শ্রাবণ_আঁধারে #পর্ব_৫

0
634

#শ্রাবণ_আঁধারে
#পর্ব_৫
#নিশাত_জাহান_নিশি

“তোকে অসীমভাবে চাওয়াটা কখনো আমার পাপ হতে পারে না চিএা। বরং তখনই পাপ হবে যখন তোকে এতোটা চেয়ে ও আমি একান্তভাবে নিজের করতে পারব না! নিজের মনের মালিক হওয়া সত্ত্বে ও মনকে নিঁগূঢ় ভাবে ভেঙ্গে দেওয়াটা তখন আমার চরম শাস্তি হয়ে দাঁড়াবে।”

আনন্দে এক প্রকার উচ্ছ্বাসিত হয়ে আমি স্নান সেরে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলাম। ব্যাথা যুক্ত আঙ্গুলিটায় জলে সিক্ত রূপে পেঁচিয়ে থাকা চিএার উড়নার ছেড়া অংশটা নিংড়ে আমি পুনরায় অতি যত্নের সহিত আঙ্গুলিতে বেঁধে নিলাম। চিএার দেহের কোমল স্পর্শ লেগে আছে উড়নার এই ছেড়া অংশটায়। যদি সম্ভব হয় তো, আমি চেষ্টা করব উড়নার এই ছেড়া অংশটা আজীবন এই আঙ্গুলিটায় বেঁধে রাখতে! এর জন্য যদি আমাকে পুনরায় আঘাত পেতে হয় আমি তাতে ও রাজি! অন্তত এই ভেবে তো শান্তি পাবো যে, চিএার শরীরের স্পর্শিত কোনো একটা অংশ আমার শরীরে ও স্পর্শ করে আছে। অন্তঃকরণের গভীর এক অভিভূত টানে দুজন দুজনকে স্পর্শ করে আছি। প্রতিনিয়ত তাকে অনুভব করতে পারছি। এই হয়তো আমার জন্য পরম সৌভাগ্যের। প্রয়োজনের তুলনায় প্রিয় জিনিসটাকে অতিরিক্ত চাইলেই এর হিসেব চরম কোনো ক্ষতি রূপে পরিশোধ করতে হয়। ঈশ্বর সবসময় প্রিয় জিনিসটাকেই কেড়ে নিতে অভ্যস্ত। নয়তো প্রকৃত মনুষ্যের পরীক্ষা নিবেন কিভাবে উনি?

জলপাই রঙ্গের টি শার্ট গাঁয়ে জড়িয়ে আমি উৎফুল্ল মনে আয়নায় স্ব-প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত চুল গুলো বাঁ দিকে এলিয়ে ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বললাম,,

“ইসসস, চিএা হয়তো আমার জন্য অপেক্ষা করছে। এক্ষনি আমাকে চিএার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হতে হবে। দুপুরের খাবার চুলোয় যাক। তাছাড়া আমি তো পাগলীটাকে কথা দিয়েছিলাম, পদ্মবিল থেকে ১০১ খানা পদ্ম ফুল তুলে দিবো। আমি নিশ্চিত চিএা হয়তো পদ্ম ফুলের অপেক্ষায় গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে নাওয়া, খাওয়া বিসর্জন দিয়ে বসে আছে।”

ইতোমধ্যেই রুমের দরজা ঠেলে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির প্রবেশ উপস্থিতি আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় শক্তিকে জাগান দিলো। অধিক কৌতুহল নিয়ে আমি পিছু ফিরে তাকাতেই খাবারের থালা হাতে নিয়ে মাকে দেখতে পেলাম। কেনো জানি না মা কে দেখতে মোটে ও স্বাভাবিক লাগছে না। খুব চিন্তাগ্রস্থ এবং আতঙ্কগ্রস্থ মনে হচ্ছে। চক্ষু জোড়ায় উদয়মান শঙ্কার ছড়াছড়ি নিয়ে মারআমার সম্মুখস্থ হয়ে দাঁড়ালেন। ব্যাকুল কন্ঠে মা আমার কৌতুহলী দৃষ্টিতে ভয়াতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,,

“খাবারটা খেয়ে তুই এক্ষনি কাশিয়ানী ফিরে যা আরাধ্য। তোর বাবা ভীষণ রেগে আছেন। দুপুরের খাবারটা পর্যন্ত উনি মুখে তুলতে চাইছেন না। বলছেন, তুই কাশিয়ানী রওনা হওয়ার পর পরই উনি খেতে বসবেন। এর পূর্বে এক ফোঁটা জল ও স্পর্শ করবেন না।”

কিঞ্চিৎ সময়ের জন্য থমকালাম আমি। আমাকে কাশিয়ানী পাঠানোর জন্য বাবা এতোটা উদগ্রীব হয়ে উঠবেন তা আমার বোধ বুদ্ধিতে ও কুলোয় নি। অনাগত ভয়ের কোনো পূর্বাভাস ও পাই নি। প্রতিত্তুর করার কোনো শব্দ গুচ্ছ আপাতত আমি খুঁজে পাচ্ছি না। তাল কেটে যাচ্ছে শব্দের। নিবার্কতার চরম শীর্ষে আমার মন মানসিকতা অবস্থান করলে ও মস্তিষ্কে রাগ ভর করছিলো দ্বিগুনভাবে। প্রখর রাগের বশবর্তী হয়ে আমি ডেস্কের নিচের অংশটায় জোরালো এক লাথ মেরে চোয়াল শক্ত করে বললাম,,

“কোথাও যাবো না আমি শুনতে পেরেছ তোমরা? একটা মাএ ছেলেকে বাড়ি থেকে তাড়ানোর জন্য তোমরা এভাবে উঠে পড়ে লাগবে, বিশ্বাস করো, সন্তান হয়ে এই বিরল কাহিনী মানতে পারছি না আমি।”

খাবারের থালা টা টেবিলের উপর রেখে মা গলা জড়ানো কন্ঠে আমাকে পেছন থেকে ঝাপটে ধরে বললেন,,

“আমাকে মাফ কর আরাধ্য। তোর বাবাকে তো তুই ভালো করেই চিনিস বল? একবার রেগে গেলে উনার রাগ ভাঙ্গানো অতো সহজ নয়। বরং যে জিনিসটার জন্য উনি রাগ করেছেন, সেই জিনিসটাই উনার মন মতোন হলে তবেই উনার রাগ ভাঙ্গবে৷ তাছাড়া কাশিয়ানীতে তো তোর অনেক গুলো ম্যাচ আছে বাবা! তোর সমস্ত স্বপ্ন তো ক্রিকেটকে কেন্দ্র করেই। কি দরকার বল? নিজের স্বপ্নকে ছেড়ে এভাবে উদ্দেশ্যহীন ভাবে গ্রামে থেকে যাওয়ার? মূল্যবান সময় গুলো হেলায় নষ্ট করার?”

বিপুল রেগে আমি তটস্থ কন্ঠে বললাম,,

“আমি তো অস্বীকার করছি না মা। ক্রিকেট আমার স্বপ্ন নয়, বা আমি কাশিয়ানী ফিরে যাবো না। মাএ তো একটা মাস আমি বাড়িতে থাকতে চাইছি। পরিবার এবং বন্ধু বান্ধবদের সাথে বিশেষ কিছু সময় কাটাতে চাইছি। আমার থেকে যাওয়াতে তোমাদের ক্ষতিটা কোন জায়গায় হচ্ছে একটু বলবে?”

মা ঈষৎ রেগে কঠোর কন্ঠে বললেন,,

“ক্ষতি তো নিশ্চয়ই হচ্ছে আরাধ্য। তুই আমাদের সাথে, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে সময় কাটাতে এসেছিস খুব ভালো কথা৷ তবে তুই চিএাকে কেন্দ্র করে নিরঞ্জনের সাথে মারপিটে জড়াতে গেলি কেনো এটাই হচ্ছে আমাদের মূল অভিযোগ।”

পিছু ঘুড়ে আমি ক্ষীপ্ত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে চেয়ে বললাম,,

“ঠিক কাকে কেন্দ্র করে আমি নিরঞ্জনকে মেরেছি তা হয়তো একদিন তোমরা জানতে পারবে মা। সেদিন হয়তো ভীষণ আপসোস করবে। নিজের ছেলের সাথে বিরূপ আচরণ করার জন্যে ও অনুতপ্ত বোধ করবে। মন থেকে ক্ষমা করতে পারব না ঐ দিন তোমাদের। তোমার ছেলের জেদ সম্পর্কে কিন্তু তোমার খুব ভালো করে জানা আছে মা। বাবাকে ঝাঁপিয়ে যাবে ঐদিন আমার জেদ। কথাটা মাথায় রেখো কিন্তু!”

মায়ের থেকে দু ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আমি প্রশ্নবিদ্ধ কন্ঠে বললাম,,

“আমি ফিরে গেলেই তো তোমরা খুশি হবে তাই না? প্রশান্তি ও মিলবে তাই তো?”

মা চোখের জল ছেড়ে মাথা নিচু করে হ্যাঁ সূচক মাথা নাঁড়ালেন। সমস্ত রাগ, জেদ, ক্ষোভকে কিছু মুহূর্তের জন্য দমিয়ে আমি চোখ বুজে দীর্ঘ একটা শ্বাস ছেড়ে হম্বিতম্বি হয়ে আলমারী থেকে ট্রলি ব্যাগটা বের করে রুম থেকে প্রস্থান নেওয়ার পূর্বেই মা পেছন থেকে আমাকে ঝাপটে ধরে ঢুকড়ে কেঁদে বললেন,,

“খাবারটা খেয়ে যা বাবা। মা খুব শখ করে তোর জন্য রেঁধেছি। সকাল থেকে ঘটা করে এই পর্যন্ত তোর সব পছন্দের খাবার রান্না করেছি। কবে না কবে ফিরবি। মায়ের মন তো উসখুস করবেই বাবা।”

কঠোর কন্ঠে আমি হুংকার তুলে বললাম,,

“আর্শীবাদ করো মা, যেনো আর কখনো এই বাড়িতে না ফিরি। আমার অনুপস্থিতিতেই তোমরা বেশি শান্তি পাও, মুক্তি পাও। সন্তান হয়ে তোমাদের শান্তি, মুক্তিরএকান্তভাবে কামনা করছি।”

দম নিয়ে আমি পুনরায় বললাম,,

“আর হ্যাঁ বাবাকে বলবে, আপদ বিদেয় হচ্ছে। আর কখনো এই কুলাঙ্গার ছেলেটা উনার মুখাপেক্ষী হবে না। যে ছেলের জন্যে পাড়ায়, হাটে বাজারে উনার মান-সম্মান নিলামে উঠে, দয়ার বস্তু হয়ে সেই ছেলে কখনো উনার সম্মুখস্থ হবে না। আর একটা কথা, বাবাকে বলে দিও খেয়ে নিতে। উপোস থাকলে খাদ্যনালীতে পিত্তি পড়বে।”

মাকে ছাড়িয়ে আমি হিমেল হাওয়ার বেগে রুম থেকে প্রস্থান নিয়ে সিঁড়ি পথে পা বাড়াতেই মা উচ্চ শব্দে কেঁদে মাটিতে ধপ করে বসে পড়লেন। মায়ের চিৎকারের শব্দে বাড়ির সবাই যার যার রুম থেকে বের হয়ে এলেন। আমার যাওয়ার পথে তাকিয়ে সবাই পেছন থেকে আমাকে ডাকতে আরম্ভ করলেন। শর্মিলা দৌঁড়ে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,,

“তুমি সত্যিই ফিরে যাচ্ছ দাদা?”

ম্লান হেসে আমি শর্মিলার চুলে আলতো হাত ছুঁইয়ে বললাম,,

“নিজের যত্ন নিস। সামলে থাকিস। নিরঞ্জন যদি তোকে পুনরায় বিরক্ত করেন তো আমাকে নিশ্চয়ই জানাবি। তুচ্ছ বিষয়টা ও মনে চেঁপে রাখবি না। এতে ক্ষতির সম্ভাবনা বাড়তে থাকবে।”

শর্মিলা টলমল চোখে হ্যাঁ সূচক মাথা নাঁড়ালো। শর্মিলাকে পাশ কাটিয়ে আমি বসার রুমে পা বাড়াতেই বাবার সম্মুখীন হলাম। গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে বাবা ঝাঁঝালো কন্ঠে বললেন,,

“৬ মাসের পূর্বে যেনো তোমাকে গোপালগঞ্জ না দেখি। স্মরণে রেখো কথাটা।”

আমি ক্ষীণ কন্ঠে বললাম,,

“৬ মাস কেনো বাবা? ৬ বছরের পূর্বে আমাকে দেখবে কিনা সন্দেহ আছে। সন্তানকে এক পলক দেখতে না পাওয়ার শোকে তোমার যে দম আটকে আসবে না তা আমার ভালো করেই জানা আছে। এক্ষেএে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো বাবা। আমাদের মনের মিল কখনো ছিলো না বাবা। হয়তো তুমি আমাকে বুঝো নি, নয়তো আমি তোমাকে বুঝি নি। আমাদের মাঝে না আছে কোনো ভালোবাসা, না আছে কোনো সম্মান, শ্রদ্ধা, স্নেহতা, অথবা মনের মিল। আমরা সর্বদা বিপরীত ধর্মী বাবা। ভবিষ্যতে ও হয়তো এই সীমাটা আমাদের মধ্যে দন্ডায়মান থাকবে।”

প্রস্থান নিলাম আমি৷ মা পেছন থেকে উচ্চ শব্দে কেঁদে আমার নাম ধরে ডাকছেন। পরিবারের সবাই মা কে সামলানোর চেষ্টায় মগ্ন আছেন। ভেবেছিলাম বাবা অন্তত একবার পেছন থেকে আমাকে ডাকবেন। ছেলেকে অন্তত একবার বুকে জড়িয়ে ধরবেন। অতি স্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে বলবেন,,

“থেকে যা না আরাধ্য। তোর ধারণা ভুল। তোর বাবা তোকে সত্যিই ভীষণ ভালোবাসে।”

রাগ, জেদ, অভিমান, অভিযোগ, মনের এক কোণায় চেঁপে রাখা অসীম কষ্ট নিয়ে আমি চিএাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে কদম বাড়ালাম। একান্তে কিছুটা সময় কাটাতে চাইছি চিএার সাথে। হয়তো আগামী এক যুগ ও চিএার সাথে আমার দেখা হবে না। গোপালগঞ্জ ফিরে আসা হবে না আর। চিএাকে কি আজ সত্যিটা বলা উচিত হবে? চিএাকে আমি ভালোবাসি, চিএা আমার অর্ধাঙ্গিনী?

না, এখনই কিছু প্রকাশ করা উচিত হবে না হয়তো। চিএাকে দেখার অসুখ নিয়ে আমি মোটে ও এক যুগ কাটাতে পারব না। এক মাসের মাথায় লুকিয়ে হলে ও আমি চিএাকে দেখতে গোপালগঞ্জ ছুটে আসব। দূর থেকে চিএাকে এক পলক দেখে কাশিয়ানী ফিরে যাবো। তাছাড়া, কাকুকে ও তো ইঙ্গিতে বুঝিয়ে যেতে হবে চিএা আমার অর্ধাঙ্গিনী। অন্য কোথাও যেনো চিএার বিয়ের সম্বন্ধ না খুঁজেন!

নির্দিষ্ট সময়ে আমি চিএাদের ছোট্ট দু রুম বিশিষ্ট ইট, বালু খসে পড়া বাড়িটায় পা বাড়ালাম। নীল রঙ্গের গেইটটা জং ধরে বিবর্ণ রূপ ধারণ করেছে। শক্ত হাতে গেইটের দরজাটা ঠেলে আমি বাড়ির আঙ্গিনায় পা বাঁড়ালাম। ইতোমধ্যেই চিএা কল ঘর থেকে হাত ভর্তি ভেজা কাপড় নিয়ে বাড়ির আঙ্গিনায় টেনে রাখা দঁড়িটার সম্মুখে দাঁড়ালো। সাদা তোয়ালে চুলে পেঁচিয়ে চিএা শূণ্য সিঁথিতে খুব ব্যতিব্যস্ত ভঙ্গিতে দঁড়িতে কাপড় নাড়ছে। আমি মোহনীয় দৃষ্টিতে চিএার স্নিগ্ধ, মনোহরা অবয়বে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছি। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় হুট করেই থমকে গেছে আমার। বেসামাল ভাবে আবদ্ধ চিত্তে আমি থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তাকে চেয়ে চেয়ে দেখার মাঝেই প্রকৃত ভালোবাসাকে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছি৷ ভাবতেই অর্ন্তআত্তাটা কেঁপে উঠছে আমার। আজই বুঝি তাকে ছেড়ে আমার কাশিয়ানী ফিরে যেতে হবে? এতো সুন্দর, অমায়িক মুহূর্তগুলোকে পিছনে ছেড়ে কিভাবে আমি সামনে এগিয়ে যাবো? পিছুটান তো জোরালো ভাবে আঘাত করবে আমায়। শ্বাস রুদ্ধ অবস্থাতে ও আমাকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। নয়তো বাবার জেদের সাথে আমার জেদ নতজানু হতে বাধ্য হবে।

আচ্ছা? চিএাকে কিভাবে মুখ ফুটে বলব? আমি আজই কাশিয়ানী ফিরে যাচ্ছি? তোকে দেওয়া কথা আমি রাখতে পারলাম না চিএা। তোর সাথে হয়তো অনেক দিন দেখা হবে না, জেদ শান্ত না হওয়া অব্দি হয়তো বছর খানিক ও দেখা হবে না! তোর সিঁথি ভর্তি রক্তিম সিঁদুর দেখা হবে না, তোর আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে দীর্ঘ পথ ক্লান্তিহীন ভাবে হেঁটে যাওয়া হবে না, মুগ্ধতায় বশবর্তী হয়ে তোর দু চোখে থমকে যাওয়া হবে না। কান্না মুখে ও সুখের হাসিটা আমার দৃষ্টির অগোচরেই রয়ে যাবে। নিজের মুখেই তো বলেছিলাম ১ মাসের পূর্বে আমি তোকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। তবে বাবার কথা ও আমি অগ্রাহ্য করতে পারছিলাম না চিএা। জানি না বাবার সাথে রাগ থেকেই আমি নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টেছি নাকি বাবার কথা রাখতে শ্রদ্ধাবোধ থেকে সিদ্ধান্তটা পাল্টেছি। বুকটা এক অদ্ভুত যন্ত্রণায় ফেঁটে যাচ্ছে চিএা। বোধ হয় তোর সম্মুখীন আমি হতে পারব না। তোর মুখোমুখি দাঁড়ালেই হয়তো প্রখর পিছুটানে আটকে যাবো। তখন তোর মায়া ভীষণ কাটানো দায় হয়ে পড়বে। আমার ভবিতব্য আটকে যাবে!

দ্রুত পায়ে হেঁটে আমি চিএাদের বাড়ির গেইট থেকে প্রস্থান নিলাম। চিএা এতটুকু সময়ে ও আমার উপস্থিতি ঘুনাক্ষরে ও টের পায় নি। ভালোবাসলেই তো সে আমার উপস্থিতি উপলব্ধি করতে পারবে! এক তরফা ভালোবাসায় হয়তো নিবদ্ধিত আমি। চিএার দিক থেকে আদৌ কখনো কোনো সাড়া পাবো কিনা আমি জানি না। তবে অধীর অপেক্ষায় থাকব আমি। প্রতিটা মুহূর্তে তার পাশাপাশি থেকে তাকে অনুভব করাতেই ভালোবাসা বুঝায় না। দূর থেকে তার জন্য অপেক্ষা করাটাকে ও ভালোবাসা বুঝায়। তোকে কাছে পাওয়ার কষ্টটা তো আমি ভুলে থাকতে পারব চিএা, তবে তোকে শুধু মাএ এক পলক দেখার অসুখটাকে আমি সেরে তুলতে পারব কি না জানি না!

সন্ধ্যা ৬ টা বাজার কিছুক্ষণ পূর্বে আমি কাশিয়ানী এসে পৌঁছলাম। গোপালগঞ্জ থেকে ফেরার পূর্বে চিএার নাচের একাডেমীতে একবার বিশেষ প্রয়োজনে গিয়েছিলাম আমি৷ প্রতিবারের মতো এবার ও চিএার গত তিন মাসের বকেয়া ফি সহ আগামী পাঁচ মাসের নাচের কোর্স ফি আমি পরিশোধ করে এলাম। বিষয়টা অতি গোপনীয়। নাচের টিচার এবং আমি বাদে এই বিষয়ে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি অবগত নয়। এমনকি স্বয়ং চিএা ও নয়! চিএা জানে, টিচার বিনা মূল্যে চিএাকে নাচ অনুশীলন করাচ্ছেন। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে উনি চিএাকে ছাড় দিচ্ছেন! আমার জীবদ্দশায় আমি না কখনো পারব না চিএার অতি ক্ষুদ্র শখ গুলো ও অপূর্ণ রাখতে। তার মধ্যে চিএার নাচ শেখার ঝোঁক অন্যতম। পরের বার যখন চিএাকে দেখতে গোপালগঞ্জ ফিরে যাবো? ১০১ টা পদ্মফুল হাতে নিয়ে তবেই আমি চিএার মুখোমুখি দাঁড়াবো। পাশাপশি এক জোড়া নতুন ঘুঙ্গুর ও উপহার হিসেবে চিএার হাতে তুলে দিবো৷ চিএা হয়তো জানেই না, তার নাচের কতো বড় ফ্যান আমি। যতোই মুখে মুখে বলি তোর নাচ আমার পছন্দ না, তবে আমার অন্তর জানে গোপালগঞ্জ থাকার সময়টাতে আমি একটা দিন ও চিএার অগোচরে নাচ দেখা মিস করেছি কিনা।

________________________________________________

দীর্ঘ এক মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেলো নিমিষেই। যদি ও প্রতিটা ক্ষণ, প্রতিটা মুহূর্তে আমি সর্বাঙ্গে চিএাকে ভীষণ ভাবে অনুভব করেছি। ঘুটঘুটে অন্ধকারে যেখানে দলবদ্ধ লোকজনরা ও ভয় পাবে, সেই অন্ধকার গলিতে, রাস্তাতে আমি আপন মনে পায়চারী করে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি। হৃদয়ে এতোটাই দহন হচ্ছিলো যে, তখন যদি ঈশ্বর ও ধরণীতে প্রবল ধারায় বৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন না? সেই বৃষ্টির ফোঁটা ও আমার দ্বগ্ধ হৃদয়কে শীতল করতে কম পড়ে যেতো! মরমে মরমে নিশ্বেস হয়ে যাওয়ার পরে ও ফোনের কন্ট্রাক্ট লিস্ট ঘেঁটে চিএাকে কল করার মন মানসিকতা আমার হয়ে উঠছিলো না। দুর্বল হতে চাচ্ছিলাম না আমি মোটে ও। আমার এই দুর্বলতা চিএার পক্ষে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বাবা যদি কোনোভাবে জানতে পারেন, চিএার সাথে আমি যোগাযোগ করছি তাহলে হয়তো চিএার কোনো ক্ষতি করে দিতে উনি দুবার ও ভাববেন না! বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, তবে এটাই সত্যি চিএার উড়নার ছেঁড়া অংশটা এখনো আমার ডান হাতের আঙ্গুলীতে অতি যত্নে বাঁধা আছে। যুগ যুগ ধরে উড়নার এই অংশটা আমার হাতে বাঁধা থাকবে।

সন্ধ্যা ৭ টা বাজতেই টান টান উত্তেজনা নিয়ে বড় একটা ম্যাচ জিতেই পরে হলে ফিরে এলাম। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। হুট করেই বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ হলো। সামান্য পূর্বে বৃষ্টিটা নামলে হয়তো খুব ভালো হতো। অন্তত একটা বাহানা দিয়ে তো বৃষ্টিতে ভেজা যেতো?

স্নান নিয়ে ওয়াশরুম থেকে উন্মুক্ত এবং সিক্ত শরীরে বের হয়ে আমি জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়ালাম। বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটার দিকে চেয়ে মৃদ্যু হাসতেই আজহার (রুমমেট এবং খেলার পার্টনার) হঠাৎ পেছন থেকে উচ্চ শব্দে হেসে আমার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“কি জনাব? আজ খুব হাসি খুশি মনে হচ্ছে? বৃষ্টিকে আজ নতুনভাবে দেখছ মনে হচ্ছে?”

আমি মৃদ্যু হেসে আজহারের দিকে চেয়ে বললাম,,

“বর্ষার প্রতি ভালোবাসা আমার আগে ও ছিলো। তবে আজ বর্ষাটাকে বিশেষ রকমের ভালো লাগছে। বিগত বর্ষার মৌসুম গুলোতে যে দল বাঁধা মেঘের অন্তরালে ছিলো, সে আজ হুট করেই চোখের সামনে বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে ধরা দিলো। তাকে দেখেই খুব হাসতে ইচ্ছে হলো। তাকে হাত বাড়িয়ে ছোঁয়ার ইচ্ছেটা ও যেনো ভীষণ ভাবে জেগে উঠল!”

“ওহ্ আচ্ছা। ভাবীকে খুব মিস করছ তাই না?”

“ভীষণের চেয়ে অধিক কিছু থাকলে ওটা করছি।”

“তাহলে যাচ্ছ না কেনো ভাবীকে দেখতে?”

“যাবো। খুব শীঘ্রই।”

মনটা বিষন্নতায় ছেঁয়ে গেলো আমার। আজ এই ব্যাকুল মনকে কিছুতেই আটকে রাখা যাবে না। যে কোনো ক্রমেই হোক, চিএার সাথে আজ আমার যোগাযোগ করতেই হবে। তড়িঘড়ি করে আমি বালিশের তলা থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে চিএার নাম্বারে ক্রমাগত ৫ বার ডায়াল করার পরে ও নাম্বারটা বিচ্ছিন্ন আসছিলো৷ আতঙ্কে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের উদয় হলো৷ অসীম ভয় মুহূর্তের মধ্যে আমার মস্তিষ্ক এবং মনকে গ্রাস করে নিচ্ছিলো। শুকনো মুখে আমি ব্যতিব্যস্ত হয়ে শর্মিলার নাম্বারে ডায়াল করলাম। দুবার রিং বাজার পর মুহূর্তে শর্মিলা কলটা রিসিভ করল। উদ্বিগ্ন কন্ঠে আমি উচ্চ শব্দে চেঁচিয়ে বললাম,,

“কোথায় ছিলি তুই? কলটা রিসিভ করতে এতো বিলম্ব হলো কেনো?”

শর্মিলা শুকনো কন্ঠে বলল,,

“স্যরি দা। আসলে চিএা দিদির বাড়িতে গিয়েছিলাম, ফিরে এসেই দেখলাম তোমার কলটা বাজছে। আমার কি দোষ বলো?”

“মানে? চিএার বাড়িতে তুই গিয়েছিলি? এটা ও এখন আমার বিশ্বাস করতে হবে?”

“সত্যি বলছি দা৷ চিএার দির বাড়িতেই আমি গিয়েছিলাম, শুধু আমি কেনো, বাড়ির বাকি সদস্যরা ও গিয়েছিলো!”

“আশ্চর্যের বিষয় তো! হঠাৎ চিএাদের বাড়ি যাওযার কারণ কি?”

“চিএা দির বাড়িতে পুলিশ এসেছে। ওটাই দেখতে গিয়েছিলাম।”

“হোয়াট? ভনিতা না করে বল কি হয়েছে? চিএাদের বাড়িতে পুলিশ এসেছে কেনো?”

“চিএা দির নাচের ক্লাসের একজন স্টুডেন্ট সুইসাইড করেছে৷ সেই সুইসাইড নোটে মেয়েটা গুটি গুটি অক্ষরে লিখে গিয়েছিলো, মেয়েটার আকস্মিক সুইসাইডের কারণ নাকি চিএা দি খুব ভালো করেই জানে!”

ফোনটা কান থেকে সরিয়ে আমি বিছানার উপর ছুড়ে মারলাম। চিএার পাশে এই মুহূর্তে দাঁড়ানোটা আমার ভীষন জরুরি। আর এক মুহূর্ত ও বিলম্ব করা যাবে না আমার। আজহারকে কিছু না বলেই আমি এক কাপড়ে বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে পাগলের মতো ছুটে চললাম বাস স্টপের উদ্দেশ্যে।

#চলবে….?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here