শ্রাবণ_তোমার_আকাশে,১৭,১৮
লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
পর্ব___১৭
দুজনের মধ্যে প্রেমটা অবশেষে হয়েই গেলো। অবশ্য এটাকে বিবাহ পরবর্তী ভালোবাসার নতুন রুপান্তর বলাই যায়। আর বেলার মুখে ‘ভালোবাসি’ কথাটি শোনার পর শাইনির মধ্যে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা আরো প্রবল হলো। ছোট ছোট মুহূর্ত, আনন্দগুলো স্মৃতি হিসেবে জমিয়ে রাখে। কখনো খাতায়, কখনো ডায়েরির পাতায়, কখনো ফোনের ক্যামেরায়। একদিন পৃথিবীর সব সুখ এনে দেবে বেলাকে। ওর হাত ধরেই সামনের দিনগুলো এগুতে চায় সে। বেলার জীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হয়ে চিরকাল কাটাতে চায়। পাহাড়ের ওপর ওদের একটা ঘর থাকবে, সেখানে ছোট্ট একটা সংসার হবে, একটা মিষ্টি বাচ্চা ওদের কোল আলো করে আসবে আর ওদের জীবনকে পূর্ণতা দান করবে! পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে ভোরের সূর্যোদয়, গোধূলির রঙিলা আকাশ, সূর্যাস্ত দেখবে একসঙ্গে। গ্রীষ্মের নরম রোদ হয়ে ঝিকমিক আলোয় ভরিয়ে দেবে বেলার কমলা রঙের শাড়ির আঁচলটা। শ্রাবণের মেঘভাঙা বর্ষণ হয়ে বেলার গাল ছুঁয়ে দেবে। শরৎের কাশফুল হয়ে ওর ঘনকালো চুলগুলো ছুঁয়ে দেবে। শীতের কুয়াশা হয়ে একবুক ভালোবাসায় জড়িয়ে নেবে। বসন্তের উষ্ণতা গায়ে মাখিয়ে ফুলগন্ধি হাওয়ায় ভাসিয়ে নেবে ভালোবাসার মানবীটিকে। উঠোনে মাদুর পেতে দুজনে একসাথে বসে রাতের তারা গুণবে, জোৎস্নাবিলাসে মাতবে। এক পৃথিবী সুখ প্রজাপতি হয়ে ওড়াওড়ি করবে তাঁদের জীবনে।
ভালোবাসাময় সংসার কেমন হয় তার সংজ্ঞা জানা নেই বেলার। তবে তার সংসারে কোনো অপূর্ণতা নেই। স্বস্তির হাসি হেসে বারান্দা থেকে ঘরে এসে দেখলো শাইনি বিছানায় হেলান দিয়ে বসে বিরক্তিকর দৃষ্টিতে ঘরটাকে পরখ করছে। বেলা জিজ্ঞেস করলো, ‘কিছু খুঁজছেন?’
শাইনি মাথা নাড়ালো।
-হুম, তোমাকে। কোথায় যাও আমাকে রেখে?
-আমিতো বারান্দায় ছিলাম।
-আমি দেখিনি কেন? তুমি সবসময় আমার কাছে কাছেই থেকো।
-আপনি তো ঘুমাচ্ছিলেন, দেখবেন কীভাবে!
-তাই তো। মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে আমার।
বেলা বলল, ‘এতো স্ট্রেস নিচ্ছেন কেন আপনি? আমিতো বলেছি কোথাও যাবো না।’
শাইনি নাক টেনে বলল, ‘তবুও তবুও তবুও, তুমি আমাকে একা রাখবে না। তোমাকে একদিন, এক মুহূর্ত না দেখলে আমি মরে যাবো। তুমি হলে আমার জীবনের অন্যতম একটা আয়না, যার মাঝে আমি নিজেকে দেখতে পাই। তুমিহীনা আমি ভাঙা কাচের টুকরোর মতো চুরমার হয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবো।’
বেলা এগিয়ে গিয়ে বিছানার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। শাইনি ওর কোমড় জড়িয়ে ধরলো। বেলা ওর চুলগুলোয় আঙুল চালাতে চালাতে বলল, ‘ভালোবাসি। আপনার কষ্টে আমারও কষ্ট হয়। উলটাপালটা ভাবনা ভেবে প্লিজ অসুস্থ হয়ে পড়বেন না।’
-তোমার মতো আমাকে কেউ খেয়াল রাখেনি। না তো কেউ এভাবে পাশে থেকেছে আব্বু ছাড়া…
-আমি আছি তো!
-তাইতো নিজের কাছে আটকে রেখেছি। তুমি আমাকে খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পেরেছো বেলা বউ!
বেলা গভীর কন্ঠে বলল, ‘যে মানুষটিকে ভালোবাসবো তাকে যদি না বুঝতে পারি তাহলে এই ভালোবাসার কোনো অর্থ আছে বলে মনে হয় না।’
শাইনি বেলার মুখের দিকে তাকালো। ওর ঠোঁটের কোণে হাসি আঁকা। শাইনি মুগ্ধ হয়ে ওকে দেখছে। বেলা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এভাবে কী দেখছেন?’
-তোমার হাসি।
-হাসি আবার দেখার জিনিস নাকি?
-তুমি পুরোটাই তো দেখার জিনিস আমার প্রিয় বউ! যেমনটা আমরা সুন্দর ফুলের দিকে চেয়ে থাকি, ঠিক তেমনই!
বেলা হাসতে হাসতে বলল, ‘ফুল? লাইক সিরিয়াসলি? আমাকে ফুলের সাথে তুলনা? নো নো.. আমাকে নয়, আমার হাসিকে? নাইস জোকস কিন্তু!’
শাইনি মাথা দুলিয়ে বলল, ‘মেয়েদের হাসি হলো ছেলেদের কাছে এই পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু। বুঝেছো বেলা বউ?’
-জি না।
-কারো কাছে না হোক, অন্তত আমার কাছে।
বেলা চুপ করে শুনলো। লোকটা আজকে বেশিই হাসিখুশি। প্রচন্ড উৎফুল্ল লাগছে ওকে। শাইনির মায়ের সত্যিটা বেলা এখনো ওকে জানায়নি। সবটা শুনে ও উত্তেজিত হয়ে পড়তে পারে, যেটা ভালো নয় এই মুহূর্তে। তাই বেলা ঠিক করেছে, যখন শাইনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে তখন কথাটা বলবে।
-ঔষধ খেয়ে নিন।
-দাও।
বেলা শাইনিকে ঔষধ খাইয়ে, তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছে দিয়ে নিচে চলে গেলো। দুপুরের রান্নাবান্নায় নাজনীন বেগমকে সাহায্য করলো। তিনি আজ খুব একটা কথা বললেন না বেলার সাথে। তারপর শাইনির জন্য রান্না করা আলাদা খাবার বেড়ে ঘরে নিয়ে এলো। শাইনিকে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়ে সব গোছগাছ করে দুজনে ছাদে গেলো। আজকাল নিজের ঘর আর হাসপাতালে যাওয়ার সময়টুকু বাদে কোথাও যাওয়া হয় না শাইনির। সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে শুয়েই থাকে। খাবারটা পর্যন্ত ঘরে বসে খেতে হয়। এক কথায় অন্যের ওপর নির্ভরশীল সে। কিন্তু কখনোই বেলাকে কাজ করতে দিতে চায় না। বেলা নিজে থেকে জোর করে ওকে ঘরে রেস্ট নিতে বলে নিজে থেকে ওর দেখাশোনা করে, যত্ন করে। নয়তো রেগে কথা বলে না শাইনির সঙ্গে। বেলা ওকে এড়িয়ে যাবে, এটা শাইনি কিছুতেই মানতে পারেনা। তাই চুপচাপ বেলার কথামতো বাধ্য হয়ে থাকে। সে ঘর থেকে বেরুয় না, সব নিয়ম মেনে চলে ছোট্ট একটা বাচ্চার মতো।
অনেকদিন পরে ছাদে এসে শাইনির বেশ ভালোই লাগছে। টবে লাগানো বিভিন্ন রঙের ফুলের গাছগুলো বাতাসের ঝাপটায় নুয়ে নুয়ে যাচ্ছে। উবু হয়ে থাকা হাসনাহেনার গন্ধে ম ম করছে ছাদ। বেলা আর শাইনি অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে দৃশ্যগুলো অবলোকন করলো। এমন সময় শিলা এলো ছাদে। হাতে চায়ের ট্রে। সিমেন্টের তৈরি বসার জায়গাটার ওপর ট্রে’ টা রেখে বেলাকে বলল, ‘ভাবি, তোমার জন্য চা এনেছি।’
বেলা হেসে বলল, ‘ধন্যবাদ।’
শাইনি কপাল কুঁচকালো। ‘আমার জন্য আনো নি শিলু?’
-না তো। চা খাওয়া বারণ তোমার।
-আমি না করেছি?
-না।
-তাহলে বারণ কীভাবে হলো?
-ওফ ভাইয়া, ভাবি না করেছে।
-কেন? তোমার ভাবিই কী তোমার সবকিছু? ও যা বলবে তা-ই হবে?
বেলা এপাশে ফিরে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘আপনি এরকম করে বলছেন কেন? আপনি অসুস্থ তাই চা দিতে নিষেধ করেছি, এটা খেলে আপনার বমি হবে তাই মানা করেছি। সেদিন ডাক্তার আংকেলও নিষেধ করেছেন তাই চা দিতে না করেছি! আর আপনার খাওয়াদাওয়া সম্বন্ধে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নেই আমার? সামান্য বিষয়টা মেনে নিতে আপনার কষ্ট হচ্ছে? আগে বলে দিলেই পারতেন। আমি আর কোনো বিষয়ে আপনাকে না জানিয়ে কিছু করবো না।’
শাইনি হতভম্ব হয়ে বলল, ‘সেটা কখন বললাম?’
-তাহলে একটু আগে কী বলছিলেন?
-কই কী বলছিলাম? আমিতো….
-থাক। কষ্ট করে আর বলতে হবে না। ঠিক আছে আপনার যা ইচ্ছা আপনি তা-ই করুন। আমি বলার কে?
বেলা মুখ কালো করে বসে রইলো। শাইনি থতমত খেয়ে বোকার মতো বলতে লাগলো, ‘আরে আমিতো এমনি বলেছি। ওফ, শুধু শুধু রাগ করেছো কেন? আমি তো জাস্ট জিজ্ঞেস করেছি শিলুকে আমায় কেন চা দেয়নি! এই, কথা বলো না কেন? তাকাও তো একবার? আচ্ছা আর কিছু বলবো না। তোমার যা ইচ্ছা তা-ই খেতে দিও আমাকে। বেলা বউ? এই বেলা বউ?’
বেলার অভিমান ভাঙাতে শাইনির মুখে এমন সব কথা শুনে শিলার প্রচন্ড হাসি পেয়ে গেলো। সে মুখে হাত দিয়ে হাসি চাপতে চাইলেও পারলো না। তার ভাইয়ের হম্বিতম্বি রুপটাই সে সবসময় দেখেছে। আর আজ অন্যরুপে দেখতে পেয়ে ওর বিস্ময়ের সীমা রইলো না। শাইনি চোখ রাঙাতেই উচ্চস্বরে হেসে বলল, ‘ভাইয়া, তোমাকে নাদান বাচ্চার মতোন লাগছে। ভাবি, আর রেগে থেকো না ভাইয়ার ওপর। আমি যাই।’
বলে শিলা নেমে গেল ছাদ থেকে। শাইনি এতকিছু বলেও বেলার মান ভাঙাতে পারছিলো না। তাই হুট করে বেলার ঠোঁটে চুমু খেয়ে বসলো। বেলা রেগে ছাদ থেকে নেমে যেতে গিয়েও আবার ফিরে আসলো। শাইনিকে সঙ্গে নিয়ে নিচে নেমে আসলো। তবুও রাগ কমলো না ওর। ঘরে এসে বসতেই বেলার মোবাইল বেজে ওঠলো। ফোনটা ক’দিন আগে শাইনি উপহার দিয়েছে ওকে। যাতে বাইরে গেলে ওর সাথে কথা বলতে পারে। বেলা ফোন তুলে দেখলো এটা তাঁর মায়ের নাম্বার। রিসিভ করে বারান্দায় চলে গেলো।
-হ্যালো আম্মু? কেমন আছো?
-আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তোরা কেমন আছিস?
-ভালো।
-শাইনির শরীরের অবস্থা কী?
-এই ভালো, এই খারাপ। তবে আজকে অন্যদিনের তুলনায় ভালোই। পরশু আবার ডাক্তারের এপয়েনমেন্ট আছে। কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করতে হবে।
-কী করে যে এত বড় রোগটা হলো ছেলেটার। মুখটা দেখলেই মায়া লাগতো।
বেলা বলল, ‘অনেক কারণেই হয়। খাদ্যভাস, বংশগত কারণে, নানান ভিন্ন কারণেও হয়। অনেক চিকিৎসা বেরিয়েছে, কিন্তু ক’জন সুস্থ হয় জানা নেই আমার!’
-থেরাপি-টেরাপি দিতে হবে নাকি?
বেলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘হুম। সেটার জন্যই আলোচনা চলছে। থেরাপি না দিলে তো আরো বেড়ে যাবে সমস্যাটা।’
সীমা বেগম বললেন, ‘দোয়া করি। ছেলেটা যাতে সুস্থ হয়ে যায়।’
-তাই যেন হয়।
-তুই ভালো আছিস তো?
বেলা জানেনা এর উত্তর কী? ও কী আদৌ ভালো আছে? ভালোবাসার মানুষটাকে প্রতিনিয়ত হারানোর ভয় যে ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে সেটা কী মা জানে? নাহ, ও ভালো নেই! সবার সামনে ভালো থাকার অনিমেষ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে শুধু! ওর নীরবতায় কিছু একটা বুঝতে পারলেন সীমা বেগম। তিনিই কথা বলে উঠলেন।
-শোন, যেজন্য ফোন করেছিলাম!
-হুম, বলো।
-তোর আব্বু তো তোকে বাসায় আসতে বলছে। কালকেও আমার সাথে রাগারাগি করেছে। এতদিন কোনো উপযুক্ত মেয়ে অন্যের বাড়িতে কাটায়, ব্যাপারটা তাঁর ভালো লাগছেনা।
-আমি আমার শ্বশুরবাড়িতে আছি।
-তা কী আর তোর আব্বু জানে? সে তো বেজায় ক্ষেপেছে। আমার সাথে কথা বলাই বন্ধ। শাইনিকে সামনে পেলে মেরে ফেলবে এমন রুপ ধারণ করেছে তার রাগ।
বেলা মনে মনে আঁৎকে উঠলো। তাঁর বাবা ভীষণ কঠিন মানুষ। এমনিতে ভালো হলেও কোনো খারাপ মানুষের সাথে চলাফেলা, উঠাবসা তার পছন্দ নয়। একবার যদি জানতে পারে বেলা শাইনির সঙ্গে তাঁর বাড়িতেই থাকছে তাহলে কী হবে আল্লাহ তায়ালা জানেন।
-শোন, তুই একটু ম্যানেজ করে দেখ আসতে পারিস না-কি!
-সম্ভব না আম্মু। পরশুই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে! ওনার অবস্থা ক্রিটিকাল। এটলিস্ট তুমি বুঝার চেষ্টা করো আমাকে। আমি ছাড়া ওনি এক-পা কোথাও যান না। সেখানে ট্রিটমেন্টের জন্য তো না-ইই। মরে গেলেও এখন ওনাকে রেখে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে।
সীমা বেগম প্রশ্ন করলেন, ‘খুব ভালোবাসিস জামাইকে? তাই না?’
বেলা বলল, ‘তোমাকে অনেক কথা বলার আছে আম্মু!’
-দরকারি?
-এখন এসব বলার সময় নয় আম্মু। সময় হলে সবদিক সামলে কথাগুলো বলবো তোমাকে। অনেক কথা জমে আছে!
চলবে…ইনশাআল্লাহ!
#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব___১৮
এর মধ্যে দুদিন পেরিয়ে গেছে। চন্দ্রহীন ম্লান আকাশটার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিও আজ নিশ্চুপ হয়ে আছে। গুমোট ভাব ছড়িয়ে আছে চারদিকে। বেলার মনটা বড্ড অস্থির। ঝড় আসার পূর্বে প্রকৃতি যেমন তার নিঃস্তব্ধতা তুলে ধরে, ঠিক তেমন মনে হচ্ছে ওর কাছে। যেন কিছু হতে চলেছে। মনটা ভীষণ কু ডাকছে। জানালা থেকে নজর সরিয়ে বেলা কম্বলের ভেতরে ঢুকে শাইনির বুকে মাথা রেখে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে শুয়ে পড়লো। ঘুমের ঘোরে শাইনিও ওর বক্ষে টেনে নিলো তাঁর প্রিয়তমাকে। রাতে আর ঘুম এলো না ওর। তন্দ্রা এলো ভোরে। যখন চারপাশে শীতল উষ্ণতা ছড়াচ্ছিলো তখন! বাইরে বৃষ্টি পড়ছিলো অবিরামভাবে।
ঘুম ভাঙতে বেশ দেরি হয়ে যায় বেলার। উঠে দেখে সকাল সাড়ে দশটা বেজে গেছে। শাইনি ওর পাশে নেই। বেলা দু’বার ওর নাম ধরে ডাকতেই ওয়াশরুম থেকে শাইনির গলা ভেসে এলো।
-আমি ফ্রেশ হচ্ছি!
-একা একা না উঠে, আমাকে ডাকলেই পারতেন।
-তুমি ঘুমাচ্ছিলে তখন।
-আচ্ছা সাবধানে দাঁড়াবেন। বেশি পানি গায়ে ঢালবেন না। হট ওয়াটার ইউজ করবেন। ওকে?
-হুম।
শাইনি ওকে না ডেকেই ওয়াশরুমে গিয়েছে। বেলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানাপত্র গুছিয়ে রাখলো। ঝুড়িতে রাখা কাপড়গুলোর সাথে আরও কিছু কাপড় যোগ হলো। সবকিছু ধুয়ে দিতে হবে। শাইনির জন্য টি-শার্ট আর ট্রাউজার বের করে বিছানার ওপর রেখে দিলো। তারপর তড়িঘড়ি করে ঘর ঝাঁট দিয়ে বেরিয়ে গেলো। নিচের বেসিং থেকে হাতমুখ ধুয়ে রান্নাঘরে আসতেই নাজনীন বেগম জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন উঠেছো?’
বেলা বলল, ‘জি। রাতে দেরিতে ঘুমিয়েছিলাম তাই।’
-নাস্তা রেডি আছে। শাইনির ভেজিটেবল স্যুপটাও ঢাকা দেওয়া আছে।
-আচ্ছা আন্টি। ধন্যবাদ।
নাজনীন বেগম হাসলেন।
-আপনারা ব্রেকফাস্ট করেছেন?
-হুম।
-শিলা কোথায়?
-স্কুলে। কোনো প্রয়োজন ছিল?
-নাহ, এমনি।
-শাইনি উঠেছে? শরীর কেমন এখন ওর?
বেলা মৃদু হেসে বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো।’
-ভালো হলেই ভালো। ওহ আচ্ছা দাঁড়াও।
বেলা দাঁড়ালো।
-কিছু বলবেন আন্টি?
-হুম। তোমরা জন্য মিষ্টি বানিয়েছি।
বেলা অবাক হয়ে বলল, ‘আমার জন্য? কেন?’
নাজনীন বেগম খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন, ‘আজ খুশির দিন তাই।’
-খুশির দিন? আজ কী আন্টি?
নাজনীন বেগম বললেন, ‘শাইনির শরীরটা আজ ভালো। সেটাই বলছিলাম আরকি!’
-ওহ।
-হুম।
-আচ্ছা আমি ঘরে যাই। ওনার খাবারটা দিয়ে আসি।
-আচ্ছা যাও।
সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে বেলা ভাবলো শাইনির জন্য এমন উৎফুল্লতা কোনোদিন তো নাজনীন বেগম প্রকাশ করেননি! তাহলে আজ এত খুশি কেন? আর এতই খুশি যে মিষ্টি খাওয়ানোর মতো? স্ট্রেজ! মহিলাটার হলো কী? কত রুপ যে দেখাবে ওনি, ওনিই জানে!
ঘরে এসে দেখলো শাইনি বিছানায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। বেলা খাবার নিয়ে ওর সামনে রাখলো। স্যুপের গন্ধ পেয়ে শাইনি তাকালো অসহায় ভাবে।
-কতদিন এসব উটকো খাদ্য খাওয়াবে আমাকে?
-যতদিন পর্যন্ত খাওয়া লাগে!
-আমাকে একটু বাইরে নিয়ে চলো প্লিজ। বাসার ভেতর দম বন্ধ লাগছে আমার। একটা কথা শুনো।
বেলা ওকে থামিয়ে দিলো।
-সব কথা পরে শুনবো। খাবারটা ইমিডিয়েটলি শেষ করুন।
শাইনি অসহায় চোখে তাকালো। বলল, ‘ওকে।’
খাওয়ার পর্যায় শেষ করে শাইনি বেলার কোলে মাথা রেখে বলল, ‘আমাকে একবার বাইরে নিয়ে চলো না প্লিজ!’
বেলা কড়া গলায় বলল, ‘আপনি ঠিক কতটা অসুস্থ তা কি আপনি জানেন?’
-জানতে চাইও না।
-আপনার জন্য আমাদের অনেক চিন্তা হয়, বুঝলেন! শরীরের প্রতি এতটা বেখেয়ালি হবেন না প্লিজ। বাইরে যাওয়াটা কোনোভাবেই পসিবল নয় আপনার পক্ষে!
-আমি তো তোমার সঙ্গে যাচ্ছি। অন্য কারো সঙ্গে নয়।
-না।
শাইনি অধৈর্য কন্ঠে বলল, ‘বিয়ের পর আমরা কোথাও গিয়েছি? তোমাকে নিয়ে আমার কত স্বপ্ন ছিল, তার কিছুই তো পূরণ হলো না। আমার আফসোস হচ্ছে খুব।’
বেলা বলল, ‘আপনাকে সুস্থ করতে যা যা প্রয়োজন, সবই করে যাচ্ছি আমরা৷ এতটা অবুঝ হবেন না প্লিজ।
-শুধু আজকের দিনটা প্লিজ। থেরাপি দেওয়া স্টার্ট করলে তো হসপিটাল আমার বাড়িঘর হয়ে উঠবে।
-নো ওয়ে।
-প্লিজ বেলা বউ না করো না। তুমি সবুজ শাড়ি আর আমি সবুজ পাঞ্জাবি পরে একটু হাঁটবো রাস্তায়। আর কোনো এক রেস্টুরেন্টে ডিনার করে চলে আসবো। ডিনারটা আমি সন্ধ্যাবেলায় নিয়ে নেব। প্লিজ! আলমিরাতে দেখো শাড়ি-পাঞ্জাবি আছে।
বেলা অবাক হয়ে উঠে গিয়ে আলমিরা খুলে দুটো প্যাকেটে শাড়ি,পাঞ্জাবি দেখে অবাক হয়ে বলে, ‘কখন কিনলেন এগুলো?’
-সেদিন। আব্বুর সাথে ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরার সময়।
-আংকেল যেতে রাজি হলো?
-জোর করে নিয়ে গিয়েছি।
-আপনি লোকটা মানসিক রোগী!
-যা ভাবার ভাবতে পারো।
-হুহ!
-যাবে তো?
বেলা এবার রাজি না হয়ে পারলো না। আর রাজি না হলেও শাইনি ঠিকই ওকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তো। বেলা হঠাৎ কেঁদে ফেললো। শাইনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কাঁদছো কেন?’
-আপনাকে সুস্থ করতে পারবো তো আমি? আমরা সবাই?
শাইনি ঢোক গিলে বলল, ‘অবশ্যই।’
-আমার নিজেকে প্রচন্ড দুর্বল মনে হচ্ছে। আপনার যদি কিছু একটা হয়ে যায় আমি তাহলে কীভাবে বাঁচবক? মরে যাবো একদম।
শাইনি হেসে ওকে বুকে জড়িয়ে নেয়। গম্ভীর কন্ঠে বলে, ‘শোনো বেলা বউ! কেনো ভাবছো তুমি পারবেনা? তুমি দুর্বল? যেই তুমি শক্ত মনে নিজের স্বামীর অন্যায়কে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে, প্রতিবাদ করলে এবং দিনশেষে ভালোবাসলে এবং তাঁকে কঠিন এক রোগ থেকে মুক্তি দিতে আপ্রাণ চেষ্টা চালালে এবং চালিয়ে যাচ্ছো! ভাবো, সেই তুমি কতো টা শক্তিশালী আগের চেয়ে, কতটা নমনীয় এবং অসাধারণ একজন। এটা কি তুমি জানো?’
বেলা শাইনির বুকে মাথা রেখেই বলল, ‘জানিনা। জানতে চাইও না।’
বিকেলের দিকে শাইনিকে নিয়ে বাইরে বেরুলো বেলা। বাড়ির গাড়ি করেই রওয়ানা হলো৷ ড্রাইভার আছে সঙ্গে। শাইনির পরণে সবুজ পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা। অসুস্থ রোগা শরীর, তবুও ঠোঁটের কোণে ছিলো প্রশান্তির উষ্ণ হাসি৷ বেলার পরণে সবুজ শাড়ি সঙ্গে খোলা চুল, হাতে কাচের সবুজ চুড়ি। দেখতে ভীষণ মায়াবী লাগছিলো ওকে। কিন্তু শাইনির কাছে কীসের যেন একটা কমতি মনে হচ্ছে। প্রিয়তমার সাথে অনেকদিন পর বাইরে বেরিয়ে শাইনির মনে হচ্ছিল ও পুরোপুরি সুস্থ একটা মানুষ। বেলা আছে বলেই ও বেঁচে থাকার স্বাদ পাচ্ছে। নয়তো জীবনের প্রতি ওর এতোটা মায়াও নেই! গাড়ি থামলো সম্পূর্ণ খালি একটা রাস্তায়। দু-পাশে ঘন সবুজের সমারোহ! তার মাঝে ওরা দুজন হাত ধরাধরি করে হাঁটছে। বেলা খুব সাবধানে পা ফেলে ওকে নিয়ে এগুচ্ছে। কিছুদূর এগুতেই বন্যঝোপে ফুটে থাকা জংলি সাদা ফুলের গোছা দেখতে পেয়ে সেগুলো মুঠো করে ছিঁড়ে নিলো শাইনি। বেলার চুলে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘এটাই মিস ছিলো। এবার পারফেক্ট!’
বেলা হাসলো। শাইনি স্বপ্নালু চোখে তাকালো ওর দিকে। কন্ঠে উচ্ছলতা।
-তোমার মনে আছে পাহাড়ের ওই দিনগুলোর কথা?
বেলা হেসে বলল, ‘মনে থাকবে না? জীবনের প্রথম কিডন্যাপারের সাথে ঘুরতে গিয়েছিলাম তা কী আর ভোলা যায়? হা হা। আমার কিডন্যাপার বর!’
-কিডন্যাপার বরটা কিন্তু একপিসই। আর খুঁজেও পাবেনা।
-তা তো বটেই! বেলা হাসতে হাসতে বললো।
অনেকক্ষণ ঘুরাঘুরি করার পর শাইনি বেলাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে চলে এলো। নামীদামি রেস্টুরেন্ট। বিভিন্ন রঙিন আলোয় সজ্জিত। চারপাশটা ভুতুড়ে নীরব৷ ভেতরে কোনো মানুষজন নেই। শাইনি পুরোটাই বুক করে নিয়েছে। ওরা দুজন গিয়ে টেবিলে বসলো। শাইনি বেলার পছন্দমতো খাবার অর্ডার দিতে বললো। নিজের জন্য কিছুই নিলো না। কারণ বাইরের খাবার খাওয়া ওর জন্য মানা। আর বেলা তো খেতেই দিবে না। অবশ্য বেলা হট টিফিন ক্যারিয়ারে ওর পছন্দের খাবার তৈরি করে নিয়ে এসেছে। ওয়েটার খাবার সাজিয়ে দিয়ে গেলো৷ দুজনে মিলে গল্প করতে করতে খেলো বেশ ভালো একটা সন্ধ্যা কাটিয়ে বাড়ি ফিরে এলো দুজন।
বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে শাইনিকে ঔষধ দিয়ে ওর পাশে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়লো। দুজনেই খুব ক্লান্ত থাকায় আর নিচে নামলো না বেলা।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই কানে এলো চেঁচামেচির শব্দ। নিচ থেকে হট্টগোলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। পাশে তাকিয়ে শাইনিকে দেখতে না পেয়ে অবাক হলো বেলা। বাথরুমেও নেই৷ তাহলে কী নিচে? অসুস্থ শরীরে আবার নিচে নামতে গেলো কেন ও? আজ আবার ডাক্তারের এপয়েনমেন্ট আছে! লোকটাকে আর পারা যায় না! বেশ রেগেই ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে এসে যা দেখলো তা দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল না বেলা!
চলবে…ইনশাআল্লাহ!