শ্রাবন_আধারে_তুমি,০১,০২

0
1349

#শ্রাবন_আধারে_তুমি,০১,০২
#লেখিকা_আফরিন_ইসলাম
#পার্ট :১

অনেক দূর থেকে ফজরের আজান কানে আসতেই চোখের পানি মুছে নিলাম ৷ আমার বিয়ের দেড় বছর হয়ে গেছে কিন্তু এখনো স্বামীর সাথে একটা কথা বলতে পারি নি ৷আমাকে বিয়ে করে চলে গেছে আমেরিকা ৷আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলাম ৷অতঃপর নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালাম ৷

নামাজ শেষ করে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালাম ৷বড্ড মাথা ব্যাথা করছে তাই চুলায় গরম পানি বসালাম চা বানাতে ৷ চা বানিয়ে নিজের ঘরে এলাম আবারো ৷ বিছানায় বসে চা খাচ্ছিলাম হঠাৎ চোখ পড়লো একটা ছবির ওপর ৷মূহুর্তেই ভুলে গেলাম মাথা ব্যাথার কথা ৷ছবিটা হাতে তুলে নিলাম ৷আমার চোখে জল রাশি জমা হয়েছে ৷ ছবিটা আর কারো নয় আমার স্বামীর ৷হাত বুলিয়ে দিলাম তার ছবিতে ৷তাকে কখনো ছুয়ে দেখা হয় নি ৷আচ্ছা আমি কি কখনো তাকে ছুতে পারবো নিজের হাতে ৷আমার বুকটা ভারী হয়ে গেল ৷আচ্ছা সেও কি আমার কথা ভাবে ৷সেও কি আমার কথা ভেবে রাত জাগে ৷এই যে আমি তার অপেক্ষায় শত শত রাত পার করে দেই ৷এই যে আমি গাড়ীর আওয়াজ পেলেই ছুটে যাই সে আসবে বলে ৷কিন্তু সে আসে না একবারও ৷সেও কি আমার কথা ভাবে ৷সেও কি আমার কাছে আসতে চায় ৷আচ্ছা সে যদি জানতে পারে আমার রাত জাগার কারন সে তাহলে কি করবে ৷ আর ভাবতে পারলাম না কারন আমার হাতের কাপটা নিচে পরে গেছে ৷ তার কথা ভাবতেই আমার শরীর এতটা কাপঁতে ছিল যে চায়ের কাপটা হাত থেকে পরে গেছে ৷

আমার নাম রাই ৷আমার বয়স আঠারো বছর ৷মামা আর মামির কাছে আমি বড় হয়েছি ৷ আর আমার স্বামী আবরার খান জয় ৷ সে পেশায় ব্যবসায়ী ৷আর বাকিটা আস্তে আস্তে জানতে পারবেন ৷

আবরার ছবিটা খুব যত্ন করে শাড়ীর আচঁল দিয়ে পরিষ্কার করলাম ৷ ছবিটা বিছানার পাশে রেখে ভাঙ্গা কাচ গুলো পরিষ্কার করে নিলাম ৷ হঠাৎ করে একটা কাচ আমার হাতে ঢুকলো ৷ হাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম ৷মনে পরে গেল অতিতের কথা ৷

আমার তখন ১০ বছর বয়স ৷আমি গ্রামের সাধারন একটা পরিবারের মেয়ে ৷আমার মা ক্যান্সারে মারা গেছে যখন আমার দশ বছর ৷মা মারা যাওয়ার পর বাবা আবারো বিয়ে করে ৷সৎ মা আমাকে একদম দেখতে পারতো না ৷আমার বাবার গ্রামের বাজারে কাপড়ের দোকান ছিল অনেক বড় ৷বাবা সারাদিন পর বাড়ীতে আসলেই সৎ মা আমার নামে মিথ্যা বলে বিচার দিত ৷আমার নিষ্ঠুর বাবা সত্য মিথ্যা যাচাই না করেই আমাকে শাস্তি দিত ৷আমার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে মামা আমাকে তার কাছে নিয়ে আসেন ৷আমার মামা গ্রামের চেয়ারম্যান ৷গ্রামে মামার মোটামুটি ভালোই দাপট আছে ৷মামা আমাকে অনেক ভালোবাসতো ৷কিন্তু মামি আমাকে একদম দেখতে পারতো না ৷আমাকে দিয়ে বাড়ীর সব কাজ করাতো ৷ এভাবেই দিন যাচ্ছিলো ৷ আস্তে আস্তে আমি বড় হতে লাগলাম ৷

আমার যখন প্রায় সতেরো বছর তখন এক বৈশাখী ঝড়ের মতো আবরার আমার জীবনে আসে ৷আবরার এসেছিল তার বন্ধুদের সাথে বেড়াতে আমাদের গ্রামে ৷আবরারকে আমি চিনতামও না ৷সবই ঠিকঠাক ছিল কিন্তু এক কাল বৈশাখী ঝড় আমার জীবনটা এলোমেলো করে চলে গেল ৷

এই রাই কোথায় গেলি ৷মামির গলার আওয়াজ শুনে রান্নাঘর থেকে দৌড়ে তার কাছে গেলাম ৷আমি যেতেই মামী বলল

হ্যা রে নাবাবের বেটি এত সময় লাগে আসতে ৷

রাই নিচু স্বরে বলল মামী আসলে আমি খাচ্ছিলাম তাই ৷

হ্যা সারাদিন শুধু গেলা আর অন্ন ধ্বংস করা তাই না ৷এই নে টাকা আজ স্কুল থেকে আসার সময় এই ঔষুধ গুলো নিয়ে আসবি ৷

ঠিক আছে মামী রাই বলল ৷

একটু পরেই রাই স্কুলে চলে গেল ৷স্কুল শেষ করে ঔষুধ কিনে নেয় রাই ৷কিন্তু তার পরেই মুষলধারে বৃষ্টি নামে ৷রাই তিন ঘন্টা দাড়িয়ে থাকে একটা দোকানের পাশে ৷ঐ দিকে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে ৷রাই কোনো কুল না পেয়ে এবার দৌড় দেয় বৃষ্টিতে ৷ এদিকে মেঘে চারিদিকে অন্ধকার ছেয়ে গেছে ৷কোথাও কোনো মানুষের চিহ্ন নেই ৷রাই দৌড়াতে দৌড়াতে একটু দুরেই একটা কুড়ে ঘর দেখতে পেল ৷রাই ঐ ঘরটার দিকে দৌড়ে গেল ৷রাই ঘরটায় প্রবেশ করতেই তার মুখে ভয় এসে জমা হলো ৷কারন ঐ ঘরে একটা ছেলে বসে আছে খড়ের পাশে ৷ছেলেটাও রাইকে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেল ৷এদিকে রাইয়ের ভিজে যাওয়া শরীরে লেপ্টে যাওয়া জামার দিকে তাকিয়ে ছেলেটির নাজেহাল অবস্থা ৷রাই যে তাকে ভয় পাচ্ছে ছেলেটা বুঝতে পেরে বলল

আমাকে ভয় পেতে হবে না ৷আমিও তোমার মতো বৃষ্টিতে আটকে গেছি পুচকি ৷ বৃষ্টি থামার আগে তুমি চাইলে এখানে বসতে পারো ৷ছেলেটাকে রাইয়ের খারাপ মনে হলো না ৷রাই ছেলেটার থেকে অনেক দুরে বসলো ৷রাইকে স্বাভাবিক করার জন্য ছেলেটা বলল তোমার না কি ?

রাই কাপাঁ গলায় বলল আমার নাম রাই ৷আপনার কি নাম ?

ছেলেটা জবাব দিল আমার নাম আবরার খান জয় ৷

আপনাকে তো কখনো দেখি নি ৷আপনি কি এলাকায় নতুন ৷

আসলে আমি আমার বন্ধুর বাড়ীতে বেড়াতে এসেছি ৷একটু দরকারে বেড়িয়ে ছিলাম ৷কিন্তু দেখ বৃষ্টির জন্য আটকে গেলাম ৷তুমি কেন আটকে গেলে বৃষ্টিতে ৷

স্কুল শেষ করে মামার ঔষুধ কিনতে দেরি হয়েছে ৷

ও তুমিতো শীতে কাপঁছো ৷তুমি আমার এই শার্টটা পড়তে পারো ৷

না থাক লাগবে না ৷

আরে নাও ৷ভালো লাগবে ৷

রাই শার্টটা নিল ৷এমনিতেও তার শীত লাগছিল অনেক ৷

এমন অনেক কথা হলো রাই আর আবরার মাঝে ৷কথা বলতে বলতে দুইজন যে কখন ঘুমিয়ে গেছে তা বুঝতেই পারলো না ৷আর এটাই ওদের কাল হয়ে দাড়ালো ৷

চলবে…

#শ্রাবন_আধারে_তুমি
লেখিকা:আফরিন ইসলাম
পার্ট:২

মানুষের প্রচন্ড চিৎকারের আওয়াজে আবরার আর রাইয়ের ঘুম ভাঙ্গে ৷তারা বাইরে আসতেই সবাই তাদের ঘিরে ধরলো ৷একজন বলল এই মাইয়া এতই যখন পুরুষ মানুষের লগে ঢলাঢলি করতে মন চায় ৷তাহলে নিজের মামারে বলতে পারিস নি ৷এই ভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে তামাশা করছোস কেন ৷এমন ভাব ধরে থাকিস যেন কিছুই বুঝিস না ৷আর তলে তলে পুরুষ মানুষের সাথে রাত কাটাতে ভালো লাগে না ৷

আরেকজন বলল তা হ্যা রে লুকিয়ে লুকিয়ে এই ভাবে অবৈধ সম্পর্ক কতবার করেছিস হ্যা ৷

আবরার এবার সহ্য করতে না পেরে বলল আপনারা এই সব কি বলছেন ৷কারো ব্যাপারে না জেনে কথা বলা উচিত না ৷কাল রাতে আমরা….

আবরার কথা শেষ করার আগেই আরেকজন বলল ব্যভিচার করে এখন আবার বড় বড় কথা ৷এই ওদের নিয়ে চল ৷

আবরার আর রাইকে নিয়ে বিচার সভা বসেছে ৷গ্রামের সবার একটাই কথা হয় রাইকে বিয়ে করতে হবে ৷নইলে তারা আবরারকে জেলে দেবে ৷রাইয়ের মামা মামি খবর পেয়ে দৌড়ে এসেছে ৷কাল সারারাত রাইয়ের মামা রাইকে খুজেছে ৷মামাকে দেখে রাই তার কাছে গেল ৷মামাকে জরিয়ে ধরতে গেলেই রাইয়ের গালে সজোরে থাপ্পর পড়লো ৷

রাইয়ের মামা বলল আমাকে একদম তুই ছুবি না ৷এই পাপ করার আগে তুই কেন মরে গেলি না ৷আমার মান সম্মান এভাবে তুই নষ্ট করে দিলি ৷

মামা বিশ্বাস করো আমি কিছু করি নি ৷ওনারা না জেনেই আমার নামে মিথ্যা কথা বলছে রাই বলল ৷

রাইয়ের মামি বলল হ্যা রে একে তো পাপ করেছিস আবার বড় বড় কথা ৷নিজের মাকে খেয়ে বসে আছিস ৷বাবার ঘরেও তো ঠাই হলো না ৷এখন আমাদের ঘাড়ে এসে পড়লি ৷

পরের কথা সহ্য করতে পারলেও নিজের মানুষদের এই অপবাদ রাই সহ্য করতে না পেরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো ৷রাই বলল আমাকে তোমরা ভুল বুঝছো মামা ৷আমি ঐ লোকটার সাথে কিছু করি নি ৷

আস্তে আস্তে পুরো গ্রামে আবরার আর রাইয়ের কথা ছড়িয়ে পড়েছে ৷পুরো গ্রামে রাইকে ছি ছি করছে ৷আবরার বন্ধুরাও এলো ৷আবরার তার বন্ধু সাদির বাড়ীতে এসেছিল ওর বোনের বিয়েতে ৷সাদি অবস্থা খারাপ দেখে আবরারকে বলল

যা করার তাড়াতাড়ি কর আবরার ৷একবার যদি তোকে জেলে দেয় এরা তাহলে রক্ষা নেই ৷তোর বাবার মান সম্মান সব শেষ হয়ে যাবে ৷তাই যা করার ভেবে চিন্তে কর ৷

আবরার কিছুক্ষন ভেবে তারপর বলল ঠিক আছে আমি এই মেয়েকে বিয়ে করবো ৷

আবরার কথা শেষ হতেই সবাই কাজী আনতে গেল ৷অবশেষে আবরার আর রাইয়ের পনেরো লাখ টাকা দেনমোহরে বিয়ে হলো ৷

রাইকে ওর মামা আর ঘরে তোলে নি ৷শেষ বিদায়ে নিজের কলিজার টুকরার দিকে ফিরেও তাকায় নি ৷

গাড়ী চলছে আপন গতিতে আবরার রাইকে নিয়ে নিজের বাড়ীর দিকে রওনা দিয়েছে ৷গাড়ীতে কেউ কারো সাথে কোনো কথা বলে নি ৷তবে আবরার ফোনে কারো সাথে কথা বলেছে ৷আবরার রাইকে নিয়ে বাড়ীতে ঢুকলো ৷গাড়ী ভেতরে যেতেই আবরার গাড়ী থেকে নেমে গেল ৷কিন্তু রাইকে বের হতে বলে নি ৷রাই চুপচাপ গাড়ীতেই বসে আছে ৷হঠাৎ কেউ একজন গাড়ীর দরজা খুলে দিল ৷রাই সেই দিকে তাকিয়ে দেখলো একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে ৷বয়সের দিক থেকে রাইয়ের চেয়ে বড়ই হবে মেয়েটা ৷মেয়েটা কোমল গলায় বলল

আমার নাম মিশকা ৷সম্পর্কে তোমার ননদ হই আমি ৷ কি হলো নেমে এসো ৷বাড়ীর মধ্যে সবাই অপেক্ষা করছে তোমার জন্য ৷

রাই মাথা নিচু করে বেড়িয়ে এলো ৷রাইকে বাড়ীর ভেতর মিশকা নিয়ে গেল ৷রাই বাড়ীর ভেতরে যেতেই এক ভদ্র মহিলা বলে উঠলো

এই গাইয়া ভুতটাকে কেন বাড়ীর ভেতরে নিয়ে এলি মিশকা ৷অসভ্য মেয়ে কোথাকার ৷আমাদের ছেলেকে ফাসিঁয়ে বিয়ে করেনিলি ৷বড় লোক দেখলেই মাথা খারাপ হয়ে যায় না ৷রাই ছলছল চোখে তাকিয়ে রইল মহিলাটার দিকে ৷

মিশকা এবার বলল প্লিজ ফুপি চুপ করো ৷কারো ব্যাপারে না যেনে কখনো কথা বলতে নেই ৷এতে পাপ হয় যানো না ৷

এই মিশকা তুই আমাকে জ্ঞান দিস না ৷

হঠাৎ একটা কঠিন কন্ঠস্বর রাইয়ের কানে আসতেই রাই চমকে উঠলো ৷

মিশকা এইটা বুঝি আমাদের আবরার বউ ৷

হ্যা মা মিশকা বলল ৷মহিলাটি রাইয়ের কাছে এসে দাড়ালো ৷নিজের হাত থেকে দুটো বালা খুলে রাইকে পড়িয়ে দিয়ে বলল সুখী হও ৷এবার আবরার ফুপু বলল

এটা কি করছো আনিলা ৷নিজের ঘরে কাল সাপকে ঠাই দিচ্ছো তুমি ৷

আমার ছেলে বিয়ে করে এনেছে ৷শ্বাশুড়ি হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব পালন করলাম ৷এখন এই মেয়ে কি করবে তা তার ব্যাপার ৷

রাই যখন বুঝতে পারলো বালা পড়িয়ে দেওয়া এই কঠিন গলার মানুষটি তার শ্বাশুড়ি ৷ তখন সে মাথা নুয়িয়ে আনিলা বেগমকে সালাম করতে গেল ৷

রাইয়ের হাত আনিলা বেগমের পা ছোয়ার আগেই তিনি রাইয়ের হাত ধরে ফেললেন ৷অতঃপর বললেন ছেলের বউরা মেয়ের মতো হয় ৷তুমি মিশকার থেকে কোনো অংশে কম নও আমার কাছে ৷আর কখনো আমার পা ছোয়ার মতো অপরাধ যেন না হয় ৷আমাকে নিজের মা মনে করবে সব সময় ৷কথা গুলো বলে আনিলা বেগম চলে গেল ৷

এতক্ষন সামনে দাড়িয়ে থাকা শ্বাশুড়ী নামক মানুষটা যে স্বচ্ছ মনের মানুষ তা রাই বুঝলো ৷তার কথা কঠিন স্বরে বললেও মনটা একেবারে নরম ৷

মিশকা রাইকে আবরার ঘরে নিয়ে গেল ৷

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here