শ্রাবণ_তোমার_আকাশে,৭,৮

0
1484

শ্রাবণ_তোমার_আকাশে,৭,৮
লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
পর্ব___৭

কথাটা শুনে শাইনি দু-পা এগিয়ে আসে। বেলা ভয় পেয়ে যায়৷ চোখ বন্ধ করে বলল, ‘আমি কিন্তু পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিয়ে মরে যাব।’
শাইনি উচ্চস্বরে হেসে উঠে। বলে, ‘আমাকে ছেড়ে মরে যাবে? এত আগে? মরতে হলে আমাকে নিয়েই মরে যেও।’
-হুহ!
-চলো দুজন একসাথে ঝাঁপ দিই৷ ইতিহাসের পাতায় গোটাগোটা অক্ষরে আমার পাশে তোমার নামও লেখা থাকবে। চিরকাল সবাই আমাদের জুটিকে মনে রাখবে।
বেলা চোখ বড়বড় করে তাকায়। কি হচ্ছে ওর সাথে! ওফ.. পাহাড়ের উপর থেকে নিচে চোখ গেলেই ওর আত্মা কেঁপে উঠে। ইশ, কী ভয়ংকর! শাইনি ওর হাত ধরতেই বেলা ভাবে সত্যিই বুঝি এখন ওকে নিয়ে ঝাঁপ দিবে। এই লোককে বিশ্বাস নেই। লোকটা যে অতিশয় পাগল এটা ইতোমধ্যে বুঝে গেছে। আর পাগল লোকদের বেলা ভীষণ ভয় পায়। অনেকটা সময় পার হলেও নড়াচড়া টের না পেয়ে বেলা অবাক হয়।
সে ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে তাকায়৷ শাইনির ওর দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসছে। সেইসাথে ওর গালের ডিম্পলগুলোও যেন হাসছে। বেলা চোখ কুঁচকে বলল, ‘হ হাসছেন কেন পাগলের মতো? আপনি কী মদ-গাঁজা খান নাকি?’
শাইনি হাসি থামিয়ে বলল, ‘মদ-গাঁজা খেলে কী হয়?’
-না মানে, এসব খেলে মানুষ পাগলের মতো হাসে শুধু।
-তুমি কী খেয়েছো এসব?
-না।
-জানো কীভাবে?
-মুভিতে দেখেছি।
-আর কী দেখেছো?
-মানে?
-রোমান্স দেখোনি?
বেলা রেগে বলল, ‘আমি আপনার মতো না। সারাদিন নোংরা চিন্তা নিয়ে ঘুরেন, ছিঃ!’
-ছিঃ বলার কী হলো? এসব নরমাল ব্যাপারস্যাপার।
-মোটেও তা নয়। সবকিছুর একটা নিয়ম আছে। নিয়মের বাইরে গেলে সেটা আর নরমাল থাকেনা। নিয়মবহির্ভূত কাজ যেমন জঘন্য তেমনি অপরাধও বটে! অবশ্য কাকে কী বলছি! হোটেলে ওই আপুটার সাথে যা করেছিলেন!
শাইনি চেপে ধরে ওকে নিজের সাথে। বেলার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। গলা কাঁপতে থাকে। কোনোমতে বলে, ‘কি করছেন, ছ ছাড়ুন আমায়।’
শাইনি দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘কী দেখেছিলে সেদিন হোটেল ঘরে? যে বারবার আমাকে নোংরা বলো? ভুলে ভরা একটা ঘটনা নিয়ে যা ইচ্ছে তাই রটিয়ে বেড়াচ্ছো।’
-ভুল? কোনটা ভুল? আমি নিজের চোখে সবটা দেখেছি!
-সব দেখা সবসময় সত্যি হয়না। বলিনি বারংবার?
বেলা কটমট করে বলল, ‘ছাড়ুন আমাকে।’
শাইনি ছেড়ে দিলো ওকে। তারপর ঘরের ভিতরে গিয়ে সটান শুয়ে পড়লো। তীর্যকভাবে রোদ এসে পড়ছে পাহাড়ের গায়ে। হালকা বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে। খুব দূরে সরু একটা ঝর্ণা দেখা যাচ্ছে। অন্তনীল আকাশখানি ঘন নীলের সমারোহে ডুবে আছে। শুভ্রসাদা মেঘেরা চোখের পলকেই দূরে ছুটে যাচ্ছে। কিছু মেঘ নিচে দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। বেলা অবাক হয়ে গেলো। এ কোথায় আছে সে? এটা ওর নিজের দেশ? এত মুগ্ধতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে! এত আনন্দিত সে কোনোদিন হয়েছে বলে মনে পড়েনা। পৃথিবী কী আসলেই এতো সুন্দর? কুয়াশার মতো ধোঁয়াটে মেঘেরা ওর দিকে আস্তে করে এগিয়ে আসছে। বেলা চোখ বন্ধ করে দু’হাত পাখির মতো ছড়িয়ে দাঁড়ালো। কয়েক সেকেন্ড পরেই ভেজা ভেজা অনুভব করলো ও। সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে তাকালো। মেঘ ওর হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। বেলা খুশিতে চিৎকার করলো খুব জোরে। পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তুলে সেই চিৎকার আবারও ফিরে এলো ওর কর্ণকুহরে। খুশিতে ওর চোখে জল চলে এসেছে। জাগতিক সব চিন্তাভাবনা ভুলে সে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করায় মগ্ন হয়ে আছে। শাইনি কখন থেকে ওকে দেখে চলেছে। মেয়েটার মাঝে শিশুসুলভ এক ধরণের স্নিগ্ধতা, নমনীয়তা আছে যার কারণে কিছুতেই বেলাকে চোখের আড়াল কর‍তে পারছেনা ও। ওকে ছেড়ে থাকতে হবে ভাবলেই গায়ের পশম কাঁটা দিয়ে ওঠে৷ শূন্যতা অনুভূত হয়।
বেলার ধ্যান কাটে শাইনির ডাকে। ও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। শাইনি বলল, ‘মেঘ দেখা শেষ হলে ঘরে আসো।’
-কেন?
-বরকে বাইরে রেখে এত ঘুরাঘুরি কীসের তোমার?
-আচ্ছা এগুলো কী সত্যিই মেঘ? নাকি কুয়াশা? প্রশ্ন এড়িয়ে প্রশ্ন করলো বেলা।
শাইনি মুচকি হেসে বলল, ‘উহু। সত্যিই মেঘ। শ্রাবণের মেঘলা দিন, মেঘলা আকাশ।’
-খুব সুন্দর।
-কী?
-জায়গাটা।
-আগে পাহাড় দেখোনি?
-না। সিলেটে একবার দূর থেকে দেখেছিলাম। কাছ থেকে কখনো নয়। এবারই প্রথম।
শাইনি জিজ্ঞেস করলো, ‘একটু পরে আরেকটা জায়গায় নিয়ে যাবো। সেটাও অসাধারণ।’
বেলা সন্দেহ নিয়ে বলল, ‘কোথায়?’
-আকাশে।
বেলা ভয়ার্ত কন্ঠে বলল, ‘মানে? আপনি মেরে ফেলবেন আমায়?’
-না গো আমার বউ। শ্রাবণ মাসে আকাশের অপরুপ সৌন্দর্য দেখা যায় ওখান থেকে। সেটাই দেখাতে নিয়ে যাবো তোমায়।
-ওহ। কিন্তু এসবের থেকেও বেশি প্রয়োজন আমার এখান থেকে ফিরে যাওয়া।
শাইনি বলল, ‘যেদিন আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা তৈরি হবে সেদিনই যেতে পারবে। তার আগে নয়।’
বেলা তব্দা মেরে রইলো ওর কথা শুনে। এই লোককে ও দেখতেই পারেনা আবার বলে ভালোবাসার কথা! কিন্তু এখান থেকে যেতে হলে কিছু একটা ভাবতে হবে। হোক সেটা নাটক করে বা অন্যকিছু! কেশে বলল, ‘এর জন্য এতদূর নিয়ে আসার কী প্রয়োজন ছিল?’
শাইনি উদাস কন্ঠে বলল, ‘ভালবাসতে, গভীরভাবে ভালোবাসতে। আর ভালবাসানোতে। এই দুইটা জিনিস অনেকটা সূর্যের দুই দিক থেকে ছোঁয়া পাবার মতো৷ প্রকৃতির কাছে থাকলে অনুভূতি প্রগাঢ় হয়। আমাকে ভালোবাসতে হবে তোমার।’
বেলা তাচ্ছিল্য করে বলল, ‘আপনি ভালোবাসার কী বুঝেন?’
-বুঝিনা। তবে বোঝার চেষ্টা করছি। এই এতগুলো দিন পরে এসে উপলব্ধি করতে পেরেছি নিশা আমার কেউ-ই ছিল না। সে মরিচীকার ন্যায় দৃশ্যমান হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে। সত্যটা হলো, তুমি সত্যিই আমার কেউ হও। একদম নিজের কেউ, যার ভাগ আমি কাউকে দিতে পারবনা।
রোদ পড়ে যেতেই চারদিকে অন্যরকম একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয় পাহাড়ে। বেলা নিচে নামতে ভয় পায়। কিছুতেই নামতে চায়না। শাইনি ওর চোখ বেঁধে দেয়। অতি সাবধানে উঁচু পাহাড়টির ওপর থেকে নেমে আসে ওরা। কাঁটায় পা লেগে কতবার ব্যথাও লেগেছে শাইনির। সেসবের তোয়াক্কা না করেই নামতে সক্ষম ও। নিচে নেমে বেলার চোখ খুলে দেয়। সরু পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে। বেলা কৌতূহল দমাতে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনার মাথায় টুপি কেন?’
শাইনি হাসে৷ বলে, ‘কেন?’
-অচেনা মনে হয়। গুন্ডা গুন্ডা লাগে।
-খুলে ফেলব?
-আপনার যা ইচ্ছা তাই করুন। আমি জানতে চাইছি ওটা পরে আছেন কেন?
-ভালো লাগে।
-আপনি না অসুস্থ। কী হয়েছিল আপনার?
-জানিনা। ওসব বিষয়ে আরকিছু জিজ্ঞেস করলে ধাক্কা মেরে ফেলে দিব নিচে।
বেলা ভয় পেয়ে চুপ করে যায়। অদ্ভুত লোক, অসভ্য ব্যবহার তার।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা অনেকদূর চলে যায়। এদিকটায় কোনো বাড়িঘর নেই। এ সময়ে বেলার বাসার কথা মনে হয়। পা দুটো আর চলতে চাইলোনা। হঠাৎই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। শাইনি হতচকিত হয়ে ওকে দেখে। শক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘কাঁদো কেন?’
বেলা ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলল, ‘আম্মুর কথা মনে হচ্ছে!’
-একা থাকতে আর বাঁচতে শিখো। পিছুটান বড় খারাপ জিনিস। জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
-আপনি নিষ্ঠুর। আমি কখনো ওদের বিশ্বাস ভাঙতে পারবনা।
-এখানে বিশ্বাস ভাঙার প্রশ্ন আসছে কেন?
-আপনি উল্টোপাল্টা কথা বলে আমার ব্রেইনওয়াশ করতে চাচ্ছেন। কিন্তু আমি সেসব শুনবোনা।
শাইনি বেক্কল হয়ে যায়। বেলার হাত মুঠোতে নিয়ে
হাঁটতে থাকে। ওর মুখ গোমড়া। রাস্তার ধারের বুনো লাল রঙের ফুল দেখে বেলা সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। মুখফুটে কিছু বলেনা। শাইনি ওকে ছেড়ে দিয়ে কয়েকটা বুনোফুল ছিঁড়ে নেয়। লাল আর গোলাপির মিশেলে জবাফুলের ন্যায় বড় ফুল। হালকা মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছে। হুট করেই বাতাসে উড়ন্ত বেলার কানের পাশে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো পেছনে গুঁজে দেয় শাইনি। আলতো হাতে ফুলগুলো পরিয়ে দেয়। বেলা হতভম্ব কয়েক কদম পিছিয়ে যায়।
শাইনি মুগ্ধ কন্ঠে বলল, ‘মাই কুইন লুকস ভেরি নাইস! টু সুইট…’
বেলা ধমকের সুরে বলল, ‘চুপ করুন আপনি।’

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব___৮

শাইনি বলল, “তুমি কী আমাকে ভয় পাও?”
“না। আপনি বাঘ, ভাল্লুক না যে ভয় পাব!”
“এখন ভয় হচ্ছেনা? আমি যদি কিছু করে বসি?”
“আপনি বড্ড বেশি কথা বলেন। দয়া করে চুপ থাকুন আর বিরক্ত করা বন্ধ করুন!”
শাইনি ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। দুজনে সামনে এগিয়ে চললো৷ কিছুক্ষণ পর ওরা নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে গেল। শাইনি বলল, “এখানেই।”
বেলা মুগ্ধ হয়ে চারিপাশ দেখছে। সবুজের সমারোহে ঘেরা প্রকৃতি কন্যার নতুন রুপ ধরা পড়লো তার চোখে। উঁচুনিচু পাহাড়ের একটা বিরাট অংশজুড়ে দখল করে আছে সমতল জায়গা। তার একপাশ জুড়ে আছে মাঝারি আকারের একটা হ্রদ। তার পানি স্বচ্ছ নীল। পানির ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা রঙের হাঁস ও তাদের ছানারা। হ্রদের পাড়ে আছে বন্য গাছ। পাহাড়ের গা ঘেঁষে এত সুন্দর একটা জায়গা দেখে বেলা বিমোহিত নয়নে চেয়ে রইলো। শাইনি ওর হাত ধরে টানলো৷ ওর ধ্যান ভাঙতেই দুজনে সামনে এগিয়ে গেলো। কার্পেটের মতো বিছিয়ে থাকা ঘাসের ওপর গিয়ে বসলো। শাইনি জিজ্ঞেস করলো, “জায়গাটা সুন্দর না?”
বেলা বলল, “হুম। আপনি এখানে আগে এসেছেন?”
“বললাম তো। শ্রাবণ এলেই আসি!”
“কেন আসেন?”
“ভালো লাগে!”
“কেন?”
“ভালো লাগে।”
“কেন?”
শাইনি বলল, “এক প্রশ্ন বারবার করছো কেন?”
বেলা চোখ বড়বড় করে বলল, “বিরক্ত হচ্ছেন আমার ওপর?”
শাইনি অট্টহাস্যে বলল, “তুমিতো তাই চাচ্ছো৷ যাতে আমি বিরক্ত হয়ে কিছু একটা করে বসি। সেই সুযোগে তুমি পালিয়ে যাবে! মিসেস..আমি এতটাও বোকা না।”
বেলার মুখ কালো হয়ে গেল। ও কিছুতেই শাইনিকে ইম্প্রেস করতে পারছেনা। শাইনির বিশ্বাস অর্জন করায় বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। এ লোক আস্ত ঘাড়ত্যাড়া এটা বুঝতে ওর বাকি নেই। আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ও।
“ভালোবাসি বউ!”
চমকে তাকালো বেলা। শাইনি মুখ গম্ভীর করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। রোদের আলো লুকোচুরি খেলছে শাইনির চোখেমুখে। বেলা চুপ করে বসে রইলো। ওর মাথায় কোনো শব্দ আসছেনা, মস্তিষ্ক কোনো শব্দ গঠন করতে পারছেনা। নির্মল চোখে দেখে যাচ্ছে টুপি পরিহিত শাইনিকে।
“আমি জানি তুমি আমাকে পছন্দ করোনা।”
“বলবেন না আমাকে এসব কথা।”
“আচ্ছা বলবোনা৷ আসলে ভালোবাসা অদ্ভুত একটা বিষয়। কখন যে কী হয়ে যায় বোঝা মুশকিল।”
“হুম।”
“তবে এটুকু নিশ্চয়ই ধারণা করতে পারি যে, আমাকে ভালোবাসতে আর দেরি নেই। আমার প্রেমে পরতে দেরি নেই তোমার।”
বেলা মুখ ভেঙিয়ে বলল, “আপনি সবজান্তা? নন তো! একটা কথা জানেন তো? কনফিডেন্স ভালো, তবে ওভার কনফিডেন্স ভালো নয়।”
শাইনি কাঠ কাঠ গলায় বলল, “ওটা তোমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এতক্ষণে আমার ওপর তোমার ছোট্ট একটা বিশ্বাস হলেও জন্মেছে যে, আমি পাশে থাকলে তোমার কোনো ক্ষতি হবেনা। নইলে কোনো মেয়ে কিডন্যাপ হয়েছে জানার পর এত সহজ-স্বাভাবিক ভাবে বিহেভ কর‍তে পারেনা। আর তুমি দেখো, আমার সঙ্গে হেসে-খেলে ঘুরাঘুরি করছো!”
বেলা মুখ বাঁকালো। আসলেই শাইনির কথাটা ঠিক। অপ্রিয় হলেও এটাই সত্য যে, ছোটখাটো বিশ্বাস এই লোকটার প্রতি বেলার জন্মেছে। কিন্তু এটা কিছুতেই শাইনির সামনে স্বীকার করা যাবেনা। ও কথাটা গোপন করে বলল, “ম মোটেও না।”
“মেয়ে ভাঙবে তবুও মচকাবে না। জিদ্দি কোথাকার।”
“হুহ!”
“চলো ফিরে যাই। একটু পর সন্ধ্যা নেমে যাবে।”
বেলার মোটেও ইচ্ছে করছেনা যেতে। ইচ্ছে করছে সারাজীবন এখানে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে। ও ক্লান্ত কন্ঠে বলল, “আরেকটু থাকি!”
“কেন?”
“নিয়ে গিয়ে তো ওই খড়ের গাদায় ফেলে রাখবেন। তারচেয়ে এখানেই ভালো। বসে বসে সন্ধ্যে নামা দেখব। আমি আগে কখনো সূর্যাস্ত দেখিনি।”
“সূর্যাস্ত দেখতে হয় ওই পাহাড়ের চূড়ায় ওঠে।”
“সত্যি?”
“হুম। যাবে?”
“নিয়ে যাবেন আপনি?”
“যেতে চাইলে আমি নিয়ে যেতে পারি।”
বেলা সাথে সাথে রাজি হয়ে যায়। ঘটনাক্রমে যখন এত সুন্দর একটা জায়গায় এসেই পড়েছে তাহলে মুহূর্তটা উপভোগ করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। শাইনি ওকে জানিয়েছে বাসায় নাকি খবর পাঠানো হয়েছে। ওদিকের সবাই এই খবর শুনে না জানি কি রিয়েক্ট করেছে খোদা মাবুদ জানে। পুলিশের কাছে গেলেও বেলা অবাক হবেনা। কারণ নাইমুদ্দীন সাহেব নিশ্চয়ই শাইনির ওপর রেগে আছেন। মেয়ের জন্য কিছু না কিছু তো ঠিক করবেন ওনি। বেলা ওঠে দাঁড়ালো বসা থেকে। শাইনি ওকে একনজর পরখ করে বলতে লাগলো,
“আমার শ্রাবণ দিনের আকাশে
সে তাকায় স্বপ্নালু চোখে,
সে রংধনু ফোটায় আকাশপানে।
সে দেখে ভোরের সূর্য
শিশিরে ভেজা পদ্মফুল,
গোধূলির লাল আকাশ
রাতের প্রস্ফুটিত তারাদের।
আমার ভালোবাসার আকাশটাই
যে শ্রাবণ চোখে দেখলো!
তাঁকে দেখে‌ই আমার বেঁচে থাকার সাধ জাগলো,
হাজারো বছর!”

বেলা মাথা নত করে রইলো। ভাববার মতো কোনোকিছু মাথায় নেই। শাইনি প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “অপেক্ষায় থাকবে, একদিন ফিরে আসবো এই নীল হ্রদের ধারে।”
“চ চলুন।”
“হ্যাঁ।”
যে স্থান থেকে সূর্যাস্ত দেখা যায় সেটাকে পাহাড় বলা যায়না। তবে বেশ উঁচু। একপাশে মাটি কেটে সরু সিঁড়ি তৈরি করা আছে৷ রেলিঙ দেওয়া আছে। তবুও বেলা শাইনির হাত ধরে চোখ বন্ধ করে ওপরে উঠে এলো৷ কারণ ও ভয় পায় উঁচুতে চড়তে৷ তবে ওদের ভাগ্য খারাপ, কারণ এত কষ্ট করে সূর্যাস্ত দেখতে এসে তা আর দেখতে পেল না। সূর্য ডুবে গেছে ইতোমধ্যেই। আকাশ অন্যরকম। ঘন-কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। শ্রাবণ মাস, বৃষ্টি উপহার দেওয়ার পায়তারা করছে সে। হঠাৎই ঝপ করে বৃষ্টিরাজি নেমে এলো পাহাড়ে। ওরা দুজন ভিজে গেলো। বেলা বেশ আনন্দিত হলো। অনেকদিন পর বৃষ্টিতে ভিজতে পেরে মনটা ভালো হয়ে গিয়েছে।
শাইনি তাগড়া দিয়ে নেমে এলো নিচে। দুজনে কাকভেজা হয়ে গিয়েছে। বেলা কিছুতেই খড়ের বাড়িতে ফিরতে রাজি হলোনা। সে বৃষ্টিতে ভিজবেই। ওর অতি উৎসাহ দেখে শাইনি রেগে প্রচন্ড জোরে একটা ধমক দিলো। সঙ্গে সঙ্গে বেলার চোখ জলে টইটম্বুর হয়ে গেলো।
শাইনি হতবিহ্বল হয়ে ওর গালে হাত রেখে বলল, “স্যরি স্যরি। এক্সট্রেমলি স্যরি বউ। প্লিজ কেঁদোনা। প্লিজ চোখ মুছো। ঠিক আছে, ঠিক আছে আমরা ভিজবো। যতক্ষণ থাকতে চাও, শুধু তোমার কান্না বন্ধ করো।”
শাইনি অপেক্ষা না করে নিজেই বেলার চোখের পানি মুছে দিলো। বৃষ্টি থামার নামগন্ধ নেই। বেলা নিজেকে সামলে নিয়ে মনে মনে বলল, “দাঁড়াও বাছাধন। আজ এত ভিজা ভিজবো যে আমার সঙ্গে গলা উঁচিয়ে ধমক দেওয়া কাকে বলে সেটা ভুলে যাবি। কিডন্যাপ করার খুব শখ হয়েছে তাইনা? তোর শখ আমি ঘুচিয়ে দেব!আমার সঙ্গে যত অন্যায় করছিস তার শাস্তি পাবি হাড়ে হাড়ে। খুব ভালোবাসা উতলে উঠছে, যত্তসব নাটকবাজি! তোদের মতো বড়লোকের বিগড়ে যাওয়া সন্তানদের আমি খুব ভালো করেই চিনি। তোরা কখনো শুধরানোর মানুষ নস। স্বার্থ ফুরিয়ে গেলেই ডাস্টবিনে ফেলে দিস। যেমন নিশা আপুটাকে দিয়েছিস তেমন তো আমাকেও দিবি, হুহ!”

দীর্ঘ আধঘন্টা ওরা বৃষ্টিতে ভিজেছে। বেলা উপভোগ করলেও শাইনি তা পারেনি। ওর শরীর কাঁপছিলো প্রচুর। হাত-পায়ের তালু নীল হয়ে যাচ্ছিলো, মাথার শিরা দপদপ করছিলো তবুও সে বেলার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্রাবণের বর্ষণে নিজেকে মাতিয়ে তুলার অদম্য চেষ্টা করে চলেছিল। কোনো এক প্রতীক্ষার অবসান ঘটাতে, কোনো এক টানে, কোনো এক মোহে’র আশায় সে বিকারগ্রস্ত লোকের মতো ভুলেই বসেছিলো তার অসুস্থতার কথা! যেন ভালোবাসা পেলেই তার জীবন ধন্য। তার মানুষটার হাসিমুখটাই ওই সময়টাতে ওর জীবনের সবচেয়ে দামী বস্তু ছিল যেন। পৃথিবীর সবকিছু সেই মুহূর্তে ভুলে গিয়েছিল সে!

শাইনি ওর অসুস্থতা গোপন করেই চিৎকার করে বলেছিল, “তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা ততোটাই স্নিগ্ধ, যতটা হলে এ জীবনে তুমি আমাকে ভুলতে পারবেনা। যতটা হলে আমি একজন স্বার্থক প্রেমিক পুরুষের মর্যাদা পাবো তোমার চোখে।”

পাহাড় সে কথাগুলো প্রতিধ্বনি হিসেবে ফিরিয়ে দেয়নি। দূর থেকে দূরান্তে ছড়িয়ে দিয়েছিল বার্তাগুলো। পৌঁছে দিয়েছিল ধোঁয়াটে মেঘের দেশে। মিলিয়ে গিয়েছিলো হাওয়ায়। প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার অনুভূতি ছড়িয়ে দিয়েছিল দুজন কপোত-কপোতীর মনে নতুন করে, আবারও!

গল্প কেমন হচ্ছে একটু জানাবেন? শাইনির সম্বন্ধে কিছু বলুন যাতে বুঝতে পারি আপনারা কী চান!

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here