু ফাহমানের কি আদৌ সেটা বলার অধিকার আছে ?
ঝুমুর ফাহমানকে চুপ থাকতে দেখে বললো ‘ একটা জিনিস লক্ষ্য করেছেন আপনি ? ‘

ঝুমুরের কথায় ফাহমান দ্রুত বললো ‘ কি ? ‘
‘ এই যে আপনার হাতে এপ্রন আবার আমিও কলেজ ড্রেস হিসেবে এপ্রন পড়েছি। এর মানে আপনি বুঝতে পারছেন ? ‘ ঝুমুর বললো।

ফাহমান অবিবেচকের মত বললো ‘ কি বুঝবো ? ‘
‘ আপনি অন্যদের মনের ডাক্তার আর আমি আপনার মনের ডাক্তার। ভাবা যায় মনের ডাক্তারেরও ডাক্তার আছে ? ‘
ফাহমান এবার ধরতে পারলো ঝুমুরের কথার অর্থ। সে চমৎকার হেসে বললো ‘ অবশ্যই। আমিও তো মানুষ। আমারও মনের জন্য ডাক্তার দরকার হয়। কিন্তু আমার মনের চিকিৎসা যে সে করতে পারে না। আমার মন নিয়ে খেলার অধিকার একমাত্র শ্যামাঙ্গণার আছে। ‘

—-

ঘোমটা মাথায় নিয়ে চা ও বিভিন্ন রকম নাস্তা ট্রেতে সাজিয়ে বসার ঘরে হাজির ঝুমুর। ত্রস্ত পায়ে সে ঘোমটা টেনে একে একে চায়ের কাপগুলো অতিথিদের হাতে তুলে দিয়েছে। তারপর ট্রেতে থাকা নাস্তার প্লেটগুলো টি টেবিলে খুব গোছালো হাতে সাজিয়ে ঠায় দাড়িয়ে রইলো পাত্র পক্ষের সামনে। পাত্র চা খেতে খেতে আয়েশী ভঙ্গিতে তাকে দেখছে।

পাত্রের মা চা মুখে দিয়ে তেলতেলে হাসি হেসে বললেন ‘ এই চা কি তুমি বানিয়েছো মা ? ‘
ঝুমুর মাথা নেড়ে কম কথায় উত্তর দিলো ‘ জী ‘
পাত্রের চোখে মুখে তুমুল উৎসাহ। মনে হয় ঝুমুরের মায়া ভরা মুখ তার মনে ধরেছে। তবে মায়ের অনুমতি বিনা কিছু বলতে পারছে না। এইদিকে ঝুমুর প্রাণপনে চাইছে পাত্রপক্ষ যেভাবেই হোক বিয়েতে না করে দিক। বিয়েতে রাজি হলে যে আর উপায় থাকবে না। তার মন তো সে দিয়ে বসেছে এক মনের ডাক্তারকে।

পাত্রের পাশেই পাত্রের বাবা উপস্থিত ছিলেন। এতক্ষণ উনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঝুমুরকে লক্ষ্য করেছেন। তবে ঝুমুরের এত নিখুঁত মায়াভরা মুখ দেখে উনার ভ্রু কুচকে গেলো। যেন তিনি মেয়ের খুঁত খুঁজে বের করার মতো গুরুতর দায়িত্ব পালন করতে না পেরে বিরক্ত। তিনি ধীমি গলায় বললেন ‘ তা মেয়ে তোমার নাম কি ? ‘

ঝুমুর বরাবরের মতোই অল্প কথায় উত্তর দিলো ‘ অঙ্গণা ঝুমুর ‘
পাত্রের বাবা আবারও সুধালেন ‘ পড়াশোনা কতদূর ? ‘
‘ জি ইন্টার পরীক্ষা দিবো এবার ‘

‘ রান্না পারো ? ‘

‘ জি ‘

‘ ঘর গোছাতে পারো ? ‘

‘ জি ‘

‘ ঘর পরিষ্কার করতে পারো ? ‘

‘ জি ‘

সব প্রশ্নের উত্তরে ঝুমুরের জি বলাটা যেন পাত্রের বাবার সহ্য হলো না। উনি কিয়ৎক্ষণ বিরক্তি ঠাসা চোখে তাকিয়ে রইলেন ঝুমুরের দিকে। এইদিকে পাত্রের বাবার এরকম প্রশ্নে মনোয়ারা বেগমের ফর্সা মুখ রাগে ফুলে ফেপে লাল গোলগাল টমেটোর রূপ ধারণ করেছে। পাত্র পক্ষের এ কেমন ধারার অভদ্রতা ? তারা কি ছেলের বউ দেখতে এসেছেন না কাজের লোক খুঁজছেন ?

এবার পাত্রের বাবা তার পান খাওয়া মুখে বিরক্তিকর শব্দ তুলে বললেন ‘ তোমার চুল দেখাও ‘
এই কথায় এবার ঝুমুর তার নত দৃষ্টি তুলে তাকাল। এতক্ষণে এই প্রথম তারা মায়াভরা কাজল চোখের অপরূপ দৃষ্টি সবার নজরে এলো। পাত্র আর পাত্রের মা অনিমিখ চেয়ে আছে তার গভীর দৃষ্টির দিকে। কিন্তু এই দৃষ্টি দেখে পাত্রের বাবা গললেন না। উনি নিবিড় ভাবে বললেন ‘ কি হলো চুল দেখাও ‘

এবার মনোয়ারা বেগম সত্যিই রেগে গেলেন। এই লোকগুলো পেয়েছে কি উনার নাতনিকে ? উনি কি নাতনিকে বাজারে প্রোডাক্ট হিসেবে ডিসপ্লে করে তারপর চওড়া দামে বিক্রি করছেন যে এভাবে চুল দেখাতে হবে ? কিছুক্ষণ পরে তো হেঁটেও দেখাতে বলবে। এতক্ষণ ধরে উনি ভদ্রতার খাতিরে বদান্যতা দেখিয়েছেন। কিন্তু ধৈর্য্যেরও একটা সীমা আছে। ভদ্রলোক সেই সীমা পেরিয়ে গেছেন।

‘ চুল খোলার প্রয়োজন নেই ঝুম ‘

মনোয়ারা বেগমের কথায় ঝুমুর আর চুল খোলার প্রয়োজন মনে করলো না। মনোয়ারা বেগম এবার পাত্রের বাবার মুখোমুখি শক্ত পোক্ত চোয়ালে বসলেন। মুখে বললেন ‘ আমি আমার নাতনিকে বাজারে বিক্রি করছি না যে তার কোয়ালিফিকেশন দিতে হবে ? আপনি আগে আপনার ছেলের কোয়ালিফিকেশন দিন। আপনার ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়া আর কি পারে ? রান্না পারে সে ? নাকি কাপড় ধুতে পারে নাকি ঘর গুছাতে পারে ? ‘

মনোয়ারা বেগমের কথায় জসিম সাহেব রেগে গেলেন। এসব কোন ধরনের প্রশ্ন ? উনার ছেলে কেন এসব শিখতে যাবে ? মেয়েদের তো এসব স্বাভাবিক নিয়মে শিখতেই হয়। উনি গলা চড়িয়ে বললেন ‘ আমার ছেলে কেন এসব শিখতে যাবে ? আর নাতনিকে পাত্র দেখতে এলে এসব প্রশ্ন করলে যদি আপনার এতই গায়ে পড়ে তাহলে ওকে কলের পুতুল সাজিয়ে বাড়িতেই রেখে দিন নয়তো ঘর জামাই আনুন আপনার মেয়ে জামাইয়ের মতো। এই মেয়ের বাবা তো আপনাদের বাড়িতেই ঘর জামাই হয়ে থাকে তাইনা ? ‘

শেষের কথাটা জসিম সাহেব তার তর্জনী তুলে ঝুমুরের দিকে ইশারা করে বললেন। এই কথায় যেন মনোয়ারা বেগমের রাগে ঘৃতাহুতি পড়লো। উনি শান্ত গলায় গম্ভীর কণ্ঠে বললেন ‘ গলা নামিয়ে কথা বলুন,জনাব। এটা ভদ্রলোকের বাড়ি। আর আমার নাতনিকে কলের পুতুল সাজিয়ে রাখবো নাকি বিয়ে দিয়ে জামাইকে ঘর জামাই করবো সেটা আমাদের ব্যাপার। আমার জামাই ঘর জামাই নাকি বাইরের জামাই সেটার কৈফিয়ত নিশ্চই আমি আপনাকে দিবো না। ধন্যবাদ আপনি আসতে পারেন। ‘

মনোয়ারা বেগমের এহেন ধারার অপমানমূলক কথায় জসিম সাহেব রেগে গেলেন। স্ত্রী, পুত্র সমেত বেরিয়ে যাওয়ার সময় বললেন ‘ ঘরে সাজিয়ে তো রেখেছেন কালো নাতনিকে। এখন আমিও দেখবো ওর বিয়ে কি করে হয়। আমাকে অপমান করার ফল যে খুব খারাপ সেটা আপনি বুঝতে পারবেন। ‘

লোকটার এই ব্যবহারে মর্মাহত ঝুমুর। আগেও অনেকজনকে দেখেছে তার গায়ের রং দেখে কালো মুখে বেরিয়ে যেতে কিন্তু এই প্রথম তাকে কেউ বদদোয়া দিয়ে গেলো যেন তার জীবনেও বিয়ে নাহয়। মানুষ বুঝি এতটাও খারাপ হয়। ঝুমুরের বিশ্বাস হলো না। অপমানে তার কান ঝা ঝা করছে। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনা অশ্রু।

জসিম সাহেব তার পরিবার সমেত প্রস্থান করতেই আক্রোশে ফেটে পড়লেন মনোয়ারা বেগম। রাগে গড়গড় করতে ভাতিজি লাবিবা বেগমকে ফোন দিলেন এবং বললে ভবিষ্যতে যেন আর কখনও ঝুমুরের বিয়ে নিয়ে লাবিবা বেগম ঘটকালি না করেন। ভাতিজির সঙ্গে কথা শেষে উনি নিজেকে শান্ত করলেন আর ঝুমুরের দিকে তাকিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললেন ‘ ঝুমুর আমার বড় নাতনী কাজেই তাকে আমি যার তার কাছে বিয়ে দিবো না। আত্মসম্মানী, বিবেক বুদ্ধিমান মানুষের কাছেই বিয়ে দিবো। তারমানে এই না যে নিম্ন মানসিকতার, টাকার অহংকারে ডগমগে পরিবারে বিয়ে দিবো। সুখী থাকার মূলমন্ত্র নিজের লাগাম কোথায় টানতে হবে সেটা জানা। লাগামহীন হয়ে আত্ম দেমাগে মজে থাকলে এই সুখ কখনোই পাওয়া সম্ভব না। ‘

চলবে…
মিফতা তিমু

শ্যামাঙ্গণা-৬
———–

কাজ শেষে হাউজ থেকে ফিরে দোতলায় আসতেই সবার চোখে মুখে থমথমে, গম্ভীর ভাব দেখে মোতালেব সাহেব বুঝলেন তার অনুপস্থিতিতে মারাত্মক কিছু একটা ঘটে গেছে। সকলে তখন খাবার ঘরে রাতের খাবার খাচ্ছে বলে কাউকে আর কিছু জিজ্ঞেস করে বিরক্ত করলেন না তিনি। ঝুমুর রাতের খাবার খাচ্ছিল কিন্তু মোতালেব সাহেবকে দেখে খাবার রেখে উঠে গেলো।

ঝুমুর বেশ অনুনয়, বিনয় করে মোতালেব সাহেবকে আজকের রাতের খাবারটা দোতলাই খেতে রাজি করলো। সচরাচর মোতালেব সাহেব দোতলায় খাননা কারণ একেতেই শশুড় বাড়িতে থাকছেন তার উপরে তার মা রোজ খাবার নিয়ে অপেক্ষা করেন তার জন্য। তবে আজ মালিনী বেগম শরীর খারাপ বলেই বাধ্য হয়ে মোতালেব সাহেবকে জানিয়ে শুয়ে পড়েছেন।

আজ আর মালিনী বেগম ছেলের খাবার নিয়ে বসে নেই বলেই মোতালেব সাহেব আজ তার রাতের খাবারটা শশুর বাড়ি তথা ছেলে মেয়ের সঙ্গে খাবেন। মোতালেব সাহেবকে দেখে আমির বেশ উচ্ছ্বসিত হলো। এইবার সে ক্লাস সিক্সে পড়ছে। সদ্য কৈশোরে পা রাখা আমিরের দুই চোখে যেন উচ্ছল স্বপ্নের বাস। আমির এখন নতুন ক্লাসে,জীবনের নতুন অধ্যায়ে নতুন নতুন বন্ধু তৈরি করছে আর সেসব গল্পই তার বাবাকে শোনাচ্ছে।

মোতালেব সাহেব খাচ্ছেন আর ছেলের কথা শুনছেন। সারাদিন শেষে মোতালেব সাহেব শুধু খাবারের সময়টাতেই একটু শান্তি পান বলে ঝুমুর বার দুয়েক ভাইকে সাবধান করলো কারণ মনোয়ারা বেগম তখন অসন্তোষ চোখে আমিরের দিকে তাকিয়ে।

সামি, তাফিম ওরা খেতে ব্যস্ত। খাওয়ার সময় তারা কেউই কথা বলেনা। এর পিছনে দুটো কারণ। এক মনোয়ারা বেগম দুই ঝুমুর। মনোয়ারা বেগমকে ওরা ভয় পায় কারণ উনি গম্ভীর ধরনের মানুষ। কিন্তু ঝুমুরকে ভয় পাওয়ার কারণ নেই। সে ঝর্ণার মতোই উচ্ছল আর স্রোতস্বিনী নদীর মতোই প্রাণবন্ত। তবুও বড় বোনের প্রতি এক অজানা সম্মানে তারা কখনো ঝুমুরের কথার অবাধ্য হয়না। হয়তো ঝুমুর তাদের ফুপাতো বোন তবুও তারা ওকে নিজের বড় বোন রুপেই মেনে চলে কারণ তাদের নিজের কোনো বোন নেই।

‘ আমরা এখন খেতে বসেছি আমির। তুমি কি চুপ করবে ? ‘

মনোয়ারা বেগমের উত্তপ্ত দাবানল ঝড়ানো কণ্ঠে আমির চুপ করে গেলো। সে চিনে তার আপিকে। সে অত্যন্ত রেগে গেলেই কেবল তাকে তুমি করে বলে। কাজেই এখন চুপ থাকাই শ্রেয়। ঝুমুর তার বাবার দিকে তরকারি এগিয়ে দিল। মোতালেব সাহেব নিজেদের বাসায় সাধারণত কোরিয়ান হালাল খাবারই খান। যেই কোরিয়ান খাবারগুলো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খাওয়া হয় সেগুলোই খান। কিন্তু দীর্ঘদিন বাংলাদেশে থাকার দরুন উনার, মালিনী বেগমের এবং ঝুমুরের বাংলাদেশী খাওয়ার খাদ্যভাসও গড়ে উঠেছে।

খাওয়া দাওয়া শেষে ঝুমুর যখন টেবিল গোছাতে ব্যস্ত তখন মোতালেব সাহেব মেয়েকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। মনোয়ারা বেগম কোরআন শরীফ পড়ছিলেন টেবিলে বসে। ঝুমুর তার বাবাকে এক মিনিট দাড়াতে বলে এগিয়ে গেলো। ধীমী কণ্ঠে বলল ‘ বাবা আমার একজন টিউটর দরকার। কয়েক মাস পরই তো মডেল টেস্ট শুরু হবে। তাই ইংলিশের জন্য টিউটর দরকার। ‘

মোতালেব সাহেব মেয়ের কথায় মুহূর্ত কয়েক নিঃশব্দে চিন্তা করলেন। তারপর বললেন ‘ তুই চিন্তা করিস না,ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তুই শুধু মন দিয়ে পড়াশোনা কর। আর যা যা লাগবে তা শুধু একবার বলবি। ‘

‘ কিছু টাকা লাগবে ‘

মেয়ের কথায় মোতালেব সাহেব মেয়ের হাতে পাঁচশো টাকা গুঁজে দিলেন। এমন প্রায়শই হয়। মোতালেব সাহেব মাসে দুবার নিয়ম করে মেয়েকে টাকা দেন এবং দিয়ে তিনি নিশ্চিন্তেই থাকেন কারণ উনি জানেন উনার মেয়ে ঝুমুর একমাত্র বই কেনা ছাড়া অন্য কিছুর পিছনে টাকা খরচ করেনা। এমন কি সেটার প্রয়োজনও পড়ে না কারণ উনি তো কোনোকিছুরই অভাব রাখেননি ছেলে মেয়েদের জন্য।

—-

আজ ঝুমুরের বাগানে যাওয়া হয়নি। পরীক্ষা আসন্ন বলে কাল একটু পড়া এগিয়ে রাখতে রাত অব্দি পড়েছে। যার কারণে সকালে উঠতে দেরি হয়েছে। ঘুম থেকে উঠে দ্রুত পায়ে রেডি হয়ে যখন ঝুমুর বের হলো তখন তার নজর গেলো সিড়ির দিকে। সিঁড়ির ঠিক সামনে দেওয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে আছে ফাহমান। তার ঠোটে মুখে আলতো হাসি। ঝুমুর বুঝলো না তার এই হাসির কারণ। হাসার কথা নয় মানুষটার কারণ ও আজ বাগানে যাইনি বলে তার দেখাও হয়নি।

ঝুমুর মোজা পড়ে ধীর পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় উঠলো। এতক্ষণে তার পাশে থাকা ফাহমানের সঙ্গে কথা বললো সে। সচরাচর সে কিংবা ফাহমান কেউই বাড়ির আশেপাশে থাকাকালীন একে অপরের সঙ্গে কথা বলে না কারণ কেউ দেখে ফেললে সাড়ে সর্বনাশ হবে। ঝুমুর বললো ‘ আপনি কি রেগে আছেন আমার উপরে ডাক্তার সাহেব ? ‘

ঝুমুরের কথায় অবাক ফাহমান বললো ‘ রাগ ? কেন করবো ? ‘
‘ ঐযে আজ বাগানে যেতে পারলাম না তাই। আসলে… ‘

ঝুমুর চাচ্ছিল তার স্বপক্ষে যুক্তি দিতে কিন্তু ফাহমানই তাকে মাঝপথে থামিয়ে বললো ‘ প্রয়োজন নেই অঙ্গণা… আমি যেমন কাল বিশেষ প্রয়োজনে বাগানে যেতে পারিনি তেমনই তুমিও যে প্রয়োজনেই যেতে পারোনি সেটা আমি বুঝেছি। সম্পর্ক সবাইকে স্বাধীন হতে শেখায়,বন্দী করতে নয়। কাজেই সব কাজের কৈফিয়ত আমাকে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ‘

ফাহমানের কথায় ঝুমুরের চোখে মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না তবে সে আড়ালে মুখ নত করে মিটমিটিয়ে হাসলো। তারপর মুখ তুলে গলা খাঁকারি দিয়ে ফাহমানের মনযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করলো। হলোও তাই। ফাহমান জিন্সের পকেটে হাত গুজে হাটতে হাটতে তার দিকে তাকালো। মুখে বললো ‘ কিছু বলবে ? ‘

‘ হু… কাল পাত্রপক্ষ এসেছিল। পাত্রের মা আর পাত্র আমাকে পছন্দ করলেও পাত্রের বাবা আমার হাজার খুঁত বের করার চেষ্টা করেছে। পরে আপি রেগে গিয়ে তাকে অনেক কথা শুনিয়েছে। আসল কথা হলো লোকটা যাওয়ার আগে অভিশাপ দিয়ে গেছে আমাকে যে আমার কখনও বিয়ে হবে না। ‘

ঝুমুরের নির্বিকার কণ্ঠ শুনে ফাহমান একটু চিন্তিত হয়ে পড়ল। পাত্র ওকে পছন্দ করেছেন। তাহলে কি ঝুমুরও… আর ভাবতে পারলো না ফাহমান। ঠিক করলো সরাসরিই জিজ্ঞেস করে নিবে কারণ মনে মনে উল্টাপাল্টা কিছু ভেবে নিজেকে কষ্ট দেওয়া বড়ই অযৌক্তিক ফাহমানের কাছে। ফাহমান বললো ‘ তোমারও কি পাত্রকে পছন্দ ? ‘

ঝুমুর ফাহমানের কথায় অবাক হয়ে বললো ‘ অদ্ভুত!! আমি ওই ছেলেকে পছন্দ করবো কেন ? টাকা পয়সা,ফেম থাকলে কি হবে তার বাবা তো অহংকারী মানুষ। যেই ছেলে নিজের বাবার ভুল কথাকে ভুল ধরে প্রতিবাদ করতে না পারে তাকে পছন্দ করা,বিয়ে করার প্রশ্নই উঠে না। ‘

ঝুমুরের কথা শুনে সস্তির নিশ্বাস ফেললো ফাহমান। যাক তাহলে এখনই ঝুমুরের বিয়ে হচ্ছে না। ফাহমানের বুক থেকে যেন পাষাণ ভার নেমে গেলো। ও এবার হাসি মুখে ঝুমুরের দিকে তাকালো। ঝুমুর কিছু একটা ভাবছে। ঝুমুরকে চিন্তিত দেখে ফাহমান জিজ্ঞেস করলো ‘ কি ব্যাপার ? মনে হচ্ছে টেন্সড ‘

‘ কয়েক মাস পরেই টেস্ট পরীক্ষা শুরু। আমি পড়াশুনায় ভালো হলেও পরীক্ষার সময় প্রশ্ন দেখে ভয় পেয়ে যাই। এখন এই ভয় কিভাবে দূর করবো সেটাই বুঝতে পারছি না। ‘ ঝুমুর বললো।

‘ ওয়েল তুমি একটা কাজ করতে পারো। তোমার যারা হোম টিউটর আছে তাদের কাছে বেশি বেশি স্মল টেস্ট দিয়ে প্রাকটিস করো। দেখবে আস্তে আস্তে ভয় কমে গেছে। আর তুমি তো সামনেই যেহেতু ইন্টার দিচ্ছ তাই তোমার গ্রুপ সাবজেক্টসহ অন্য যেসব আদার্স সাবজেক্ট আছে ট্রাই করো ওগুলোতেও ভালো রেজাল্ট করার। এতে তোমার স্কিলস বাড়বে। তাছাড়া কোনো প্রবলেম হলে আমাকে বলতে পারো, বুঝিয়ে দিব। ‘

ফাহমানের কথায় ঝুমুর আলতো করে মাথা নেড়ে বললো ‘ আপনি তো ভালই স্কিলড ডাক্তার সাহেব। আপনার অনেক গুণ আছে। একজন ডক্টর,তার উপরে ভালো মোটিভেশনাল স্পিকার এবং টিচারও বটে। আমার ভাবতেই অবাক লাগছে আমি একটা মাল্টি ট্যালেন্টেড মানুষের সঙ্গে রোজ কলেজ যাই। আমি মনে হয় খুব তাড়াতাড়ি ফেমাস হয়ে যাবো। ‘

ফাহমান হাসলো ঝুমুরের কথায়। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল ‘ আমারও ভাবতে অবাক লাগছে আমি রোজ দুমুখো মানুষের সঙ্গে কথা বলি। তুমি সবার সামনে এক রকম আর আমার সাথে একরকম। মনে হয় সবার সামনে যত নীরব থাকো আমার সামনে ততই উচ্ছল, প্রাণবন্ত হয়ে উঠ। এভাবেই থেকো অঙ্গণা। তোমার এই শ্যামাঙ্গণা উচ্ছল রূপটাই আমার পছন্দ। ‘

ঝুমুর ফাহমানের কথায় তেমন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। তাদের পথ চলছে হাজারও নানান অজানা কথা একে অপরের সঙ্গে ভাগাভাগি করে। বাতাসে মিশে আছে প্রেমের গুনগুন। ভোরের এই স্নিগ্ধ সকালে দুই নর নারী এগিয়ে চলেছে নিজেদের গন্তব্যের দিকে। হয়তো সময়ের পরিবর্তনে একসময় তাদের পথ আলাদা হয়ে যাবে কিন্তু জীবনের পথ কি আদৌ তাদের আলাদা করবে ?

—-

মিস মার্জিয়ার কাছে ফিজিক্স নিয়ে পড়তে বসেছে ঝুমুর। বইয়ে কিছু লাইন মার্ক করে দিয়ে বইটা ঝুমুরের দিকে এগিয়ে দিয়ে কিছু বলছিলেন মার্জিয়া। কিন্তু ঝুমুরের সাড়া শব্দ না পেয়ে মুখ তুলে দেখলেন ঝুমুর গালে হাত দিয়ে কিছু একটা ভাবছে। তার ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি। ঝুমুরকে এভাবে আনমনে হাসতে খুব কমই দেখেছেন মার্জিয়া। তাই গলা খাকারি দিয়ে ঝুমুরের মনযোগ আকর্ষণ করতে চাইলেন।

তবে মিস মার্জিয়ার সমস্ত চেষ্টা চেষ্টা ব্যর্থ হলো যখন ঝুমুর তার ইশারা ইঙ্গিত না দেখে নিজের কল্পনার রাজ্যে ডুবে রইলো। ঝুমুরকে এতটা অন্যমনস্ক দেখে মিস মার্জিয়া এবার ওর কাঁধে হাত রাখলেন। এবার ঝুমুর চমকে উঠে বললো ‘ কিছু বলবে আপু ? ‘

ঝুমুর মিস মার্জিয়াকে আপু বলে ডাকে কারণ মিস মার্জিয়া ঝুমুরের থেকে বয়সে ততটা বড় নয়। তাছাড়া ঝুমুরের সঙ্গে উনার সম্পর্কটাও বন্ধুত্বপূর্ণ। এমন কোনো কথা নেই যা ঝুমুর উনাকে বলে না। ঝুমুরকে উনি প্রায় বছর ছয়েক ধরে পড়ান যখন ঝুমুর ক্লাস সিক্সে পড়তো। উনার বাড়িও ঝুমুরদের বাড়ির পাশেই তাই উনার পরিবারের সঙ্গে ঝুমুরের পরিবারের সকলের সম্পর্কই যথেষ্ট ভালো। ঝুমুরের যেকোনো ব্যাপারে উনাকে সবাই চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেন।

‘ কি ব্যাপার ঝুম ? কি এত ভাবছো যে আমার হাজার ডাকও কানে যায় না ? আবার হাসছোও ? এই সিক্রেট কি বলতো ? তুমি কি কিছু লুকাচ্ছ ? ‘

মিস মার্জিয়ার কথায় ঝুমুর ইতস্তত বোধ করলো তবে তা প্রকাশ করলো না। মুখে বললো ‘ সামনে টেস্ট। তুমি তো জানো আমি পরীক্ষার সময় ভয় পেয়ে যাই তাই ভাবছি কিভাবে ভয় না পেয়ে পরীক্ষা দিয়ে ভালো রেজাল্ট করতে হয়। আবার বাড়ি থেকে থেকে আমিও বোর হয়ে যাচ্ছি। একটা কাজ করি। তুমি আর আমি বাইরে কোথাও ঘুরে আসি। এই রাস্তার মোড়ে নুডুলস আছে তো। ওটা খাবে ? তুমি আর আমি খাই যেখান থেকে। তোমার সময় হবে না ? ‘

ঝুমুরের কথায় মিস মার্জিয়া মুহূর্ত কয়েক ভাবলেন। তারপর বললেন ‘ বের তো হওয়া যায় কিন্তু আন্টিকে বলে ম্যানেজ করতে হবে। সেটা করবে কে ? ‘
‘ ওসব নিয়ে তুমি ভেবো না। আমি এই যাবো আর এই আসবো। আপিকে মানানো আমার ডান হাতের খেলা। ‘ বলেই ঝুমুর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

—-

ঝুমুর আর মিস মার্জিয়া বেড়িয়েছেন আজ একটু ঘোরাঘুরি করার উদ্দেশ্যে। ঘোরাঘুরি বলতে এই বাড়ির কাছে গলির মোড়েই একটা স্টল আছে যেখানে নুডুলস পাওয়া যায়। এই নুডুলস তাদের খুব প্রিয়। সেটা খেতে খেতেই সুখ দুঃখের গল্প করবে তারা।

বস্তুত সমবয়সী ঝুমুরের কোনো বন্ধু নেই। বন্ধু বলতে অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ুয়া হৈমন্তী আর অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ুয়া মার্জিয়াই আছে। সমবয়সীরা কেউ তার সঙ্গে মিশে না সমাজের কিছু কুসংস্কার নামক অপসংস্কৃতির কারণে। অনেকেরই ধারণা ঝুমুরের মতো শ্যামলা,কালো মেয়ের সঙ্গে মিশলে তারাও কালো হয়ে যাবে। প্রথম প্রথম সবার এসব কথায় ঝুমুর কষ্ট পেলেও এখন অসম দুই সখিকে পেয়ে সে বড়ই খুশি কারণ এখন আর কেউ বলবে না তার বান্ধবী নেই।

ঝুমুর আর মার্জিয়া স্টলের পাশে দাড়িয়ে দাড়িয়ে নুডুলস খেতে ব্যস্ত। তাদের মধ্যে আলাপ চলছে মার্জিয়ার ক্লাস নিয়ে। মার্জিয়ার এক ক্লাসমেট কিছুদিন আগে তাকে প্রপোজ করেছে তবে বিয়ের আগে কোনরকম প্রেম করবে না বলেই সে নিজেকে বিবাহিত বলে জাহির করে ওই ছেলেকে রিজেক্ট করেছে। এই নিয়েই দুই সখিতে হাসাহাসির শেষ নেই।

ঝুমুর মার্জিয়ার কথায় হাসতে হাসতে যখন নুডুলস মুখে দিয়ে পাশে নজর দিল তখন দেখলো ক্লান্ত পায়ে ফাহমান ফিরছে বাড়ির পথে। সারাদিনের এত খাটাখাটনির পর তার শরীরে যেন বিন্দুমাত্র শক্তি নেই। তবে সে রোজই নিয়ম করে বাস স্ট্যান্ড থেকে হেঁটে আসা যাওয়া করে বাড়িতে যাতে শরীর তার সবসময় সুস্থ থাকে। এমন না তার রিকশায় আসা যাওয়া করার সামর্থ্য নেই। কিন্তু পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতেই ফাহমানের ভালো লাগে। হেঁটে আসতে আসতে চারপাশের মানুষ দেখা তার নিত্য দিনের কাজ।

চলবে….
মিফতা তিমু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here