#শ্রাবন_আধারে_তুমি,১৫,১৬,১৭
লেখিকা:আফরিন ইসলাম
পার্ট:১৫
রাই কোনো রকম দৌড়ে গেটের কাছে আসার আগেই আবরার গেট লাগিয়ে দিল ৷রাই লোহার গেটে একের পর এক আঘাত করতে লাগলো ৷রাই কাদঁতে কাদঁতে বলল
আবরার একটু দয়া করুন আমার উপর ৷আপনি দয়া করে এমন করবেন না ৷আমাকে আর কয়েকটা দিন এখানে থাকতে দিন ৷তারপর এমনিতেই সব জানতে পারবেন ৷আমার মুখ থেকে আর কোনো কিছু শুনতে হবে না আপনাকে ৷একটু দয়া করুন আবরার ৷আবরার দরজা খুলুন ৷
আবরার গেট খুলল না ৷ গেটের এপাশে দাড়িয়ে রইলো ৷হাতের তালু দিয়ে চোখের পানি মুছে নিল ৷তারপর হাটা দিল বাড়ির দিকে ৷কারো সাথে কোনো কথা না বলে নিজের ঘরে চলে গেল আবরার ৷তারপর ঘরের দরজা আটকে দিল ৷
অপর দিকে রাই আবরার কে ডেকেই চলেছে ৷আবরার নিজের জানালার পর্দা সামান্য ফাকা করলো ৷আবরার জানালা থেকে গেট স্পষ্ট দেখা যায় ৷রাই যে গেটে হাত দিয়ে আঘাত করছে তা দেখতে পারছে আবরার ৷না আবরার গলবে না কোনো মতেই এই ছলনার মায়ায় ৷ অনেক ছাড় দিয়েছে কিন্তু আর না ৷
অন্যদিকে রাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে গেটে আঘাত করতে করতে ৷চিৎকার করে ডাকতেও কষ্ট হচ্ছে ৷কান্না করার কারনে মাথা ব্যাথা করছে ৷রাই কাদতে কাদঁতে বসে পড়লো ৷
হে আল্লাহ তুমি কি দেখ না ৷ এতই যদি কষ্ট দেবে তাহলে কেন এই জীবন আমাকে দিয়েছো ৷এভাবে আস্তে আস্তে না মেরে একেবারে নিয়ে যাও ৷ তিলে তিলে আর মরতে পারছি না ৷না কাউকে বলতে পারছি আর না কাউকে নিয়ে বাচঁতে পারছি ৷ আমি আর পারছি না ৷আমাকে তুমি মুক্তি দাও খোদা ৷ রাই হাউমাউ করে কাদঁতে লাগলো ৷
অপর দিকে সাদি আবরার বাড়ীর দিকে যাচ্ছে ৷রাই ভুল করে ওর মেডিকেলের কাগজ গুলোই নেয় নি ৷ সাদি ঐ গুলো দিতেই আবার আসছে ৷কিছু দুর যেতেই কাগজ গুলো সাদির চোখে পড়ে ৷সাদির গাড়ী আবরার বাড়ীর কাছেই অনেকটা চলে এসেছে ৷ সাদি দূর থেকেই রাইকে গেটের কাছে এলোমেলো ভাবে বসে থাকতে দেখে চমকে গেল ৷গাড়ী চালিয়ে গেটের কাছে আসতেই সে সত্যিই চমকে গেল ৷রাই এই ভাবে কেন কাদঁছে তা সাদি বুঝলো না ৷ দ্রুত গাড়ী থেকে নেমে আসলো ৷
আবরার জানালা দিয়ে সবই দেখছে ৷এতক্ষন চোখ থেকে নোনা জল বের হলেও এখন তার রং বদলে গেছে ৷আবরার শরীর কাপঁছে রাগে ৷ সাদিকে এখনই মাটিতে পুতে ফেলতে ইচ্ছে করছে ৷
সাদি দৌড়ে রাইয়ের কাছে এসে বলল রাই বোন তোর কি হয়েছে ৷এভাবে কাদঁছিস কেন এখানে ৷বাড়ীর সবাই কোথায় ৷
রাই শুধু কেদেঁই যাচ্ছে ৷ কোনো কথা বলছে না ৷
সাদি বলল ঠিক আছে আমি ভেতরে যাচ্ছি ৷ আমি ভেতরে যেয়ে কথা বলছি ৷
রাই সাদির হাত ধরে আটকালো তারপর বলল ওখানে যেয়ে লাভ নেই ভাইয়া ৷
কেন কি হয়েছে ৷ আর হাতেই এই অবস্থা কেন রাই ৷ হাত ফেটে রক্ত বের হচ্ছে ৷কিভাবে হলো এমন ৷কেউ কিছু বলছে ৷আমাকে বল তাড়াতাড়ি কি হয়েছে ৷
রাই কাদঁতে কাদঁতে সব বলল সাদিকে ৷
সাদির শরীর এখন রাগে কাপঁছে ৷সাদি বাড়ীর ভেতরে ডুকবে বলে পা বাড়াতে রাই বলল
আমাকে জীবনের শেষ কয়েকটা দিন তোমার বাড়ীতে থাকতে দেবে সাদি ভাই ৷তুমি যেখানে থাকতে বলবে আমি সেখানেই থাকবো ৷তোমার বাড়ীর সব কাজ করে দেব আমি ৷ প্লিজ সাদি ভাই শুধু দু বেলা খেতে দিলেই হবে ৷তুমি আমাকে সবার মতো ছুড়ে ফেলনা ৷ একটু দয়া করো আমার ওপর ৷
সাদি নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলো না ৷রাইকে জরিয়ে ধরলো ৷তারপর নিজেও কেদেঁ দিল শব্দ করে ৷ এই রকম একটা মেয়ে কেউ কিভাবে কষ্ট দিতে পারে তা সাদি বুঝে উঠতে পারে না ৷
সাদি কাদঁতে কাদঁতে বলল আমি যত দিন বেচেঁ আছি তত দিন তোর কোনো চিন্তা নেই ৷আমি তোর চিকিৎসা করাবো ৷তোর কিছু হবে না ৷এখানে আর এক মুহূর্ত না ৷চল আমার সাথে ৷সাদি রাইকে গাড়ীতে বসিয়ে দিল ৷
অন্য দিকে সাদিকে দেখে আবরার খুব রাগ হলেও যখন দেখল সাদি রাইকে জরিয়ে ধরেছে ৷তখন তার রাগ পাহাড় সমান কষ্টে রূপ নিল ৷চোখ বেয়ে আবারো নোনাজল গড়িয়ে পড়ল ৷বাইরের রূপ সবাই দেখলেও ভেতরের কষ্ট কেউ দেখে না ৷
আনিলা বেগম আর মিশকাও এই দৃশ্য দেখেছে ৷ সাদি যে রাই কে জরিয়ে ধরেছে ৷আর রাই যে সাদির হাত ধরেছে ৷আবরার ফুপু আনিলা বেগমের কাছে এসে বলল
দেখলে তো আনিলা কি থেকে কি হয়ে গেল ৷আগে কতবার সাবধান করেছি ৷কিন্তু তুমি আমার কোনো কথাই কানে নিলে না ৷ মিশকার দিকে তাকিয়ে বলল দেখলি তো মিশকা তলে তলে রাইয়ের সাথে কত কি করছে সাদি ৷আহারে তোরা কিছু বুঝতেও পারলি না ৷মিশকা নিজেকে আর আটকাতে না পেরে নিজের ঘরের দিকে দৌড়ে গেল ৷আনিলা বেগম মিশকার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল ৷মিশকা যে সাদিকে পছন্দ করে এটা সে ভালো করেই বুঝতে পারে ৷কিন্তু তারা যে একে ওপর কে ভালোবাসে তা জানে না ৷
রাত গভীর হচ্ছে ৷ঘড়ির কাটায় দুইটা বাজে ৷ আবরার ঘরের ফ্লোরে শুয়ে আছে ৷সারা ঘর জুড়ে সিগারেটের গন্ধ ৷মদের বোতল গুলো মেঝেতে পড়ে আছে ৷ রাইয়ের একটা ছবি সামনে নিয়ে আবরার বলল
তুমি আমাকে এত দিন দয়া করেছো তাই না ৷ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে সবাইকে ধোকা দিতে পারলেও আমাকে পারবেন না ৷কি ভেবেছো বিদেশে বসে তোমার কোনো খোজঁ আমি নেই নি ৷তোমার সব খোজ আমি ফুপুর কাছ থেকে নিয়েছি ৷আমি তো তোমাকে প্রথম দেখেই ভালোবেসে ছিলাম ৷কিন্তু তুমি আমায় বুঝলে না ৷তুমি জানো আমি কেন বিদেশে গিয়ে ছিলাম ৷তুমি তখন অনেক ছোট ছিলে রাই ৷তাই আলগা রাগ দেখিয়ে চলে গিয়ে ছিলাম ৷জানো ওখানে তোমাকে ছাড়া থাকতে খুব কষ্ট হতো ৷আর ফুপু যখন তোমার আর সাদির ক্লোজ ছবি গুলো পাঠাতো তখন হৃদয়টা বারবার ভেঙ্গে যেত আমার ৷তুমি বুঝ নি রাই ৷তোমাকে সংসার নামক বেড়া জালে আটাতে চাই নি আমি ৷তোমাকে চিন্তে চেয়ে ছিলাম আস্তে আস্তে ৷ জানতে চেয়ে ছিলাম আমি ৷ সংসার মানেই তো আর এক বিছানায় শোয়া না ৷সংসার মানে ভালোবাসা ৷যেখানে হৃদয়ের বন্ধন থাকবে ৷ কিন্তু তুমি তো মুখোশের আড়ালে থাকা এক নারি ৷ তাই আমি বুঝাতে পারি নি তোমাকে ৷
ওপর দিকে মিশকা সাদিকে ভুল বুঝে যা নয় তাই মেসেজে লিখে দিয়েছে ৷তারপর সব জায়গা থেকে ব্লক করে দিল ৷অপর দিকে সাদি মিশকার সাথে যোগাযোগ করতে যেয়েও বারবার ব্যর্থ হলো ৷
রাইয়ের গা কাপিঁয়ে জ্বর এসেছে ৷সাদির মা বাবা অনেক ভালো ৷সাদির মা রাইকে ধরে কেদেঁই দিয়ে ছিল সব শুনে ৷ রাইকে ভালো একটা ঘরে থাকতে দিয়েছে ৷আনিলা বেগম যেমন রাইকে খাইয়ে দিত ৷ঠিক তেমনি সাদির মা রাইকে খাইয়ে দিয়ে গেছে ৷রাত বারোটার দিকে রাইয়ের জ্বর এসেছে ৷রাই মাথার ব্যাথায় ছটফট করছে ৷এত রাতে কাউকে বিরক্ত করতে সে চায় না ৷রাই খুব কষ্টে বিছানা থেকে উঠে বসলো ৷ তারপর দেয়াল ধরে কোনো রকম ওয়াসরুমে গেল ৷বেসিন থেকে পানি নিয়ে মাথায় দিতে লাগলো ৷রাই হাপাচ্ছে ৷রাই নিজের নাকে ও কানে আবারো প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলো ৷রাই আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখলো আবারো সেই রক্ত আসছে ৷গলগল করে রক্ত আসছে ৷ রাই নিজের মাথা চেপে ধরলো আর পারছে না সে ৷রাইয়ের হঠাৎ কেন জানি মনে হলো তার চুল গুলো গোড়া থেকে উঠে গেছে তার হাতের চাপে ৷রাই নিজের একটা হাত সামনে আনতেই চমকে গেল ৷রাইয়ের হাতে তার আস্ত চুলের গোছা ৷রাই হাত দিয়ে নিজের চুল গুলো আবারো আলগা করে টান দিল ৷দেখতে পেল তার রেশমি চুল গুলো উঠে আসছে ৷চোখ দুটো জলে ভরে এলো তার ৷তার প্রিয় কোনো জিনিস তার কাছে কেন যেন থাকতে চায় না ৷রাই শুধু তাকিয়ে রইলো নিজের প্রতিবিম্বর দিকে ৷কতটা অসহায় সে ৷নিজের প্রতিবিম্বটা যেন তাকে দেখে হাসছে ৷ এটা এক ভয়ংকর হাসি ৷রাইয়ের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো ৷দুর্বল শরীরটা ঢলে পড়লো ওয়াসরুমের চকচকে মেঝেতে ৷কিছুক্ষনের মধ্যেই মুখ থেকে গলগল করে বেড়িয়ে এলো রক্ত স্রোত ৷ ঝাপসা চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এলো ৷
চলবে…..
#শ্রাবন_আধারে_তুমি
লেখিকা:আফরিন ইসলাম
পার্ট :১৬
রাতের অন্ধকার কেটে গেছে ৷চারিদিকে আলো ফুটে উঠছে ৷অন্ধকার রাতকে বিদায় জানিয়ে আবারো দিনের আগমন ৷কিন্তু সবার জীবনে আলোর দেখা মিলে না ৷যেখানে কেবল অন্ধকারের রাজ্যত্ব ৷
রাইয়ের ঘরের দরজায় ক্রমাগত ধাক্কা দিচ্ছে সাদি ৷একটু আগে একজন সার্ভেন্ট রাইকে ডাকতে এসে ছিল ৷রাইয়ের ব্যাপারে বাড়ীর সবাই জানে ৷রাই যখন অনেক ডাকার পরেও আর সাড়া দিল না ৷তখন সার্ভেন্ট সবাইকে ডেকে নিয়ে আসে ৷পনেরো মিনিট যাবত সাদি দরজায় ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে ৷ গলা ফাটিয়ে রাইকে সবাই ডেকে যাচ্ছে ৷কিন্তু দরজার ওপারে থাকা মানুষটা আজ বড্ড অসহায় ৷ভাইয়ের মতো মানুষটার চিৎকার কানে ভেসে গেলেও কিছু তার করার নেই ৷ উপর ওয়ালা তার সব শক্তি কেড়ে নিয়েছে ৷তবুও নিজের চোখ জোড়া খুলে রাখা চেষ্টা সে করেই চলেছে ৷
সাদি চিৎকার করে ডাকলো ৷ রাই দরজা খোল ৷এমন করিস না ৷ তোর কোনো ভয় নেই ৷ভাই দরজা ভেঙ্গে তোকে বের করবে ৷ভয় পাস না কেমন ৷ সাদির মা চোখের পানি মুছে নিলেন ৷এর মধ্যে দরজার লক কাটার লোকেরা চলে এসেছে ৷তারা নিজেদের কাজ শুরু করে দিল সাথে সাথে ৷দরজার লক কাটতে খুব একটা সমস্যা হলো না ৷মিনিট দুইয়ের মধ্যেই দরজার লক খুলে গেল ৷ দরজার লক খুলতেই সাদি দৌড়ে ঘরে গেল ৷ রাইকে ঘরে না পেয়ে বারান্দায় ছুটে গেল সাদি ৷কিন্তু সেখানেও রাইকে পেল ৷
হঠাৎ সাদি নিজের মায়ের চিৎকার শুনতে পেল ৷সে রাইয়ের নাম ধরে চিৎকার করছে ৷দৌড়ে ওয়াসরুমের মধ্যে যেতেই এক ভয়ংকর দৃশ্য সাদি দেখতে পেল ৷ তার চোখের সামনেই রাই নামের সহজ সরল মেয়েটা পরে আছে ৷যার মাথায় চুল নেই ৷যেই চুল কিনা মেয়েদের সৌন্দর্যের অংশ ৷ চুল গুলো ওয়াশরুমের মেঝেতে পরে আছে ৷ যে মুখটা আগে খুশিতে লাল হয়ে যেত ৷ যেই মুখটা আগে লজ্জা পেলে লাল হয়ে যেত ৷সেই মুখটা আজ লাল রঙ্গে রঞ্জিত ৷ মায়াবী চোখ জোড়া আজ গর্তে প্রবেশ করেছে ৷চেহারার সৌন্দর্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে ৷ ঠোটঁ শুষ্ক হয়ে গেছে ৷রাইয়ের নিথর দেহটা পরে আছে ফ্লোরে ৷এই দৃশ্য কি সত্যি সহ্য করা যায় ৷ সাদি তা জানে না ৷ এর জন্যই হয় তো সাহিত্যিকরা বলেন
করো চোখের প্রেমে পরতে নেই
অন্ধ হয়ে গেলে ভালোবাসা ফুরিয়ে যাবে ৷
কারো চুলের প্রেমে পরতে নেই
ক্যান্সারে ঝড়ে যেতে পারে ৷
কারো রুপের প্রেমে পরতে নেই
আগুনে ঝলসে যেতে পারে ৷
কারো হাসির প্রেমে পরতে নেই
চর্মরোগের প্রভাবে নষ্ট হতে পারে ৷
কারো কথার প্রেমে পরতে নেই
যে কোনো সময় বোবা হয়ে যেতে পারে ৷
যদি সত্যি কারো প্রেমে পরতে হয় ৷তবে ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড় ৷ব্যক্তিত্ব কখনো নষ্ট হয় না ৷ তা কেবল সুন্দর হয় দিনকে দিন ৷অপর দিকে সেই রূপের মোহে আজ দুনিয়া মত্ত ৷ যা কিনা নষ্ট হতে পারে চোখের নিমিষে ৷
রাইয়ের কাধে সাদি একের পর এক ধাক্কা দিতে লাগল ৷রাই পিটপিট করে নিজের চোখ জোড়া খুলল ৷তারপর খুব কষ্ট করে বলল
আমায় একটু পানি দেবে সাদি ভাই ৷বড্ড পিপাসা লেগেছে ৷সাদি রাইকে কোলে করে ঘরে নিয়ে আসলো ৷সাদির মা কাদঁতে কাদঁতে পানি আনতে গেলেন ৷
রাইয়ের চোখ বার বার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ৷রাইয়ের মাথাটা সাদির কোলে ৷সাদির মা পানি নিয়ে ঘরে আসলেন ৷রাইয়ের মুখের কাছে পানি ধরলেন ৷রাই নিজের মুখটা বাড়িয়ে দিল ৷ রাইকে কাদঁতে কাদঁতে পানি খাইয়ে দিতে লাগলো সাদির মা ৷ মেয়েটা বড্ড ভালো ৷ কিন্তু আজ তার এই অবস্থা তিনি মেনে নিতে পারছেন না ৷
রাইয়ের গলা থেকে পানি নিচে গেল না ৷ রাইয়ের গলা থেকে আবারো রক্তর স্রোত আসতে লাগল ৷ নাক আর কান থেকে প্রবল বেগে রক্ত আসতে লাগল ৷রাই নিজের গলা চেপে ধরলো দুই হাতে ৷ রাইয়ের চোখ উল্টে গেছে ৷ সাদি আর দেরি করলো না ৷রাইকে আবারো কোলে তুলে নিল ৷সাদি রাইকে নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গাড়ীতে নিয়ে শুইয়ে দিল তার মায়ের কোলে ৷তারপর নিজে ড্রাইভ করতে লাগলো ৷ড্রাইভ করতে করতে ফোন করলো তার ডাক্তার বান্ধবী প্রিয়ন্তীর কাছে ৷সাদি ফোন করার কিছুক্ষন পরেই প্রিয়ন্তী রিসিভ করলো তারপর বলল
হ্যা সাদি বল ৷ হঠাৎ ফোন করলি কেন ৷
সাদি রাইয়ের অবস্থার কথা বিস্তারিত বলল ৷আর রাইয়ের চিকিৎসার সব রকমের ব্যবস্থা করতে বলল ৷তারপর ফোন রেখে দিল ৷
অপর দিকে আবরার হাতে রাইয়ের সাইন করা সেই ডিবোর্স পেপারটা ৷ আবরার পেপারটার দিকে তাকিয়ে আছে ৷তারপর একটা কটাক্ষ হাসি দিয়ে বলল
কি ভেবেছো আবরার তোমাকে ছাড়া মরে যাবে ৷ নো ডিয়ার ৷তুমি এই আবরার খান জয়কে এখনও চেনো না ৷এইটা ঠিক আমি আমার জীবনে আর কখনো কাউকে প্রবেশ করাতে পারবো না ৷কিন্তু বেচে থাকবো আর তোমাকে ছাড়াই ৷আমি কাল চলে যাব ৷ সারা জীবনের মতো তোমাকে রেখে ৷ ভালো থেকো তুমি ৷নিজে চোখের পানিটা আবরার মুছে নিল হাতের তালু দিয়ে ৷
অপর দিকে সাদির গাড়ী ট্রাফিক জ্যামে আটঁকে পড়েছে ৷জ্যাম ছাড়তে দেরি হবে ৷এই দিকে রাইয়ের অবস্থা বেগতিক হচ্ছে ৷ হঠাৎই সাদির মা সাদিকে বলল
সাদি রাই কোনো রেসপন্স করছে না ৷তাড়াতাড়ি কিছু কর বাবা ৷
সাদি ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখলো রাইয়ের অসহায় পানা মুখটা ৷সাদি গাড়ী থেকে বেড়িয়ে এলো ৷রাইকে গাড়ী থেকে বের করলো ৷তারপর কোলে নিয়ে ছুট লাগালো ৷আর চিৎকার করে কাদঁতে কাদঁতে রাইকে ডাকতে লাগলো ৷আচ্ছা সাদির মতো এই নিঃস্বার্থ মানুষটার কান্না ভেজা চিৎকার কি রাইয়ের কানে পৌছাবে ৷ নাকি এখানেই শেষ হবে শ্রাবন আধারে তুমি ৷
চলবে …..
শ্রাবন আধারে তুমি
লেখিকা:আফরিন ইসলাম
পার্ট:১৭
রাইয়ের নিস্তেজ শরীরটা নিয়ে ছুটে চলেছে সাদি ৷হাজারো মানুষের ভিরে সাদির মতো লোকের আজ বড্ড অভাব ৷ বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে রাইকে নিয়ে যেতে ৷সাদি চলমান গাড়ী গুলোর থেকে সাহায্য চাইতে লাগলো ৷কিন্তু কেউ এগিয়ে এলো না ৷সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত ৷বাস্তবতা বড্ড কঠিন ৷এখানে প্রতি মুহূর্তে যুদ্ধ করতে হয় ৷ এই দুনিয়াতে কেউ কারো জন্য নয় ৷ সবই দুই দিনের মায়া ৷ সাদির ডাকে চকচক করা প্রাইভেট কারের মালিকেরা সাড়া দিল না ৷কিন্তু একজন বৃদ্ধ ভ্যান ওয়ালা এগিয়ে আসল ৷ বৃদ্ধ লোকটা ভরাট গলায় বলল
আব্বা আমার ভাঙ্গা ভ্যান গাড়ীটায় আম্মাটারে উঠান ৷আপনে কই যাইবেন ৷আমি লইয়া যাইতাছি ৷
সাদির চোখ ছলছল করে উঠলো ৷যেই মানুষটা কিনা কোটি টাকার গাড়ী ছাড়া কখনো বের হয় নি ৷সে আজ কতটা অসহায় ৷রাইকে নিয়ে আসার সময় মানিব্যাগটাও নিয়ে আসে নি ৷ মোবাইলটাও ভুল করে গাড়ীতে ফেলে এসেছে ৷কারো কাছে সাহায্য নিতে পারছে না ৷ এর জন্যই হয়তো টাকা নিয়ে ,ক্ষমতা নিয়ে অহংকার করতে নেই ৷কারন আল্লাহ কখন কাকে কোথায় নিয়ে দাড় করায় তা কেউ জানে না ৷কখন কার সাহায্য দরকার হয় তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না ৷
সাদি সময় নষ্ট করলো না ৷রাইকে ভ্যান গাড়ীটার মধ্যে শুইয়ে দিল ৷ভ্যান গাড়ীটা বৃদ্ধ লোকটা বাতাসের বেগে চালাতে লাগলো ৷
এই দুনিয়াতে আল্লাহ যাকে অর্থদেয় তাকে মন দেয় না ৷আর যাকে মন দেয় তাকে অর্থ দেয় না ৷তাই হয়তো চোখের সামনে কেউ মরে গেলেও কারো কিছু যায় আসে না ৷
অপরদিকে মিশকা নিজের ঘরে বসে আছে ৷আজ একদিন সে খাওয়া দাওয়া করছে না ৷মেয়েটার পাগল প্রায় অবস্থা ৷সাদি কেন তার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করলো ৷মিশকা ফুপিয়ে কেদেঁ উঠলো ৷হঠাৎ করেই নিজের কাধে কারো হাতের স্পর্শ পেতেই মিশকা সে দিকে তাকালো ৷
আনিলা বেগম মেয়ের চোখের পানি মুছে দিল ৷মিশকা নিজের মাকে ধরে জোড়ে কেদেঁ উঠলো ৷আড়াল থেকে আবরার ফুপু সবই দেখলো ৷তার মুখে হাসি ৷সে তো এটাই চেয়ে ছিল ৷ভালবাসার মানুষকে হাড়ানোর যে কতটা কষ্ট তা আফজাল খানের ছেলে মেয়ে বুঝবে ৷যেমনটা একদিন সেও পেয়ে ছিল ৷আফজাল খান সেইদিন তার চোখের পানির ভাষা বোঝে নি ৷কিন্তু এবার নিজের ছেলেমেয়ে চোখের পানির ভাষা বুঝবে ৷
রাই কে কিছুক্ষন আগে সাদি হাসপাতালে এনেছে ৷ডাক্তারা রাইয়ের চিকিৎসা শুরু করেছে ৷রাইয়ের অবস্থা ভালো না ৷হার্টবিট অনেক কম ৷রাইয়ের জ্ঞান নেই ৷ সাদি প্রিয়ন্তীর মোবাইল থেকে নিজের ম্যানেজারকে কল করে টাকার ব্যবস্থা করতে বলেছে ৷চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে রাইকে সিঙ্গাপুরে নেওয়ার সব ব্যবস্থা করতে বলেছে সাদি ৷চার পাঁচ জন ডাক্তার রাইকে দেখছে ৷রাইয়ের কাছে কারো যাওয়া নিষেধ ৷ আইসিইউ থেকে প্রিয়ন্তী বেড়িয়ে আসতেই সাদি বলল
কি রে রাইয়ের কি খবর ৷ও ঠিক আছে তো ৷আমি ওকে কালকের মধ্যে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাব ৷রাই ঠিক হয়ে যাবে তো বলনা ৷
প্রিয়ন্তী হতাশ কন্ঠে বলল সাদি উত্তেজিত হস না ৷ রাইয়ের হাতে সময় নেই আর ৷আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে যদি জ্ঞান না আসে তাহলে শেষ কথা টুকুও বলতে পারবি না ৷ রোগটা একেবারে ছড়িয়ে পরে তারপর ধরা পড়েছে৷ আর ওর অবস্থা এখন এতটাই খারাপ যে কোথাও নিয়ে গেলেও আর কাজ হবে না ৷ওর ব্রেনে ছড়িয়ে পড়েছে টিউমারের বিষাক্ততা ৷যদি একবছর আগেও রোগটা ধরা পড়তো তবুও বাচানো যেত ৷কিন্তু এখন আর সম্ভব না ৷
সাদি ফ্লোরে বসে পড়লো ৷অবশেষে সে চেয়েও কিছু করতে পারবে ৷মেয়েটা তার সামনেই এভাবে ঝড়ে যাবে অকালে ৷ সাদি উঠে রাইয়ের দিকে তাকালো ৷বেডের ওপর কত নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে ৷ মুখটা কালো হয়ে গেছে ৷পুরো মাথায় চুলের ছিটে ফোটাও নেই ৷ডাক্তার নাকের ভেতরে চিকন পাইপ ঢুকিয়ে দিয়েছে ৷পাইপটা ঢুকানোর সময় নড়ে উঠে ছিল ৷হয়তো প্রচন্ড কষ্ট হয়ে ছিল তখন ৷মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো ৷চোখের চারপাশ কালো হয়ে গেছে ৷ পাশের মনিটরের সবুজ দাগটা আস্তে আস্তে ওঠা নামা করছে ৷ এই সবুজ দাগটা হঠাৎ যদি সমান হয়ে যায় তখন কি হবে ৷ভাবতেই সাদির চোখ চিকচিক করে উঠলো ৷
দিন শেষে রাতের আগমন ৷রাত বারোটা বাজে ৷ সাদি কিছুক্ষন আগে সামান্যই খেয়েছে ৷ওর মা জোড় করে খাইয়ে দিয়েছে ৷ রাইয়ের চিকিৎসা চলছে ৷এক বারের জন্য তার জ্ঞান ফিরে নি ৷
অপর দিকে আবরার নিজের বারান্দায় দাড়িয়ে একের পর এক সিগারেট খাচ্ছে ৷রাইকে বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে ৷ মেয়েটা একটা বারো তাকে কল করলো না ৷আবরার সিগারেটের অভিমানি ধোয়া গুলো উড়িয়ে দিল ৷ রাতে কিছুই খায় নি আবরার ৷কেন যেন কিছু ভালো লাগছে না ৷ বারবার রাইকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব তার ৷ নিজের সব কিছু প্যাকিং করেছে আবরার ৷কালকের ফ্লাইটে চলে যাবে বিদেশে আবার ৷আর কখনো আসবে না এই দেশে ৷
আফজাল খান নিজের মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন ৷ সে কিছুতেই হিসাব মিলাতে পারছেন না ৷কোথাও একটা ভুল হচ্ছে ৷আফজাল খানকে চিন্তিত দেখে আনিলা বেগম বললেন
ঘুমিয়ে পড় ৷রাত জাগতে নেই ৷ আফজাল খান স্ত্রীর কথার ভাজে কিছুই বললেন না ৷শুয়ে পড়লেন ৷
খোলা আকাশে তাকিয়ে আছে সাদি ৷তার ঠোটঁ জোড়া কাপছে ৷বিনা দোষে আজ সে শাস্তি পাচ্ছে ৷সে তো মিশকা কে সব জানাতে চেয়ে ছিল রাইয়ের ব্যাপারে ৷কিন্তু সেই সময়টাও পেল না সে ৷ভালবাসার মানুষকে ছাড়া থাকতে যে কত কষ্ট তা রাইকে দেখে সে বুঝেছে ৷ভালবাসায় এত কষ্ট কেন ৷আবরার যদি রাইয়ের অবস্থা একবার জানতো তাহলে কি করতো ৷আজকাল একটু বেশিই কেদেঁ ফেলছে সাদি ৷হয়তো আপন মানুষদের হারানোর যন্ত্রনা গুলো এমনই হয় ৷
অন্ধকার রাত পার হয়ে গেছে ৷সকালের সোনালী আলো সাদির চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে গেল ৷কাল রাতে হাসপাতালের বারান্দাতেই কখন যে ঘুমিয়ে গেছে টের পায় নি ৷ রাইয়ের কথা মনে হতেই সাদি দৌড় লাগায় সেই দিকে ৷যেয়ে দেখে ডাক্তাররা রাইকে নিয়ে ব্যস্ত ৷সাদি প্রিয়ন্তীকে নার্স এর মাধ্যমে একবার ডাকে ৷প্রিয়ন্তী আসতেই সাদি বলে
রাই ঠিক আছে তো প্রিয়ন্তী ৷
না রে ৷ অবস্থা শুধু খারাপই হচ্ছে ৷হার্টবিট কমে যাচ্ছে ৷ওর আত্মীয় স্বজন কেউ থাকলে আসতে বল ৷যেন শেষ দেখাটা দেখে নেয় ৷
সাদি ঘাড় ঘুড়িয়ে একবার রাইকে দেখলো ৷তারপর দৌড়ে হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে এলো ৷সাদি নিজের গাড়ীতে বসে ড্রাইভ করতে লাগলো অতি দ্রুত ৷কাল রাতে সাদির ম্যানেজার গাড়ী দিয়ে গেছে হাসপাতালে ৷সাদি নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে ৷অনেক সহ্য করেছে আর না ৷ এবার সে আবরার মুখোমুখি হবে ৷
চলবে ….