শ্রাবণ তোমার আকাশে,পর্ব_১
লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
নিজের বরকে অন্য একটা মেয়ের মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেলো বেলার। সে মৃদু স্বরে চিৎকার দিলে হুঁশ ফেরে ঘরের ভেতর থাকা দুজন মানব-মানবীর। মেয়েটি হতচকিত হয়ে উঠে বসলেও বেলার বর শাইনির তাতে কোনো হেলদোল নেই।
বেলা এলোমেলো পা ফেলে মেয়েটির কাছে এগিয়ে গিয়ে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিতেই মেয়েটি রেগে বলে উঠে, ‘কে তুমি? এত বড় সাহস আমার গায়ে তুমি হাত তুলছো?’
বেলা ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল,
–আমি কে? সেটা আপনার প্রেমিককেই জিজ্ঞেস করুন।
–কাউকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনবোধ করছিনা৷ কারো রুমে ঢোকার আগে নক করে ঢুকতে হয় সেটা জানোনা? ম্যানার্সলেস কোথাকার!
বেলা কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দু-চোখ জলে টলমল করছে। মনের ভেতর ঝড় বয়ে চলেছে অবিরামভাবে। বুঝতে পারছেনা ওর এখন কী বলা বা করা উচিৎ। সত্যিই তো সে ম্যানার্সলেস মেয়ে। ঘরে তো নক করে ঢোকাই উচিৎ ছিলো। কিন্তু দরজা ভেজানো দেখে বেলা সেটা করেনি। তার ওপর নিজের স্বামীর ঘর মানে নিজের ঘর। তেড়ে এলো সে শাইনির দিকে। শোয়া অবস্থায়ই ওর শার্টের কলার দু-হাতে টেনে ধরে জিজ্ঞেস করলো, ‘কেন এরকম করলেন? আমাকে কেন ঠকালেন?’
শাইনি মুচকি হেসে বলল, ‘নক করে ঘরে ঢুকলেই হতো।’
থাপ্পড় মারলো বেলা ওর গালে। কটমট চাহনিযুক্ত চোখদুটো ইতোমধ্যে লালবর্ণ ধারণ করেছে। গলা চেপে খুন করতে ইচ্ছে করছে সবাইকে। শাইনির হাত আপনাআপনি মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে এলো। তার আগেই মেয়েটি চেঁচিয়ে বলতে লাগলো, ‘এই মেয়ে? তুমি ওকে মারলে কেন? এত্ত সাহস? জানো কে ও?’
বেলা উত্তর দিল, ‘জানি।’
–জানো?
–হুম। একটা চরিত্রহীন জানোয়ার লোক।
–বেশি বলছো তুমি? এত স্পর্ধা দেখালে ভালো হবেনা কিন্তু। শাইনি আমার বয়ফ্রেন্ড। আমার সামনে ওকে ছোট করে কথা বললে ভালো হবেনা বলে দিলাম।
তেড়ে ওঠলো বেলা। মেয়েটার চুলের মুঠি টেনে ধরলো। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, ‘ওই বেহায়া মহিলা, জানোস আমি কে? না জেনে বড় বড় কথা কেন শোনাচ্ছিস আমাকে?’
মেয়েটি ব্যথায় আর্তনাদ করে সাহায্য চাইলো শাইনির কাছে। বেলা কিছুতেই ওকে ছাড়ছেনা। যেন মেরে ফেলতে পারলে তার শান্তি৷ ওর স্বামীর সাথে নোংরামি করে আবার ওকেই দুনিয়ার কথা শোনানো হচ্ছে সেটা ওর মাথায় রক্ত উঠিয়ে দিয়েছে। শাইনি পরিস্থিতি বেগতিক দেখে তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নেমে এলো। বেলাকে টেনে সরাতে চাইলে বেলা ওকে ধাক্কা মারে। শাইনি এবার ভীষণ রেগে যায়। বলে,
–এবার কিন্তু তোমার গায়ে হাত তুলতে বাধ্য হবো আমি।
–যা ইচ্ছে করতে পারেন। আমি একে উচিৎ শিক্ষা দিয়েই ছাড়বো। একটা মেয়ে হয়ে অন্যের সংসার ভাঙতে এসব মেয়েরা দু’বার ভাবেনা। তাই ওদের বেঁচে থাকার কোনো মানে হয়না।
শাইনি ধাক্কা মেরে বেলাকে সরিয়ে মেয়েটাকে ফ্লোর থেকে তুলে বিছানায় বসিয়ে দেয়। মেয়েটা কাশতে থাকে। গলা চেপে ধরেছিল বেলা। শাইনি না থাকলে এতক্ষণে মেরেই ফেলত। মেয়েটি কোনোমতে সেখান থেকে উঠে চলে গেলো। বেলা এককোনায় বসে কাঁদছে। কী থেকে কী হয়ে গেলো এসব?
শাইনি এবার পূর্ণদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায়। মাথায় রক্ত চড়ে গেছে ওর। এগিয়ে এসে কিছু বলার আগেই বেলা বলে ওঠে,
–আপনার যখন অন্য কাউকেই পছন্দ তাহলে আমাকে কেন বিয়ে করলেন? আমি কী ক্ষতি করেছি আপনার? আমার জীবন কেন নষ্ট করলেন?
শাইনি বাঁকা হাসলো। বিছানায় পায়ের ওপর পা তুলে বসলো। তারপর বলল,
–ইউ নো? তোমাকে বিয়ে করেছিলাম ফ্যামিলির কথায়। তবে অপছন্দ যে তা নয়। তুমিও খুব সুন্দর। তবে তোমার জন্য যে বাকিসব সুন্দরী মেয়েদের সাথে সময় কাটাতে পারবোনা? লাইফ এঞ্জয় করতে পারবোনা তা তো হতে পারেনা মাই সুইট ওয়াইফ!
বেলার গা রাগে কাঁপছে। এমন চরিত্রহীন লোক শাইনি? ছিঃ! ভদ্র চেহারা আর টাকাপয়সা দেখে বিয়ে দিয়ে ওর বাবা-মা যে কতবড় ভুল করেছে তা হাড়ে হাড়ে টের পেলো। ঘৃণাভরা কন্ঠে বলল,
–কাল বিয়ে করে আজকেই আমাকে এসব শুনতে হচ্ছে? আপনার যে এত এত মেয়ে লাগবে সেটা বিয়ের আগে বলে দিলেই পারতেন।
শাইনি ভ্রু কুঁচকালো। এখনো একদিন হয়নি তাদের বিয়ের৷ তার আগেই এই মেয়েটা এমন ঝামেলা শুরু করলো। জাস্ট অসহ্য লাগছে ওর। বেলার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটার ফর্সা গাল আর নাকের ডগা লাল হয়ে আছে। দেখতে সুন্দর লাগছে। পরক্ষনেই দৃষ্টি ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে হাতে গুণে গুণে উত্তর দিল,
–কমপক্ষে…
বেলা চোখ রাঙিয়ে তাকালো। শাইনি বলল, ‘শুনতে চাইলে বলতে পারি।’
–আপনার মা’কে জানাতে বাধ্য হবো আমি।
–এটা তুমি করবেনা।
–অবশ্যই করবো। সবাইকে জানাতে হবেনা তাদের ছেলে কেমন? হোটেলে নিজের বউকে দেখা করতে ডেকে অন্য মেয়ের সাথে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়! সেটা আমি ছাড়া আর কে জানাবে? আমি প্রশ্ন করবো কেন আমার জীবন নিয়ে খেললো তাঁরা! এসব কুকীর্তি নিশ্চয়ই তাদের অজানা নয়?
শাইনি রেগে গেল। সে জানে এই মেয়ের কথাবার্তা খুবই সিরিয়াস৷ আর এসব কথা বাড়িতে জানালে সবার কী অবস্থা হবে তা ভাবনার বাইরে। বেলাকে দেখতে যতোটা আলাভোলা মনে হয় মেয়েটা তা নয়। শাইনি কিছু একটা ভেবে বাঁকা হাসলো। বলল,
–তুমি কী আমাকে ভয় দেখাচ্ছো? আমি তোমার সো কল্ড কথাগুলোকে ভয় পাচ্ছিনা একদমই।
–আপনি একটা নিচ লোক।
–বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে এবার।
–আমি বাড়াবাড়ি কিছু করছিনা। এই বিয়েটা ভাঙতে হবে। আমি চরিত্রহীন লোকের সাথে ঘর করতে পারবোনা।
শাইনি অবাক হওয়ার ভান করে বেলার দিকে একটু ঝুঁকে গেলো। ভয় পেয়ে বেলা দূরে সরে গেলে শাইনি ওকে কাছে টেনে এনে আলতো করে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। ঘৃণায় গা কেঁপে ওঠে ওর। অন্য একটা মেয়েকে টাচ করে এখন ওর সাথে..! দুহাতে ধাক্কা দিয়ে সরায় শাইনিকে। কাঁপতে কাঁপতে বলে,
–কী করছেন আ আপনি? দ দূরে থ থাকুন আমার থেকে।
শাইনি একহাতে কাছে টেনে এনে বলে, ‘আমি যা ইচ্ছা তাই করবো। মেয়েদের কাছে যাব না না-যাব সেটা পার্সোনাল ম্যাটার। বউ তুমি আমার। দূরে যেতে দিই কীভাবে? আবার বলছো সবাইকে সব জানিয়ে ডিভোর্স দেবে ব্লা ব্লা। এখনো তো বাসরই হয়নি আমাদের। তার আগেই ছেড়ে যেতে চাও? দিস ইজ নট ফেয়ার জানেমন!’
বেলার মাথায় আবারও রাগ উঠে গেলো। হাতের কাছে ফল কাটার ছুঁড়ি পেয়ে সেটাই শাইনির গলায় চেপে ধরলো। কিন্তু তাতে ভয় না পেয়ে উলটো হাসির পরিমাণ বেড়ে গেলো ওর। তা দেখে বেলা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘খুন করে ফেলব একদম। বাস্টার্ড কোথাকার।’
–তাই নাকি জানেমন? ফল কাটার ছুঁড়ি দিয়ে আমায় খুন করবে? ফানি টক, ভেরি ফানি টক..
–মজা মনে হচ্ছে আপনার?
–ইয়েস মাই মিসেস। এনিওয়ে, তুমি একটু বসো। আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি। আর আমার থেকে পালানোর চিন্তাধারা যদি করে থাকো তাহলে সেসব ভুলে যাও৷ ওসব আর এ জীবনে হচ্ছেনা। স্বয়ং তোমার পুরো পরিবার ও যদি আমার পায়ে পড়ে তাহলেও এ জীবনে তোমায় ছাড়বোনা আমি। কারণ আমি নিজে তোমার মতো সুন্দরীকে পছন্দ করেছি।
ভেতর থেকে দরজা লক করে কথাগুলো বলেই ওয়াশরুম চলে গেলো শাইনি। বেলা বসে বসে কাঁদতে লাগলো। পরিবারের সবার সম্মতিতে ঘরোয়াভাবে কাল বিয়ে হয়েছে তাদের। এখনো উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়নি ওকে। সকালেই শাইনি ফোন করে ওকে একটা হোটেলে দেখা করতে বলে। আর বেলা এসে দেখে এই অবস্থা! কিছুতেই মানতে পারছেনা ব্যাপারটা। এত নোংরা একটা লোকের সাথে ওর বিয়ে হয়েছে ভাবতেই মরে যেতে ইচ্ছা করছে। অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলো, যাই হয়ে যাক না কেন! এই চরিত্রহীন লোকের সাথে ও থাকতে পারবেনা৷ তার একমাত্র সমাধান ছাড়াছাড়ি। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। এমন অদৃষ্ট ওর?
শাইনি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ওকে দেখে মনে মনে কিছু ভাবলো। তারপর বাঁকা হেসে এগিয়ে এলো। কান্নারত বেলার কানে ফিসফিস করে বলল, ‘বাসরটা সেরেই ফেলি কী বলো?’
হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেলো বেলার। কাঠ হয়ে গেলো সে। কথা বলতে পারলোনা। শাইনি ওর ওড়না ধরতেই ভয়ে আধমরা হয়ে গেলো বেলা। চোখ বন্ধ করে আল্লাহ আল্লাহ জপতে লাগলো বিড়বিড় করে! শাইনি ওর হাতে…
চলবে…ইনশাআল্লাহ!