শ্রাবণ_তোমার_আকাশে,১৯,২০

0
1309

শ্রাবণ_তোমার_আকাশে,১৯,২০
লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
পর্ব___১৯

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই কানে এলো চেঁচামেচির শব্দ। নিচ থেকে হট্টগোলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। পাশে তাকিয়ে শাইনিকে দেখতে না পেয়ে অবাক হলো বেলা। বাথরুমেও নেই৷ তাহলে কী নিচে? অসুস্থ শরীরে আবার নিচে নামতে গেলো কেন ও? আজ আবার ডাক্তারের এপয়েনমেন্ট আছে! লোকটাকে আর পারা যায় না! বেশ রেগেই ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে এসে যা দেখলো তা দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল না বেলা! ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে এলো। নাইমুদ্দীন সাহেব এসেছেন। শাইনিও এখানে আছে। অতএব নিচে কী চলছে তা বুঝতে বাকি নেই ওর। নাইমুদ্দীন সাহেব আর শাইনির মধ্যে কথা কাটাকাটি চলছে। তিনি কিছুতেই বেলাকে ছাড়া যাবেন না। ওকে নিয়ে যেতে এসেছেন তিনি। তবে ওনি খবর কীভাবে পেলেন সেটা বেলা কিছুতেই বুঝতে পারছেনা। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে ওর। কী হবে না হবে এতে শাইনি আরও উত্তেজিত হয়ে পড়তে পারে। এমনিতে লোকটা সারাদিনে হাজার বার টেনশন করে। প্রশ্ন করতে করতে পাগল করে দেয় বেলাকে। সেখানে আবার নতুন করে আরেক ঝামেলা শুরু হলো। বেলার মাথাটা ধরে আসলো খুব। নাইমুদ্দীনের সাহেবের উচ্চ কন্ঠে কথা বলাটা বারবার শাইনির হৃদস্পন্দনকে কাঁপিয়ে তুলছে। গলা শুকিয়ে আসলেও যথাসম্ভব ঠান্ডা মাথায় শাইনি ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বলল,
-আংকেল আপনি বোঝার চেষ্টা করুন! বেলা এখনো আমার বিবাহিতা স্ত্রী।
নাইমুদ্দীন সাহেব কঠিন গলায় বললেন, ‘তার আগে ও আমার মেয়ে। আর আমার মেয়েকে আমি তোমার মতো লম্পট, চরিত্রহীনের সাথে সংসার করতে কিছুতেই দেব না।
শাইনি বলল, ‘সবটাই আপনার বোঝার ভুল। সেদিন ঠিক কী হয়েছিল সেটা আপনি জানেন না বিধায় এই কথা বলছেন।’
-আমি কিছুই জানতে চাইও না। অন্তত তোমার কাছ থেকে না।
-এটা কোনো কথা নয় আংকেল!
-তাহলে কোনটা কথা? তুমি আমার মেয়ের জীবনটাই নষ্ট করতে উঠেপড়ে লেগেছে। লাভ কী এসব করে?
-আমি ওকে ভালোবাসি আংকেল।
নাইমুদ্দীন সাহেব তাচ্ছিল্য করে বললেন, ‘ভালাবাসা মাই ফুট। ভালোবাসা কাকে বলে জানো তুমি? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কী জানো? বিয়ের মতো পবিত্র সম্পর্ক সম্বন্ধে জ্ঞান আছে তোমার? কিচ্ছু নেই। আসলে এসব তো পরিবার থেকে শিখতে হয়৷ যেখানে তোমার বাবা-মা তোমাকে এসব শিক্ষা দেয়নি, সেখানে তাদের ছেলে কেমন হবে তা আমার বোঝা হয়ে গেছে।’
শাইনি রাগ চেপে বলল, ‘আমার পরিবারের লোকজনদের এর মধ্যে টানবেন না।’
-টানতে হবে। কারণ ওনারা তোমার জন্মদাতা-জন্মদাত্রী। ছেলের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিবরণ ওনাদের শোনা দরকার।
শাইনি বলল, ‘আংকেল আপনি শান্ত হোন আর আমার কথা ঠান্ডা মাথায় শুনুন। আপনি একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি। নিশ্চয়ই এমন কিছু করবেন যা যাতে আমার ভালোবাসা আমার থেকে দূরে সরে যায়!’
নাইমুদ্দীন সাহেব বললেন, ‘আমি তোমার ভালোবাসা নিয়ে কিছু বলতে চাই না। যে ছেলে বিয়ের আগে-পরে অন্য মেয়েদের সাথে সম্পর্ক রাখে তাকে নিয়ে বলার মতো কিছু আমার শব্দ ভান্ডারে নেই।’

আলম সাহেব বরাবরই ঠান্ডা স্বভাবের মানুষ। ঝুট ঝামেলা তার পছন্দ নয়। কিন্তু নিজের ছেলেকে নিয়ে কোনো কম্প্রোমাইজ করতে রাজি নন তিনি। তার অসুস্থ ছেলেটাকে এতোটা হার্ট করবে কেউ, আর তিনি বসে বসে সহ্য করবেন তা কখনোই হতে পারেনা। নো নেভার। এতক্ষণ বসে বসে ছেলে আর নাইমুদ্দীন সাহেবের কথা শুনছিলেন তিনি। নাজনীন বেগম ডাইনিং টেবিলের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আড়ি পাতছেন। শিলা বোধহয় বাড়িতে নেই, বেলা সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে সবকিছু শুনছে। ভয়ে এক পা নড়ার সাহস হচ্ছেনা ওর। শাইনিকে ছেড়ে কোত্থাও যেতে পারবেনা ও। বাবা কেন কোনো কথা শুনতে চাইছেনা? ওর বাবা তো এমন নয়!

আলম সাহেব এবার মুখ খুললেন। তিনি মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে নাইমুদ্দীন সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন,
-ভাইজান, আপনি আমার কথা শুনুন।
বেলার বাবা অনিচ্ছাবশত বলল, ‘দেখুন ভাই। আমি আপনাদের সাথে তর্কে জড়াতে আসিনি। আমার মেয়েকে দিন, এই নরক থেকে নিয়ে যাই!’
আলম সাহেব বললেন, ‘আপনার মেয়েকে আমরা নরকে রাখিনি। ও যথেষ্ট সুখে আছে।’
-যে ছেলে কিডন্যাপ করে আমার মেয়েকে নিয়ে আসে, সে আমার মেয়েকে সুখে রেখেছে এটা আমার মানতে হবে? আর যাইহোক, আজ আমার মেয়েকে নিয়ে তবেই যাবো। দরকার হলে পুলিশ ডাকবো।

আলম সাহেব বললেন, ‘আপনার মেয়ে যথেষ্ট ভালো। মানছি আমার ছেলে একটা ভুল করে ফেলেছে, কিন্তু তা শুধরে নিয়েছে শাইনি। আর আপনি তো জানেন আমার ছেলে অসুস্থ!’
নাইমুদ্দীন সাহেব বললেন, ‘এটা অসুস্থতা নয়। এটা আপনাদের চাল, নাটক। আমার মেয়েকে আপনার চরিত্রহীন ছেলের বউ করার জন্য বেলার ব্রেইন ওয়াশ করে চলেছেন আপনারা। সেসব কী আমি জানিনা ভেবেছেন?

শাইনির রক্ত ছলকে উঠলো। মাথা গরম হয়ে গেলো। আলম সাহেব শক্ত করে ওর হাত ধরে রাখলেন। তারপর হাসিমুখে বললেন, ‘বেলা অবুঝ বাচ্চা না যে আমরা যা বলবো সে তা বিশ্বাস করে নেবে। আপনার মেয়েকে আপনি ভালো চিনেন ভাইজান।’
-দেখুন। আমার সময় নষ্ট না করে বেলাকে ডাকুন।

শাইনি এবার রুখে দাঁড়ালো। কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘বেলা বউকে আপনি কোথাও নিয়ে যেতে পারবেন না। আমি কোথাও নিয়ে যেতে দেব না।’
-আমার মেয়েকে আমি নিয়ে যাব। দেখবো কে আটকায়!
-আংকেল আপনি বাড়াবাড়ি করছেন। সবকিছুর লিমিট থাকে!
-লিমিট তুমি ক্রস করেছো। আমার মেয়েকে তুলে এনে। জোর করে নিজের কাছে আটকে রাখতে বাধ্য করেছো।
শাইনির বুক কেঁপে উঠলো।
-বেলাকে নিজের ভালোবাসার মিথ্যে নাটক করে ফাঁসিয়েছো । আমার বোকা মেয়ে তাই মেনেছে।
শাইনি ধরা গলায় বলল, ‘ও আমাকে ভালোবাসে।’
-এটা তোমার ভুল ধারণা। আমার মেয়ের বিশ্বাস যে একবার ভাঙে সে দ্বিতীয়বার হাজার ভালো কাজ করে বিশ্বাস অর্জন করার চেষ্টা করলেও তাকে মন থেকে মাফ করেনা। আর সেখানে তোমাকে? ইম্পসিবল! তোমার অসুস্থতা, অসহায়তার কথা শুনে হয়তো সাময়িকভাবে তোমার প্রতি উইক হয়ে পড়েছে, কিন্তু পরবর্তীতে ঠিকই নিজের ভুল বুঝতে পারবে। ও তোমাকে ভালোবাসেনা এই সত্যটা যত তাড়াতাড়ি বিশ্বাস করতে পারবে ততই কম কষ্ট পাবে তুমি।

শাইনি একেবারে চুপ হয়ে গেলো। ধপ করে সোফায় বসে পড়লো৷ চোখের কোণে পানি জমলেও তা গড়িয়ে পড়ে না। নিজেকে ব্যর্থ মনে হয়। সত্যিই তো, ওর জোরাজুরিতেই তো বেলা এ বাড়িতে রয়েছে। তাহলে কী নাইমুদ্দীন সাহেবের কথাই ঠিক? বেলা ওকে ভালোবাসে না? শুধু ওর মন রক্ষার জন্য এসব করছে? ও অসুস্থ বলে দয়া দেখাচ্ছে?

সোফায় বসে থাকা নাইমুদ্দীন সাহেবের এবার চোখ পড়লো সিঁড়িঘরে দাঁড়ানো বেলার ওপর। নিমিষেই তার চেহারা রক্তিম হয়ে উঠলো। তিনি সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বেলার সামনে এসে কিছু না বলেই ঠাস করে একটা থাপ্পড় মারলেন। বেলা হতভম্ব হয়ে গেলো। নাইমুদ্দীন সাহেব শক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে কী করো তুমি?’

বেলা ভয়ে চুপসে গেলো। কয়েক কদম দূরে শাইনি বসে আছে। ওর মুখাবয়ব দেখেই বেলা বুঝতে পারলো ভীষণ রেগে গেছে ও। শুধু চুপচাপ বসে নাইমুদ্দীন সাহেবের কান্ড দেখছে। বেলার গায়ে হাত উঠানোর পর শাইনি আর ধৈর্য রাখতে পারলো না। কিন্তু আলম সাহেব ইশারায় ওকে চুপ থাকতে বললেন। নয়তো পরিস্থিতি সামলানো দায় হয়ে পড়বে!

বেলা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। নাইমুদ্দীন সাহেবের কথার উত্তর দেয় না ও। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীভাবে পারলে এসব করতে? ওই ছেলের জন্য নিজের বাবাকে মিথ্যা বলতে একবারও বিবেকে বাঁধা দিলো না?’
বেলা দু’হাতে মুখ চেপে কেঁদে দিলো। এতদিন পর বাবাকে দেখে মনটা শান্ত হলেও কান্না পেয়ে গেলো।সাথে ভয়ও হচ্ছে। শাইনিকে হারিয়ে ফেলার ভয়। বাবার বুকে মাথা রেখে ক্রন্দনরত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-আব্বু, কেমন আছো?
নাইমুদ্দীন সাহেব মেয়ের ওপর রাগ ধরে রাখতে পারলেন না। বললেন, ‘ভালো আছি। এসব করার আগে আমার কথা মনে পড়েনি? আজ দুইমাস তুমি বাসা ছেড়ে বেরিয়েছো এই ছেলেটার সাথে। জানি তুমি নিজে যাওনি, জোর করে নিয়ে এসেছে। তবুও, শহরে ফেরার সাথে সাথে তুমি আমাকে একবারও জানাওনি কেন? দিনের পর দিন তোমার মাকে দিয়ে মিথ্যে বলিয়েছো৷ এসব কী ঠিক ছিল? আমাকে কেন অন্যের কাছ থেকে খবর নিয়ে এখানে আসতে হলো?’
-জানানোর মতো পরিস্থিতি তখন ছিল না।
নাইমুদ্দীন সাহেব বললেন, ‘যাইহোক, চলো আমার সঙ্গে।
বেলা ভয়ার্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায়?’
-বাসায়। এতদিন বাড়ি ছেড়ে আছো। এবার তো চলো।
শাইনি বলে উঠলো, ‘কোথাও যাবেনা ও। আমার সঙ্গে থাকবে।’
-কখনো হবেনা এটা।

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব___২০

‘কখনো হবেনা এটা। আমার মেয়ে যেতে না চাইলেও আমি নিয়ে যাব।’
‘বেলা বউ যেমন আপনার মেয়ে, তেমনই আমার লিগ্যাল স্ত্রী। ওর ওপর আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে!’
নাইমুদ্দীন সাহেব একবার বেলার মুখের দিকে তাকালেন। দৃষ্টি ফিরিয়ে বললেন, ‘আমার মেয়ে আমার সিদ্ধান্তকে যথেষ্ট সম্মান করে। ও আমার সাথেই যাবে৷ ওর চুপ থাকাটাই প্রমাণ করতে যথেষ্ট যে ও তোমাকে ভালোবাসে না। তুমি সাইকোর মতো ব্যবহার করছো শাইনি। ঝামেলাটা এখানেই বন্ধ করলে সবার পক্ষেই ভালো হয়। তুমি তোমার ক্যারেক্টারের মেয়েদের ডিজার্ভ করো। আমার মেয়েকে না। অবশ্য আমারই ভুল। বিয়ের আগে তোমার সম্বন্ধে সবকিছু ভালো করে জেনে নেওয়া উচিৎ ছিল!’

বেলা ওর বাবা আর শাইনিকে কথা কাটাকাটির মাঝে থামিয়ে দিলো।
‘আব্বু প্লিজ থামো। আমার এসব ভালো লাগছেনা।’
‘তুমি আমার সঙ্গে চলো।’ বললেন নাইমুদ্দীন সাহেব।
শাইনি বাঁধা দিলো আবার।
‘যাবেনা বলেছি তো!’
বেলা কথা গোছাতে হিমশিম খাচ্ছে৷ শাইনির এখন চিল্লাচিল্লি করা উচিৎ না, কিন্তু লোকটা তা-ই করছে। নাইমুদ্দীন সাহেবকে চটালে তিনি আরও রাগবেন। তাই বেলা ধমকের সুরে ওকে বলল, ‘আমাদের বাবা মেয়েকে একা কথা বলতে দিন। আমি কোথায় যাব না না-যাব সেটা আমার ব্যাপার। আপনি আপনার ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকুন৷ যান।’

শাইনির মনের অবস্থা ভালো নয়। বেলাকে চুপচাপ থাকতে দেখে ও যে দহনে পুড়ছে সেটা বলে বোঝানোর মতোন নয়। এখন আবার ওকে ধমকাচ্ছে? তাহলে বেলার বাবার কথাই ঠিক। শাইনিকে ভালোবাসলে বেলা নিশ্চয়ই ওর বাবার সঙ্গে যেতে চাইতো না। অথচ ও কি-না চুপ করে আছে! এই ওর ভালোবাসা? আর এখন বেলা ওর বাবাকে কী বলতে চায়? শাইনিকে যে দয়া দেখাচ্ছে এটা জানাতে চায়? মন বিষিয়ে উঠলো ওর। বেলার চুপ থাকাটা সহ্য হচ্ছেনা মোটেও। বড় বড় পা ফেলে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো। ঠাস করে ঘরের দরজা বন্ধ করে হাতের কাছে যা পেলো তাই-ই ছুঁড়ে মারলো। ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখা কাচের পারফিউমের বোতলটা মেঝেতে আছড়ে ফেলতেই ঝনঝন শব্দ তুলে সেটা ফেটে চৌচির হয়ে গেলো। এর মধ্যে থেকে সবচেয়ে বড় ভাঙা টুকরোটা হাতে নিয়ে কবজিতে কয়েকটা টান দিলো শাইনি। তারপর! তারপর হাতে-পায়ে, বুকে-পিঠে ইচ্ছেমতো কাটলো। একটুও কষ্ট হচ্ছেনা ওর৷ ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন বন্ধ হয়ে গেছে। অনুভূতিরা মরে গেছে। ভালোবাসায় এত কষ্ট কেন? বেলা নামক মেয়েটিকে ভালোবাসা কি ওর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল? মেয়েটি ওকে ভালোবাসেনা? তাহলে এত কেয়ার দেখানোর কি দরকার ছিল? কেন প্রতিরাতে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলতো ‘ভালোবাসি’ শব্দটা? ও কী রাস্তায় পড়ে থাকা ডাস্টবিনের কোনো কুকুর? যে সবাই তাচ্ছিল্য করছে? ভালোবাসে সে তাঁর বেলাকে। এটা কেন সবাই মেনে নিতে চাইছেনা? ওফ…! আর ওর মা। মহিলাটি যেন থেকেও নেই। ওর সুখে-দুঃখে এই মহিলাকে পাশে পায়নি কোনোদিনও। অথচ এই নারীজাতিই নাকি পাগলের মতো ভালোবাসতে পারে। কই, মা ওর সাথে তো ভালো করে কথাই বলে না। ছোটবেলা থেকেই তার মা- নামক মহিলাটি কোনোদিন ওকে বুকে তুলে নেয়নি, ভালোবাসেনি শিলার মতো। আর এক বেলা, যে নারীটি ভালো না বেসেও ভালোবাসার নাটক চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই দুজন রমণীর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কাঙ্গাল হয়ে ঘুরেছে এতদিন। আর তা করবেনা শাইনি৷ ঠিক করে নিলো সে! তাছাড়া বেলার বাবা তো আর মিথ্যে বলবেনা। মেয়েকে এতগুলো বছর লালনপালন করে এসেছে। এমনিতেও বেলা অসহায় মানুষের প্রতি দয়াশীল। সবাই ঠিক, শাইনিই শুধু ভুল। ওর এই পৃথিবীতে আসাটাই যেন ভুল। ভালোবাসার যোগ্য নয় সে। বেলা ঠিকই বলেছিল! শেইম অন ইউ শাইনি, শেইম অন ইউ! নিজেকে নিজেই ধিক্কার দিলো সে। হাত থেকে গড়িয়ে পড়া রক্তের ফোঁটা গুলো মেঝেতে ঝরে পড়ছে। সেদিকে ওর খেয়াল নেই৷ ভাবনায় মত্ত্ব শাইনির মনের ভেতর চলা দহনক্রিয়া কেউ জল হয়ে নেভাতে আসেনি। ঘরের ভেতর চলা এই তান্ডবলীলার শব্দ সেদিন কারোর কানেই পৌঁছায়নি সাউন্ড প্রুফ রুম হওয়ার কারণে। কেউ জানতেই পারলোনা বেপরোয়া ছেলেটা ভালোবেসে নিজেকে নিজেই কষ্ট দিয়েছে …

___________________________
বেলা ওর বাবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বরাবরই সে তাঁর বাবার রাগকে ভয় পায়। আজও পাচ্ছে। তিনি যেহেতু একবার নিয়ে যাবেন বলেছেন সেখানে নিয়েই যাবেন। কিন্তু বেলা তো শাইনিকে ছেড়ে কোথাও যাবেনা, যা-ই হয়ে যাক না কেন! অতএব একটা রাস্তাই খোলা আছে। বাবাকে বোঝাতে হবে। নাইমুদ্দীন সাহেব নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে ওর মনের অবস্থা। মেয়েকে চুপ করে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী বলতে চাও? ওই চরিত্রহীন ছেলেটা..!’

বেলা ওর বাবার দিকে চেয়ে বলল, ‘আব্বু থামো প্লিজ। তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে?’
‘কীসের কথা?’ ধমকে উঠলেন নাইমুদ্দীন সাহেব।
‘দরকারি কথা আব্বু।’
‘বলো!’
‘এখানে নয়। তুমি আমার সঙ্গে চলো।’
নাইমুদ্দীন সাহেব ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘সবার সামনে বললে কী সমস্যা?’
‘আমি শুধু তোমাকেই বলতে চাই।’
নাইমুদ্দীন সাহেব বললেন, ‘চলো তাহলে।’
বেলা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘ছাদে চলো।’

বেলার কথা শুনে আলম সাহেব এগিয়ে এসে বেলাকে বললেন, ‘তার আগে আমার কিছু কথা আছে মা।’
‘জি আংকেল বলুন।’
আলম সাহেব এক কিনারে এসে ধরা গলায় বেলাকে বললেন, ‘দেখো মা! জানিনা তোমার বাবাকে তুমি কী বলবে, কিন্তু একবার আমার ছেলেটার কথা চিন্তা করে তোমার সিদ্ধান্ত নিও। তোমার বাবা তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছে, চাইলেই তুমি চলে যেতে পারো। এটা তোমার ওপর ডিপেন্ড করে। আমরা আটকাতে পারবো না। কিন্তু আমার অসুস্থ ছেলের ভালোবাসাকে অবমূল্যায়ন করে যদি সত্যিই তুমি চলে যাও, তাহলে কখনোই না-তো আমি তোমাকে ক্ষমা করতে পারবো, না-তো তুমি নিজেকে নিজে ক্ষমা করতে পারবে। জানো তো শাইনির ব্যাকগ্রাউন্ড! ওর মায়ের মতো শাইনিও আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পায়তারা করছে। জানিনা ছেলেটাকে বাঁচাতে পারবো কি-না। কিন্তু এই সময়ে ওর কোনো ইচ্ছা আমি অপূর্ণ রাখতে চাইনা। আমার ছেলেটা শুধু তোমার জন্য নিজের মনোবল বাড়িয়েছে। বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছে ক্যান্সার নিয়েও।সে ট্রিটমেন্ট ফেলে দেশে এসেছে। এখন তোমাকে ছেড়ে যেতেও চাচ্ছেনা কোথাও। শুধু তোমার জন্য। খুব ভালোবাসে তোমাকে!’
বেলা আলম সাহেবকে বলল, ‘জানি আংকেল। চিন্তা করবেন না আপনি।’
‘তোমার ওপর ভরসা আছে। তোমার বাবা আমাদের কোনো কথা শুনতেই ইচ্ছুক নয়।’
বেলা বলল, ‘আপনি বাবাকে খবর পাঠিয়েছেন? যে আমি এখানে?’
আলম সাহেব অবাক হয়ে বললেন, ‘না। আমিতো ভাবলাম তুমি।’
‘আমি দিইনি।’
‘তাহলে? কেউ না জানালে তো আর তোমার বাবা খবর পেতো না।’
‘আমিও এটাই ভাবছি।’

রুক্ষ দুপুরের তেজদীপ্ত রোদে কমলা রঙ ধারণ করেছে প্রকৃতি। বেলা শাইনির ঘরের সামনে এসে দেখলো দরজা বন্ধ। ভেতর থেকে হালকা টুংটাং শব্দ আসছে। খুব বেশি শব্দ শোনা না গেলেও দেয়ালে কান পাতলে বোঝা যায় ফ্যান ঘুরছে। শাইনি ভেতরেই আছে। বাবার সাথে কথা বলে তারপর ঘরে যাবে বলে ঠিক করলো বেলা৷ নাইমুদ্দীন সাহেবকে নিয়ে ছাদে আসার কারণ, নিচে নাজনীন বেগম আছে। আর ওই মহিলাটির সামনে কথা বলতে চায় না ও। তাই এখানে আসা। নাইমুদ্দীন সাহেব বেলার উপর বিরক্ত হচ্ছেন। মেয়েটা এত ভনিতা করছে কেন? তবে কী ও যেতে চায় না? তিনি কাশি দিয়ে গলা ঝেড়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী বলতে এখানে এনেছো আমাকে?’
বেলা সিমেন্টের বসার জায়গাটায় বসলো। বলল, ‘কথাগুলো শুনে তুমি রাগ করবে জানি। তবে রাগ করলেও আমার কিছু করার নেই আব্বু৷ আমি নিরুপায়।’
নাইমুদ্দীন সাহেব ভ্রু কুঁচকালেন।
‘বলো।’
‘আব্বু, আমি এখান থেকে যেতে চাই না। এখানেই থাকতে চাই।’
রাগ উঠলো নাইমুদ্দীন সাহেবের।
‘কারণ?’
‘ওনি অসুস্থ। হ্যাঁ, ওনার লিউকেমিয়া এবং কাল ওনাকে হসপিটালে এডমিট করা হবে। ওনার থেরাপি শুরু হবে। কথাটা পুরোপুরি সত্য।’
‘তুমি কী চাচ্ছো?’
‘আমি ওনার পাশে থাকতে চাইছি।’
‘তোমাকে অন্ধ বানিয়ে রেখেছে, ব্রেইন ওয়াশ করেছে।’
‘আমি অবুঝ বাচ্চা না আব্বু। ডিভোর্সের কথা আমিই বলেছিলাম তোমাদের!’
‘সে তোমাকে অত্যাচার করে না?’
বেলা মুচকি হেসে বলল, ‘মোটেও না। ভালোবাসে আমায়।’
নাইমুদ্দীন সাহেব কিছুক্ষণ ভেবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি ছেলেটাকে ভালোবেসে ফেলেছো?’
বেলা কথা লুকায় না। সে নত গলায় জবাব দেয়, ‘হুম।’
‘এই ভুলটা কীভাবে করলে তুমি? ছেলেটা তোমাকে ঠেকিয়েছে!’
‘ঠকায়নি। ভালোবাসে ওনি আমাকে৷’
‘তোমাকে কিডন্যাপ করেছে।’
‘তা করেছিলো। কিন্তু ভালোবাসে বলেই করেছিল, আমাকে ছাড়তে পারবেনা বলে করেছিল। আর ওনার সাথে থাকতে গিয়ে, বুঝতে গিয়ে আমি মানুষটাকে না ভালোবেসে থাকতে পারিনি৷ ওনি আমার জন্য অনেক স্যাক্রিফাইস করেছেন। তাঁর বিনিময়ে আমার ভালোবাসাটা ওনার প্রাপ্য ছিল এবং আমি তা করেছিও। আমার মনে হয়না এটা ভুল।’
নাইমুদ্দীন সাহেব বললেন, ‘বিয়ের পরদিন হোটেলে কি করেছিল ভুলে গেলে?’
‘ভুলিনি। বরং এটা আমার জীবনের অন্যতম ভুল বুঝাবুঝি ঘটিয়েছিল।’

বেলা সেদিনের ঘটনা খুলে বললো তাঁর বাবাকে। তবে সন্তুষ্ট হলেন না তিনি। শাইনির সম্বন্ধে এত এত নেগেটিভ কথা শুনেছেন যার ফলে ঘৃণা ছাড়া অন্যকিছু তাঁর মনে আসছেনা। বেলা ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে গিয়েছে, তাই আবেগের বশে ঠিক-ভুল বিচার করার ক্ষমতা হারিয়েছে।
‘এখন তুমি আমার সাথে ফিরতে চাও না?’
‘ফিরতে চাই অবশ্যই। তবে শ্বশুরবাড়িই আমার আসল ঘর৷ তোমার বাসায় বেড়াতে যাব।’
‘আমার কিছুই বলার নেই।’
‘রাগ করো না। আর আমি যে এখানে আছি তার খোঁজ কে দিলো তোমাকে? মা বলেনি নিশ্চিত। তাহলে কে?’
‘সে তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী। নাম জানতে চেও না। আমি এখন তোমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিনা। আসছি আমি।’

নাইমুদ্দীন সাহেব বেলাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ছাদ থেকে নেমে গেলেন। অতঃপর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। বেলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাইনির ঘরে চলে এলো। দরজায় ধাক্কা দিলো, নক করলো। ভেতর থেকে বন্ধ সেটা। দু-একবার টোকা দিতেই ভেতর থেকে শব্দ এলো। বেলা দাঁড়িয়ে পড়লো।

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here