শ্রাবণ_আঁধারে #পর্ব_১

0
1859

#শ্রাবণ_আঁধারে
#পর্ব_১
#নিশাত_জাহান_নিশি

প্রখর রোমাঞ্চে প্রলোভিত হয়ে আমি আগ পাছ না ভেবেই “চিএার” বা গালটায় দীর্ঘ একটা চুমো এঁকে দিলাম! ঘটনার আকস্মিকতায় চিএা চোখ দুটো প্রকান্ড করে আমার দিকে চেয়ে দেখতেই হলির আবিরে মিশিয়ে রাখা লুকায়িত এক গাঁধা সিঁদুরে আমি চিএার ধূসর সিঁথিকে রাঙ্গিয়ে দিয়ে ক্ষীণ হেসে বললাম,

“আজ থেকে তুই আমার অর্ধাঙ্গিনী চিএা!”

সিঁথি থেকে সিঁদুর গড়িয়ে চিএার কপাল থেকে নাক বরাবর এক লম্ব রেখার তৈরী হচ্ছিলো। ধবধবে ফর্সা আদলে সিঁদুরের লাল রঙ্গটায় চিএাকে কতোটা লাবণ্যময় এবং রমনীয়তায় প্রতীক মনে হচ্ছিলো তা আমার বিশ্লেষণ শক্তির বাইরে! তার ভুবন ভুলানো অমায়িক রূপে আমি যতোটা না অভিভূত হচ্ছিলাম তার’চে অধিক আকৃষ্ট হচ্ছিলাম। ভাবতেই হৃদকোটরে মৃদ্যু হিমেল হাওয়ার উষ্ণতা ছড়িয়ে ভালোবাসার রাগিনী বেজে উঠছিলো সুরেলা শব্দে। মুহূর্তের মধ্যে আমার রঙ্গিন ভাবনা গুলোকে বিবর্ণতার রূপ দিয়ে চিএা বিক্ষুব্ধ হয়ে আমার গালে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিলো! পুরো ছাঁদ জুড়ে চড়ের প্রতিধ্বনি বেজে উঠছিলো ক্ষিপ্র শব্দে!

________________________________________________

ধরফড়িয়ে ঘুম ভেঙ্গে আমি লাফিয়ে উঠলাম। দিশেহারা হয়ে পুরো রুমটায় চোখ বুলিয়ে গ্রীলযুক্ত জানালায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই সকালের তেজর্শিনী রৌদ্র আমার অস্ফুট চক্ষু জোড়ায় অসম্ভব জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছিলো। প্রজ্বলিত চোখে আমি রুমের ডান পাশের দেয়ালটায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই ছোট্ট এক্রলিক ঘড়িটায় সকাল ৮ টার ঘন্টা টিক টিক শব্দে বেজে উঠল। কপালে উদয়স্ত বিন্দু বিন্দু ঘাম গুলো মুছে আমি চোখ জোড়ায় বেহিসেবী উদ্বিগ্নতা নিয়ে গাঁয়ে জড়ানো নকশিকাঁথাটা শরীর থেকে ছুড়ে ফেলে তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠে ডেস্কের উপর থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে আধো দৃষ্টিতে চিএার নাম্বারটায় ডায়াল করে অধৈর্য্য কন্ঠে বললাম,,

“ধ্যাত, ভোরের এতো স্নিগ্ধ স্বপ্নটার প্ররোচনায় পড়ে বড্ড দেরি হয়ে গেলো আমার ঘুম থেকে জাগতে৷ না জানি ওদিকে আবার চিএাকে আমার পূর্বেই না অন্য কেউ আবির পড়িয়ে দিলো!”

ইতোমধ্যেই রুমে দ্বিতীয় কারো উপস্থিতি আমার কর্ন কুহরে মিহিভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো। হৃদপিন্ডের লম্বচ্ছেদের ধমনী জুড়ে বিস্ফোরকের মতো কি যেনো টিপটিপ সুরে বাজছিলো। আমি হয়তো বুঝতে পারছি সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটাই নীরবে পা ফেলে আমার রুমে প্রবেশ করছে। ঠোঁটের আলিজে এক চিলতে প্রাণবন্ত হাসি ফুটিয়ে আমি পিছু ঘুড়ে তাকাতেই বিচলিত হয়ে মুহূর্তের মধ্যেই চোখ, মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলাম। হলি এ্যাটাক হয়েছে আমার উপর! চোখ সমেত হলির রঙ্গে রেঙ্গে উঠেছে আমার। চোখের যন্ত্রণায় নাজেহাল হয়ে আমি অতিষ্ঠতা নিয়ে চোখ কঁচলাতেই চিএা হু হা করে হেসে আমার চার পাশে চড়কির মতোন ঘুড়ঘুড় করে বলল,,

“হ্যাপি হলি আরাধ্য! এই প্রথম আমি বাজিতে জিতে গেছি৷ নিজ হাতে ঠিক তোকে আবির লাগাতে পেরেছি।”

রাগান্বিত হয়ে আমি চোখ বুজেই চোয়াল শক্ত করে বললাম,,

“তোর সাহস হলো কি করে চিএা? আমার গাঁয়ে আবির মাঁখানোর? ইউ নো হোয়াট, এই অব্দি আমার লাইফে কেউ কখনো আমাকে আবির মাখাতে পারে নি?”

চিএা ঝগড়ুটে কন্ঠে বলল,,

“হ্যাঁ জানি। তো কি হয়েছে? আমি মাখিয়েছি, রেকর্ড ভেঙ্গেছি। শোন? তোর উচিত ছিলো, এভাবে আমার সাথে এভাবে রাগ না দেখিয়ে, উল্টে আমাকে বাহবা দেওয়ার! কেনো বল তো? কারণ, তোকে আবিরের রঙ্গে নিঃসন্দেহে সুদর্শনের প্রতীক মনে হচ্ছে।”

জ্বালা ধরা চোখে আমি স্পষ্ট ভাবে সম্পূর্ণ চোখ খুলে চিএার দিকে অবলোকন করতেই আমার জেদটা যেনো মুহূর্তের মধ্যেই মাটিতে মিশে জল হয়ে গেলো। সাদা সালোয়ার কামিজ পরিহিতা শুভ্র পরীটা ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে আমার মুখ পানে চেয়ে আছে। কৃষ্ণ চুলে ঘন গুচ্ছ যুক্ত বেনুনিটা তার কাঁধ বেয়ে কোমড় অব্দি দোল খাচ্ছে। মুখের আদলের কোথাও কোনো আবিরের অস্তিত্ব মিলছে না। মাঝখানের সিঁথিটা ও ফাঁকা পড়ে আছে। ইসসস, মনে আমার আবির লেগে গেছে! এই দুনিয়ায় এখনো দ্বিতীয় কারো সাধ্য হয় নি আরাধ্যের আগে চিএাকে আবির পড়াবার। আবিরের প্রথম রঙ্গটা আরাধ্যই চিএাকে পড়াবে। চিএা তো পূর্বেই তার দায়িত্ব পালন করে নিলো। এবার দায়িত্বটা আমার, চুপিসারে চিএাকে আবির পড়াবার। সে যেনো কোনো ক্রমেই আমার চালাকি ঘুনাক্ষরে ও টের না পায়। ভোরের স্বপ্ন আমি সত্যি করেই ছাড়ব। অগোচড়ে চিএাকে আমার ভাগ্যের সাথে গাটছড়ায় বেঁধেই ছাড়ব!

চিএার থেকে চোখ ফিরিয়ে আমি বাঁ পাশে তাকিয়ে কর্কশ কন্ঠে বললাম,,

“রুম থেকে বের হ তুই। সকালটা মাটি করে দিয়েছিস আমার। আর কিছুক্ষণ আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো দেখা যাবে আমি তোর গলা টিপে দিয়েছি। রাগটা কিন্তু কিছুতেই সংবরণ হচ্ছে না আমার!”

চিএা রাগে গজগজ করে আমার সম্মুখস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে বাঁ পাশে আমার মুখের দিকে হেলে বলল,,

“খুব ভাব দেখানো হচ্ছে তাই না? খুব ভাব? এতো ভাব তুই কোত্থেকে পাস বল তো? নাকি নতুন শহরে গিয়ে এই চিএাকেই এখন পুরাতন লাগছে? ব্যাকডেটেড লাগছে খু্ব তাই না?”

তেজী চোখে আমি চিএার শান্ত হয়ে আসা দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,,

“রুম থেকে বের হতে বলেছি তোকে। এক্ষনি বের হবি তুই আমার রুম থেকে। এক কথা বারংবার রিপিট করতে কিন্তু আমার ভীষষষণ এক ঘেয়েমি লাগে। আগে ও বহুবার বলেছি, এখন ও বলছি।”

চিএা এক রোঁখা ভাব নিয়ে আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে মেরে বলল,,

“যাবো না আমি৷ কি করবি বল? বকবি আমাকে? মারবি আমাকে? এতো বড় সাহস হয়ে গেছে তোর?”

চিএার দিকে তেঁড়ে এসে আমি বাঁকা হেসে বললাম,,

“আমাকে উদোম শরীরে দেখতে তোর খুব ভাল্লাগছে তাই না? খুব ফিল নিচ্ছিস? তাই রুম থেকে বের হতে চাইছিস না এম আই রাইট? যদি তাই হয়, তবে ক্লিয়ারলি বলে দিলেই পারতিস। দরজার খিলটা আটকে আমি একদম তোর গাঁ ঘেঁষে দাঁড়াতাম, দুজনের তপ্ত শ্বাস এক যোগ হয়ে হৃদয়ে উষ্ণতার উত্তেজনা তৈরী করত। ব্যাপারটা খুব মাখো মাখো হতো। খুব কাছ থেকে ফিল করতে পারতিস আমায়। সিরিয়াসলি, দারুন এন্জ্ঞয় করতে পারতিস।”

চিএা কটমট চোখে আমার দিকে চেয়ে বলল,,

“আর কক্ষনো তোর রুমে আসব না আমি। কক্ষনো না! ইডিয়ট একটা। তোর রুমে আসাটাই আমার সব’চে বড় ভুল হয়েছে বুঝলি? তার’চে বড় ভুল হয়েছে তোকে আবির মাখানোটা। কাশিয়ানী থেকে ফিরে এসে তুই একদম পাল্টে গেছিস। পুরোপুরি পাল্টে গেছিস।”

অভিমানের পাহাড় নিয়ে চিএা আবির মাখা রঙ্গিন হস্তযুগল নিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে রুম থেকে প্রস্থান নিলো। পরক্ষনে আবার কি যেনো মনে করে চিএা দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সন্দিহান কন্ঠে বলল,

“এই আরাধ্য বল না? তুই আমাকে সত্যিই ভুলে গেছিস? তোর ছোট্ট বেলার এই ফ্রেন্ডটাকে ভুলে গেছিস? চিএাকে তুই একদম ভুলে গেছিস আরাধ্য?”

আমি ভাবশূণ্য হয়ে বললাম,,

“স্বাভাবিক! কারণ ওখানে তোর চেয়ে ঢেড় ভালো ফ্রেন্ড আমি খুঁজে পেয়েছি। জানিস? সে আমার খেলার কতো বড় ফ্যান? মানে তোকে বুঝাতে পারব না, সে আমার খেলার কতোটা অন্ধ ভক্ত। তুই তো কখনো আমার খেলা ধূলোকে পছন্দই করিস না!”

মন খারাপের মেঘে ছেঁয়ে গেলো চিএার সমগ্র মুখমন্ডল। পিছু ঘুড়ে চিএা রুম থেকে প্রস্থান নেওয়ার পূর্বে অভিমানী কন্ঠে বলল,,

“চিএা ও ঠিক তোর চেয়ে ঢেড় ভালো ফ্রেন্ড জুটিয়ে নিবে দেখিস! যে আমার নাচকে ভালোবাসবে। তুই ও আমার নাচকে পছন্দ করিস না তাই না?”

অল্প সময় থেমে চিএা পুনরায় বলল,,

“আর স্যরি হ্যাঁ? পার্মিশান ছাড়াই অনধিকার চর্চা খাঁটানোর জন্য। আবিরটা ধুঁয়ে নিস জল দিয়ে। চললাম আমি!”

আমি ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে পেছন থেকে চেঁচিয়ে বললাম,,

“তুই না বললে ও ধুঁয়ে নিবো ওকে? আর শুন, বাড়ির ছাঁদে দাঁড়া, আমি আসছি।”

“কোথাও দাঁড়াতে পারব না আমি। তোর জন্য তো একদমই না। দয়া করে আর পিছু ডাকবি না।”

চিএার পেছনটায় তেঁড়ে এসে আমি উচ্চ শব্দে বললাম,,

“তুই দাঁড়াবি না, তোর ঘাঁড় দাঁড়াবে।”

চিএা এক রোঁখা ভাব নিয়ে বলল,,

“বাড়ি যাচ্ছি আমি ওকে? কাজ আছে। বাবা হয়তো আমায় খুঁজছেন!”

“যা বলছি তাই কর! অযথা ঘাঁটাস না আমায় প্লিজ!”

চিএা নিরুপায় হয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,,

“দশ মিনিটের বেশি ওয়েট করতে পারব না আমি ওকে? যা করার তাড়াতাড়ি কর!”

চিএার যাওয়ার পথে কিছুক্ষণ মৌণ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে আমি পরক্ষণে মৃদ্যু হেসে পেছনের চুল গুলো হালকা টেনে বললাম,,

“তোর জন্যই তো আমার এতো বড় ম্যাচ ছেড়ে তড়িঘড়ি করে সমস্ত প্রতিকূলতা পেরিয়ে রাতের আঁধারে বাড়ি ফিরতে হলো চিএা। তোকে আবিরের রঙ্গে রাঙ্গাবো বলে! তোকে ঘিরে আমার হৃদ কুটিরে গুপ্তায়িত হাজারটা অনুভূতিকে আজ বাস্তবতার ছোঁয়ায় রাঙ্গিয়ে তুলব বলেই হন্ন হয়ে এতোটা পথ ছুটে আসা। তুই না এই জন্মে আমার জন্যে পুরাতন হবি না আগামী ৭ জন্মে! তোকে নিজের করেই তবে আমি স্থির মনে খেলার মাঠে ফিরব চিএা। বিশ্বাস কর, তোকে একা ছেড়ে, তোর থেকে এতোটা দূরত্বে গিয়ে কোনো ক্রমেই আমি খেলায় ফোকাস করতে পারছিলাম না। বার বার মনে হতো আমার অনুপস্থিতিতে না তুই অন্য কারো হয়ে যাস চিএা। তুই তো শুধু আমার চিএা, শুধুই আমার! সৃষ্টিকর্তার কাছে সবসময় প্রার্থনা করি জানিস? সৃষ্টিকর্তা যেনো আগামী সাত জন্মে ও তোর থেকে আমাকে আলাদা না করেন! আমার সাথেই যেনো গাটছড়ায় বেঁধে রাখেন।”

শাওয়ার নিতে ওয়াশরুমে প্রবেশ করলাম আমি৷ সাদা পাঞ্জাবি, পায়জামা পড়ে কিছু সময়ের মধ্যেই আমি শাওয়ার নিয়ে তড়িঘড়ি করে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলাম। সিক্ত চুলে ডেস্কের ড্রয়ার থেকে সিঁদুর কৌটোটা পায়জামার পকেটে পুড়ে আমি হম্বিতম্বি হয়ে তিন তলা বাড়ির ছাঁদে ছুটে এলাম। আমাদের বাড়ির ছাঁদ থেকে গলির প্রতিটা ছাঁদে স্পষ্টত ছেলে, মেয়ে, মহিলা, পুরুষ নির্বিশেষে দোল খেলার আনন্দঘন উৎসব অবলোকন করা যাচ্ছে। প্রকৃতি আজ দোলের আবিরে সেজে উঠেছে। সূর্যের তীর্যক কিরণের সাথে মৃদ্যুমন্দ হিমেল হাওয়ার প্রভাবে দোলের আবিরের মিশ্র রঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে এ ছাঁদ থেকে ও ছাঁদে। আবিররা ও একে অপরকে দোলের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। পুরো পাড়া জুড়ে হৈ,চৈ, হাসি, খুশির আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে। যে দিকটায় চোখ যাচ্ছে কেবলই সাদা রঙ্গ পরিহিত/পরিহিতা ছেলে, মেয়েদের কলরব দেখা যাচ্ছে। ডালে ডালে পাখিদের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। চারিপাশ থেকে দোলের নানান সুরের সঙ্গীত ভেসে আসছে। সঙ্গীতের তালে তালে নেচে উঠছে কিশোর-কিশোরীরা।

পুরো ছাঁদটায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই কাজিনদের হৈ, হুল্লোড় চোখে পড়ল। চার চারটে কাজিন আমার। মেঝো কাকুর দু কন্যা। জৈষ্ঠ্য কন্যার নাম শর্মিষ্ঠা, কনিষ্ঠ কন্যার নাম শর্মিলা। ছোট কাকুর এক কন্যা এবং এক পুএ। জৈষ্ঠ্য পুএের নাম সৌরভ, কনিষ্ঠ কন্যার নাম সুদীপ্তা। তাদের পাশে আবার আম্মু এবং আমার দুই কাকিমনি ও পড়নে লাল পাড়ের কাপড় পরিহিত অবস্থায় সিঁথিতে গাঢ় এবং দীর্ঘ সিঁদুর পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আবির নিয়ে সবাই খুব মাতামাতি করছে। একে অপরকে আবিরের রঙ্গে মিশ্র ভূত বানানোর জোগাড়ে তৎপর হয়ে উঠছে। আমার অস্তিত্ব এখনো কেউ টের পায় নি। নতুবা এতক্ষনে সবাই আবিরের থালা হাতে নিয়ে আমাকে পুরো পাড়ায় ধাওয়া করত! পুরো পাড়া জুড়ে আবারো নুতন করে হৈ, চৈ, হট্টগোলের উদ্ভব হতো!

পা টিপে হেঁটে আমি ছাঁদের ফ্লোরে রাখা আবিরের থালা থেকে এক মুঠো লাল আবির হাতে নিয়ে কৌটো ভর্তি সম্পূর্ণ সিঁদুরটা লাল আবিরে মিশিয়ে নিলাম। মহা গুপ্ত কাজটা সেরে আমি উতলা চোখে চিএাকে খুঁজতে লাগলাম। ছাঁদের পশ্চিম পাশের বাগান বিলাসের সামনাটায় চিএা গম্ভীর ভাব নিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার কাজিনদের কাছে ঘেঁষছে না পর্যন্ত৷ সব’চে আশ্চর্যের বিষয় এই হলো, চিএা এখনো বির্বণ অবস্থাতেই আছে! আবিরের কোনো রঙ্গ লাগে নি তার গাঁয়ে। প্রতিবার তো চিএার এতক্ষণে দু বার আবির স্নান হয়ে যায়। তবে আজ কেনো সে নিরাগ, রঙ্গহীন? অতি আশ্চর্যিত হয়ে আমি চোখে, মুখে কৌতুহলী ভাব নিয়ে চিএার পেছনে দাঁড়িয়ে ছোট কন্ঠে চিএাকে ডেকে বললাম,,

“এই চিএা শোন?”

চিএা পিছু ঘুড়ে তাকালো। চোখে, মুখে তার নিদারুন বিষাদের ছাপ। গম্ভীর ভাব নিয়ে আমি প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চিএাকে বললাম,,

“চোখে তো গোঁটা একটা শ্রাবণ নিয়ে বসে আছিস। হয়েছে কি বল তো?”

চিএা ব্যাকুল নয়নে আমার দিকে চেয়ে জিগ্যাসু কন্ঠে বলল,,

“তুই আমার জন্য গোপালগঞ্জ আসিস নি তাই না আরাধ্য? আমাকে তুই সত্যিই ভুলে গেছিস?”

আমি গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে বললাম,,

“তুই আমার কে হুম? তোর জন্যই কেনো আমাকে গোপালগঞ্জ আসতে হবে? তাছাড়া তোকে মনে রাখার তো বিশেষ কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না আমি। তুই আমার বিশেষ কে হস শুনি?”

চিএা হেয় হেসে বলল,,

“সেই তো! আমি তোর বিশেষ কে হই? বন্ধুত্বের সম্পর্কটা এই ৫ মাসের ব্যবধানে এতোটা কাঁচের মতোন ঠুনকো হয়ে দাঁড়াবে তা আমি দুঃস্বপ্নে ও ভাবতে পারি নি!”

ম্লান হেসে আমি আবিরে মাখা সিঁদুরটা নিঃসংকোচে চিএার সিঁথিতে দীর্ঘ এবং গাঢ় করে বিবাহিত মহিলাদের মতোন পড়িয়ে বললাম,,

“হ্যাপি হলি চিএা!”

চিএা বিমূর্ষিত হয়ে ফ্যাল ফ্যাল চোখে আমার দিকে চেয়ে উচ্চ শব্দে চেঁচিয়ে বলল,,

“এ তুই কি করলি আরাধ্য?”

ভ্রু যুগল কুঁচকে আমি সাবলীল কন্ঠেই বললাম,,

“কি করলাম আবার? আবির পড়ালাম তোকে! এতে এতো বিস্মিত হওয়ার কি আছে?”

আবেগে আপ্লুত হয়ে মনে মনে বলছিলাম,,

“আজ থেকে তুই আমার অর্ধাঙ্গিনী চিএা! স্বপ্ন আমার সত্যি হয়েছে! ভোরে দেখা স্বপ্নটা আমি সত্যি করে দেখিয়েছি। আমার মনে বেড়ে উঠা গরিষ্ঠ শঙ্কা গুলোকে আমি খুব সহজেই নিশ্চিহ্ন করতে পেরেছি। আজ থেকে আমি নিশ্চিন্ত মনে তোর থেকে হাজার মাইল দূরত্বে অবস্থান করে ও প্রখর শান্তিতে প্রতিটা দিন উপভোগ করতে পারব। প্রতিটা রাত স্বস্তিতে কাটাতে পারব। “উপযুক্ত সময় হলেই তবে আমি এই চিরন্তন সত্যিটা সবার সামনে তুলে ধরব। জাত, বাতের পার্থক্য খুঁজতে আসব না। আমার মহাকাশ সমান ভালোবাসায় জাত, বাতের কোনো প্রশয় নেই।” ঐদিন তুই ও খুব অবাক হয়ে যাবি চিএা। খুশিতে হয়তো উন্মাদ হয়ে যাবি!”

চিএা মুখে হাত দিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে আমার পানে চেয়ে বলল,,

“বাড়ির সবাই দেখলে কি ভাববে আরাধ্য? তুই সোজা আমার সিঁথিতে আবির পড়িয়ে দিলি? জেঠু শুনতে পেলে তোকে ভীষণ বকবেন আরাধ্য। জেঠিমনি ও কম কথা শুনবেন না! এমনিতেই তোর সাথে আমার মেলামেশাটা জেঠু তেমন পছন্দ করেন না। এই বিষয়টা জানতে পারলে জেঠু হয়তো সরাসরি আমার বাবার কাছে নালিশ জানাবেন। আমার ধৃষ্টতায় বাবা ভীষণ কষ্ট পাবেন আরাধ্য।”

ইতোমধ্যেই আম্মু এবং কাকীমারা হুড়মুড়িয়ে এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়ালেন। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আম্মু চিএার সিঁথিতে চেয়ে প্রশ্নবিদ্ধ কন্ঠে আমাকে বললেন,,

“অবিবাহিত একটা মেয়ের সিঁথিতে তুই আবির পড়িয়ে দিলি আরাধ্য?”

আমি রাগান্বিত কন্ঠে বললাম,,

“আম্মু প্লিজ প্রতিবারই তো আমি চিএাকে আবির মাখিয়ে দেই। আজ এতো অবাক হওয়ার কি আছে এতে? এতো উদ্বিগ্নতার ই বা কি আছে?”

আম্মু চোখ জোড়া প্রকান্ড করে আমার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললেন,,

“বেছে বেছে তোকে চিএার সিঁথিতেই কেনো আবির পড়াতে হলো আরাধ্য? তুই চাইলে তো প্রতিবারের মতো চিএার শরীরের অন্যান্য অঙ্গ প্রতঙ্গে ও আবির পড়াতে পারতিস!”

আমি তটস্থ কন্ঠে বললাম,,

“মনে হলো এবার সিঁথিতে পড়ানো উচিত, তাই পড়িয়ে দিলাম। তোমাদের এতো ব্যস্ত হওয়ার কি আছে?”

চিএা নিষ্পলক দৃষ্টিতে কিছু মুহূর্ত আমার দিকে চেয়ে থেকে ছাঁদ থেকে প্রস্থান নেওয়ার পূর্বেই আমার বাবা “নির্মলেন্দু সেনগুপ্ত” আকস্মিক চিএার সম্মুখে পড়লেন। কপালে লাল টিকা পড়ে বাবা এক হাতে ধুুঁতি সামলে খড়তড় চোখে চিএার সিঁথিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললেন,,

“অবিবাহিত মেয়ের সিঁথিতে আবির কেনো? কে পড়িয়েছে এই আবির?”

চিএা ভয়ার্ত চোখে বাবার দিকে চেয়ে শুকনো ঢোক গিলল। আম্মু ভীষন আতঙ্কিত হয়ে আমার ডান হাতটা চেঁপে ধরে ফিসফিসিয়ে বললেন,,

“ভুলে ও বলিস না তুই পড়িয়েছিস আবিরটা। বিষয়টা আমি সামলে নিচ্ছি।”

আম্মুর হাতটা ছাড়িয়ে আমি এক রঁখা ভাব নিয়ে বললাম,,

“সত্যি কথাটা মুখে স্বীকার করতে অন্তত আমার কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই আম্মু। আমাকে সত্যিটা বলতে দাও!”

দ্রুত পায়ে হেঁটে আমি বাবার সম্মুখীন হতেই পেছন থেকে শর্মিষ্ঠা উচ্চ শব্দে চেঁচিয়ে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল,,

“জেঠু, আরাধ্য দাদাই চিএা দিদির সিঁথিতে আবির পড়িয়েছে। কাজটা মোটে ও যর্থাথ হয় নি জেঠু। আরাধ্য দাদা যথেষ্ট নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছেন!”

চিএার থেকে চোখ ঘুড়িয়ে বাবা আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই আমি নতজানু হয়ে ম্লান কন্ঠে বাবাকে বললাম,,

“বন্ধু ভেবে আমি চিএার সিঁথিতে আবির পড়িয়েছি বাবা। এতে আমার কোনো নির্বুদ্ধিতা বা দুঃসাহসিকতার ও প্রকাশ পায় না। বিষয়টা নিতান্তই ক্ষুদ্র এবং স্বাভাবিক। আমরা এই স্বাভাবিক বিষয়টাকেই, অস্বাভাবিক ভেবে বৃহৎ অর্থে দেখছি। আমার মনে হচ্ছে আমার সকলেই এখানে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিচ্ছি।”

বাবা কঠোর কন্ঠে চিৎকার করে বললেন,,

“তোমার সাহস দেখে আমি আশ্চর্য না হয়ে পারছি না আরাধ্য। প্রথমত, এই ছোট জাতের মেয়েটাকে আমার মোটে ও পছন্দ না, দ্বিতীয়ত মেয়ের চাল চুলন ও আমার পছন্দ না, তৃতীয়ত মেয়েটার সাথে তোমার অবাধে মেলামেশাটা ও আমার নিতান্তই পছন্দের বাইরে। তার উপর কি করলে তুমি? সরাসরি মেয়েটার সিঁথিতে আবির পড়িয়ে দিলে? মেয়েটা যদি হঠাৎ দাবি করে বসে তুমি আবির নয় সিঁদুর পড়িয়েছ মেয়েটার সিঁথিতে! তখন এর দায় কে নিবে? তুমি নিবে? না আমার গোঁটা পরিবার এর দায় নিবে?”

রাগান্বিত হয়ে আমি মাথা তুলে বাবাকে কিছু বলার পূর্বেই চিএা কান্নাজড়িত কন্ঠে বাবাকে বলল,,

“আমার ভুল হয়ে গেছে জেঠু। আর কখনো আমি আপনাদের বাড়ির চৌকাঠে পা রাখব না এমনকি আরাধ্যের সাথে ও মেলামেশা করার দুঃসাহস দেখাব না। দয়া করে, আমার জাত, স্বভাব, চরিএ এবং আমার সতীত্বকে নিয়ে এই কঠিন প্রশ্ন গুলো তুলবেন না জেঠু। আরাধ্য কেবলই আমার একজন ভালো বন্ধু। বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে আমি আবিরকে সিঁদুর ভেবে এতোটা গুলিয়ে ফেলতে পারি না!”

খিটখিটে মেজাজে আমি চিএার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,

“শাট আপ চিএা। ইউ জাস্ট শাট আপ। বাবার সাথে আমি কথা বলছি তো। আমাদের কথার মাঝে খানে তোর প্রবেশ নিষিদ্ধ!”

#চলবে….?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here