শ্রাবণ_তোমার_আকাশে,২১,২২

0
1302

শ্রাবণ_তোমার_আকাশে,২১,২২
লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
পর্ব___২১

নাইমুদ্দীন সাহেব বেলাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ছাদ থেকে নেমে গেলেন। অতঃপর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। বেলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাইনির ঘরে চলে এলো। দরজায় ধাক্কা দিলো, নক করলো। ভেতর থেকে বন্ধ সেটা। দু-একবার টোকা দিতেই ভেতর থেকে হালকা শব্দ এলো। বেলা দাঁড়িয়ে পড়লো। ওর বাবার কথা ভাবছে। তিনি এত সহজে ওকে কিছু না বলে চলে গেলেন কেন? ভালো করে কিছু বললেনও না আবার শুনলেনও না। বেলার সন্দেহ হচ্ছে। নাইমুদ্দীন সাহেব এত সহজে ওকে না নিয়ে ফিরে গেলেন! এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো রহস্য আছে। কি হতে পারে? ওফ, ভাবতে ভাবতে মাথাব্যথা হয়ে গেলো। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রাণভরে শ্বাস নিলো। চারদিকে যেন অক্সিজেনের অভাব। এত চিন্তা আর নেওয়া যাচ্ছেনা। এভাবে চলতে থাকলে খুব শ্রীঘ্রই পাগলের খাতায় নাম উঠবে ওর৷ ভাবনাগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেখলো শাইনির ঘরের দরজা বন্ধ। মানে কী? এখনো দরজা খুলেনি ও? বেলার মন আতঙ্কিত হলো। দরজা খুলছে না কেন শাইনি? নিচের ঘটনার জেরে রাগের মাথায় আবার কিছু করে বসেনি তো?

বেলা জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগলো। উপায় না পেয়ে নিচে আলম সাহেবের কাছে ছুটে গিয়ে সব খুলে বললো। আলম সাহেব ভয় পেয়ে তড়িঘড়ি করে উপরে চলে এলো। নাজনীন বেগমও এলেন। তবে তার মধ্যে তেমন কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। সবাই মিলে কয়েকবার ডাকতেই এবার ভেতর থেকে শাইনির গলা শোনা গেলো।
‘আমাকে কিছুক্ষণ একা থাকতে দাও প্লিজ।’
শাইনির রুক্ষ কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে বেলা অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি ঠিক আছেন? প্লিজ দরজা খুলুন।’
‘তোমরা যাও। আমাকে একা ছাড়ো প্লিজ।’
‘আপনি দরজা খুলুন।’
‘না।’
আলম সাহেব বললেন, ‘ওকে ওকে খুলতে হবে না। তুমি ঠিক আছো কি-না সেটা বলো।’
শাইনি জবাবে বলল, ‘আমি ঠিক আছি।’
নাজনীন বেগম বললেন, ‘বেচারাকে একা ছেড়ে দাও। শুধু শুধু ডিস্টার্ব করো না।’
আলম সাহেব ধমকে বললেন, ‘তুমি যাও এখান থেকে।’
নাজনীন বেগম মুখ কালো করে সেখান থেকে চলে গেলেন। বেলা বুঝতে পারছে শাইনির কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু দরজা না খুললে, কথা না বললে বুঝবে কীভাবে সেটা? তার ওপর ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। ও নড়লো না জায়গা থেকে। শাইনির উদ্দেশ্যে বলল, ‘আপনার আজ ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।’
শাইনি উত্তর দিলো না। আলম সাহেব বললেন, ‘কী হয়েছে ওর? এমন করছে কেন?’
‘আমি জানি না আংকেল।’
‘আচ্ছা কিছুক্ষণ একা ছেড়ে দাও। একটু পর নিজেই দরজা খুলবে।’
‘কিন্তু..’
‘শতবার বললেও এখন দরজা খুলবে না এই ছেলে। আর তোমার আব্বুর সাথে কী কথা হয়েছে মা?’
বেলা বলল, ‘আমি আব্বুকে জানিয়ে দিয়েছি আমি এখানে থাকবো।’
‘ওনি কিছু বললেন না?’
‘নাহ।’
‘ওনিতো তোমাকে নিয়ে যাবেন বলেই এসেছিলো। তাহলে এত সহজে চলে গেলো?’
‘বুঝতে পারছিনা আংকেল। আব্বু এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নন।’
আলম সাহেব বললেন, ‘আচ্ছা থাক। ওনি বোধহয় তোমার মুখ থেকে শুনতে চাইছিলেন যে এখানে মেয়ে ভালো আছে কি-না!’
‘হয়তো।’
‘আচ্ছা আমি যাই৷ ডাক্তার সুশান্তকে ফোন করতে হবে।’
‘ঠিক আছে।’

আলম সাহেব ওখান থেকে চলে গেলেও বেলা এক পা-ও নড়লো না সেখান থেকে। ওর ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। লোকটা এমন করছে কেন? দু’বার ডাকলো। শাইনি আগের মতোই চুপ। সে বেলার উন্মাদিত কন্ঠ শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু কষ্টে ওর বুক ফেটে যাচ্ছে। নিজের ওপর রাগ হচ্ছে। মানুষ বোধহয় মৃত্যুর আগে নিজের সব পাপ, ভুল বুঝতে পারে। শাইনির জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল বেলাকে ভালোবাসা। ওর প্রতি এত ভালোবাসা কেন ওর? তাইতো এখন কষ্ট পাচ্ছে। নাইমুদ্দীন সাহেবের কথাগুলো বুকের ভেতর তীরের মতো বিঁধছে। মনে হচ্ছে ওর সবকিছু শেষ! বেলার ওমন নিশ্চুপ থাকাটা কেন যেন মানতে পারছে না এখনো। রাগে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় ফুলদানি ছুঁড়ে মারতেই সেটাও ঝনঝন করে ভেঙ্গে পড়লো। মুছে গেলো শাইনির নিজের অবয়বটাও। নিজের চেহারাও দেখতে ইচ্ছা করছে না।

বেলা আওয়াজ শুনে পাগলের মতো দরজা ধাক্কাচ্ছে। বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে আর দরজা খোলার অনুরোধ করে যাচ্ছে ক্রমাগত। নিশ্চয়ই শাইনির কিছু একটা হয়েছে। নাহলে এমন ব্যবহার করার ছেলে না ও। এত কেন কষ্ট দিচ্ছে শাইনি ওকে। ও তো চলে যায়নি বাবার সাথে। তাহলে? একবারও কি শাইনি ওর কথা শুনতে চাইবে না? এদিকে বেলার কান্নার আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছে শাইনি৷ এই মেয়ের কান্না কোনোভাবেই সহ্য করতে পারে না ও। না চাইতেও শাইনি দুর্বল পায়ে উঠে দাঁড়ালো মেঝে থেকে। মনে হচ্ছে এখনি পড়ে যাবে। তবুও নিজেকে সামলে বিছানায় ভর দিয়ে দাঁড়ালো। কার্পেটের ওপর রক্তের ফোঁটাগুলো শুকিয়ে লেগে আছে। সবুজ কার্পেটের জায়গায় জায়গায় খয়েরি রঙ ধারণ করেছে।

বেলার কান্নার মাঝেই হুট করে দরজা খুলে শাইনি ওর হাত ধরে একটানে ওকে ঘরের ভেতর নিয়ে এলো। তারপর ঠাস করে দরজা বন্ধ করলো। বেলা আকস্মিক এমন টানে পড়ে যেতে নিলেও নিজেকে সামলে নিলো। ঘরে ঢুকে চারদিকের অবস্থা অবলোকন করে ও হতভম্ব হয়ে গেলো। ঘরের ওপর দিয়ে সুনামি বয়ে গেছে যেন! ড্রেসিং টেবিলের আয়না ভাঙা, ফুলদানি গুঁড়ো হয়ে পড়ে আছে। গ্লাস, জগ ভাঙা। বালিশ, বিছানার চাদর এলোমেলো। পর্দাগুলো স্ট্যান্ড থেকে ঝুলে আছে কোনোরকমে। পায়ের নিচে কার্পেটে রক্ত শুকিয়ে লেগে আছে। ভয়ার্ত চোখে শাইনিকে অবলোকন করে দেখলো ফর্সা গায়ে কাটা-ছেঁড়ার চিহ্ন। ভূত দেখার মতো চমকে ওঠলো বেলা। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না। ও দৌড়ে গেল শাইনির কাছে। শাইনি দরজায় হেলান দিয়ে বসে ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বেলাকে নিজের দিকে আসতে দেখে ও হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিলো।
‘আমার কাছে আসবে না তুমি। দূরে যাও।’
বেলা অবাক হয়ে গেলো।
‘কেন আসবো না? আর আপনি নিজের কী অবস্থা করেছেন?’
‘যা-ই করি না কেন তুমি আমার কাছে আসবে না।’

শাইনির কথা বেলা শুনলো না। জোর করে ওর কাছে গেল। হাতে, বুকে, পিঠে কাটা দাগ। রক্ত লেগে আছে। বেলা কাঁদতে থাকলো। ড্রয়ার থেকে এন্টিসেপটিক আর ব্যান্ডেজ এনে জায়গাগুলো পরিষ্কার করে সময় খানে ব্যান্ডেজ করে দিলো। শাইনি বাঁধা দিয়েও পারলো না৷ ওর শুধু বেলাকে দেখে যাচ্ছে। ও তো চায় বেলা ওকে এভাবেই ভালোবাসুক, কেয়ার করুক। কিন্তু সব যে অভিনয় সেটা তো ও চায় না। ও ভালোবাসা চেয়েছে, নাটক নয়। বুকের ভেতর দগ্ধ পোড়া অনুভূতি হচ্ছে। নির্নিমেষ বেলার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আচমকাই বেলার কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে এনে কানের কাছে মুখ রেখে বলতে লাগলো,
‘সখী, ভাবনা কাহারে বলে?
সখী, যাতনা কাহারে বলে?
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী
ভালোবাসা ভালোবাসা..
সখী, ভালোবাসা কারে কয়!
সে কি কেবলই যাতনাময়?
সে কি কেবলই চোখের জল?
সে কি কেবলই দুঃখের শ্বাস?
লোকে তবে করে
কী সুখেরই তরে,
এমন দুঃখের আশ!’

বেলা চোখের জল মুছতে মুছতে নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
‘এরকম কেন করছেন? নিজের অবস্থা কী করেছেন দেখেছেন আপনি?’
শাইনি উদাস কন্ঠে বলল, ‘কিছুই করিনি।’
‘পাগল হয়েছেন আপনি?’
‘হ্যাঁ। আমি পাগল, আমি নির্বোধ এবং বোকা। নইলে কী আমার মতো ছেলেকে তুমি ঠকাতে পারো?’
বেলা অবাক হয়ে বলল, ‘ঠকিয়েছি? আমি? কী বলছেন আপনি? মাথা ঠিক আছে তো আপনার?’
শাইনি উত্তর দিলো না। বেলা ওর মুখটা উঁচু করে বলল, ‘বলুন আমি কী করেছি? আমার অপরাধ কি?’
‘তুমি আমাকে ভালো না বেসেও ভালোবাসার অভিনয় করে চলেছো। এটা কী অপরাধ নয়?’ শাইনি বলল।
‘কে বলেছে আমি আপনাকে ভালোবাসি না?’
‘তোমার বাবা।’
বেলা ক্লান্ত ভঙ্গিতে দীর্ঘ করে শ্বাস নিলো। ক্রন্দনরত অবস্থায় বলল, ‘আপনি আব্বুর কথা ধরে বসে আছেন? আমাকে বিশ্বাস করেন না আপনি? আমার ভালোবাসার দাম নেই আপনার কাছে?’
শাইনি অতি কষ্টে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘ভালোবাসলে তো দাম থাকতো বেলা বউ। আমায় তো কেউ ভালোবাসে না।’
বেলা ওর গলা জড়িয়ে ধরলো৷ শাইনি সচকিত হয়ে উঠলো। ধমকের সুরে বলতে লাগলো, ‘ছাড়ো আমাকে। দূরে যাও বলছি!’
বেলা মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘যাবো না।’
শাইনি রেগে বলল, ‘আমাকে রাগালে ভালো হবে না বলে দিলাম। ঘর থেকে বেরিয়ে যাও।’
বেলা নাক টেনে বলল, ‘আমি আব্বুকে বলে দিয়েছি আপনাকে আমি ভালোবাসি।’
‘এসব নাটক ফাটকের জায়গা নেই আমার কাছে।’
‘আমি নাটক করছিনা।’
‘কারোর দয়ার প্রয়োজন নেই, তুমি এখান থেকে যাবে নাকি আমি কিছু একটা করে বসবো?’ শাইনি রাগী স্বরে বলল।
বেলা এবার নিজেই রেগে গেলো। ওর কথা না শুনে ওর বাবার বলা কথা ধরে বসে আছে। নিজেকে কষ্ট দিচ্ছে। এই লোক তো মহা বোকা! যত্তসব..
শাইনি বেলাকে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা কর‍তে লাগলো। বেলা ছাড়লো না দেখে ও রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার এসব নাটক বন্ধ করো বেলা। আমার ভালো লাগছে না।’
বেলা বলল, ‘আমি আপনার কোলেই বসে থাকবো।’
শাইনি ধাক্কা দিয়ে সরাতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। এদিকে বেলা ওর রাগ না ভাঙিয়ে ছাড়বে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছে৷ ওকে চমকে দিয়ে বেলা ওর মুখে আচমকা চুমু খেতে লাগলো। শাইনির বুকে মাথা রেখে বলল,
‘আমার কথা না শুনে আব্বুর কথা বিশ্বাস করেন। যাকে ভালোবাসেন তাঁকেই বিশ্বাস করেন না। এ কেমন ভালোবাসা আপনার?’
শাইনি বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বলল, ‘তিনি তোমার বাবা। মিথ্যে নিশ্চয়ই বলবে না।’
বেলা ভারী কন্ঠে বলল, ‘আপনি বুঝেননা কেন আমি আপনাকে ভালোবাসি? সবকিছু বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু আপনার প্রতি আমার ভালােবাসাটা থেকে যাবে, হয়তাে আক্ষেপে নয়তাে অপেক্ষায়।’

শাইনি বলল, ‘সত্যিকারের ভালোবাসাকে সম্মান করাটাও জরুরি।’
‘আপনি আমার ওপর রাগ করেছেন?’ জিজ্ঞেস করলো বেলা।
‘জানিনা।’ শাইনি মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
‘জানেন, অভিমান রাগ একমাত্র তার উপরেই করা যায়,
যাকে মানুষ সবচেয়ে বেশী ভালােবাসে। আপনি তো আমাকে ভালোবাসেন। আপনাকে পেয়ে আমি ভাগ্যবতী মনে করি নিজেকে৷ আর আপনি ভুল বুঝে দূরে ঠেলে দিচ্ছেন আমাকে। একটু তো তাকান আমার দিকে।’

শাইনি তাকালো না। বেলা ওর ওষ্ঠজোড়া শাইনির কপালে, চোখে, মুখে ছুঁইয়ে দিলো৷ শাইনি মুখ ফুটে কিছু বললো না। নিজেকে ধাতস্থ করে ভাবছে, আসলেই তো! যাকে ভালোবাসে তাঁর প্রতি বিশ্বাস না থাকলে সেটা তো ভালোবাসার পর্যায়েই পড়ে না। শাইনি বেলাকে ভালোবাসে। তাহলে কেন বেলার কথা না শুনে অন্যের কথায় নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিলো?

বেলা ছলছল চোখে তাকালো। শাইনি একটু থেমে নিজের চোখ বন্ধ করলো। চোখের কিনার বেয়ে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা নোনতা পানি। বেলাকে শক্ত করে নিজের সাথে জাপটে ধরে চিৎকার করে বলল, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। বুকের ভেতর যন্ত্রণা হচ্ছে। তোমার থেকে দূরে যাওয়ার কথা চিন্তা করলেই আমার ভেতরটা মরে যায়। বারবার মনে হয় আমি আর বেঁচে নেই। তোমাকে ভালোবেসে এত কেন কষ্ট পেলাম আমি? আর ক’টা বছর একসাথে থাকার সুযোগ কেন হবে না আমাদের? মরণ যন্ত্রণা হচ্ছে বুকের গভীরে। আমি বোধহয় মরে যাচ্ছি বেলা বউ! তোমার রঙিন আকাশখানি শ্রাবণের ধূসর আকাশে পরিণত হবে। কেন তোমার আকাশে শ্রাবণ আসবে? এসব ভাবলেই শরীর শিউরে ওঠে আমার!’

শাইনির হার্টবিট ট্রেনের বেগে ছুটছে। মাথার যন্ত্রণার সাথে সাথে বুকে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। বেলাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অদ্ভুত কন্ঠে বলল, ‘তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে। কিন্তু বলতে গিয়ে শব্দ খুঁজে পাই না। আমি যেন ক্রমশই সবার থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। এমন কেন হচ্ছে বেলা বউ? আমার কেন এত কষ্ট? আমার ভাগ্য এত নির্দয় কেন আমার প্রতি? আমি কেন তোমার সাথে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে পারবো না? কি করেছি আমি? আমি তো তোমাকে খুব ভালোবাসি। কেন আমার সাথে এসব হচ্ছে?’

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব___২২

ইউনাইটেড হসপিটালের তিনতলায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটি কক্ষে বসে কথা বলছেন ডাক্তার সুশান্ত আর আলম সাহেব। তিনি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত শাইনির সবগুলো রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করলেন। ডাক্তার সুশান্ত কিছু একটা ভেবে আলম সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বিদেশেও চিকিৎসা করিয়েছেন দেখছি!’
‘হুম। কিন্তু মাঝপথে বন্ধ করে শাইনি চলে এসেছে।’
ডাক্তার সুশান্ত অবাক হয়ে বললেন, ‘এটা কিন্তু মোটেও উচিৎ হয়নি।’
‘আমার কথা শোনেনি শাইনি। এখন জোর করেও নিয়ে যেতে পারছিনা। চিকিৎসা করলে দেশেই করাবে নয়তো না।’
‘এর আগে আপনাদের ফ্যামিলিতে কারোর লিউকেমিয়া ছিল?’
আলম সাহেব বললেন, ‘জি। শাইনির মায়ের ছিল।’
‘বুঝতে পেরেছি! আপনাদের পারিবারিক ইতিহাস এবং শাইনির সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে আমারও তাই মনে হচ্ছিলো।’
‘কিন্তু এখন শাইনির কী অবস্থা?’
ডাক্তার সুশান্ত বললেন, ‘দেখুন, এই অবস্থায় এত টেনশন করাটা যে কতটা ভয়ানক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে তা ভাবনার বাইরে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে ওর। আমার ধারণা মতে, শাইনির একটা স্ট্রোক হয়ে গেছে। বাকিটা রিপোর্ট এলেই বোঝা যাবে!’
আলম সাহেব স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। তিনি বুঝতে পারছেন না এখন কী করবেন। একদিকে শাইনির এই অবস্থা অন্যদিকে বেলা বাইরে বসে কান্না করছে। মেয়েটার মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করে ওনার মাথায় কিছুই আসছে না। যদিও নাজনীন বেগম ওকে সামলাচ্ছে। কিন্তু এই খবরটা শুনলে মেয়েটার কী অবস্থা হবে আলম সাহেব ভাবতেই পারছেন না। ছেলের জন্য তাঁর বুক ফেটে যাচ্ছে, সবকিছু সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। নিজেকে ব্যর্থ মনে হচ্ছে। মাথাটা ফাঁকা হয়ে আছে। ডাক্তার সুশান্ত ওনার অবস্থা বুঝতে পেরে নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মি. আলম, আপনি এত ভেঙ্গে পড়বেন না।’
আলম সাহেব শুকনো কন্ঠে বললেন, ‘আমাকে একটু পানি খাওয়ান দয়া করে।’

ডাক্তার সুশান্ত পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন আলম সাহেবের দিকে। অন্যমনস্ক হয়ে তিনি গ্লাসটা নেন। কিছুটা ছলকে পড়ে তাঁর শার্টে, তাতে ওনার কোনো হেলদোল নেই। এক চুমুকে পুরো গ্লাসটা খালি করে তিনি ডাক্তার সুশান্ত এর কেবিনে বসে থাকেন। নীরবতা কাটিয়ে একসময় তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘এটা কী থেরাপি দেওয়ার জন্য হয়েছে? আমি বলতে চাইছি শাইনির যেসব পরিবর্তন এসেছে সেগুলো? কেমোথেরাপির সাইড এফেক্ট?’

ডাক্তার সুশান্ত বিজ্ঞ ভঙ্গিতে বললেন, ‘ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীকে যখন কেমোথেরাপি দেয়া হয়, তখন শরীরে বেশি করে অনেক বেশি পরিমাণে মেডিসিন পুশ করা হয়। ফলে বিভিন্ন প্রকারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। তার মধ্যে অন্যতম কিছু, যেমন—চুল পড়ে যাওয়া, চোখের নিচে কালো দাগ ও খাবারে অরুচি হওয়া। এই সময়টা বেশ কঠিন, অনেক বেশি সাফার কর‍তে হয়। লিউকেমিয়া আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার পাশাপাশি খাবারের প্রতি প্রচুর যত্নশীল হতে হবে এই সময়ে।’
আলম সাহেব বললেন, ‘কিন্তু শাইনি তো কিছু খেতেই পারছে না!’
‘শাইনি একটু বেশিই অসুস্থ।’
‘আমি কিছু চিন্তা করতে পারছি না ডাক্তার। কী করা উচিৎ, কোথায় নিয়ে গেলে আমার ছেলে সুস্থ হবে আমার মাথায় কিছু আসছে না।’
ডাক্তার সুশান্ত বললেন, ‘সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছিলাম আমরা। কিন্তু থেরাপির সাইড এফেক্ট যে এতোটা প্রভাব ফেলবে সেটা ভাবনার বাইরে ছিলো আমাদের। আর ও হয়তো প্রথম থেকেই বেশি স্ট্রেস নিয়েছে৷’
‘ঠিক বলেছেন ডাক্তার। কত করে বোঝাতাম এত ভেবো না, তবুও কথা শুনেনি ছেলেটা।’ আলম সাহেব শুকনো গলায় বললেন।
ডাক্তার সুশান্ত কপাল কুঁচকে হাসলেন। তারপর নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন, ‘টেনশন তো আর বলে কয়ে আসেনা আলম সাহেব! যারটা সে-ই বুঝে। মানবজীবনই এমন। চিন্তাহীন কোনো মানুষ নেই। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে প্রতিনিয়ত মানুষকে চিন্তা করতে হয়। তবে খেয়াল রাখতে হবে এটা যাতে দুশ্চিন্তায় পরিণত না হয়।’

এমন সময় সাইড টেবিলের ওপর রাখা লাল রঙের টেলিফোনটা বেজে ওঠলো। ডাক্তার সুশান্ত ফোনটা রিসিভ করে কথা বলতে লাগলেন। মনে হচ্ছে কারো সাথে আলোচনা করছেন এবং কথা শেষে ওপাশে থাকা ব্যক্তিকে কেবিনে আসতে বললেন। সাথে আরও তিনজন ডাক্তারের নাম বললেন। ফোন রেখে তিনি আলম সাহেবের দিকে তাকালেন। নরম স্বরে বললেন, ‘মি. আলম। শাইনির রিপোর্টগুলো এসে পড়েছে। ডাক্তার সাঈদুল সাহেবের সাথে কথা হয়েছে। ওনারা এখানে আসছেন। আমাদের কিছু আলোচনা কর‍তে হবে। আপনি কী এখানেই বসবেন?’
আলম সাহেবের কপাল কুঞ্চিত হয়ে উঠলো। তিনি সবটা শুনতে চান। ভনিতা আজীবনই তাঁর ভীষণ অপছন্দ। তিনি জোরালো কন্ঠে বললেন, ‘হ্যাঁ। আমিও শুনতে চাই এটা আসলেই স্ট্রোক ছিলো নাকি!’
ডাক্তার সুশান্ত বললেন, ‘একচুয়েলি আপনি আমার পরিচিতদের মধ্যে একজন বলেই আপনাকে সুযোগটা দেওয়া। নয়তো অন্য পেশেন্টদের গার্ডিয়ানদের সবকিছু খোলাসা করে বলি না আমরা।’
আলম সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমার কাছে কিছু লুকাবেন না দয়া করে। ছেলেটা আমার ছোট থেকেই একা একা বড় হয়েছে। আমি জানতে চাই সবটা, শেষপর্যন্ত!’

ডাক্তার সুশান্ত জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাইরে একটা মেয়েকে দেখলাম অনবরত কাঁদছে! এর আগে এত কাঁদতে কাউকে দেখিনি। মেয়েটা কে হয় আপনার?’
‘মেয়েটা শাইনির স্ত্রী বেলা, অবশ্য আমার মেয়েই! ওকে খুব ভালোবাসে আমার ছেলেটা। ওর জন্যই বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টাটুকু করে যাচ্ছে। থেরাপি নেওয়ার একমাত্র কারণ বেলা। ও আমার ছেলেটাকে এই কঠিন পরিস্থিতিতেও ফেলে যায়নি বরং আমাদের চেয়ে বেশি খেয়াল রেখেছে। ওর নিজেরও বিশ্বাস শাইনি সুস্থ হয়ে যাবে।’
‘ভালোবাসা এমনও হয়?’ আনমনে বললেন ডাক্তার সুশান্ত। তিনি একটু অবাকই হয়েছেন।
‘হয় হয়তো!’
ডাক্তার সুশান্ত হেসে বললেন, ‘বলতেই হচ্ছে খুব লাকি মেয়েটা। আমি চাইবো ওদের ভালোবাসা, বন্ধন যাতে এভাবেই অটুট থাকে। কখনো হারিয়ে না যাক..’
‘আমিন।’ ছোট্ট করে বললেন আলম সাহেব।
‘পাশের মহিলাটা কে?’ জিজ্ঞেস করেন ডাক্তার সুশান্ত।
‘ও আমার স্ত্রী নাজনীন।’
ডাক্তার সুশান্ত ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার স্ত্রী? কিছুক্ষণ আগে যে বললেন তিনি লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন?’
‘ঠিকই বলেছিলাম ডাক্তার। ও আমার দ্বিতীয় স্ত্রী। অবশ্য শাইনিকে কখনো জানাইনি কথাগুলো যে ওর নিজের মা নেই।’
‘এত বছরেও জানতে পারেনি?’
‘না।’
‘খুব ভালোবাসেন ছেলেকে বোঝাই যাচ্ছে।’
আলম সাহেব অতি কষ্টে মুচকি হেসে বললেন, ‘ভালোবাসার মানুষগুলোই আমাদের ছেড়ে অতি দ্রুত হারিয়ে যায়।’

………

আজ প্রায় সাতদিন হলো শাইনিকে থেরাপি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শাইনি এতোটা সহ্য করতেই পারেনি। থেরাপি দেওয়ার পর থেকে ও আরও ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। থেরাপি দেওয়ার পর থেকে এই পর্যন্ত অনেকবার বমি করেছে, যার ফলে শাইনি ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। চোখমুখ ভীষণ লাল হয়ে শুকিয়ে গেছে। শরীরে যেন মাংস নেই। মাথার চুলগুলোও কেমন যেন কমে যাচ্ছে। কোনোকিছু খেতে পারছেনা, খাওয়ার সাথে সাথে বমি হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তাররা ওকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছেন। কিন্তু শাইনির অবস্থার কোনো উন্নতি না হয়ে বরং আরো অবনতি হয়েছে। এই কয়দিনে হসপিটাল টাই যেন বাসার সকলের বাড়িঘর হয়ে উঠেছে। চিন্তায় চিন্তায় যখন বাড়ির সবার অবস্থা খারাপ তখন গত রাতে ওর অবস্থা প্রচন্ড খারাপ হয়ে পড়েছিলো। খারাপ মাবে প্রচন্ড খারাপ। যার ফলে ডাক্তাররা ইমার্জেন্সি ওকে আই সি ইউতে এডমিট করতে বাধ্য হন। ওর কন্ডিশন ভালো নয়। বেলার অবস্থা খুব খারাপ। শাইনির এই অবস্থা মেনে নিতে না পেরে কাল থেকে অনবরত মেয়েটা কেঁদেই চলছে!

………….

কিছুক্ষণ পর তিনজন ডাক্তার প্রবেশ করেন কেবিনে। সবাই নির্ধারিত চেয়ারে বসে ডাক্তার সুশান্ত এর সাথে আলোচনা করেন৷ সবার মুখে চিন্তিতভাব। আলম সাহেব কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। তিনি একটু দূরে বসেছিলেন ওদের থেকে। অনেকক্ষণ পর ওরা চলে যায়। ডাক্তার সুশান্ত কিছুক্ষণ নিজেকে সময় দেন। মাথার ভেতর তালগোল পাকিয়ে থাকা কথাগুলো সাজিয়ে নেন মনে মনে। প্রতিবার রোগীর স্বজনদের খবর দিতে গেলেই তিনি নিজেকে অসহায়বোধ করেন। কিন্তু আজ একটু বেশি খারাপই লাগছে। কারণ আলম সাহেবের সাথে আগে থেকে পরিচয় থাকার দরুণ সব কথা খোলাসা করেই বলেছেন। আলম সাহেবের অসহায় চেহারার দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, ‘যা ধারণা করেছিলাম তাই৷ শাইনির একটা স্ট্রোক হয়ে গিয়েছে। ফুসফুসেও সমস্যা দেখা গিয়েছে। তাতে ওর অবস্থা এতোটাই খারাপ হয়ে গেছে যে আমরা বুঝতে পারছি না কী করা উচিৎ বা অনুচিত। কৃত্রিম ভাবে শ্বাস চালু রাখার জন্যে ভেন্টিলেটরের সাহায্য নিয়েছি আমরা৷ শাইনি ভেন্টিলেটর থেকে সুস্থ হয়ে বেরিয়ে আসতে পারবে কিনা তা নির্ভর করবে ওর সার্বিক শারীরিক অবস্থার উপর। অনেক ক্ষেত্রেই রোগী ভাল হয়ে উঠতে দেখেছি, ওর বেলায় সম্ভাবনা পাচ্ছি না একদমই। চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখছি না আমরা। এর আগে এরকম কেইস একটাও পাইনি আমরা। আ’ম স্যরি মি. আলম, রিয়েলি ভেরি স্যরি।’

আলম সাহেব নিস্তব্ধ, কিছুই বলছেন না। পুতুলের ন্যায় বসে সব কথা শুনলেন তিনি। এসবের জন্য কাকে দায়ী করবেন তিনি? ভাগ্যকে? নিজের ছেলেকে? নাকি বেলার বাবা নাইমুদ্দীন সাহেবকে? সবাই মিলে অসুস্থ ছেলেটাকে যেভাবে মেন্টালি টর্চার করেছে এরই ফল এই স্ট্রোক৷ কি হতো শাইনিকে এতোটা অত্যাচার না করলে? আলম সাহেব কেবিন থেকে বেরিয়ে যান। করিডোরে বেলা আর নাজনীন বেগম বসে আছেন। বেলার চোখমুখ এই ক’দিনে শুকিয়ে ভেঙে গেছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে। মেয়েটাকে দেখে তাঁর মায়া হয়। তিনি রোবটের মতো বললেন, ‘শাইনির একটা স্ট্রোক হয়ে গিয়েছে।’

বেলার বিশ্বাস হলো না৷ চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইলো। তারপর ধীর পায়ে হেঁটে আই.সি.ইউ ইউনিটে গেল। যে কেবিনে শাইনিকে রাখা হয়েছে ওখানকার দরজার বাইরে থেকে শাইনিকে অবলোকন করলো। স্বচ্ছ কাচের দরজার ওপাশে নিথর দেহে পড়ে আছে শাইনি। বিপ বিপ শব্দ আসছে ভেন্টিলেটর নামক একটি যন্ত্রাংশ থেকে। বেলার কান্না আসছে না। এতদিনে কান্না করার ফলে ওর চোখের পানি যেন শুকিয়ে গেছে। কাচের দেয়ালে হাত রেখে ফুঁপিয়ে উঠলো৷ কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘আমি আপনাকে রেখে কোথাও যাবো না প্রমিজ। কেন এত কষ্ট পাচ্ছেন? এত কেন চিন্তা করেন আমাকে নিয়ে? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝেন আপনি? শুধু একবার ফিরে আসুন, আপনাকে নিয়ে আমি অনেক দূরে চলে যাবো। কেউ আলাদা করতে পারবে না আমাদের…ফিরে আসুন না আমার কাছে! আসুন না…’

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here