শ্রাবণ_তোমার_আকাশে,৯,১০
লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
পর্ব___৯
রাত বারোটা। ঘুমের মধ্যেই পায়ে কারোর ছোঁয়া টের পাচ্ছে বেলা। ধীরে ধীরে চোখ মেলে চাইতেই দেখলো চারদিকে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আছে। কিছুই দেখা যাচ্ছেনা৷ কিন্তু ও স্পষ্ট পায়ে কোনো কিছুর ছোঁয়া পাচ্ছে৷ কিন্তু এ ঘরে ও ছাড়া তো আর কেউ নেই। তাহলে কী ভূত? না পাশের ঘরে তো শাইনি আছে, তাহলে? ও নয়তো আবার!! বেলা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মৃদু চিৎকার করে চৌকির ওপর উঠে বসলো। চোখ বন্ধ করে বলতে লাগলো,
-প্লিজ প্লিজ আমাকে ছেড়ে দাও। কে আছো বাঁচাও আমায়..ইয়া আল্লাহ!
পাশের ঘরে শাইনি ঘুমাচ্ছিলো। জ্বরের কারণে শরীর দুর্বল, চোখ পর্যন্ত জ্বলছে। সারা শরীর ব্যথা করছে৷ হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে যে এত অসুস্থ হয়ে পড়বে তা ভাবেনি ও। বেলার চিল্লানো শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেলো ওর। জ্বরের কারণেই ও পাশের ঘরে শুয়েছে যাতে বেলা কিছু টের না পায়৷ নয়তো বেলার ঘরের মেঝেতেই শুয়ে পড়তো। যাইহোক, চিল্লানো শুনে ও শোয়া থেকে উঠে টলমল পায়ে একপ্রকার দৌড়ে এলো বেলার ঘরে। তাড়াহুড়ো করে বাতি জ্বালিয়ে দেখলো বেলা কাঁথা জড়িয়ে ধরে হুদাই চেঁচাচ্ছে। হয়তো ভয় পেয়েছে ভেবে শাইনি ওর কাঁধ ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-কী হয়েছে? এরকম করছো কেন আজব?
বেলা চোখ খুলে ভয় ভয় কন্ঠে বলল,
-ভূত। এ ঘরে ভূত আছে।
-কোথায় ভূত? আরে এখানে কেউ নেই আমি, তুমি ছাড়া।
-ত ত তাহলে আমার পায়ে কে হাত দিচ্ছিলো?
শাইনি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, ‘হোয়াট? কী বলছো তুমি?’
-সত্য বলছি৷ আ আমার পায়ে কারোর ছোঁয়া পেয়েছি।
-কিন্তু এ ঘরে তো কেউ নেই। তুমি হয়তো ভুল অনুভব করেছো।
-না। খুব স্পষ্ট।
শাইনি বুঝতে পারছেনা এখানে কে আসবে। কে এই কান্ড করবে। কিন্তু বেলার ভয় পাওয়া দেখে মনে হচ্ছে ও সত্যিই কিছু অনুভব করেছে। সন্দেহ নিয়ে শাইনি এদিকওদিক দেখতে লাগলো এবং খুঁজতে খুঁজতে একপর্যায়ে চৌকির তলায় একটা বিড়ালের ছানাকে দেখতে পেলো। এবার বুঝতে পারলো আসল কারণ। মুচকি হেসে ছানাটাকে কোলে নিয়ে বেলার কাছে গিয়ে বসলো। বেলা বিড়ালটাকে দেখে ভয় পেয়ে পেছনে সরে গেলো। বলল,
-এটা কী?
-আজব। বিড়াল চেনো না? ভাবসাব দেখে তো মনে হয় দুনিয়ার সব চেনো!
বেলা কড়া গলায় বলল, ‘চুপ করুন। আমিও দেখতে পাচ্ছি এটা বিড়াল। কিন্তু এত রাতে একে কোথায় পেলেন?’
-চৌকির তলায় ম্যাডাম।
বেলা থতমত খেয়ে বলল, ‘কখন আসলো এটা?’
-জানিনা। হয়তো বৃষ্টিতে ভিজে এখানে আশ্রয় নিয়েছিল আর বেরুতে পারেনি৷ আর এতক্ষণ এটার নরম, কোমল শরীরে তোমার পা লাগছিল হয়তো। আর তুমি ভাবলে ভূত..!
বেলা ভয়ার্ত কন্ঠে বলল, ‘কেন এরকম করছিল ও?’
-বসে বসে আমার বউকে পাহারা দিচ্ছিলো।
-বাজে কথা বন্ধ করুন। এটা নির্ঘাত অন্যকিছু। আমি শুনেছি রাতবিরেতে কিছু একটা অনেক কিছুর রুপ ধরে মানুষকে ভয় দেখায়। এটাও হয়তো তেমনকিছু..প্লিজ এটাকে বাইরে রেখে আসুন!
শাইনি হু হা করে হাসতে লাগলো। বেলা অগ্নিদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো। কিছু একটা ভেবে বলল, ‘অন্ধকারে হয়তো আপনি ছিলেন। এখন বিড়ালটার দোষ দিচ্ছেন যাতে আমার কাছে ধরা না পরেন। আমার কাছে ভালো সাজতে পারেন! তাই না?’
সঙ্গে সঙ্গে শাইনির হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। ও চোখমুখ শক্ত করে বলল, ‘এরকম করার প্রয়োজন নেই আমার৷ কারণ প্রথম থেকেই তুমি আমাকে জানো। আমি চাইলে যখন খুশি তোমাকে টাচ করতে পারি। আর চোরের মতো তোমাকে টাচ করতে বয়েই গেছে আমার। নিজের মতো উলটাপালটা ভাবা বন্ধ করে মানুষকে একটু বিশ্বাস করলে মাঝে মাঝে ক্ষতি তো আর হয়না। যত্তসব!’
বেলা আর কিছু বললো না। বিড়ালটাকে থাপ্পড় দিতে ইচ্ছা করছে। কি ভয়টাই না পাইয়ে দিয়েছিল। আরেকটু হলে হার্ট-অ্যাটাক হয়ে যেতো। এমনিতেই কত চাপের ওপর আছে তার ইয়ত্তা নেই। শাইনি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘বিড়ালটাকে ওই ঘরে রেখে আসি।’
বলেই পাশের ঘরে চলে গেলো। তারপর আবার ফিরে এলো। জিজ্ঞেস করলো, ‘ক্ষিধে পেয়েছে? খাবে তো?’
-হুম।
শাইনি খাবারের ব্যবস্থা করলো। সে স্টোভে আগুন জ্বালিয়ে কড়াই বসালো। ডিম সেদ্ধ করে, পানি গরম করে আধঘন্টার মধ্যেই নুডুলস তৈরি করে ফেললো। সাথে বনরুটি আর কলা। যেটা বেলা দুচোখে সহ্য করতে পারেনা। তাই ও নুডুলসই গিলতে লাগলো। যদিও খেতে ততোটা মন্দ হয়নি, বরং ভালোই।
শাইনি কুঁড়েঘরে আগেই এসব খাদ্যদ্রব্য, স্টোভ এবং প্রয়োজনীয় ছোটখাটো জিনিস জোগাড় করে রেখেছে। এমনকি কিছু কাপড়চোপড়ও পরার জন্য। আজ সন্ধ্যায় বৃষ্টিতে ভিজায় কাপড়ের অভাবে ভুগতে হয়নি তাদের। এসবকিছু দেখে বেলা বুঝতে পারলো শাইনি আঁটঘাট বেঁধেই ওকে তুলে এনেছে। এদিকে
জ্বরের শরীর নিয়ে রান্না করতে গিয়ে আরও ক্লান্ত হয়ে পড়লো শাইনি। খাবারগুলো কেমন বিস্বাদ লাগছে। কোনো ঘ্রাণই পাচ্ছেনা, যেন ওর ঘ্রাণশক্তি লোপ পেয়েছে। অথচ বাইরে বৃষ্টিতে ভেজা সোদা মাটির গন্ধ, ফুলের গন্ধ ঠিকই পাচ্ছে। ঘামে ওর সারা শরীর ভিজে যাচ্ছে৷ তাই মাথা থেকে টুপিটা খুললো ও। বেলা খাওয়া থামিয়ে ‘হা’ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। এই তিনদিনে প্রথম টুপি ছাড়া ওকে দেখতে পেয়েছে ও!
ঝাকড়া চুলের শাইনিকে দেখে বেলা মাথা নিচু করে ওর মুখটা দেখার চেষ্টা করে বলল, ‘একী! আপনার চুল এত বড় কেন? গুন্ডাদের মত?’
শাইনি হকচকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। টুপিটা আবার মাথায় জড়িয়ে বলল, ‘ও কিছুনা। বাদ দাও তো।’
-এড়িয়ে যাওয়ার কী হলো?
-বাদ দাও।
-তার আগে বলুন কেন?
-কী কেন?
-এই যে এত বড় বড় চুল। আপনি কী সন্ত্রাসীর খাতায় নাম লিখিয়েছেন?
শাইনি বিরক্ত কন্ঠে বলল, ‘নিজে নিজেই যখন এতকিছু আন্দাজ করতে পারো তাহলে জিজ্ঞেস করো কেন আজব!’
বেলার মুখ দিয়ে ফট করে বেরিয়ে এলো, ‘আপনি না আমাকে ভালোবাসেন? এই তার নমুনা? আসলে মনে মনে সব শয়তানি। কিছু যদি লুকালেনই তাহলে ভালোবাসা কী করে হলো? ভালোবাসা হয় বিশ্বাস, ভরসায়। এসব কিছুই তো নেই। খালি জোর করে আটকে রাখা আর মেয়েদের লাইন মারা এটাই আপনার কাজ।’
শাইনি রুক্ষ স্বরে বলল, ‘উঁহু। শেষ কথাটা ভুল বললে, মেয়েদের সাথে লাইন মারতাম বহুকাল আগে। প্রাচীনকালে। এখন বউ হয়েছে তার সাথেই লাইন মারবো বলে ঠিক করেছি। ‘
বেলা ভ্রু কুঁচকালো। বলল, ‘তাহলে বলুন চুল এত বড় কেন? কাকে ইম্প্রেস করতে চান?’
শাইনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘কাউকে না।’
-তাহলে?
-জানতে যখন এতই উৎসুক তবে বলি, চুলগুলো কিছুদিন পর আর থাকবেনা।
-কেন?
-কারণ আমিই আর থাকবোনা।
বেলা হতভম্ব হয়ে বলল, ‘মানে? কী বলছেন এসব?’
শাইনি বেলার হাতটা টেনে ওকে নিজের কাছে নিয়ে এলো৷ বেলা ওর কথা শুনে এতটাই বিস্মিত হয়েছে যে কিছু ঠাহর করতে পারছেনা। শাইনি ওর হাতটা নিজের কপালে রাখলো। বেলা চমকে উঠলো। বলল, ‘আপনার গায়ে তো অনেক জ্বর!’
-হুম।
-কীভাবে হলো এত জ্বর হঠাৎ?
-বৃষ্টিতে ভিজায়।
-তাহলে ভিজলেন কেন?
-তুমি ভিজলে তাই। একসঙ্গে ভেজার আনন্দই আলাদা। তাও আবার পাহাড়ে৷ আর তুমিতো মনে মনে চাইছিলেই যে আমি বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধিয়ে মরে যাই, যাতে তুমি আমার থেকে পালাতে পারো।
বেলা ওর হাতটা সরিয়ে নিলো। গিয়ে বসলো চৌকির আরেক কোণে। এই শাইনি লোকটা কী? ওর মনের সব কথা কেমন করে বুঝে গেল? আর বেলার নিজেরও বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর হয়, ঠান্ডা লাগে। কিন্তু কই আজ তো ওর তো জ্বর হয়নি। কিন্তু শাইনি এত অসুস্থ হয়ে পড়লো কেন? লোকটার আসলে কি হয়েছে? এত অদ্ভুত ব্যবহার। চুলগুলো বড়, কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো সব কর্মকাণ্ড করছে! বেলা নির্লিপ্ত চোখে শাইনিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। বলল, ‘আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি? ঠিক ঠিক উত্তর যেন পাই!’
শাইনি বলল, ‘কী?’
-আপনার আসলে কী হয়েছে? মানে এত অসুস্থ কেন আপনি? সবাই শুধু বলে আপনি অসুস্থ, কিন্তু রোগটা কী তা বলে না।
শাইনি আলতো হেসে বলল, ‘সত্যিই জানতে চাও নাকি?’
-হুম। বলুন।
-খুশি হবে খুব।
-তা তো বটেই। ভনিতা না করে বলে ফেলুন তো!ঠিকটা বলবেন।
-লিউকেমিয়া। বলতে পারো রক্তের বা অস্থিমজ্জার ক্যান্সার!
চলবে…ইনশাআল্লাহ!
#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব___১০
কথাটা যেন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে বেলার কাছে। এতো শক্ত-সামর্থ্য লোকটার শরীরে এমন ভয়ানক একটা রোগ বাসা বেঁধে আছে এটা কিছুতেই কারোর কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হবেনা৷ ওর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠলো। বলল, ‘কথাটা আগে জানালেন না কেন?’
শাইনি বলল, ‘কেন? আগে বললে ভালোবাসতে বুঝি?’
-না।
-তাহলে?
-আপনি এই রোগের কথা লুকিয়ে আমাকে বিয়ে করেছেন। আপনার কী মনে হচ্ছেনা এটা করা ঠিক হয়নি, এটা অন্যায়?
শাইনি মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘না।’
-আশ্চর্য!
-তুমি আমার সাথে ঝগড়া করতে চাইছো?
-মোটেও তা নয়। আমি শুধু জানতে চাইলাম।
শাইনি আকুতিভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘আমাকে ভালোবাসবে কবে?’
বেলা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ওর পা টলমল করছে। কষ্ট হচ্ছে, খারাপ লাগছে। কাঁদতে ইচ্ছা করছে। মা-বাবার কথা মনে হচ্ছে। মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে মন চাইছে। এই কয়টা দিন এত খারাপ লাগেনি, কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে বেলার মনে হচ্ছে এক্ষুনি মাকে দরকার। মায়ের কোলের আশ্রয়টা ওর দরকার। ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে ও বুঝতে পারছেনা। আসলে বুঝতে পারছে অল্প অল্প, কিন্তু কারণটা মেনে নিতে ওর মন সায় দিলেও কেন জানি মস্তিষ্ক সায় দিচ্ছেনা।
শাইনির মুখ পাংশুটে দেখাচ্ছে। বেলার নীরবতা আর অন্যমনস্কতা ওর ভালো লাগছেনা। জ্বরের ঘোর গাঢ় হচ্ছে। সবকিছু একটু-আধটু ঝাপসা হয়ে আছে যেন। সে আবারও জিজ্ঞেস করলো, ‘কবে একটু ভালোবাসবে আমাকে? তোমার মনে কী আমার জন্য কোনো অনুভূতি নেই? কিছু নেই? দেখো আমি তোমার কাছ থেকে একটু ভালোবাসা পাওয়ার নেশায় চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করে আছি। আমি চাই আমার শ্রাবণ ঘেরা আকাশটাতে এক টুকরো রঙিন মেঘ হয়ে বসবাস করো। আরো চাই, শ্রাবণের ওই আকাশটা তোমার নামে লিখে দিতে, খুব করে ভালোবাসতে। আমার বেপরোয়া জীবনের রঙিন মেঘ হয়ে আমাকে আপন করে নিতে। কখনো কী সেই ভালোবাসা পাবো না আমি?’
বেলা শুনলো। অনেকক্ষণ পর একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘বাইরে বৃষ্টি থেমেছে, তাইনা?’
-হুম!
-ঘরে আমার ভালো লাগছেনা। বাইরে যাব।
-এখন? এত রাতে?
-হুম। আপনি থাকুন। আমি বাইরে যাই।
শাইনি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘আমিও যাব। একা যাওয়ার কী প্রয়োজন!’
বেলা হাসলো। বলল, ‘ভয় নেই। পালাচ্ছি না। এত রাতে পাহাড়ের উপর থেকে নামতেই পারবোনা আর পালাবো কী! আর এখন পালিয়ে যাব-ই বা কোথায়। সো টেনশন ফ্রি থাকুন!’
-না যাব।
-আপনার শরীর খারাপ, বিশ্রাম নিন।
-না।
বেলা রেগে গেলো। বলল, ‘যাব-ই না আমি।’
বলে চৌকির ওপর উঠে বসলো। গাল ফুলিয়ে রাখলো। শাইনি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। আচমকাই বেলাকে অবাক করে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলো। বেলা হতভম্ব হয়ে বলল, ‘কী করছেন কী? ছাড়ুন আমাকে।’
-ছাড়ব না।
বেলা কটমট করে বলল, ‘বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু…’
-হোক। চলো বাইরে বসে গল্প করি।
-আমি কোথাও যাবো-না।
-যেতে হবে।
বেলা বিরক্ত কন্ঠে বলল, ‘আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি। আমার রাগ সম্বন্ধে আপনার ধারণা নেই মিস্টার শাইনি।’
-আহ!
বেলা ছোট ছোট চোখ করে বলল, ‘কী হলো?’
শাইনি ঈষৎ হেসে বলল, ‘কী মধুর লাগলো তোমার মুখে আমার নাম।’
বেলা মুখ কালো করে বলল, ‘বেহায়া লোক!’
-আমার ছোট্ট বউটার জন্য যদি বেহায়া হতে হয়, তাহলে তাই-ই হবো।
-এরকম করার কারণ? আপনি অসুস্থ, নিশ্চয়ই এরকম কিছু করা উচিৎ নয়।
শাইনি উদাস গলায় বলল, ‘আমার বউ একটা আবদার করেছে, আর আমি সেটা পালন করবো না? অসুস্থ বলে রোগীর মতো পরে থাকব, তা কখনোই হবেনা।’
-আমি আবদার করিনি। ঘরে ভালো লাগছিলো না তাই বাইরে বসতে চাচ্ছিলাম একা।
-বিয়ে হয়েছে তোমার। একা একা আবার কী?
-আপনার সাথে কথা বলাই অন্যায়।
-তা বটে!
বেলা মুখ ভেঙালো। অনুরোধের স্বরে বলল, ‘নামিয়ে দিন না প্লিজ। আপনি অসুস্থ, আমি হেঁটে যাব প্লিজ!’
শাইনি ধমকে বলল, ‘চুপ। আর একটা কথাও নয়।’
-গুন্ডা লোক। রোগে ধরেছে তাও ভিমরতি যাচ্ছেনা আপনার। কোথায় সব পাপ মোচনের জন্য খোদার কাছে প্রার্থনা করবেন, নিজের সুস্থতা চাইবেন তা না। হিরোগিরি, গুন্ডাগিরি করতে আসছেন!
শাইনি ‘হা হা’ করে হাসলো। শরীরের উত্তাপ ক্রমশই বাড়ছে। বেলাকে নিয়ে চৌকাঠ পেরুনোর সময় একটু হেলে গেলো শাইনি। বেলা ভয়ে সঙ্গে সঙ্গে ওর কাঁধ খামচে ধরলো। আর তখনই ওর ঘাড়ে হাত পড়ায় বুঝতে পারলো জ্বর বাড়ছে ওর৷ ও ভীষণ আশ্চর্য হয়ে দেখলো এত তাপমাত্রায় জ্বর নিয়েও একটা লোক কীভাবে ওর চাওয়া পূরণ করতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বেলা নিচু স্বরে বলল, ‘জ্বর তো বাড়ছে।’
-তেমনই আছে।
তারপর ওকে নিয়ে শাইনি বাইরে চলে এলো। খড়ের ঘরটার সামনের সমতলে যে গাছটা আছে তার নিচেই বাঁশ দিয়ে বানানো একটা মাচা আছে। সেখানে ইচ্ছেমতো হাত-পা মেলে বসা যায়। শাইনি বেলাকে ওখানে বসিয়ে নিজেও বসলো। হাঁপাচ্ছে সে। বেলা ঘর থেকে পানির বোতল এনে ওকে দিলো। তারপর পাশে বসলো। শাইনি অবাক হয়ে দেখলো, পানিটাও খেয়ে নিলো। কিন্তু কিছু বললোনা। ওর চোখ কেমন জ্বলজ্বল করছে।
বেলার মন বিষন্ন। চোখদুটো রাতের প্রকৃতিকে দেখায় ব্যস্ত। মাথার উপর ছাদ নেই, আছে বিশাল আকাশ। আর আছে শুক্লাদ্বাদশীর চাঁদ। কোটি কোটি তারায় ভরা রুপোলি আভা ছড়ানো চাঁদের আকাশ। দূরের পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে গড়ে ওঠা আদিবাসীদের ঘরবাড়ি গুলোতে টিমটিম করে আলো জ্বলছে। বৃষ্টি হওয়ার কারণে চারদিকে যেমন সতেজতা নেমে এসেছে, তেমনি হাওয়ায়ও কেমন একটা উদ্ভ্রান্ত ভাব। ঝর্ণার ছুটে চলার আওয়াজ, নিশুতি পাখিদের উড়ে চলা আর নিঃশব্দতার গান সব মিলিয়ে অসাধারণ এক দৃশ্য! শ্রাবণ মাসে বুঝি পাহাড়ের প্রকৃতি এতো সুন্দর হয়? জীবনের মূল্যবান বিশটা বছর কাটিয়ে ফেলার পর জীবনের এই প্রথম, এতো জাদুকরী একটা রাত কাটানোর সৌভাগ্য হয়েছে বেলার। সে আদৌ তা উপেক্ষা করতে রাজি নয়! অথচ এই অসাধারণ লোভনীয় মুহূর্তগুলোর পদার্পণ ঘটিয়েছে ওর জীবনের সবচেয়ে অপ্রিয় ব্যক্তিটি, যে নাকি ওর স্বামী! যে ভয়ানক একটা রোগে আক্রান্ত এবং মারা যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। যতই হোক, বেলা চায়-না কেউ অকালে মারা যাক। আর এতদিনে ওর সাথে থাকতে থাকতে কেমন একটা মায়াও বসে গেছে। যদিও ওকে অন্যায়ভাবে তুলে এনেছে। কিন্তু মনকে সে কি দোষ দেবে! মন তো অবাধে ছুটে চলছে! হঠাৎ ওর চোখের কোণে দু-ফোটা জল চলে এলো। শব্দ করে কেঁদে দিলো বেলা। শাইনি হতচকিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে? কাঁদছো কেন?’
বেলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, ‘লিউকেমিয়া হলে কী মানুষ মরে যায়?’
শাইনির বুক কেঁপে উঠলো। ঢোক গিলে বলল, ‘তুমি জানোনা? সায়েন্সের ছাত্রীর এটুকু তো অন্তত জানার কথা।’
বেলা কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘প্লিজ বলুন!’
-হুম, মারা যাওয়ার চান্স থাকে। ভালো চিকিৎসা হলে অনেক মানুষই সুস্থ হয়ে যেতে পারে।
বেলা ওর দিকে তাকালো। ওর চোখ ভেজা৷ শাইনির কথা শুনে সটান হয়ে উঠে দাঁড়ালো। রেগে গেলো অনেক। তারপর উন্মাদিত কন্ঠে চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘তাহলে আপনি চিকিৎসা করাচ্ছেন না কেন? এখানে আমাকে নিয়ে ঘুরাঘুরি, মাতামাতি করার প্রয়োজনটা কী? আমার জন্য বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধানো, ঠান্ডা লাগানোর কী দরকার? আমাকে কোলে তুলে নেওয়ার কী দরকার? আমার কী পা নেই? নাকি আমি অন্যের ওপর নির্ভর করে চলি? আমি বলেছি আমাকে পাহাড়ে নিয়ে আসতে? এত সৌন্দর্য উপভোগ করাতে বলেছি একবারও? এত দুর্বলতা, অসুস্থতা নিয়ে এতসব করে আপনি নিজেকে মহান প্রমাণ করতে চান? ভালো স্বামী সাজতে চান? কেন এতসব করছেন? আপনি বুঝতে পারছেন না আমার এগুলো চাইনা? আমি এমনই ঠিক আছি?’
শাইনি শুধু হতভম্ব হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আর অবাক হয়ে ওর কথাগুলো শুনছে। কিন্তু কিছুই তার বোধগম্য হচ্ছেনা। ওর চুপ থাকাটা বেলার আর সহ্য হলোনা। মাথা থেকে টুপিটা খুলে দূরে ছুঁড়ে মারলো। ওর চুল টেনে ধরে বলল, ‘আর এই চুলগুলো রেখেছেন কেন? এত লম্বা লম্বা গুন্ডাদের মতো চুল, সন্ত্রাস হতে চান নাকি দেবদাস? আমার ভালোবাসা না পেলে মেঘ হবেন, আকাশ হবেন যত্তসব কাব্যিক কথাবার্তা! এই চুল যদি না কেটেছেন তাহলে আপনার কী অবস্থা করবো ভাবতেও পারবেন না। নির্লজ্জ লোক কোথাকার! মেয়েদের সাথে ঘেঁষাঘেঁষি করে এখন আসছে দেবদাস হতে। বড়লোক বাপের ছেলে তো, জীবনকেও আপনারা খেলনা মনে করেন।’
বেলা ক্লান্ত হয়ে হাঁপাতে থাকে। বাঁশের মাচায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। শাইনি পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘বলা শেষ আপনার? পানি খান।’
বেলা এবার উঠে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলো শাইনির গালে! কটমট করে বলল, ‘আপনি খান!’
শাইনি হতভম্ব হয়ে গালে হাত দিয়ে বসে রইলো। বেলার কাছ থেকে এমন প্রতিক্রিয়া সে আশা করেনি। কী হলো হঠাৎ করে মেয়েটার?
চলবে…ইনশাআল্লাহ