শ্রাবণ_তোমার_আকাশে,২৩,২৪
লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
পর্ব-২৩
শ্রাবণের বর্ষণ নেমেছিলো কাল,
আমার আকাশে।
আমি মেঘের ডানায় ভর করে
শ্রাবণকে পাঠিয়ে দিলাম আজ,
তোমার আকাশে।
ছুঁয়ে যাবে মেঘ, ছুঁয়ে যাবে তোমার
ওই নীল সীমানা।
এক কোটি বছরের সেই ভালোবাসা,
থেকে যাবে শ্রাবণের আকাশে,
নীল মেঘেদের ডানায়।
তাইতো কানে কানে বলি,
আজ শ্রাবণ, তোমার আকাশে!
কথাগুলো শাইনি বলেছিলো বেলাকে, থেরাপি দেওয়ার দিন কয়েক আগে। শুনে বেলার সে কী কান্না। শাইনি ওর কান্না দেখে হাসতে হাসতে বলেছিলো সে মজা করে বলেছে। সেদিন পুরোরাত শাইনিকে আঁকড়ে ধরে বিড়ালছানার মতো শুয়েছিলো। কত মধুর ছিলো সেই রাতটা! পুরোনো স্মৃতিগুলো মনে পড়তেই দু-চোখের কোন ভিজে উঠলো। দিনগুলো আবার ফিরে আসুক, খুব দ্রুত!
সারা আকাশ উত্তাল করে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে কিছুক্ষণ আগে। সোডিয়াম বাতির নিভু নিভু হলদেটে আলোয় চারদিক অস্পষ্ট হয়ে আছে। বৃষ্টির রুমঝুম শব্দ তাল তুলছে বাতাসের গতিবেগের সাথে। পিচঢালা রাস্তায় চড়ছে কিছু গাড়ি আর রিকশা। অট্টালিকার ন্যায় উঁচু ইউনাইটেড হসপিটালের করিডোরের জানালার সামনে বসে আছে বেলা। অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে রয়েছে বাইরের দিকে। বাইরের এই ঝুম বৃষ্টি, উত্তাল হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওর মনে তোলপাড় শুরু হয়েছে। কালবৈশাখীর ঝড়ো হাওয়া বয়ে চলেছে মনের ভেতর। কী করে থামবে এই ঝড় বুঝতে পারছেনা বেলা। প্রতিটি মিনিট উৎকন্ঠার সহিত কাটাতে হচ্ছে। এইতো শাইনি রেসপন্স করছে, এই ওর অবস্থা ভীষণ খারাপ। কখন কী হয়ে যায় বলা মুশকিল। গত দু’দিন আগে শুধু শাইনির সাথে ওর কথা হয়েছে। এরপরই আবার অসুস্থ হয়ে পড়ায় শাইনিকে আই সি ইউ’তে রাখা হয়। বেলা এই দু’দিন কারোর সাথেই কথা বলেনি। চুপচাপ বসে নিজের অশ্রু বিসর্জন দেওয়া ছাড়া ওর আর কিছুই করার নেই। আল্লাহর কাছে চেয়েছে শাইনির সুস্থতা। তবে ওর কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই। আলম সাহেব থাকার জন্য হসপিটালের দুটো কেবিন বুক করেছিলেন। নাজনীন বেগম, বেলা কেউই বাসায় যায় না। শিলাকে তার মামার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে নাজনীন বেগম বেশ বিরক্ত। হাসপাতালের পরিবেশ তার পছন্দ নয়, তবুও তাকে থাকতে হচ্ছে আলম সাহেব যাতে খুঁত ধরতে না পারে।
বেলাকে খুঁজতে আলম সাহেব কেবিন থেকে বেরিয়ে এলেন। সামনে এগুতেই করিডোরের শেষ মাথায় চোখ যায় তার। করিডোরের লম্বা কাচের জানালা ঘেঁষে বসে থাকা মেয়েটির জন্য তাঁর মায়া হয়। অজান্তেই চোখের কোনে জল জমে যায়। মেয়েটি এখনো ভালোবাসার ওপর বিশ্বাস আর ভরসা নিয়ে সবকিছু সহ্য করে যাচ্ছে তা নিয়ে তিনি অভিভূত। শাইনি আসলেই খুব ভাগ্যবান যে বেলার মতো একটি মেয়েকে নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছে। কতই বা বয়স মেয়েটার? বাইশ? তেইশ? অন্য কেউ হলে কি এতোটা ধৈর্য আর আশা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারতো? আলম সাহেব যেখানে ছিল সেখানেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকেন। রাত হওয়ায় লোকজন নেই এদিকে। তাঁর মনে হয়, ভালোবাসা হলো এক অদ্ভুত অনুভূতি! যখন ছেলেটা বোঝে তখন মেয়েটা বোঝেনা। আবার যখন মেয়েটা বোঝে তখন ছেলেটা বোঝেনা। আবার যখন দুজনই বুঝলো তখন পৃথিবী বোঝেনা!
কে যেন বলেছিল কথাটা। আলম সাহেব ভাবেন এমন না হলে কি খুব অসুবিধা হতো? সংসার শুরু হতে না হতেই কেন দুজন মানুষের স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে? তিনি আর কিছু ভাবতে পারলেন না। বাইরে বৃষ্টি নেমেছে আবার, জোরালোভাবে। বেলা অন্যমনস্কভাবে রাতের ভেজা শহরের দিকে নিজের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে।
স্বচ্ছ কাচের জানালায় বারি খেয়ে তার ছিঁটেফোঁটা এসে পড়ছে মেঝেতে। আকাশের বুকে আজ শ্রাবণের ঢল। মেঘের প্রতি আকাশের অনুভূতির ক্ষুদ্র প্রয়াস।
এই অঝোর ধারায় বৃষ্টিপাত শুধুমাত্র জলের ফোঁটা নয়। এটি পৃথিবীর প্রতি আকাশের ভালবাসা।
তারা কখনও একে অপরের সাথে দেখা করে না তবে দুজন এভাবেই নিজেদের প্রেমকে বর্ষিত করে চলেছে অবিরাম।
আলম সাহেব বেলাকে আর ডাকলেন না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শুধু। চিন্তায় চিন্তায় তার মনে হচ্ছে কয়দিনের মধ্যে তিনিও বিছানায় পড়তে চলেছেন। যা ধকল যাচ্ছে সবার ওপর দিয়ে, কী করে সব আগের মতো হবে তা নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি।
শরীরটা ভালো লাগছে না বিধায় তিনি কেবিনে চলে গেলেন। নাজনীন বেগম নিচু স্বরে ফোনে কথা বলছেন কারোর সাথে। আলম সাহেব ঘরে ঢুকতেই তড়িঘড়ি করে ফীন কেটে হট ক্যারিয়ার থেকে খাবার নামাতে লাগলেন। এক এক করে সব প্লেটে সাজাচ্ছেন। ড্রাইভার এনে দিয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। নাজনীন বেগমের ভাইয়ের বাসা থেকে খাবার দেওয়া হচ্ছে এই কয়দিন যাবৎ। আলম সাহেব ঘরে ঢুকতেই নাজনীন বেগম একবার তাকালেন। তারপর ব্যস্ত গলায় বললেন, ‘খাবার রেডি করেছি। হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসো।’
আলম সাহেব বাথরুমের দিকে এগুতে এগুতে বললেন, ‘আমি খাবো না। ক্ষিধে নেই।’
নাজনীন বেগম ভ্রু উঁচিয়ে তাকালেন।
‘খাবে না? কেন?’
‘বললাম তো ক্ষিধে নেই।’
বলে আলম সাহেব বাথরুমে চলে গেলেন। নাজনীন বেগম রাগে গজগজ করতে লাগলেন। খাবার নিয়ে বসে রইলেন। বেশ কিছু সময় পরে আলম সাহেব বাথরুম থেকে বেরিয়ে এক কোনে রাখা ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করে পানি খেলেন। তারপর ডিভানের ওপর গিয়ে বসলেন। নাজনীন বেগম বললেন, ‘তুমি কী খাবে নাকি সব ফেলে দিব?’
আলম সাহেব এবার রেগেই বললেন, ‘তোমাকে একটা কথা কতবার বলতে হবে? বারবার এক কথা জিজ্ঞেস করে আমার মাথা গরম করে দিচ্ছ। আমার ছেলেটা অসুস্থ, বেলা না খেয়ে আছে। আর সেখানে আমি আরাম আয়েশ করে খাবার খাবো এটা তুমি ভাবী কীভাবে নাজনীন?’
নাজনীন বেগম তেজদীপ্ত কন্ঠে বললেন, ‘তোমাকে খেতেই হবে।’
‘তোমার যদি খেতে ইচ্ছে হয় তাহলে খাও। আমাকে বিরক্ত করা বন্ধ করো!’
নাজনীন বেগম ফুঁসে ওঠে বললেন, ‘আমি তোমাকে বিরক্ত করছি? আমি? এটা তুমি বলতে পারলে?’
আলম সাহেব এবার প্রচুর রেগে গেলেন। হাজার দুশ্চিন্তার মধ্যে রোজ রোজ নাজনীন বেগমের এসব অশান্তি তাঁর মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমি ক্রমাগত আমাকে বিরক্ত করছো। এটা হসপিটাল, সিনক্রিয়েট হোক আমি তা চাই না। আমি খাবো না।’
নাজনীন বেগম ফোঁস করে করতে করতে বল্ললেন, ‘আমি সিনক্রিয়েট করছি? আমি? বুঝেছি তো কেন খাবে না। আমার ভাইয়ের বাসা থেকে রেঁধে দিচ্ছে তো তাই খাবার তোমার গলা দিয়ে নামবে না। তাই-না? আমার পরিবারের কাউকেই তো তোমার পছন্দ না। সে ঘরের খাবার তোমার মুখে রুঁচবে কেন? তোমার পছন্দ তো ওই শাহানা। আমি কে? সন্তান পালন করতে এনেছিলে, আদর-যত্ন দিয়ে বড় করলাম। এখন বাপ-ছেলে আমাকে চেনো না। আমার বাপের বাড়ির অন্ন তোমাদের গলা দিয়ে নামে না তাই না? তার ওপর কোন বাড়ির কোন মেয়ের জন্য তোমার দরদ উতলে উঠছে তা বুঝি আমি জানি না? শিলাকেও তো কোনোদিন এভাবে স্নেহ করোনি যতোটা ওই বেলাকে করছো! বুঝি আমি সবই!’
আলম সাহেব এবার আর সহ্য করতে পারলেন না। জোরালো কন্ঠে বললেন, ‘সিনক্রিয়েট হোক তা চাচ্ছিলাম না। কিন্তু আর চুপ করেও থাকতে পারছিনা। শুনে রাখো, আমি শাইনিকে যতোটা ভালোবাসি শিলাকেও ততোটাই স্নেহ করি। দুজনেই আমার সন্তান। আসলে, তুমি কখনো সোজা চোখে দেখোনি বলেই শিলার প্রতি আমার ভালোবাসা তোমার নজরে আসেনি। বা, অতি সন্তপর্ণে, ইচ্ছাকৃতভাবেই তা তুমি এড়িয়ে গেছো৷ আর রইলো বাকি বেলা। এই মেয়েটাকে আমি নিজের মেয়ের মতো না ভালোবেসে থাকতে পারিনি। এটা তুমি মানো বা না মানো তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। আই ডোন্ট কেয়ার! মেয়েটাকে আমি যতটা শ্রদ্ধা করি, তেমনই ওর কোমল মনটাকে স্নেহ করি। এটলিস্ট তোমার মতো বিষে ভরা মন না ওর। বিপদের সময় কীভাবে নিজের স্বামীর পাশে থাকতে হয় তা দেখেও তোমার শিক্ষা হয়নি তাইনা? শেইম!
তুমি খারাপ তা জানতাম। কিন্তু এতোটা নিচু মনের অধিকারী জানতাম না। আমার ছেলেটা এত অসুস্থ, মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে তাঁকে নিয়ে, তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে তোমার মনে যে এতো বিষ জমে আছে, কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেও বিশ্বাস করিনি। কিন্তু এখন বাধ্য হচ্ছি বিশ্বাস করতে। তোমার বাড়ির খাবার না খাওয়ার পেছনে তোমার এসব যুক্তির কোনো ভিত্তি নেই!’
নাজনীন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ শুকিয়ে চুপসে গেছে। আলম সাহেবের মুখ রাগে লাল হয়ে গিয়েছে। একটু থেমে তিনি আবার বলতে লাগলেন, ‘আর কী বললে তুমি? আমার শাইনিকে তুমি মানুষ করেছো? হাসালে তুমি নাজনীন। সবকিছু জানি আমি, তোমার আচার-ব্যবহার এভরিথিং। কীভাবে আমার ছেলেকে ছোট থেকে একা করে রেখেছো, খারাপ চেয়েছ সব জানি। আসলে তুমি ওর মা হওয়ারই যোগ্যতা রাখো না। চিরকাল ওর সৎ মা-ই রয়ে গেছো। অথচ আমার ছেলে আজও জানে না তুমি ওর মা নও। তোমাকে কোনোদিন অসম্মানের চোখে দেখেনি আমার ছেলে। অথচ ওর পেছন থেকে ছুড়িটা তুমিই মারলে। নিজের ছেলে হলে কী এসব করতে পারতে? ছিহ নাজনীন!’
নাজনীন বেগম অবাক হওয়ার ভান করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীসের কথা বলছো তুমি?’
আলম সাহেব তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, ‘বেলার বাবার কান ভাঙানোর পেছনে তুমিই আছো তাইনা? এটা বুঝতে আমার আর বাকি নেই।’
নাজনীন বেগম থতমত খেয়ে বললেন, ‘ ক ক কী বলছক তুমি? আ আর এসবের কোনো প্রমাণ আছে যে আমার নাম বলছো?’
‘প্রমাণ? এখন তোমাকে প্রমাণ দিতে হবে? একটু আগেই তো তুমি ফোনে কথা বলছিলে, সবটাই আমি শুনেছি। মিথ্যা বলতে লজ্জা করছে না তোমার? শাইনির এই অবস্থার জন্য পরোক্ষভাবে তোমার হাত আছে এরজন্য কোনোদিন তোমাকে ক্ষমা করবো না আমি! এতদিন যে দুধকলা দিয়ে ঘরে কালসাপ পুষেছি, আর এটা যে আমার কত বড় ভুল তা আজ বুঝতে পারছি৷ আমি যদি আজ হাতেনাতে না দেখতাম তাহলে কোনোদিনই তা জানতে পারতাম না। অজানাই রয়ে যেতো। ছিহ নাজনীন! তুমি গিরগিটি চেয়েও জঘন্য। গিরগিটি তো নিজেকে বাঁচাতে রঙ বদলায়, আর তুমি নিজের স্বার্থসিদ্ধি করার জন্য। গিরগিটির চেয়েও বেশি জঘন্য তুমি!’
‘আপনি এসব করেছেন আন্টি?’
বেলার কন্ঠ শুনে ওরা দুজনেই তাকালো। নাজনীন বেগমের মুখ রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করেছেন। আলম সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বেলার চোখ জলে টলমল করছে। দুর্বল কন্ঠে আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে যাওয়ার আগেই একজন নার্স ছুটে এলো। চোখেমুখে অস্থিরতা। নার্সটির নাম সাথী। এই কয়দিনে বেলার সাথে ওর বেশ ভালোই পরিচিতি হয়েছে। শাইনির সব খবরাখবর ও বেলাকে এনে দেয়। বেলা ভয়ার্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে আপু?’
‘আসলে তোমাদের প্যাশেন্টের অবস্থা খুব ক্রিটিকাল। ওনি শ্বাস নিতে পারছেন না। স্যাররা ওখানে ওনাকে ট্রিট করছেন। তোমাদের কাউকে সেখানে না পেয়ে আমি ছুটে আসলাম। চলো তোমরা!’
সাথীর কথা পুরোটা শোনার অপেক্ষা না করেই বেলা দৌড়ে চললো। আলম সাহেবও তড়িঘড়ি করে ছুটে যাচ্ছেন। নাজনীন বেগম গেলেন না। তার কোনো হেলদোল নেই শাইনির ব্যাপারে। যা হয় হোক। ওই ছেলের জন্য তাঁকে আজ এত কথা শোনালো আলম সাহেব!
……
শাইনির অবস্থা খুব খারাপ। অক্সিজেন সাপ্লাই করার পরেও ওর কোনো রেসপন্স পাওয়া যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে একটু প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়ে আবার সবকিছু স্থির হয়ে যাচ্ছে। কিছু সময়, বোধহয় দশ সেকেন্ড পর হঠাৎ শাইনির দুর্বল চোখজোড়া আধো আধো খুলে গেলো৷ কাচের দরজার ওপাশ থেকে বেলা স্পষ্ট দেখতে পেলো শাইনির ঠোঁটের কোনের মুচকি হাসি। যেন বলতে চাইছে ভালোবাসি, ভালোবাসি এবং ভালোবাসি। যেন সেই চোখের ভাষায় লেখা আছে একটি নাম ‘বেলা বউ! ভালোবাসি ভালোবাসি।’ অতঃপর এক টুকরো মুচকি হাসি দিয়ে যখন শাইনির চোখজোড়া আবার বন্ধ হয়ে গেলো বেলা এবার ভয়ে আঁৎকে উঠলো। ওর হার্টবিট দ্রুতগতিতে ছুটতে লাগলো। ক্রন্দনরত কন্ঠে বলল, ‘আমাকে ছেড়ে যাবেন না আমাকে ছেড়ে, যাবেন না…প্লিজ যাবেন না..আমি বাঁঁচবো না…যাবেন না আপনি!’
শাইনির এই ভয়াবহ সিচুয়েশন, না খাওয়া, অতিরিক্ত টেনশন এবং ভয়ে বেলার বিপি লো হয়ে গেলো। যার ফলে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।
চলবে…ইনশাআল্লাহ!
#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব___২৪
বেলার যখন জ্ঞান ফিরলো তখন নিজেকে অন্ধকার একটা ঘরে আবিষ্কার করলো। চারপাশের গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে আবছা আলোর একটি ড্রিম লাইট টিমটিম করে জ্বলছে। বাতাসে কেমন ভ্যাপসা গন্ধ৷ বেলা বালিশ থেকে নিজের মাথাটক উঠানোর চেষ্টা করছে৷ কিন্তু মাথায় প্রচন্ড ব্যথা, মাথার ভেতরটা কেমন ভনভন করছে। একদিকে আবছা আলোর গুমোট অন্ধকারে ও চোখে সবকিছু ঝাপসা দেখছে, অন্যদিকে বোঝার চেষ্টা করছে এই মুহূর্তে ও কোথায় আছে। মনে করার চেষ্টা করতেই, প্রথমে শাইনির কথা মাথায় এলো। ধীরে ধীরে সবকিছু মনে পড়তেই বেলা চোখ ঢলে উঠার চেষ্টা করলো। শাইনি অসুস্থ ছিলো, ওরা সবাই হাসপাতালের আই সি ইউ ইউনিটের বাইরে দাঁড়িয়ে শাইনির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিল। কেবিনের ভেতরে ডাক্তার, নার্সদের হুলস্থুল অবস্থা, বিপ বিপ সাউন্ড, চিৎকার, চেঁচামেচি, মাথার যন্ত্রণা যেন চারদিকে কিয়ামত নেমে এসেছিলো। তাঁর মধ্যে শাইনির একবার চোখ খুলে তাকানোটা যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতিতে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বেলাকে। সেই চোখের মোহনীয় ভাষার দিকে তাকিয়ে ও বিমোহিত নয়নে তাকিয়ে ছিল অনেকটা ক্ষণ। ক্ষণিক সুখের সময়টা পেরুতেই শাইনি অদ্ভুত ভাবে হাসলো।।দুই গালে তৈরি হলো দুটো ডিম্পল! তখনো জলে ভেজা ছিলো ওর চোখ, নোনতা পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিলো নীলচে রঙের বালিশে। তারপর! তারপর কী হয়েছিলো? বেলা মনে করার চেষ্টা করলো। সফলও হলো! তারপর আচমকাই শাইনির চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেলো। বেলার যখন ভয়ে হার্টবিট কেঁপে কেঁপে উঠছিলো তখনই ও হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে মাটিতে ঢলে পড়ে৷ এরপর আর কোনোকিছু মনে নেই ওর। মস্তিষ্ক আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও বাকি স্মৃতিটুকুর খোঁজ পেতে ব্যর্থ হলো বেলা! মাথাটা দু-হাতে চেপে ধরে ধপ করে আবার বিছানায় বসে পড়লো ও। চোখ দুটো জ্বলছে ভীষণ। গলা শুকিয়ে কাঠ। ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছে পানির। চারপাশে তাকিয়ে দেখলো পানির বোতলটোতল পাওয়া যায় কিনা! কিন্তু ঘর অন্ধকার থাকার কিছুই দেখতে পেলো না। ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় বেলা ঘরটাকে দেখে বুঝতে পারলো এটা হাসপাতাল নয়। মুহূর্তেই আঁৎকে উঠলো। ওর তো এখন হাসপাতালে থাকার কথা! কিন্তু এটা হাসপাতাল নয়। বাঁ-হাতে মাথা চেপে, ডান হাতটা মাথা থেকে নামিয়ে বিছানার চাদর খামচে ধরলো। চিনচিনে সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভূত হলো। হাত বেয়ে কিছু গড়িয়ে পড়ছে। বেলা অবাক হয়ে অন্যহাতে ডান হাতের ওপর থেকে তরল জিনিসটা ছুঁতেই চটচটে ভাব হলো। হাতে একটা নল লাগানো। তীক্ষ্ম চোখে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে ফিরে দেখলো খাটের স্ট্যান্ডে স্যালাইনসহ নল ঝুলছে। ভীষণ অবাক হয়ে আনমনে বলল, ‘আমি কোথায় আছি?’
কোনো উত্তর এলো না। একটানে হাত থেকে ক্যানোলা খোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। পরেরবার পারলো। বিছানা থেকে নেমে হাতড়ে হাতড়ে ঘরের দরজা খুঁজতে লাগলো। একসময় পেয়েও গেলো। কিন্তু দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। বেলা ধাক্কাধাক্কি শুরু করার পরেও কেউ দরজা খুললো না। ঘরের সুইচবোর্ড খুঁজে পেতে একটু সময় লাগলো। সুইচ অন করতেই পুরো ঘরটা ঈষৎ হলদেটে আলোয় ভেসে গেলো। অনেকটা সময় পর চোখে আলো পড়ায় আপনাআপনি চোখজোড়া বন্ধ হয়ে এলো। বেলা সময় নিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। তারপর চোখ খুলে ঘরটাতে নজর বুলালো। একপাশে সেমিডাবল খাট, ওয়ারড্রব, সোফা আর টেবিল রাখা৷ অচেনা ঘর, অচেনা পরিবেশ! এটা কোন জায়গা? আগে কখনো এসেছে বলে তো মনে পড়েনা! বুকের ভেতর কান্নারা দলা পাকিয়ে বসে আছে, ঢোক গিলে তা সংবরণ করে নিলো বেলা। ওকে শাইনির কাছে যেতে হবে। শাইনি এখন কেমন আছে জানতে হবে। আর ও কোথায় আছে? কে এখানে নিয়ে এসেছে? দরজা বন্ধ করা কেন? ওর আসলে হয়েছে কী? বেলা বিষন্ন মনে ভাবলো এখন কী করবে ও! গায়ের পোশাকের দিকে তাকিয়ে আরও হতভম্ব হয়ে পড়লো। হসপিটালে থাকাকালীন ওর পরণে ছিল খয়েরি রঙের সালোয়ার-কামিজ। কিন্তু এখন অফ হোয়াইট রঙের মধ্যে সাদা পাথরের একটা লম্বা টপ পরণে৷ এটা তো ওর কাপড় নয়! এবার বেশ ভয় পেয়ে দরজায় ধাক্কা শুরু করলো বেলা।
‘কেউ আছেন? দরজা খুলুন প্লিজ।
কেউ খুলছে না দেখে বেলা এবার জোরে জোরে শব্দ করতে শুরু করলো এবং ডাকতে লাগলো। হঠাৎ বাইরে থেকে কেউ নব ধরে মোচড় দিলো। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেলো। বেলা অবাক হয়ে দেখলো দরজা এতক্ষণ খোলাই ছিলো, শুধু নব মোচড়ালেই খুলে যেত। কিন্তু অচেনা পরিবেশ হওয়ায় এসব কথা মাথাতেই আসেনি ওর। ঘরে ঢুকলো একজন পঞ্চাশোর্ধ্ব মহিলা। নির্মল মুখখানি আলোয় ঝলমলে করছে। ভেজা চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে মুড়িয়ে রেখেছে। চেহারায় বেশ মায়া মায়া ভাব হলেও চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। বুদ্ধিদীপ্ত সেই চাহনির মালকিনের দিকে দৃষ্টি নিপাত করে বেলার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরুতে চাইলো না। অস্ফুটস্বরে জিজ্ঞেস করলো, ‘আ আপনি কে?’
মহিলাটি সহাস্যে উত্তর দিল, ‘আমি তোমার ফুপি।’
বেলা ভ্রু কুঁচকালো। ফুপি? ওর তো একটাই ফুপি। রুহি আপুর মা মিতালি বেগম। আর সামনে দাঁড়ানো বয়স্ক মহিলাটিকে ও কোনোদিন দেখেনি, না ওনার বিষয়ে জানে সে। বেলা নিষ্প্রভ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘ফুপি? কিন্তু আমার তো একটাই ফুপি। আর কোনো ফুপি আছে বলে তো আমার মনে পড়ে না! আর আপনার সম্পর্কে আমি কিছু জানি না, কে আপনি তাহলে?’
মহিলাটি ভেজা চুল তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতেই শান্ত স্বরে বললেন, ‘তুমি বসো মা। আর একী? তুমি ক্যানোলা খুলেছো কেন? হাত দিয়ে তো রক্ত গড়াচ্ছে! এটা কী করলে?’
মহিলাটি উদ্বিগ্ন স্বরে আওড়ালেন কথাগুলো। তারপর হাতের ভেজা তোয়ালেটা ছুঁড়ে মারলেন সোফার উপর। দ্রুত পায়ে এগিয়ে বেলাকে টেনে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে তিনি ফার্স্ট এইড বক্স খুঁজে নিয়ে এলেন।তারপর খুব যত্ন করে ক্যানোলা লাগানো অংশটা তুলো দিয়ে পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। বেলা শুধু অবাক হচ্ছে। মহিলাটি এত ভনিতা করছে কেন? কে ইনি? আর ওকেই বা এসব করছে কেন আজব! ওনার আচার-আচরণ সবকিছু একদম প্রফেশনাল ডাক্তারদের মতো। ট্রিট করছে ওদেরই মতো।
ব্যান্ডেজ বাঁধা শেষে মহিলাটি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ব্যাথা হচ্ছে?’
‘না।’ ছোট্ট করে জবাব দিলো বেলা।
মহিলাটি ফার্স্ট এইড বক্সটা জায়গামতো রেখে ঘুরে তাকালেন বেলার দিকে। মিষ্টি করে হেসে বললেন, ‘আমাকে চিনতে পারছো না তাই তো?’
বেলা মাথা নাড়ালো।
‘আমি শাম্মী। তোমার ফুপি। কেমন ফুপি সেটা আগে বলে নেই! তোমার বাবা আর আমি দুজন ফুপাতো ভাই-বোন। সেই সূত্র ধরেই আমি তোমার ফুপি। তুমি হয়তো আমাকে দেখোনি, কিন্তু আমি তোমাকে চিনি। খুব ছোটবেলায় দেখেছিলাম তোমাকে।’
বেলা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। মহিলাটির পরিচয় জানা দরকার। তারও আগে শাইনি কেমন আছে সেই খবর জানা প্রয়োজন। ও নরম কণ্ঠে বলল, ‘আমি হয়তো দেখিনি আপনাকে। কিন্তু বাবার মুখে কয়েকবার আপনার নাম শুনেছি। বিদেশে থাকতেন বোধহয় নাকি!’
‘হ্যাঁ। আমার ডাক্তারি পড়াকে কেন্দ্র করে চলে যাই কানাডায়। বিয়ে করে নিই সেখানেরই এক বাংলাদেশীকে। স্যাটেল হই ওখানেই। এর মধ্যে আমার ছেলেটাও বড় হতে থাকে। ক্যারিয়ার, সংসার, সন্তান একসাথে সামলাতে গিয়ে এরপর আর দেশে আসা হয়নি।’
‘কখন ফিরলেন?’
‘এইতো সপ্তাহখানিক আগে স্বামী-সন্তান সহ দেশে ফিরলাম। এর মধ্যে তোমার বাবাকে একদিন ফোন করতেই গল্পে গল্পে তোমার কথা উঠে আসলো। তোমার সাথে ঘটে যাওয়া সবকিছু জানান আমাকে।
অতিরিক্ত মানসিক চাপ এবং দুর্বলতায় তুমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলে। ডাক্তার বলেছিল তোমাকে স্ট্রেস যাতে না দেওয়া হয় প্লাস হাওয়া পরিবর্তন করার জন্য। হসপিটালে এডমিট ছিলে। সব শুনে আমি আর আমার ছেলে মিলে পরামর্শ করি, তোমাকে এখানে নিয়ে আসার জন্য। আর গত পরশু আমাদের এখানে তোমাকে নিয়ে আসে তোমার বাবা।’
বেলা থমকে যাওয়া কন্ঠে অবাক হয়ে বলল, ‘গ গত পরশু? মানে? আমি কয়দিন ধরে অসুস্থ? আ আজ কত তারিখ?’
শাম্মী হেসে বললেন, ‘আজ তিন-ই সেপ্টেম্বর। তোমাকে এক তারিখে এখানে নিয়ে আসা হয়েছিলো। আজ প্রায় পাঁচদিন পর তোমার পুরোপুরিভাবে সেন্স ফিরলো মা।’
বেলার মাথা ঘুরে গেলো। সামান্য বিপি লো হওয়ার কারণে পাঁচদিন পর সেন্স ফিরলো? ও কম্পিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘আ আপনি জানেন ওনার অবস্থা কেমন? ওনি ঠিক আছেন কি-না?’
শাম্মী ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘ওনিটা আবার কে?’
বেলা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো, ‘ওনি মানে আমার হাজব্যান্ড। শা শাইনি ওনার নাম। ওনি তো হসপিটালে এডমিট ছিলেন। খুব অসুস্থ! আপনি জানেন ওনি কেমন আছেন? আমাকে এখানে নিয়ে এলো কেন? আচ্ছা আব্বু কোথায়? ডাকুন না আব্বুকে। আমি ওনার কাছে যেতে চাই, আব্বুকে ফোন করে আসতে বলুন না একবার প্লিজ।’
শাম্মী অবাক নয়নে বেলার দিকে চেয়ে রইলো। মেয়েটার পাগলামি করাটা স্বাভাবিক হলেও প্রেসার নেওয়াটা ওর জন্য ক্ষতিকর। আর তিনিই বা কী বলবেন বেলাকে? নাইমুদ্দীন তো এখানে নেই। তিনি বেলার মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত হতে বললেন। বেলা চেয়েও শান্ত হতে পারছে না। ওর মনে জমে থাকা সব প্রশ্নের উত্তর জানতে হবে। বাবা ওর সাথে এরকম করলো কেন? বাবা কী জানেনা শাইনিকে বেলা কতোটা ভালোবাসে? একপলক না দেখলে ওর দম বন্ধ হয়ে আসে! শাইনি কোথায়? কেমন আছে তাঁর হৃদয় দখল করে নেওয়া সেই পাগলটা? যাঁর সাথে প্রতিটি শ্রাবণ পাহাড়ের ওই ঘরটাতে কাটাতে চায়! যাকে বারবার ‘ভালোবাসি’ বলতে চায় ও!
চলবে…ইনশাআল্লাহ!