শ্রাবণ_তোমার_আকাশে,২,৩

0
2392

শ্রাবণ_তোমার_আকাশে,২,৩
লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
পর্ব___২

হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেলো বেলার। কাঠ হয়ে গেলো সে। কথা বলতে পারলোনা। শাইনি ওর ওড়না ধর‍তেই ভয়ে আধমরা হয়ে গেলো বেলা। চোখ বন্ধ করে আল্লাহ আল্লাহ জপতে লাগলো বিড়বিড় করে! শাইনি ওর হাতে হাত রাখলো। কোমল, নরম তুলোর মতো হাত বেলার। মুচকি হাসলো শাইনি। ছাড়তেই হচ্ছে করছেনা। মেয়েটা কতটা লজ্জা পাচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে, নইলে কী আর চোখ বন্ধ করে রাখতো? এতক্ষণ খই ফুটছিলো আর এখন বোবার মতো চুপ হয়ে গিয়েছে। আসলেই, লজ্জা নারীর ভূষণ। নারীদেরকে লজ্জা ছাড়া মানায় না। লজ্জাবতী মেয়ের মুখ এই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মায়া ধারণ করার ক্ষমতা রাখে!

অনেকক্ষণ পর বেলা চোখ খুললো। সে আগের জায়গাতেই বসে আছে। কিন্তু তার হাতে হাত রাখা সেই মানুষটি আর নেই। বেলা খুব অবাক হয়ে এদিকওদিক তাকালো কিন্তু শাইনিকে দেখতে পেলোনা। হঠাৎ করেই যেন উধাও হয়ে গেলো। ভয়ে ভয়ে বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে উঁকি দিলো, সেখানে নেই। বেলা বারান্দায় গিয়ে দেখলো শাইনি সেখানে আয়েশ করে বসে আছে। হাতে কফির মগ। মাঝেমাঝে তাতে চুমুক দিচ্ছে। দৃষ্টি বাইরে। তপ্ত দুপুরের রোদেলা আকাশ পানে। উদাস এলোমেলো সেই দৃষ্টি। একবারের জন্যও বেলার দিকে চাইলোনা। ওর এই আনমনা দৃষ্টিতে যেন কিছু একটা ছিলো। বুক কেঁপে উঠলো বেলার। অস্বস্তিতে ভেতরে ভেতরে মিঁইয়ে যাচ্ছিলো সে। এখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব বেরুনো দরকার। কিন্তু দরজা লক থাকায় সেটা করতে পারছেনা ও! ক্ষীণ কন্ঠে সে বলল,

–দরজাটা খুলে দিন।

–কেন? না তাকিয়েই প্রশ্ন করলো শাইনি।

–আমি বাড়ি ফির‍তে চাই। কাউকে বলে আসিনি।

–বলে আসার দরকার কী? এখন তোমার হাজব্যান্ড আছে। সে যেকোনো সময় তোমাকে ডাকতে পারে, দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করতে পারে। তাই বলে কী দুনিয়ার সবার কাছে বলে আসতে হবে? ডিজগাস্টিং পার্সন সব।

বেলা বিরক্তি নিয়ে বলল,

–আমি আমার পরিবারকে কিছু না জানিয়ে করিনা। আমি আপনার মতো বেয়াদব নই।

–জানি। তুমি খুব ভালো একটা মেয়ে।

–তাইতো আমার কপালে আপনার মতো চরিত্রহীন জুটলো।

–বুঝতে পারলাম না।

–সবসময় শুনে এসেছি ভালো লোকদের সাথে কখনো ভালো হয়না। আমার সাথেও তাই হলো।

–তুমি ভুল বুঝছো। সবসময় যেটা আমরা চোখের সামনে দেখি সেটা সঠিক হয়না, ভুলও হতে পারে।

বেলা রাগী স্বরে বলল, ‘তার মানে আপনি বলতে চাইছেন আমি ভুল দেখেছি?’

শাইনি না তাকিয়েই বলল, ‘ভুল দেখোনি। কিন্তু ভুল বুঝেছ!’

বেলা তাচ্ছিল্যের সুরে হাসলো। নিজের চোখে দেখা ঘটনাটিকে ভুল বুঝেছে বলে উড়িয়ে দিতে চাইছে। এই লোকটা তো আচ্ছা বদমাইশ। বিয়ের আগে ভালো করে খোঁজখবরটা নিলে কখনোই এর গলায় ঝুলিয়ে দিতে পারতোনা বেলার পরিবার। এসব জানতে পারলে ওর বাবা খুব কষ্ট পাবে যেটা ও চায়না। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,

–নিজ চোখে আমি সবটা দেখেছি। তাহলে ভুলটা বুঝলাম কোথায়? এই যে, আপনার মাথায় বা চোখে, কানে কোনো প্রবলেম নেইতো?

শাইনি সটান উঠে দাঁড়ালো। কফির মগটা রেলিংয়ের ওপর রেখে নাক টেনে বলল,

–তুমি কী একটু বেশি কথা বলো? আসার পর থেকে শুধু এটা সেটা নিয়ে কথা বলছো। একটু তো আমার খোঁজটা নাও। কেমন আছি, কী করছি, কী খাচ্ছি সেসব জানতে চাও। তা না করে ক’টা গার্লফ্রেন্ড, কার সাথে কী করেছি গোয়েন্দার মতো সেই তখন থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে চলেছো। আমি বোর হচ্ছি।

বেলা তেজ নিয়ে বলল,

–এসব জিজ্ঞেস করতে আমার বয়েই গেছে। আমিতো আজ বাড়ি ফিরে সবাইকে সত্যিটা জানাবো।

–আচ্ছা, কীসে যেন পড়ো তুমি? ওহ হ্যাঁ, ক্লাস টুয়েলভ! এই বয়সটা তোমার পড়াশোনার পেছনে ব্যয় করো, ঠিক আছে? ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।

বেলা ভীষণ বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘তাহলে বিয়েটা করলেন কেন? আপনি আমাকে বিয়ে না করলে আমি এসব ঝামেলায় পড়তাম না। পড়াশোনায় কন্ট্রিবিউট করতে পারতাম।’

শাইনি মুখ গম্ভীর করে উত্তর দিলো,

–তোমাকে অন্য কেউ চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিলো। তাইতো তাড়াহুড়ো করে বিয়েটা করে ফেললাম। কে জানে কতদিন কাছে পাই। এটলিস্ট সবাই তো এটা জানবে বেলা নামটার সাথে শাইনি জুড়ে আছে!

–আমি বাড়ি ফিরবো। প্লিজ দরজা খুলে দিন।

–দেব। তার আগে একটা শর্ত মানতে হবে।

–কীসের শর্ত? আমি কোনো শর্তটর্ত মানবোনা।

শাইনি বাঁকা হেসে বলল, ‘ওকে। তাহলে আজ দরজাও খুলবেনা। দিন পেরিয়ে রাত হলেও না। অবশ্য রাত হলে বাসরটা এখানেই সেরে ফেলা যাবে। বাড়ির মানুষও একটু টেনশনে থাকুক। মাঝেমধ্যে টেনশন না করলে স্বাস্থ্য খারাপ হয়।’

কথাটা শুনে বেলার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেলো। ঘাম ছুটে গেলো। কপালের রগ দপদপ করছে। লোকটা যে ভীষণ চালাক এই কয়েক ঘন্টায় সে বুঝতে পেরেছে। এখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব বেরুনো দরকার। নইলে বিয়ের দোহাই দিয়ে যেকোনো সময় কিছু একটা করে ফেলতে পারে। কেন যে এখানে মর‍তে এসেছিল সে! টেনশনে মাথা ফেটে আগুন হয়ে যাচ্ছে। মুখখানা গম্ভীর করে অনেক কষ্টে বলল,

–আচ্ছা বলুন কী শর্ত। আমি মানার চেষ্টা করবো।

শাইনি আঙুল উঁচিয়ে বলল, ‘উহু। চেষ্টা করবো নয়। বলো মানবে। আমি যা বলবো তাই মানতে হবে।’

বেলা সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকালো। কী চায় লোকটা ওর কাছে? খারাপ কিছু নয়তো? যা চরিত্রহীন লোক, তেমন কিছুই হয়তো চাইবে। ভাবতেই মাথা ঘুরে উঠলো ওর।

–আজ এখানে যা যা ঘটেছে সেসব তুমি কাউকে জানাবে না। আর নিজেও কখনো মন খারাপ করবেনা৷ আমি চাইনা আমার বউ সারাদিন গোমড়া মুডে থাকুক। ওয়াহেদ শাইনি’র ওয়াইফকে সবসময় সানশাইনের মতো ঝলমলে, আলোকিত আর হাসিখুশি থাকতে হবে। বুঝতে পেরেছো?

বেলা অবাক হয়ে বলল, ‘কখনোই না। আমি সবাইকে সব জানাবো।’

–ওকে। তাহলে রাতটাও এখানেই কাটিয়ে যাও। রাতে খার..

বেলা আঁতকে উঠে কম্পিত গলায় বলল, ‘আ আচ্ছা। রা রাজি আ আমি। কিছু বলবোনা ক কাউ উ কে।’

শাইনির ঠোঁটের মুচকি হাসি এবার প্রশস্ত হলো। বেলা আড়চোখে দেখলো ওর দু’গাল বরাবর দুটো গর্ত হয়ে ঢুকে গেছে। দু’গালেই ডিম্পল! সুদৃশ্য একখানি হাসি বেলাকে উপহার দিয়ে বারান্দা থেকে বেরিয়ে এলো সে। ড্রয়ারের ওপর থেকে ওয়ালেট নিয়ে চাবিটা বের করে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে খুলে দিলো। বেলা তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে আসতেই পেছনে ডাকলো শাইনি। না চাইতেও দাঁড়াতে হলো ওর। শাইনি জিজ্ঞেস করলো, ‘আমার কাছ থেকে একবারও বিদায় নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করলে না তুমি? বেয়াদব তো ভীষণ।’

বেলা কটমট করে বলল, ‘জি আমি বেয়াদব। আপনার মতো আদব-কায়দা শেখার কোনো প্রয়োজন নেই আমার।’

–শর্তের কথা ভুলে গেছ? ওকে। তুমি যেহেতু আমার সাথে উঁচু গলায় কথা বলছো আমিই এখন তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেব। ইনফেক্ট তোমাদের বাসায়ও যাব, খাওয়াদাওয়া করবো। দরকার পড়লে রাতটাও ওখানেই কাটাবো। তখন বুঝবে মজা..

বেলা আর কিছু শোনার জন্য দাঁড়ালোনা। দৌড়ে বেরিয়ে আসলো হোটেল থেকে। পাঁচতারকা বিশাল হোটেল। চকচক করছে সবকিছু। সামনে, পেছনে বিশাল বড় বড় বাগান। তাতে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলেরা বাতাসে দোল খাচ্ছে৷ আরও আছে বড় একটা সুইমিংপুল। স্বচ্ছ নীল জল টলমল করছে। দুপুরের রুপো রঙা রোদ ঝিকমিক ছায়া সৃষ্টি করে চোখ ধাঁধাচ্ছে গেস্টদের। বিশাল বড় পার্কিং লটে শ’খানিক গাড়ি। চারদিকে আভিজাত্যের ছাপ। অথচ! হোটেলঘরে বেড়াতে আসা লোকেরা অধিকাংশই তাদের গার্লফ্রেন্ড বা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে এসেছে। কারো কারো স্ত্রী-সন্তান আছে। তবুও তারা বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে আবদ্ধ! সবকিছু দেখেশুনে বেলার মন খারাপ হয়ে যায়৷ এসব কেন হলো ওর সাথে? ওর কোনো দোষ না থাকা স্বত্তেও কেন ওকে শাস্তি পেতে হলো?

কাঠপোড়া রোদ্দুরে রিকশায় করে বাড়ি ফিরেছে বেলা। চোখমুখ গম্ভীর। এতোক্ষণ কেঁদেছিলো। বাড়িতে কাউকে সত্যটা জানাতে পারবেনা সেজন্য। ভাড়া মিটিয়ে বাসায় ঢুকতেই ওর মায়ের সামনে পড়ে গেলো। সীমা বেগম মেয়েকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় গিয়েছিলি?’

–বাইরে।

–কেন?

–কাজ ছিলো কলেজে৷ অকপটে মিথ্যে বললো বেলা।

সীমা বেগম মেয়েকে নিয়ে সোফায় বসলেন। বেলার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফোন দিয়েছিল শাইনি তোর কাছে? তোর বাবা অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিল!’

–ওনি আমাকে কেন ফোন দিবেন? খাইয়া আর কাজ নাই?

–বেশি কথা বলিস কেন? ও ফোন না দিলেও তুই দিবি। স্বামী হয় তোর। কথাবার্তা বলবি তাহলেই দুজনের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং তৈরি হবে। সম্পর্ক ভালো হবে৷ তাইনা?

–ওসব পরে হবে।

–শোন। এখন তোর বিয়ে হয়েছে। তাই সমঝে চলবি যেন কেউ তোর কোনো খুঁত না ধরতে পারে। সবসময় ভালো মেয়ের মতো নিজের দায়িত্ব-কর্তব্যটা পালন করিস।

বেলা বিরক্ত সুরে বলল, ‘এসব কথা থাক না মা। আমি ভীষণ ক্লান্ত।’

–খাবার আনছি দাঁড়া। তোর পছন্দের রান্না সব।

–খাব না। আমার ঘুম প্রয়োজন।

–তোর ঘরে বড় দুলাভাই ঘুমাচ্ছে৷ তুই বরং দিবার ঘরে চলে যা।

বেলা প্রচন্ড রাগ নিয়ে সেখান থেকে উঠে এলো দিবার ঘরে। নিজের ঘর ছাড়া অন্য কোথাও ঘুম আসেনা ওর। বিয়েকে উপলক্ষ্য করে ওদের বাসায় দাদী-নানীর পরিবারের সবাই এসেছে। মামা-মামী, চাচা-চাচী, খালু-খালা, ফুপা-ফুপি, তাদের ছেলেমেয়েসহ আরও নানা আত্মীয়। ঘরোয়া বিয়ের আয়োজনেই যদি এত মানুষ হয়, তাহলে বড় অনুষ্ঠান করলে কত মানুষ হতে পারে ভাবতেই ঘাম ছুটলো বেলার৷ গোসল সেরে চুপিচুপি দিবার ঘরে এসে শুয়ে পড়লো৷ ক্লান্ত, অবসন্ন দেহটা বিছানায় লাগাতেই আশ্চর্যজনকভাবে ঘুম এসে জেঁকে বসলো বেলার চোখে। স্বপ্নে দেখলো, ‘শাইনি হাসছে, সাথে ওর ডিম্পলগুলোও হাসছে৷ দু-হাত বাড়িয়ে বেলাকে কাছে ডাকছে৷ বেলা অভিমানী মন নিয়ে যখনই শাইনির হাত ধরতে যাবে আচমকাই ভয়ানক এক জানোয়ার আঘাত করলো ওদের। চারদিকে রক্তে ডুবে গেলো। বীভৎস সেই দৃশ্য দেখে ঘুমের মধ্যেই চিৎকার করে উঠলো বেলা।’

–খারাপ স্বপ্ন দেখেছো? এভাবে ঘামছো কেন?

শাইনির কন্ঠস্বর শুনে তাজ্জব বনে গেলো বেলা। আশেপাশে গাঢ় অন্ধকার৷ চাঁদটা ঠিক পশ্চিম দিকে হেলে আছে৷ ওর মনে পড়লো, দুপুরে ঘুমানোর পর আর জেগে উঠেনি, এখন বোধহয় মাঝরাত। আর এতো রাতে শাইনি এখানে কী করছে?

চলবে..ইনশাআল্লাহ!

#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব___৩

-খারাপ স্বপ্ন দেখেছো? এভাবে ঘামছো কেন?

শাইনির কন্ঠস্বর শুনে তাজ্জব বনে গেলো বেলা। আশেপাশে গাঢ় অন্ধকার৷ চাঁদটা ঠিক পশ্চিম দিকে হেলে আছে৷ ওর মনে পড়লো, দুপুরে ঘুমানোর পর আর জেগে উঠেনি, এখন বোধহয় মাঝরাত। আর এতো রাতে শাইনি এখানে কী করছে? বেলা বিছানায় উঠে বসে অবাক হয়ে বলল,
-আপনি এখানে?
-হুম আমি।
-আমার ঘরে কী করছেন?
-বর বউয়ের ঘরে কী করবে? থাকতে এসেছি।
-থাকতে এসেছেন মানে? আমাকে এখনো উঠিয়ে দেওয়া হয়নি বুঝেছেন? থাকাথাকির কথা তো আগে বলা হয়নি!
শাইনি হেসে বলল, ‘বলা হয়নি বলে কি থাকতে পারবোনা? এই নিয়ম কোথায় লেখা আছে?’
-আপনার ফ্যামিলিকে আগেই জানানো হয়েছে।
-সেটা ফ্যামিলির বিষয়। আমি তাতে কী করব?
-আপনি যান এখান থেকে।
-যেতে আসিনি।
-এরকম কেন করছেন?
-তোমাকে পাওয়ার জন্য।
বেলা রাগে কটমট করে বলল, ‘এত সস্তা নই আমি। যে চাইলেন আর পেয়ে গেলেন।’
-এই যে, চাইলাম আর পেয়েও গেলাম। আইন ও ধর্ম মোতাবেক তুমি আমার স্ত্রী। আমি তোমার হাজব্যান্ড।
বেলা বলল, ‘হাজব্যান্ড মাই ফুট!’
-যা ইচ্ছে বলতে পারো।
-নির্লজ্জ লোক।

শাইনি কিছু না বলে ওর পাশে শুয়ে পড়লো। বেলা হতভম্ব হয়ে লাফ দিয়ে নেমে এলো বিছানা থেকে। এই লোকের সাথে একঘরে থাকতে হবে ভেবেই গা রাগে জ্বলে যাচ্ছে। ততক্ষণে শাইনি চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর পায়তারা করছে। বেলা দিবার ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো। এতোরাতে সবাই সবার ঘরে ঘুমাচ্ছে। শাইনি এসেছে এটা ওকে কেউ জানায়নি কেন আশ্চর্য! ওর বাবা-মায়ের চিন্তা, বিবেকবুদ্ধি কী লোপ পেয়েছে নাকি? যা ইচ্ছে তাই করে যাচ্ছে সবাই। ওর অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনবোধটুকু করছেনা কেউ! সারারাত আর ঘরে গেলোনা বেলা। ড্রইংরুমের সোফায় বসে কাটিয়ে দিলো। শেষরাতের দিকে চোখটা লেগে এসেছিলো বিধায় ওখানেই ঘুমিয়ে পড়ে সে। তার জীবনের অর্ধের সুখ-শান্তি বিয়ের দ্বিতীয় দিনেই শেষ। বিবাহ নামক সম্পর্কটায় বিতৃষ্ণা এসে গিয়েছে।
সকালবেলা ঘুম ভাঙলো নাইমুর উদ্দীন সাহেবের ডাকে। মেয়েকে সোফায় বসে ঘুমাতে দেখে তিনি অবাকই হলেন। ঘর থাকতে এখানে কেন? তিনি আস্তে করে ডাকলেন বেলাকে।
-বেলা মা? এখানে ঘুমিয়ে আছিস কেন?
বেলা ঘুমঘুম কন্ঠে বলল, ‘ডেকোনা তো!’
-ঘুমাবি যখন ঘরে যা না। এক্ষুনি সবাই উঠে পড়বে। ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়।
-ঘর খালি আছে? সব ঘরই তো ব্লক। আমার থাকার জায়গা কই?
-দিবার ঘরেই যা না।
-ওখানে তো..
-কী?
বেলা উত্তরে বলল, ‘কিছুনা। আচ্ছা যাচ্ছি!’
বলেই উঠে পড়লো সে। শাইনির কথা না বলে দিবার ঘরে চলে গেলো। অবাক হয়ে দেখলো শাইনি নেই। বারান্দা, বাথরুম কোথাও সে নেই। বেলার মাথায় তখন ঘুরপাক খেতে লাগলো নানান চিন্তা। সত্যিই কী শাইনি এসেছিল? নাকি মনের ভুল বা স্বপ্ন? দৌড়ে রান্নাঘরে সীমার কাছে গেলো। তিনি মেয়েকে অস্থির হতে দেখে বিচলিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে?’
বেলা অস্থিরতা গোপন করার চেষ্টা করে বলল, ‘কিছুনা।’
-দৌড়ে আসলি যে?
-ওই এমনিই।
বেলা বুঝতে পারছেনা কথাটা কীভাবে জিজ্ঞাসা করবে। মায়ের সামনে শাইনির কথা বলতে ওর শরীর কাঁপছে, লজ্জা লাগছে। তবুও সাহস করে নিঃশ্বাস আটকে বলেই ফেলল,
-ও ও ওনি কোথায় মা?
সীমা বেগম বাসন ঘষছিলেন। মেয়ের কথায় অবাক হয়ে বললেন, ‘ওনি কে?’
-শ শাইনি।
-কোথায় আর থাকবে। ওর বাসায়ই নিশ্চয়ই।
বেলা চোখ বড় বড় করে বলল, ‘ওনি চলে গেছেন?’
-চলে গেছেন মানে? কোথায় চলে গেছে?
-বাসায়?
সীমা আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘সকাল সকাল পাগল হয়ে গেলি নাকি? ও তো ওর বাসায়ই থাকবে। কোথায় আর যাবে? আচ্ছা তুই ওর সাথে কথাটথা বলিস তো?’
বেলা আমতাআমতা করে বলল, ‘না মানে হ্যাঁ। বলি তো।’
সীমা বেগম চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘কাল রাতে কথা বলেছিলি? ফোন দিয়েছিলি?’
বেলা অবাক হয়ে ভাবলো কাল রাতে ফোন দিবে কেন? কাল তো শাইনি এ বাসায়ই এসেছিল। কিন্তু ওর মায়ের কথাবার্তা শুনে বোঝা যাচ্ছে শাইনি এখানে আসেইনি। অযথা মায়ের সাথে কথা বলে লাভ নেই। তাই মাকে কিছু একটা বুঝিয়ে বেলা দিবার ঘরে চলে এলো। ঘরে এসে বসতেই ভাবলো রাতের ঘটনা স্বপ্ন ছিল। কিন্তু বেড সাইড টেবিলে একটা কাগজ পেয়ে ওর সম্পূর্ণ ধারণাই বদলে গেলো। হ্যাঁ, লোকটা সত্যিই এসেছিল। আবার চিরকুটও রেখে গেছে।
সেখানে লিখা, ‘তোমার সাথে ঘুমাতে এসে একাই ঘুমিয়েছি। ভীষণ রাগ হয়েছে আমার। তুমি যে সোফায় বসে হা করে ঘুমাচ্ছিলে তখন একটা চুমুও খেয়েছি। এভাবে কেউ ঘুমায় নাকি? আমার গার্লফ্রেন্ড নিশা তো এভাবে ঘুমায় না। অবশ্য তোমাকে কিউটই লাগছিলো৷ যাইহোক, ভোরবেলা আমি চলে এসেছি বাসায়। আসার সময় তুমি ঘুমিয়ে ছিলে দেখে আর জাগাইনি। আরেকটা কথা, হোটেলে আমাকে যে মেয়েটার সাথে দেখেছিলে ও-ই নিশা। ও ছাড়া আমার আর গার্লফ্রেন্ড নেই। না বলে চলে আসার জন্য স্যরি বউ!’

সবটুকু পড়ে কান গরম হয়ে গিয়েছে বেলার। যেন শাইনি ওর কানে কানে কথাগুলো বলছে। রাগে, দুঃখে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করছে ওর। ওর ঘুমন্ত অবস্থার সুযোগ নিয়েছে লোকটা। ছিঃ! কাগজটা ছিঁড়ে, দুমড়েমুচড়ে জানালা দিয়ে ফেলে দিলো সে।
সীমা বেগমের ডাক শোনা যাচ্ছে। নাস্তা খেতে ডাকছে হয়তো। বেলা ফ্রেশ হয়ে ডাইনিংয়ে চললো। কাজিনদের সঙ্গে বসে নাস্তা করে নিলো সে। তারপর খেলো মেহমানরা। সবাই আজ চলে যাবে। খবরটা শুনে বেলা স্বস্তি পেলো। নিজের ঘরটা অন্তত ফাঁকা পাওয়া যাবে!

বিকেলের দিকে বেলার শ্বশুরবাড়ি থেকে ফোন এলো। সীমা বেগম কথা বললেন। তারপর বেলার কাছে ফোন দিতে বললেন শাইনির মা নাজনীন বেগম। বেলা ইতস্তত করে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম আন্টি!’
-ওয়ালাইকুম সালাম। আন্টি বলছো কেন? মা ডাকবে কেমন?
বেলা নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিল, ‘জি মা।’
-কেমন আছো?
-আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?
-ভালো আছি। কথা বলতে আনইজি লাগছে?
-একটু একটু।
-আমাকে ভয় পাওয়ার দরকার নেই। মনে করবে নিজের আম্মুই। শাইনি যেমন আমার ছেলে, তেমনি তুমিও আমার মেয়ে।
-জি আচ্ছা।
-আসলে আমার ছেলের বিষয়ে কিছু কথা বলতেই ফোনটা দিলাম।
বেলা সচকিত হয়ে উঠে বসলো। বলল, ‘কী কথা?’
নাজনীন বেগম মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, ‘আসলে শাইনি একটু অন্যধাঁচের মানুষ। আমি মা হয়েও আজ পর্যন্ত ওকে ঠিকঠাকভাবে বুঝতে পারিনি। সে সবসময় নিজের মতোই চলাফেরা করে। কারো কথা কানে নেয়না। আজ থেকে প্রায় তিনমাস আগে, হুট করে একদিন তোমাকে কারোর বিয়েতে দেখে। পরবর্তীতে বাসায় এসে জানায় সে তোমাকে বিয়ে করবে। সবাই তো আমরা অবাক। প্রথমে আমরা রাজি হইনি কারণ ছেলে ভীষণ উড়নচণ্ডী স্বভাবের। কিন্তু ওর জেদের কাছে হার মেনে অবশেষে তোমাকে দেখলাম। আমাদেরও পছন্দ হলো। তখনো জানিনা শাইনির ফ্রেন্ড নিশা ওর গার্লফ্রেন্ড। জেনেছি তোমাদের বিয়ের পর, মানে কাল রাতে। এখন আমি বুঝতে পারছিনা কী করব? তোমাকে জানানো উচিৎ বলেই সবটা জানালাম। এদিকে শাইনি বলছে ও তোমাকে কিছুতেই ছাড়বেনা আবার ওর গার্লফ্রেন্ডকেও না। এ অবস্থায় আমার মাথায় কিছু আসছেনা। তুমি ভেবেচিন্তে আমাদেরকে জানিও। আমি চাইনা আমার ছেলের জন্য তুমি স্যাক্রিফাইস করো। কজ তুমি ভীষণ ভালো একটা মেয়ে।’

বেলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এসব ও জানে। নাজনীন বেগমের কাছ থেকে নতুন বিষয়ে জানতে পারলো, বিয়ের তিনমাস আগে থেকেই ওর ওপর শাইনির নজর ছিল? স্ট্রেঞ্জ! কখনো তো ওকে দেখেছে বলে মনে পড়েনা বেলার। সে ধীর কন্ঠে বলল, ‘বুঝতে পারছিনা আমি কী করা উচিৎ।’
নাজনীন বেগম ফোনের ওপাশ থেকে হতাশাজনক কন্ঠে বললেন, ‘ভাবো। ভেবে সময় নিয়ে আমাকে জানিও। পুত্রবধূ হিসেবে তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। এখন সবটাই তোমার ওপর ডিপেন্ড করছে মা।’
-হ্যাঁ।
-তোমার ফাইনাল এক্সাম কবে?
-এইতো কিছুদিন পরেই।
-আচ্ছা এক্সামের পরে না-হয় আমাকে জানিও? এখন স্ট্রেস নিতে হবেনা।
বেলা মৃদু কন্ঠে বলল, ‘জি আচ্ছা।’
-এখন রাখছি। আর আমি যে ফোনে তোমাকে এসব বললাম সেটা শাইনিকে বলোনা। ভীষণ রাগবে তাহলে।
-ওনি কী রাগী?
বেলার প্রশ্ন শুনে নাজনীন বেগম হাসলেন। বললেন, ‘না রাগী না। তবে মাঝেমধ্যে রেগে গেলে হুঁশ থাকেনা আরকি৷ তোমাকে সে ছাড়বেনা আগেই বলে দিয়েছে। এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি কর‍তে না করেছে।’
-কেন এমন করছে তাহলে? অন্য কারো সাথে সম্পর্ক থাকলে আমাকেই কেন বিয়ে করল?
-জানিনা মা।
-ঠিক আছে। রাখি।

ফোন কেটে বেলা ‘থ’ মেরে বসে রইলো। এসব তার সাথে কি হচ্ছে। স্বয়ং শ্বাশুড়ি মা ফোন করে তার ছেলেকে ছাড়ার কথা বলছে! বিয়ের দু-দিন গড়িয়ে তিনদিনে পড়লো তাতেই নাজেহাল অবস্থায় ফেলেছে বেলাকে। এ কেমন পরিবার আর কেমন শিক্ষাদীক্ষার লোকজন?

চলবে..ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here