#শ্রাবণ_আঁধারে
#পর্ব_১৩
#নিশাত_জাহান_নিশি
তব্দিত হয়ে আমি ফোনটা কান থেকে সরিয়ে চোখ জোড়া কৌতুহল নিয়ে স্ক্রীনের দিকে তাকাতেই হিংমাশুর ফোন নাম্বারটা অবলোকন করতে পারলাম। হুড়মুড়িয়ে বসা থেকে উঠে আমি সিগারেট দুটো মাটিতে পিষে পাঞ্জাবিটা কোনো রকমে গাঁয়ে জড়িয়ে আতঙ্কে বশীভূত হয়ে ছুটে চললাম গোপালগঞ্জ বাজারের উদ্দেশ্যে!
বড় রাস্তার মোড় থেকে রিকশায় উঠে আমি গোপালগঞ্জ বাজার পৌঁছাতেই পুরো বাজারটা ফাঁকা দেখলাম। হাতে গোনা দু, চারজন লোক গোলাকৃতির হয়ে বাজারের এক কোনায় ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। আবছা আলোতে বুঝাই যাচ্ছে তারা হাত নাঁড়িয়ে, চোখে, মুখে ভর আতঙ্ক নিয়ে নিজেদের মধ্যে কোনো সিরিয়াস বিষয় নিয়ে খুব চর্চা করছেন। শুকনো মুখে আমি দৌঁড়ে গেলাম দু, চারজনের ভীড়ে। পেরেশানগ্রস্থ অবস্থায় আমাকে দেখা মাএই আমাদের পাশের বাড়ির সুনীল দা উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন,,
“এইমাএ এখানে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিলো আরাধ্য। খুব রক্তক্ষরন হয়েছিলো ছেলেটার। আমার মনে হয় না ছেলেটা বাঁচবে! মাথাটা পুরো দমে থেতলে গেছে। ট্রাক ড্রাইভার পালিয়েছে অলরেডি। অটো ড্রাইভার ও সাংঘাতিক ভাবে আহত হয়েছে। বাঁচবে কিনা সন্দেহ। ”
আমি কাঠ কাঠ গলায় বললাম,,
“ছেছেছেলেটা কোথায়?”
“মুন হসপিটাল। এইতো পাশের হসপিটালটা।”
পায়ে হেঁটে চললাম আমি হসপিটালের উদ্দেশ্যে। আশা করছি ১০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাবো। যেতে যেতে শুধু একটা কথাই কানে বাজছিলো, চিএা ঠিক এই ভয়টাই পেয়েছিলো! চিএা নিশ্চয়ই জানত, মুখ খোলার সাথে সাথেই কারো না কারো কোনো না কোনো একটা ক্ষতি তো নিশ্চয়ই হবে। শতভাগ নিশ্চিত আমি, চিএা বড় কোনো ষড়যন্ত্রে ফেঁসে গেছে। যে করেই হোক, চিএাকে আমার এই ষড়যন্ত্র থেকে বের করে আনতে হবে। খুব দ্রুত রহস্যের জট খুলে, চিএাকে এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি থেকে মুক্ত কর আনতে হবে।”
,
,
এক ঘন্টা পর।
হসপিটালের মর্গে হিমাংশুর লাশের পাশে পাথর মূর্তি ধারণ করে বসে আছি আমি। একটু পূর্বেই হিমাংশুকে ডক্টররা মৃত ঘোষণা করেছেন। কেনো জানি না, হিমাংশুর আঙ্গুল থেকে আমার আঙ্গুলটা ছাড়াতে চাইছি না আমি। ফ্যাল ফ্যাল চোখে শুধু হিমাংশুর রক্তমাখা মুখটা দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছি। কেনো জানি না, হাতে গোনা মাএ কয়েকটা মুহূর্তের সমষ্টিতে হিমাংশুকে আমি এতোটা আপন ভেবে নিয়েছি। চোখ দুটো অসম্ভব রকম জ্বালা করছে আমার। হয়তো কান্নার পূর্বাভাস পাচ্ছি। এই বুঝি জীবনে প্রথমবার, চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল বলে! সেই সম্ভাবনাতেই হয়তো মগ্ন হয়ে বসে আছি আমি৷ নিজের চোখের জল দেখব বলে, নতুন একটা অভিজ্ঞতা অর্জন করব বলে!
হিমাংশুর পরিবার আমার আশেপাশে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছেন। মৃনালীর পরিবার ও অবশ্য উপস্থিত। মৃনালীর মা এবং বাবা এক কোণায় ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছেন। পাথর মূর্তি ধারণ করেছেন উনারা। গতিবিধি টের পাওয়া যাচ্ছে না মোটেও। আমি উপলব্ধি করতে পারছি, কানে কানে যেনো হিমাংশু আমায় বলছে,,
“মৃনালীর হত্যার ন্যায় চাই আমি আরাধ্য। আমাকে প্ল্যানিং করে যেভাবে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, তার ও ন্যায় চাই আমি।প্লিজ আরাধ্য, আমাদের ন্যায় দাও প্লিজ!”
মাথাটা ফট করে ধরে এলো আমার। মনে হচ্ছে মস্তিষ্কে অক্সিজেন সমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এইবার খুব সূঁচালোভাবেই আমার থেমে থাকা মস্তিষ্কের বিকিরণ ক্ষমতা সক্রিয় হতে চলেছে। অগ্নিরূপ ধারণ করা চোখ দুটো নিয়ে আমি বসা থেকে উঠে হিমাংশুর হাতটা ছাড়িয়ে মর্গ থেকে বের হয়ে রিকশা নিয়ে সোজা চিএার বাড়ি চলে এলাম। কাকু উনার বিছানার এক কোণায় গভীর ঘুমে তলিয়ে আছেন। চিএা রুমের দরজা উন্মুক্ত রেখে বিছানার উপর হাঁটু ভাজ করে ফুঁফিয়ে কাঁদছে। চট জলদি রুমের দরজাটা আটকে আমি চিএার মুখোমুখি বসে চোয়াল শক্ত করে কিছু বলার পূর্বেই চিএা হাঁটু থেকে মুখ তুলে অশ্রুসিক্ত চোখে গলা জড়ানো কন্ঠে আমায় বলল,,
“আমি সব বলছি আরাধ্য। আজ না বললে হয়তো আর কখনোই বলতে পারব না। যদি ও বেঁচে থাকি আজীবন আমাকে এই দুটো প্রাণের দোসর হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। এর’চে তো মৃত্যু শ্রেয়। চোখ বুজে বরণ করে নেওয়া উচিত আমার মৃত্যুকে!”
চোখ রাঙ্গিয়ে আমি চিএাকে বললাম,,
“সত্যিটা বল শুধু৷ যে রহস্য গুলো লুকিয়ে আছে ঠিক তাই তাই বল। পেছনের অতিরিক্ত কথা বাদ দিয়ে, অপ্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গ না তুলে।”
চিএা কান্না থামিয়ে হেচকি তুলে বলল,,
“প্রায় ৬ মাস পূর্বে, হঠাৎ আমার দুটো টিউশনিই চলে যায়। বাবা জানতেন না অবশ্য টিউশনি গুলো হাত ছাড়ার কথা। জানতে পারলে বাবা ভীষণ দুঃশ্চিন্তায় পড়ে যেতেন। চিন্তায় চিন্তায় আরো অধিক অসুস্থ হয়ে পড়তেন। এমন দুঃসহ অবস্থায় নতুন করে বাবার হার্টের ব্যামো ধরা পড়ে। একা একজন মেয়ে হয়ে এতো টাকার ঔষধ খরচ কিভাবে চালাবো তাই আমার মাথায় কুলোচ্ছিলো না। খুব দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলাম তখন। তুই ও আমার এই দুর্দিনে কাশিয়ানী ছিলি, মাসে একবার ও ঠিক মতো যোগাযোগ হতো না আমাদের। তোকে আমার সমস্যার কথা গুলো ও খুলে বলতে পারছিলাম না আমি। যদি ও জানতাম, আমার অসহনীয় পরিস্থিতি গুলো তোকে বর্ণনা করা মাএই তুই আমাকে সাহায্য করতে ছুটে আসবি। তবু ও খুব হীনমন্যতা করছিলো তখন। কোন অধিকারে আমি তোর থেকে সাহায্য চাইতাম বল? তখন তো তোর উপর আমার কোনো অধিকার ই ছিলো না। খুব দুঃশ্চিন্তায় থাকতাম তখন, চুপচাপ, মনমরা হয়ে গিয়েছিলাম পুরো। এসবের মাঝে একদিন একাডেমীর প্রফেসর, ” শুকলা স্যার” উনার বাড়িতে আমাকে ডেকেছিলেন। আমি ও উনার ডাকে সাড়া দিয়ে উনার বাড়ি যাই। বাড়ি গিয়ে জানতে পারি, উনি একজন কাজের মহিলা খুঁজছেন। শুধুমাএ রান্নার কাজটার জন্য। অবিবাহিত পুরুষ, উনার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না নিজে রান্না করে খাওয়াটা। অন্ধকারের মাঝে ও আমি যেনো আশার আলো দেখছিলাম। হাসিমুখে আমি স্যারকে বললাম, “আমিই রান্নার কাজটা নিবো। মাসে মাসে দু হাজার টাকা দিলেই হবে।” স্যার রাজি হয়ে গিয়েছিলেন, শুধু তাই নয়, মাসে ২ হাজারের বদলে উনি আমায় ৩ হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বিষয়টা প্রথমে আমার সন্দেহের ঠেকলে ও ঐ দুঃসময়ে এতো বড় সুযোগটা কিছুতেই হাত ছাড়া করতে চাইছিলাম না আমি৷ নির্দ্বিধায় খুশি মনে রাজি হয়ে গেলাম। কথা অনুযায়ী পরের দিন থেকেই রান্নার কাজে লেগে পড়লাম আমি। টিউশনির টাইম গুলোতে আমি বাড়ি থেকে বের হতাম, রান্না বান্না সেরে ঠিক সময়ে বাড়ি ফিরে আসতাম। বাবা ও সন্দেহ করতেন না তখন। ভাবতেন আমি টিউশনি থেকে ফিরছি। পাঁচ মাস দিব্যি চলছিলো এভাবে। মাঝখানে তোর সাথে আমার বিয়েটা হলো। এরপর তুই আবার কাশিয়ানী ফিরে গেলি। কাজের কথাটা আসলে আমি কাউকে জানাতে চাইছিলাম না তখন। যেমন কুন্ঠা কাজ করছিলো, তেমনি লজ্জাবোধ। তাছাড়া, কাজের কথাটা শুনলে তুই খুব বকবি আমায়, তাই ভয় থেকে বলি নি কিছু।”
ফুসফুসে একবার দম সঞ্চার করে চিএা পুনরায় বলল,,
“মৃনালীর সুইসাইডের এক সপ্তাহ পূর্বে হঠাৎ করেই শুকলা স্যার বললেন, এবার থেকে সন্ধ্যায় আমাকে কাজে আসতে হবে। উনার চারজন বন্ধু এবার থেকে উনার সাথে থাকবে। মোট পাঁচজনের রান্না করতে হবে। প্রথম অবস্থায় বিষয়টাতে আমি নারাজ থাকলে ও পরবর্তীতে রাজি হয়ে যাই। এছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না আমার। ভাবছিলাম, কোনো রকমে দু, এক মাস কাজটা করে নেই, এরপর তো তোর সাথে আমি কাশিয়ানীতেই ফিরে যাবো। তখন তুই আমাদের ঢাল হয়ে দাঁড়াবি। মোটে ও আমার কাজ করতে হবে না তখন। বাবার ঔষধ খরচ ও জোগাড় করার জন্য আমাকে এতোটা টেনশান করতে হবে না। প্রতিদিন নাচের ক্লাস শেষে আমি উনার বাড়ি যাওয়া আসা শুরু করি। সকালে টিউশনির টাইম গুলোতে পুরো পাড়া ঘুড়ে বাড়ি ফিরে এসে বলতাম, টিউশনি থেকে ফিরেছি। বাবা ও বিশ্বাস করে নিতেন। কখনো কোনো রকম সন্দেহ করতেন না। মোট পাঁচ জনের রান্না সেরে রাত ৭টা, ৮টা নাগাদ আমি বাড়ি ফিরতাম। বাবাকে বলতাম আমার এক্সট্রা নাচের ক্লাস চলছে তাই দেরি হচ্ছে। এর মাঝেই হঠাৎ একদিন মৃনালী বলল, শুকলা স্যারের বাড়িটা দেখার খুব শখ তার। বাইরে থেকে বাড়িটা দেখতে এতো সুন্দর, ভেতর থেকে দেখতে না জানি কতোটা সুন্দর হবে। মৃনালীর অনুরোধ রাখতে আমি মৃনালীকে নিয়ে স্যারের বাড়ি যাই। ঐ দিন স্যার সহ স্যারের চারজন বন্ধু তুখাড় ড্রাংক অবস্থায় ছিলেন। ভয়ে ভয়ে আমি মৃনালীকে নিয়ে সোজা রান্না ঘরে ঢুকে যাই। রান্না শেষে মৃনালীকে পুরো বাড়িটা দেখিয়ে মৃনালীসহ বাড়ি থেকে বের হতেই স্যার সহ স্যারের চার বন্ধু আচমকা আমাদের ঘিরে ধরেন৷ হিংস্র চাহনীতে চোখ দিয়েই আমাদের খাবলে খুবলে খেয়ে নিচ্ছিলেন ঐ জানোয়ার গুলো। ভয়ে আমরা দুজনই কাঁদতে শুরু করি, জোরে জোরে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করি, নিজেদের সম্মান বাঁচাতে তাদের পা দুটো চেঁপে ধরতে ও কুন্ঠাবোধ করি নি। কিন্তু তারা আমাদের রেহাই দেয় নি আরাধ্য। পাঁচ নরপশু মিলে আমার সামনে মৃনালীকে প্রথমে ধর্ষণ করে। সেই ধর্ষণের ভিডিও রেকর্ড করে। অতঃপর তারা আমার উপর হামলে পড়ে। সবাই পালাক্রমে আমাকে ধর্ষণ করতে চাইলে ও শুকলা জানোয়ারটা তাদের থামিয়ে উনি একাই আমাকে…..”
চিএা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। খেয়াল করলাম এই প্রথম আমার চোখ থেকে টলটলিয়ে জল পড়ছে৷ চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে আমার। আটকে রাখতে পারছিলাম না আমি নিজেকে। চিএার মতো আমি ও ফুঁফিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করলাম। চিএা কম্পিত কন্ঠে পুনরায় বলল,,
“আমার ধর্ষণের ভিডিও তারা রেকর্ড করে নেয়। আর হুমকি দেয় এই ব্যাপারে যেনো কাউকে কিছু না বলি৷ মুখ খুললেই ভিডিও গুলো ভাইরাল হতে দু সেকেন্ড সময় লাগবে না। আত্নহত্যা ছাড়া তখন কোনো উপায় থাকবে না আমাদের। এছাড়া ও আমাকে শর্ত দেওয়া হয়, রোজ যেনো আমি শুকলা জানোয়ারটার চাহিদা মেটাতে আসি। আমাকে রোজ তার পাশবিক অত্যাচার সহ্য করতে হবে। যদি আমি ভুল ক্রমে ও এই বিষয়টা কাউকে জানাই তবে উনি সেই ব্যক্তিটাকেই জানে শেষ করে দিতে পিছপা হবেন না। হাত অনেক প্রশ্বস্ত উনার। বড় বড় এমপি, মন্ত্রীদের সাথে নিয়মিত উঠাবসা উনার। চুপ হয়ে যাই আমি। কলঙ্ক মাথায় নিয়ে মৃণালীকে নিয়ে মৃনালীর হলে ফিরে যাই৷ মেয়েটা একদম থম মেরে গিয়েছিলো। পাথর আর তার মধ্যে কোনো পার্থক্যই খুঁজে পাচ্ছিলাম না তখন। বুঝিয়ে শুনিয়ে মৃনালীকে হলে রেখে আমি বাড়ি ফিরে আসি। নিজেকে তখন আমি খুব কঠিন অবস্থায় রাখি। খুব যত্ন করে নিজেকে সামলে রাখি। ভয়ে, আতঙ্কে মুখ খোলার চেষ্টা টা ও পর্যন্ত করি নি আমি। আমি যতোটা শক্ত ছিলাম, মৃনালী ততোটাই ভেঙ্গে পড়েছিলো। পরের দিন জানতে পারি মৃনালী সুইসাইড করেছে! সুইসাইড নোটে মৃনালী আমার নামটা লিখে গিয়েছিলো জানতে পেরেই শুকলা এবং উনার সঙ্গিরা পাগল হয়ে যান। উনারা জানতেন, পুলিশ যদি আমাকে জেরা করেন তবে আমি সত্যিটা বলে দিতে বাধ্য হবো। আর উনারা ও তখন বাজেভাবে ফেঁসে যাবেন। তাই মুহূর্তের মধ্যেই পুলিশকে হাতিয়ে উনারা কেইসটা ঘুড়িয়ে নেন। আমি ও তখন বেঁচে যাই। তোকে ঐ দিন আমার রুমে দেখে অফিসার কিছুটা সন্দেহ করে বিষয়টা শুকলাকে জানান। শুকলা তখন আমাকে আরো প্রখরভাবে হুমকি দিতে শুরু করলেন, তোকে যেনো এই বিষয়ে কিছুই অবগত না করি আমি। যদি আমি ভুলে ও তোকে কিছু জানাই উনি সাথে সাথে বাধ্য হবেন তোকে খুন করতে। তোকে হারানোর ভয়ে আমি রোজ শুকলার অত্যাচার সহ্য করে আসছিলাম আরাধ্য। ভীষণ যন্ত্রণা হয় জানিস? খুব কষ্ট দেয় ঐ লোকটা আমায়। তোর কাছে এসেই আমি একটু সুখ খুঁজে পাই। গত দুই মাস ধরে আমি কিছু খেতে পারছি না আরাধ্য। খুব বমি বমি ভাব হচ্ছে। পিরিয়ড ও মিস হচ্ছে। বোধ হয় গর্ভে কোনো নতুন প্রাণের সঞ্চার হচ্ছে। শুকলা ঐ দিনই আমাকে মুখ খুলে বললেন, উনার বাড়িতে কাজ করার প্রায় তিন মাস পর থেকেই উনি মাসে একবার হলে ও আমাকে ইউজ করতেন৷ জলের সাথে ঘুমের ঔষধ মিক্স করে উনি আমার সুযোগ নিতেন। প্রায় ৩ থেকে ৪ দিন আমি ঐ বাড়িতে নিজেকে ঘুমন্ত অবস্থায় আবিষ্কার করেছিলাম। প্রতিবার ভেবেছিলাম হয়তো কাজ করতে করতে চোখ লেগে গিয়েছিলো। তখন উনাকে সন্দেহ হতো না কারণ, সকালে আমি যখন উনার রান্নার কাজে যেতাম, তখন উনাকে একদিন ও বাড়িতে দেখতে পাই নি। সিকিউরিটি গার্ডের কাছে বাড়ির চাবি দিয়ে উনি চলে যেতেন। হয়তো আগে থেকেই উনি জলের গ্লাসে ঘুমের ঔষধ মিক্স করে রাখতেন। যখনই আমি জলটা খেতাম তখনই সুযোগ বুঝে উনি রুমে ঢুকে আমার সর্বনাশ করে চলে যেতেন!”
ফুঁফিয়ে কেঁদে আমি মুহূর্তের মধ্যে চিএাকে ঝাপটে ধরে আধো কন্ঠে বললাম,,
“চুপ কর চিএা। প্লিজ চুপ কর৷ আর কিছু বলতে হবে না তোকে। বিশ্বাস কর, আমি আর নিতে পারছি না। তুই বলেছিলি না? যেদিন আমি চোখ ভাসিয়ে কাঁদতে পারব, ঐ দিন আমাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে? দেখ আজ আমি কাঁদছি চিএা। দু চোখ ভাসিয়ে কাঁদছি। থামতে ইচ্ছে করছে না মোটে ও। তোর সাথে হওয়া অন্যায়ের সুবিচার আমি নিশ্চিন্ত করেই তবে শান্ত হবো চিএা। সাথে মৃনালী এবং হিমাংশুর ও। তুই শুধু ধৈর্য্য রাখ। দেখ, আমি কি কি করি। তোর জন্য কতোটা কি করতে পারি।”
একবার দম নিয়ে আমি পুনরায় ফুঁফিয়ে কেঁদে বললাম,,
“তোর গর্ভে যদি অন্য কারো সন্তান এসে ও থাকে না চিএা? তোকে মেনে নিতে আমার এক মুহূর্ত ও ভাবতে হবে না। সেই সন্তান সহ আমি তোকে মেনে নিতে প্রস্তুত চিএা৷ তোর গাঁয়ে হাজার কলঙ্ক লাগলে ও আমি মানিয়ে নিবো। তোর ভালো, মন্দ সব মিলিয়েই তো আমি তোকে ভালোবেসেছি, বিয়ে করেছি। তুই এসব নিয়ে একদম চিন্তা করবি না চিএা। হতাশ হবি না, কাঁদবি ও না। কাঁদবে তো ঐ নরপশু রা, শাস্তি তো পাবে তারাই। কঠোর শাস্তি পাবে তারা, তুই জাস্ট দেখে যা। তোর জন্য তোর আরাধ্য কতোটা লড়তে পারে, কতোটা ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে, কতোটা ভয়াল এবং হিংস্র হতে পারে।”
চিএা তার শরীরের সমস্ত ভার আমার গাঁয়ে ছেড়ে দিয়ে নির্লিপ্ত নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,,
“তুই আমাকে মেনে নিলে ও সমাজ আমাকে মেনে নিবে না আরাধ্য৷ জানিস অনেকবার চেষ্টা করেছিলাম, নিজেকে শেষ করে দিতে, আত্নহত্যা করতে। কেনো জানি না, বার বার থেমে গেছি। বাবার কথা ভেবে, তোর কথা ভেবে। তোরা তো আমাকে ছাড়া বাঁচবি না বল? একমাএ তোরাই তো আমাকে নিজেদের সবটা দিয়ে ভালোবাসিস। তোদের ছেড়ে আমি কিভাবে যাই বল? দারুন দ্বিধা দ্বন্ধে ভুগছিলাম তখন। নিজেকে শক্ত করে রাখছিলাম প্রতিনিয়ত। আত্নহত্যা পাপ বলে দিনের পর দিন সব অন্যায় অত্যাচার সহ্য করে গেছি। নিজের সম্মান পর্যন্ত বিলিয়ে দিয়েছি নির্দ্বিধায়। ব্যাস অনেক হয়েছে আরাধ্য৷ নিজেকে আর শক্ত করে রাখতে পারছি না আমি৷ মৃনালীর সুইসাইড এবং হিমাংশু সেনের মৃত্যু দুটোই আমার ভুলের কারণে হয়েছে। ঐ দিন যদি আমি মৃনালীর কথা রাখতে মৃনালীকে নিয়ে শুকলার বাড়ি না যেতাম, তাহলে হয়তো তারা দুজনই আজ বেঁচে থাকত৷ তাদের কাউকেই অকালে মরতে হতো না। মৃনালীকে ও ললাটে কলঙ্ক মেখে পরপারে পাড়ি জমাতে হতো না। আমিই তাদের প্রাণের দোসর আরাধ্য। আমি যে নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারব না। জীবনের কাছে যে আমি ঠকে গেছি আরাধ্য। অসহায়তা আমাকে মুখ থুবড়ে শূণ্যে তলিয়ে দিলো। পৃথিবীতে কি এমন বর্বরতা ও হয় আরাধ্য? বিশ্বের সবক’টা গরীব পরিবারের সহজ, সরল, নির্বোধ মেয়ে গুলোকে কি আমার মতোই প্রতিদিন অসহায়ত্বের স্বীকার হতে হয় আরাধ্য? ইজ্জতকে বেঁচে তাদের খেতে হয়, বাঁচতে হয়? অত্যাচারী, জানোয়ার, নরপশুদের স্বীকার হতে হয়? অপারগ হয়ে তাদের চাহিদা মেটাতে প্রতিবার তাদের সাথে শুতে হয়? শরীর বিছিয়ে দিতে হয়?”
কথা বলার শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না আমি। নিশ্চুপ থাকতে কেনো জানি না বড্ড ইচ্ছে করছে। চোখ থেকে জলের ঢেউ বাঁধ মানছে না। বুকটা করুন হাহাকারে খাঁ খাঁ করছে। প্রাণবায়ু হয়তো আমার শরীর থেকে বিদায় নিচ্ছে নয়তো আমি ইচ্ছে করেই যমরাজকে আমার সামনে আহ্বান করছি! বুঝতে পারছি না এই মুহূর্তে আমার ঠিক কি করা উচিত, কি বলা উচিত, চিএাকে কিভাবে শান্তনা দেওয়া উচিত। আমি যে মানতে পারছি না চিএার এই বুক ফাঁটা আর্তনাদ, এতো গুলো নির্মম প্রশ্নের উত্তর। ভেতরটা যেনো লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে আমার। শরীরটা ক্রমান্বয়ে অসার হয়ে আসছে। হার্টবিট টিপটিপ শব্দে ভয়ঙ্কর কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। মনে হচ্ছে এখনি ছোট খাটো একটা হার্ট এ্যাটাক আমার হয়ে যাবে। রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে চিএা অস্ফুট কন্ঠে পুনরায় বলল,,
#চলবে….?