শ্রাবন_আধারে_তুমি,০৯,১০,১১

0
663

#শ্রাবন_আধারে_তুমি,০৯,১০,১১
লেখিকা : আফরিন ইসলাম
পার্ট :৯

তিনমাস পার হয়ে গেছে ৷

আবরার এখন আগের থেকে সুস্থ ৷আবরার হাতে একটু ব্যাথা আছে ৷এখন নিজের কাজ নিজেই করতে পারে ৷ আবরার পা এখন অনেকটাই ভালো হয়ে গেছে ৷কিন্তু লাঠিতে ভর দিয়ে হাটতে হয় ৷আজ রাই আবরারকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে ৷ডাক্তার বলেছে আবরার আর একমাসের মধ্যে একেবারে সুস্থ হয়ে যাবে ৷রাইয়ের সেবার জন্য যে আবরার এত সুস্থ তা ডাক্তারও বলেছে ৷ যদিও আবরার এর বিপরীতে কিছু বলেনি ৷

রাই গাড়ীর জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে ৷ রাইয়ের মনটা খুব একটা ভালো না ৷ ড্রাইভার গাড়ী চালাচ্ছে ৷ আবরার ফোনে কথা বলছে আর রাইয়ের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে ৷আবরার কথা বলা শেষ করলো ৷কিন্তু রাই কোনো কথা বলছে না ৷ আবরার এবার নিরবতা ভেঙ্গে বলল

তোমার না দুই দিন ধরে জ্বর ছিল ৷ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ কি খেয়েছো ৷

রাই আবরার দিকে না তাকিয়ে জবাব দিল হুমম খেয়েছি ৷

আজকাল খুব একটা কথা বলো না তুমি ৷তোমার কি কিছু হয়েছে রাই ৷

রাই একবার ঘাড় ঘুড়িয়ে আবরার দিকে তাকালো ৷তারপর বলল আমার আকাশে মেঘ জমেছে আবরার ৷সেই মেঘ বৃষ্টি হয়ে রূপ নেবে যে কোনো সময় ৷আর আমি ভেসে যাব কোনো এক না ফেরার দেশে ৷আমার মন কিভাবে ভালো থাকবে বলুন তো ৷

তোমার কথার কিছুই বুঝতে পারছি না ৷

থাক বুঝতে হবে না ৷কিছু কথা না হয় অজান্তেই রয়ে যাক ৷কিছু কথা না হয় একান্তই আমার হয়ে থাক ৷

আজকাল রাই কি বলে আবরার বুঝে ওঠে না ৷আবরার রাইকে বুঝতে চায় ৷কিন্তু কোথাও একটা বাধা পায় সে ৷আবরার চায় না অভিমানের দেয়াল পার করে রাইয়ের কাছে যেতে ৷

আবরার আর রাই বাড়ী ফিরে এসেছে ৷আফজাল খান ছেলের কাছে যেয়ে বলল ডাক্তার কি বলেছে আবরার ৷সব ঠিক আছে তো ৷

আবরার বলল হ্যা বাবা সব ঠিক আছে ৷আর একমাস পরে আমি একেবারে ঠিক হয়ে যাব ৷ যদি ঠিক মতো নিয়ম অনুযায়ী চলি ৷

আনিলা বেগম রাইয়ের কাছে আসলেন ৷রাইয়ের কপালে চুমু দিয়ে তিনি বললেন

আমার মেয়ের জন্য আজ তুই সুস্থ ৷আমার মেয়েটা রাত দিন এক করে সেবা করেছে ৷এমন সোনার টুকরো মেয়ে যার ঘরে আছে ৷তার সংসারে কি কিছু হতে পারে ৷ আল্লাহ নিজের হাতে এমন হিরার টুকরা আমার কাছে দিয়েছে ৷

আবরার ফুপু কটাক্ষ করে বলল আনিলা এতটাও প্রশংসা কর না এই মেয়ের ৷এই মেয়ে সংসারের অলক্ষী ৷দেখলে না আবরার আসতে না আসতেই দূর্ঘটনা ঘটলো ৷ঘরে কাল সাপ রাখছো তুমি ৷

আবরার বেশ বিরক্ত হয়ে বলল উফফ ফুপু বাজে কথা বলো না তো ৷এই সব কথা শুনতে একদম ভালো লাগে না আমার ৷রাই আমি ঘরে যাব ৷আমার হাতটা ধরো একটু ৷

রাই আবরারকে ধরে ঘরে নিয়ে গেল ৷তারপর আবরারকে ফ্রেশ হতে সাহায্য করলো ৷আবরার চুল নিজের হাতে মুছে দিল রাই ৷তারপর আবরারকে টিশার্ট পড়িয়ে দিল আর চুল আচড়ে দিল ৷আবরারকে ফ্রেশ করে দিয়ে রাই নিজেও ফ্রেশ হয়ে আসলো ৷

রাই ডিভানে দাড়িয়ে চুল মুছে নিল ৷আর আবরার জানালা দিয়ে রাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে ৷মেয়েটা দিন দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে ৷খুব একটা কথা বলে না ৷মাঝে মাঝে একা কিছু একটা ভাবে ৷অনেক সময় আবরার ডাক দিলে কেপেঁ ওঠে ৷রাইয়ের চোখ হঠাৎ জানালার দিকে পড়তেই দেখলো আবরার তার দিকে তাকিয়ে আছে ৷আবরার নিজের চোখ ফিরিয়ে নিল ৷

দুপুর দুইটা বাজে রাই খাবার ঘরে নিয়ে এসেছে ৷রাই আবরার খাবার দিল ৷আজকাল নিজের হাতে খেতে একদম ভালো লাগে না আবরার ৷এতদিন রাই খাইয়ে দিত ৷মেয়েটা খুব সুন্দর করে তাকে খাইয়ে দিত ৷মাঝে মাঝে রাইয়ের হাত তার ঠোট স্পর্শ করলে সে কেপেঁ উঠতো ৷কয়েকবার ইচ্ছে করে রাইয়ে হাতে কামড় দিয়েছে আবরার ৷কিন্তু রাই কিছু বলে নি তাকে ৷ মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে জালাতে ভালোই লাগে তার ৷কিন্তু এখন নিজের হাতেই তাকে খেতে ৷রাই আর খাইয়ে দেয় না ৷আবরার খাচ্ছে না তাই রাই বলল

কি হলো আপনি খাবেন না ৷

আবরার আড় চোখে একবার রাইয়ের দিকে তাকিয়ে জবাব দিল ৷আমার খেতে ইচ্ছে করছে না ৷

আপনার তো ঔষুধ খেতে হবে ৷আপনি কি অন্য কিছু খাবেন রাই বলল ৷

আবরার আস্তে করে বলল তুমি খাইয়ে দাও ৷নিজের হাতে খেতে ইচ্ছে করছে না ৷

রাই হাসলো ৷আবরার প্লেট নিজের হাতে নিয়ে নিল ৷কয়েক মাস আগেও যে রাইকে দেখতে পারতো না ৷সেই মানুষ এখন রাইয়ের হাতে খাওয়ার জন্য বাহানা করছে ৷কিন্তু আর কত দিন ৷রাই আবরারকে খাইয়ে দিচ্ছে নিজের মতো করে ৷আর আবরার খেয়েই যাচ্ছে ৷রাইকে চমকে দিয়ে আবরার হঠাৎ বলল

তোমার হাতটা অনেক নরম ৷কি দাও হাতে ৷

রাই আবরার দিকে তাকিয়েই আছে ৷কোনো কথা বলছে না ৷আবরার আবারো বলল

কি হলো কিছু বলছো না যে ৷

আপনি কি করে জানলেন আমার হাত নরম ৷আপনি তো কখনো আমার হাত ঐ ভাবে ধরেন নি ৷

আবরার রাইয়ের অনেকটা কাছেই চলে আসলো ৷তারপর আস্তে করে বলল ঐ হাতের একটু খানি স্পর্শই বলে দেয় তা কেমন ৷

রাই আবরার থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল ৷ তারপর আবার আবরারকে খাইয়ে দিতে লাগলো আর নিজেও খেয়ে নিল ৷আর আবরার সে তো রাইকে দেখেই চলেছে ৷যেই দেখার কোনো শেষ ৷যেই দেখা এক জীবনে শেষ হওয়ার নয় ৷

পাখিরা নিজেদের বাসায় ফিরে গেছে ৷সন্ধ্যা শেষ হয়ে রাতের গভীরতা বাড়ছে পাল্লা দিয়ে ৷মিশকা কথা বলছে নিজের একান্ত মানুষটার সাথে ৷

মিশকা বলল তোমার সাথে সেই কবে দেখা হয়েছে ৷সারাদিন শুধু কাজ আর কাজ ৷ভালো লাগে না আমার ৷তুমি কবে আসবে আমাদের বাসায় ৷

ওপাশ থেকে জবাব দিয়ে বলল আরে বাবা কাজের অনেক প্রেশার ৷চিন্তা করো না আমি দুই দিন পর যাব ৷ঘড়িতে দেখেছো কয়টা বাজে ৷এখন ঘুমিয়ে পড় তাড়াতাড়ি ৷

ঠিক আছে ৷বাই ৷

হুমম বাই ৷লাভ ইউ ৷

অপর দিকে রাই আবরারকে বিছানা করে শুইয়ে দিল ৷ আবরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল পরম যত্নে ৷রাইয়ের হাত নেশার মতো আবরার ওপর কাজ করে ৷হাত বুলিয়ে দিলে ঘুমিয়ে যায় সে ৷রাই যখন দেখলো আবরার ঘুমিয়ে গেছে ৷ তখন রাই আবরার খুব কাছে চলে গেল ৷রাই আবরার কপালে নিজে ঠোটেঁর স্পর্শ দিল ৷রাইয়ের চোখে পানি ৷ রাই আবরার মুখটা নিজের দুই হাতে বন্দি করে বলল

জানেন আবরার আপনার দূর্ঘটনা হওয়ার পর যতটা আমি কষ্ট পেয়েছি ৷ তার থেকেও বেশি খুশি হয়েছি ৷কেন খুশি হয়েছি জানেন আপনি ৷যখন দেখলাম জীবনের শেষ মুহূর্তে আমি আপনার এত কাছে তখন আল্লাহকে হাজার ধন্যবাদ দিয়েছি ৷আমি কি করে অন্য মেয়ে আপনার সেবায় রাখতাম বলুন তো ৷ এই যে আমি আপনার এত কাছে থাকতে পারি প্রতি মুহূর্তে ৷এই যে আমি আপনাকে ছুয়ে দিতে পারি ৷জীবনের শেষ সময় দাড়িয়ে এগুলো আমার কাছে আল্লাহর দেওয়া সেরা উপহার মনে হয় ৷আপনার কি মনে হয় আমি আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে এসেছি ৷একদম না ৷আমি আপনার এই চুলে হাত বুলাতে এসেছি ৷আপনাকে একদম কাছ থেকে দেখতে এসেছি ৷আচ্ছা আপনি কি ভুলে যাবেন আমায় ৷আমি যেই দিন থাকবো না ঐ দিন মনে করবেন আমাকে ৷ নাকি আপনিও ভুলে যাবেন সবার মতো ৷রাই আর কথা বলতে পারছে না ৷কান্না গুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে ৷

চলবে

#শ্রাবন_আধারে_তুমি
লেখিকা:আফরিন ইসলাম
পার্ট:১০

রাত দুইটা ছুই ছুই ৷আবরার হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেছে ৷মূলত আবরার খুব ঠান্ডা লাগছিল ৷আর এতেই তার ঘুম ভেঙ্গে গেছে ৷ আবরার চোখ খুলতেই সোফার দিকে তাকালো ৷কিন্তু সোফা খালি ৷ রাই তো ওখানেই ঘুমায় ৷রাইকে কয়েকবার আবরার ইশারা ইঙ্গিতে বিছানায় শুতে বলেছিল ৷কিন্তু রাই তার ইশারা বোঝে নি ৷আবরার আশে পাশে তাকালো কিন্তু রাইকে দেখতে পেল না ৷ ডিভানের দরজা খোলা তাই আবরার উঠে দাড়ালো ৷ তারপর লাঠিতে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে ডিভানের দিকে পা বাড়ালো ৷ডিভানের চারিদিকে তাকাতেই এক কোনে আবরার চোখ থমকে গেল ৷ একটু দূরেই এক নারী মুর্তি দাড়িয়ে আছে ৷দমকা হাওয়ায় তার খোলা চুল গুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে ৷ হ্যা একটু দূরে রাই দাড়িয়ে আছে ৷তার দৃষ্টি উপরের দিকে ৷আবরার নিশব্দে রাইয়ের পেছনে দাড়ালো ৷আবরার দাড়াতেই রাই বলে ওঠে ৷

এত রাতে না ঘুমিয়ে এখানে কি করছেন আপনি আবরার ৷

আবরার চমকে উঠলো ৷কারন সে এতটাই আস্তে হেটে রাইয়ের কাছে এসেছে যে কোনো শব্দই হয় নি ৷ রাই কিভাবে বুঝলো তার উপস্থিতি ৷ আবরার চিন্তার মাঝেই রাই আবারো বলল

কি ভাবে আপনার উপস্থিতি বুঝলাম তাই ভাবছেন তাই না ৷আপনার মনের কথাও আমি পড়তে পারি আবরার ৷আপনার চোখের ভাষাও আমি বুঝি ৷আপনার না বলা সকল কথা বুঝি ৷আর আপনার উপস্থিতি বুঝবো না ৷এটা কি করে হয় বলুন তো ৷ কিন্তু বিশ্বাস করুন তবুও আমার আর কিছু করার নেই ৷

তুমি সত্যিই কি আমার মনের কথা বুঝতে পারো আবরার বলল ৷

রাই হাসলো ৷আবরার রাইয়ের পাশে যেয়ে দাড়ালো ৷তারপর বলল

এত রাতে এখানে কি করছো তুমি ৷না ঘুমিয়ে এখানে কেন দাড়িয়ে আছো ৷

নিজের ভবিষ্যৎ বাসস্থানকে দেখছি খুব কাছ থেকে রাই বলল ৷

কি সব বলছো তুমি ৷ আমি কি বলছি আর তুমি কি বলছো ৷

রাই আঙ্গুলের ইশারা করলো বাগানের দিকে তারপর বলল

আবরার আপনাদের বাগানের ঐ রক্তজবার গাছটা দেখেছেন ৷ঐ জায়গাটা আমার বড্ড ভালো লাগে ৷কেন ভালো লাগে জানেন ৷আপনি যখন নিজের প্রেয়সীকে নিয়ে এখানে চন্দ্রবিলাস করবেন ৷ তখন আমি ওখান থেকে দেখবো ৷ সময় পেলেই যখন আপনি এখানে দাড়াবেন ৷ তখন আমি খুব সহজেই আপনাকে দেখবো ৷

আবরার রাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল মাথাটা কি গেছে ৷নাকি আরো বাকি আছে ৷কি সব উল্টা পাল্টা বলছো তখন থেকে ৷

রাইয়ের চোখে পানি চিকচিক করছে ৷রাই আবরার দিকে না তাকিয়ে বলল

আপনি তিনমাস আগে একটা কথা বলে ছিলেন মনে আছে ৷

কি বলে ছিলাম মনে নেই আবরার বলল ৷

আপনি বলে ছিলেন আমি কেন আপনার সেবা করছি ৷ আপনার সেবা করার বদলে আমার কি চাই তাই না ৷

ও হ্যা মনে পড়েছে ৷

আজকে যদি চাই তাহলে দেবেন আমি যা চাইবো ৷মানা করতে কিন্তু পারবেন না আপনি ৷যা চাইবো তাই দেবেন ৷

আবরার মনটা খারাপ হয়ে গেছে ৷রাই নিজের স্বার্থে তার সেবা করেছে ৷ আবরার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল হ্যা দেব ৷কি চাই তোমার বলো আমাকে ৷

কাল আপনার পছন্দ মতো একটা শাড়ী এনে দেবেন আমাকে ৷পছন্দ মতো চুড়ি এনে দেবেন ৷টকটকে লাল আলতা এনে দেবেন ৷তারপর নিজের হাতে কাল সাজিয়ে দেবেন ৷তারপর আমি যেখানে বলবো সেখানে নিয়ে যাবেন ৷আর আপনাকেও আমার পছন্দ মতো পোশাক পড়তে হবে কিন্তু ৷

আবরার ভেবে ছিল রাই হয়তো বাড়ী , গাড়ী কিছু চাইবে ৷কিন্তু এই মেয়ের মাথা মনে হয় গেছে ৷কি সব জিনিস চাইছে ৷আবরার ভাবনার মাঝেই রাই আবারো বলল

বাড়ী ,গাড়ী কেন চাইলাম না ৷তাই ভাবছেন তো ৷ ঐ সব বাড়ী ,গাড়ী আমার কাছে এখন মূল্যহীন ৷আমার কাছে সব ধরনের বিলাসিতা এখন মূল্যহীন ৷এগুলো দিয়ে এখন আর আমার কিছুই হবে না ৷ঘরে চলুন ঘুমাবেন ৷আর আমার বলা জিনিস গুলো কাল নিয়ে আসবেন ৷মনে করুন এগুলো আমার শেষ চাওয়া আপনার থেকে ৷তাই দয়া করে ভুলে যাবেন না ৷

পরের দিন সকাল বেলা ৷ সকাল দশটা বাজে রাই নিজের ঘর পরিষ্কার করছে ৷ আবরার গাড়ী নিয়ে কিছুক্ষন আগে বেড়িয়েছে ৷রাই কাজ করছিল ৷হঠাৎ পেছন থেকে মিশকা এসে জরিয়ে ধরলো ৷রাই পেছনে তাকিয়ে হেসে দিল ৷তারপর বলল

আজ বেশি খুশি খুশি লাগছে তোমাকে ৷কি হয়েছে ৷

মিশকা মাথা নিচু করে বলল ও নাকি খুব তাড়াতাড়ি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবে ৷

রাই খুশিতে মুখ চেপে ধরলো ৷তারপর বলল কবে আসবে ৷

কিছু দিনের মধ্যেই আসবে বলেছে ৷

তোমার ভাই তো এগুলোর কিছুই জানে না ৷তাকে কবে জানাবে ৷

সময় হলেই জানাবো ৷

হঠাৎ আনিলা বেগম রাইয়ের নাম ধরে ডাকতেই রাই বলল

আপু মা ডাকছে ৷আমি বরং মায়ের কাছে যাই ৷রাই দৌড়ে আনিলা বেগমের কাছে গেল ৷ রাইকে দেখে তিনি বললেন

সারাদিন কোথায় থাকিস হ্যা ৷সকালে তো কিছুই খাস নি ৷তাড়াতাড়ি খেয়ে নে ৷চোখের নিচে কালো দাগ পড়ছে খেয়াল করেছিস ৷দিন দিন চেহারার কি হাল করছিস ৷তাড়াতাড়ি খা ৷নইলে খাবি এক চড় ৷রাই আনিলা বেগমের গলা জরিয়ে ধরলো ৷তারপর বলল

রাগ কেন করছো মা ৷আমি তো তোমারই মেয়ে ৷আমার না খেতে ইচ্ছে করছে না ৷ রাইয়ের এমন কথায় আনিলা বেগম গরম চোখে তাকালেন ৷তারপর হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিল ৷খাবার বেড়ে নিজের হাতে রাইকে খাইয়ে দিল ৷রাইও আর না করতে পারলো না ৷এই দুনিয়াতে হয়তো মায়েদের ভালোবাসাই খাটি হয় ৷যেই ভালবাসা কখনো উপেক্ষা করা যায় ৷যে ভালবাসায় রাগ থাকলেও হাজার গুন বেশি মমতা থাকে ৷

আবরার বাড়ীতে এলো দুপুর বারোটার দিকে ৷ আবরার ঘরে এসে রাইকে পড়ার টেবিলে দেখলো ৷ রাই বই পড়ছে ৷আবরারকে দেখে রাই উঠে দাড়ালো ৷ তারপর আবরার কাছে গেল ৷আবরার হাত থেকে শপিং ব্যাগ গুলো নিয়ে নিল ৷আবরারকে সোফায় বসিয়ে রাই বাইরে চলে গেল ৷

রাই কিছুক্ষন পরে ঘরে এলো ৷ রাই নিজের হাতে এক গ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে এলো ৷রাইয়ের হাতে শরবত দেখে আবরার ঠোটেঁ হাসি ফুটলো ৷মেয়েটাকে তার কিছুই বলতে হয় না ৷ তার না বলা সব কিছু বুঝে ফেলে ৷শরীরটা অনেক ক্লান্ত লাগতে ছিল আবরার ৷ তাই রাই গ্লাস এগিয়ে দিতেই আবরার হাত বাড়ালো গ্লাসে দিকে ৷

আবরার ফ্রেশ হয়ে রুমে এলো ৷রাইকে শপিং করে আনা কোনো কিছু আবরার দেখতে দেয় নি ৷রাই এর জন্য কিছুক্ষন আগে রাগও করেছে ৷

চলবে….

#শ্রাবন_আধারে_তুমি
লেখিকা:আফরিন ইসলাম
পার্ট:১১

আয়নাতে আবরার রাইয়ের প্রতিবিম্ব দেখছে ৷ সোনালী পারের সাদা শাড়ী , দুই হাতে সাদা চুড়ি ,খোপা করা চুলে রজনীগন্ধার মালা ,মায়াবী চোখে গাঢ় কাজলের ছোয়ায় তার বিয়ে করা বউকে হুর পরীর মতো লাগছে ৷কোনো মেয়ে কি সত্যি এত সুন্দর হয় ৷ সত্যি বলতে ভালোবাসার মানুষ গুলো সর্বদাই সুন্দর ৷সাধারন জিনিসেও তারা প্রেমিকের দেখা শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হয়ে ওঠে ৷প্রেমিকার একটু স্পর্শ প্রেমিকদের মনে মাতাল হাওয়া সঞ্চারন করতে সক্ষম ৷তাই প্রেমিকাদের থেকে সাবধান ৷নয়তো যে কেউ ঘায়েল হতে পারেন প্রতি মুহূর্তে তাদের চোখের অতল গভীরে ৷

আবরার রাইকে নিয়ে বাড়ী থেকে বের হয়ে গেল দুপুরের একটু পরেই ৷বাড়ীর কেউ এই নিয়ে কোনো কথাই বলে নি ৷বিয়ের পর দুজনে এই প্রথম কোথাও যাচ্ছে ৷আবরার মা বাবাও বেশ খুশিই হয়েছে ৷

আবরার গাড়ি চালাচ্ছে ৷খোলা জানালা দিয়ে বাতাস গাড়ীতে প্রবেশ করছে ৷ চারিদিকে বসন্তে ছোয়া লেগেছে ৷ প্রকৃতি নিজের মতো সেজে উঠছে ৷ রাই বার বার তার জীবনের বসন্তকে দেখে চলেছে ৷আবরার রাইয়ের জীবনে বসন্তের মতো ৷যাকে ছোয়া যায় না চাইলেই ৷ কিন্তু তার আগমনে জীবন সেজে ওঠে প্রকৃতির মতোই ৷আবরার দিকে একবার তাকালো রাই ৷তারপর মুখ ঘুড়িয়ে নিল ৷জানালার কাছে মুখ নিয়ে চোখ বন্ধ করে দিল রাই ৷প্রকৃতিকে খুব সুন্দর করে উপভোগ করছে রাই ৷ বাতাসের মাঝে অক্সিজেনের অভাব নেই ৷কিন্তু এখানে তার জন্য সামান্যই আছে ৷হঠাৎ একদিন তার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে ৷ চাইলেই আর প্রকৃতিকে উপভোগ করা যাবে না ৷চাইলেই আর নিজেকে নানা রং এ রাঙ্গিয়ে তোলা যাবে না ৷নিঃশ্বাস বন্ধ হলে ঐ সাদা কাপড়টাই সবাই পড়িয়ে দেবে ৷মুসলিম হলে মাটির ঘরে রেখে আসবে প্রিয়জনেরা ৷আর হিন্দু হলে আম কাঠের চিতায় দাহ করা হবে ৷ আর খ্রিষ্টান হলে কফিনে করে মাটি চাপা দেবে ৷জীবনটা বড়ই অদ্ভুত ৷ যেখানে সেকেন্ডের ভরসা নেই ৷অথচ আমরা সবাই আজ রূপ , টাকা,পয়সার মোহে পড়ে আছি ৷দুনিয়ার চাকচিক্য দেখে ভুলেই গেছি যে একদিন ওপারে চলে যেতে হবে ৷একদিন সবাইকে ছেড়ে আপন ঠিকানায় চলে যেতে হবে ৷হয়তো দুই দিন আগে নয়তো দুই দিন পরে ৷

গাড়ী থেমে গেছে ৷রাইয়ের বলা মতো তুরাগ নদীর পাড়েই আবরার গাড়ী থামিয়েছে ৷ নদীর পাড়ে গাঢ় সবুজ ঘাস ৷নদীর পানির কলকল আওয়াজ আসছে ৷নদীর পাড়েই একটা শুকনা গাছ ৷গাছটার একটা ডালে দুইটা চড়ূই পাখি বসে আছে ৷ রাই সেই দিকে তাকিয়ে হাসলো ৷ রাই নিজের পায়ের জুতো খুলে ফেলল ৷আবরার রাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল

জুতো কেন খুললে তুমি ৷

রাই বলল এই কোমল ঘাসে একবার নিজের পা ছুইয়ে দেখুন ৷দেখবেন একরাশ সিদ্ধতা আপনার মনকে ছুইয়ে দেবে ৷

আবরার নিজের পায়ের জুতো খুলে ফেলল ৷তারপর রাইয়ের একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নিল ৷কোমল ঘাসে একটা একটা পা ফেলে চলতে লাগলো ৷বাতাস এসে রাইয়ের আচঁল উড়িয়ে নিতে চায় ৷আবরার ঘন চুল গুলো এলোমেলো হয়ে গেছে ৷পাঞ্জাবীর হাতা গুটিয়ে নিয়েছে আবরার ৷ হঠাৎ রাই আবরার হাত ছেড়ে দিল ৷তারপর একটু সামনে হেটে গেল ৷রাই কিছু বন্য ফুল তুলে নিল ৷আবরার রাইকে দেখেই চলেছে ৷মেয়েটা কখন কি করে আবরার বুঝতেই পারে না ৷ আবরার যেই পাঞ্জাবীটা পরে আছে সেটাও রাইয়ের দেওয়া ৷ আবরার দেখলো রাই তার দিকে আসছে ৷রাই আবরার কাছে এসে দাড়ালো ৷তারপর একমুঠো বন্য ফুল আবরারকে দিয়ে বলল

আপনার জন্য এগুলো ৷এর দাম হয়তো খুবই কম ৷কিন্তু বিশ্বাস করুন এর সৌন্দর্য এতটাই প্রখর যে কবিও ভাষা হারিয়ে ফেলবে ৷

আবরার ফুল গুলো হাতে নিল ৷তারপর একটা গভীর শ্বাস নিয়ে তার গ্রান নিল ৷

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে ৷সূর্য বিদায় নেবে ৷নদীর স্বচ্ছ পানিতে পা দুলিয়ে বসে আছে আবরার আর রাই ৷রাই আবরার কাধে মাথা দিয়ে রেখেছে ৷দুজনেই গোধূলী বেলা দেখছে ৷সূর্য ডুবে যাচ্ছে ৷কিন্তু তার কিরন প্রেমিক আর প্রেমিকার মনে ভালবাসার এক সুন্দর সন্ধ্যি তৈরি করছে ৷আবরার রাইয়ের দিকে তাকালো ৷রাইয়ের মুখটা বড্ড মায়াবী লাগছে তার কাছে ৷রাই নিজেও চোখ তুলে আবরার দিকে তাকালো ৷তারপর বলল

এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন ৷

আবরার হাসলো ৷তারপর মাথা নেড়ে বলল কিছু না ৷

রাই মুচকি হেসে বলল সময়টা সুন্দর না ৷

হুমমম ৷এভাবে সারা জীবনও থাকা যায় ৷

রাই কবি কন্ঠে বলতে লাগলো

সময় থামিয়া যাক
প্রকৃতি শান্ত থাক
তোমার আমার প্রেম গাথা
এমনই রহিয়া যাক

জানি তাহা শুধুই স্বপন আমার
মিথ্যা মোহের সঙ্গে তুমি
থাকিবে আর কতদিন
দুদিন পরেই ছুটি নেব
জীবন সংসারের আমি

কিছুটা সময় তোমার আমার
এটাই যেন অনেক
তবুও বলিব সময় পেলে
আবার আসিব ফিরে

রাই থেমে গেল ৷আবরার ঘাড় ঘুড়িয়ে রাইয়ের দিকে তাকালো ৷তারপর বলল বেশ ভালো কবিটা বলো তুমি ৷ কিন্তু কয়েকটা লাইনের পরে আর বুঝতে পারি নি ৷না মানে অর্থ যেটা আসে তার সাথে তো তোমার কোনো সম্পর্ক নেই ৷

রাই হাসলো ৷তারপর বলল সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে ৷এবার উঠুন ৷বাড়ী যেতে হবে ৷আবরার আর রাই উঠে দাড়ালো ৷তারপর আবারো হাতে জুতো নিয়ে হাটা দিল ৷

আবরার কিছুদূর যেয়ে থেমে গেল ৷আবরারকে থাকতে দেখে রাই বলল কি হলো থামলেন যে ৷চলুন ৷

রাইয়ের কথায় আবরার পাত্তা দিল না ৷নরম ঘাসের ওপর শুয়ে পড়লো ৷আবরার নিজের মাথার নিচে একটা হাত দিল ৷আরেকটা হাত ঘাসের ওপর রেখে বলল

শুয়ে পড় রাই ৷

রাই কথা বাড়ালো না ৷জীবনের শেষ সময়ে যদি ভালবাসার মানুষের একটু কাছে থাকা যায় তাহলে ক্ষতি কি ৷রাই আবরার হাতে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো ৷রাইয়ের খোপার ফুলের ঘ্রান আর নিরব পরিবেশ আবরার সহ্য করতে পারছে না ৷ নিষিদ্ধ চাহিদা হানা দিচ্ছে প্রেমিক হৃদয়ে ৷আবরার আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো ৷রাই আবরার দৃষ্টি অনুসরন করে বলল কি দেখছেন আপনি ৷

হাজার তারার ভিড়ে একটা উজ্জল তারার খোজঁ করছি ৷কিন্তু পাচ্ছি না ৷

রাই মলিন কন্ঠে জবাব দিল ৷

যেই ক্ষনে আমার আখি বন্ধ হবে
সেই নিশিতে আকাশে তাকিও
হাজার তারার ভিড়ে
তোমার তারাটা খুজে নিও
যেই তারাটা তোমার জন্য হাসিবে
তাহারে দেখিয়া তুমি কাদিবে

আবরার রাইয়ের অপরে আধশোয়া হয়ে বলল এত কঠিন করে কেন কথা বলো ৷সোজা করে বলতে পারো না ৷

রাই বলল এবার বাড়ী চলুন মশাই ৷

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here